মানবসভ্যতার সাথে যে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটি গভীরভাবে যুক্ত আছে, সেটি হলো রাষ্ট্র। গোষ্ঠীতন্ত্রের সমাপ্তির সাথে সাথেই শুরু হয় নগররাষ্ট্রের যুগ। সেই যুগ পেরিয়ে মানবসভ্যতা প্রায় হাজার বছর এগিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার মাধ্যমে। আধুনিক যুগে উত্থান ঘটেছে জাতিরাষ্ট্রের ধারণার, তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী হয়েছে রাষ্ট্রের সীমান্ত আর সার্বভৌমত্বের ধারণা।
সুদীর্ঘ এই যাত্রাকালে রাষ্ট্র অভিজ্ঞতার আলোকে গঠন পরিবর্তন করেছে। পরিবর্তিত হয়েছে প্রয়োজন ও আদর্শের আলোকেও। সবচেয়ে আদি এই রাজনৈতিক সংগঠনের রাষ্ট্রের কোনো চরম উৎকর্ষ নেই, অদূর ভবিষ্যতে সম্ভাবনা নেই চরম পরিণতিরও। বরং, মানুষের সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হওয়া রাষ্ট্র মানবসভ্যতার নিরাপত্তার ধারণার সাথে জড়িয়ে থাকবে, জড়িয়ে থাকবে সার্বভৌমত্ব আর পরিচয়ের রাজনীতির সাথে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর গঠিত জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে আফ্রিকা থেকে সদস্য ছিল চারটি দেশ। রাজতন্ত্রের দীর্ঘ ইতিহাস ধারণ করা ইথিওপিয়া ছিল তার মধ্যে একটি দেশ। রাজতন্ত্রের দীর্ঘ ইতিহাসে ইথিওপিয়া মোটা দাগে উপনিবেশ শাসনের অধীনে গেছে একবার, ১৯৩৬ সালের মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ট ইতালির কাছে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং সমৃদ্ধ রাজনৈতিক ইতিহাস থাকার পরেও রাজতন্ত্রের পরবর্তী যুগে ইথিওপিয়া একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করতে পারেনি, পারেনি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে। বরং, গোষ্ঠীতন্ত্র আর পরিচয়ের রাজনীতি বারবার সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছে ইথিওপিয়াকে, অসহিষ্ণুতার চর্চা বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকাশকে, বাধাগ্রস্ত করেছে ইথিওপিয়ান রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকাশকে।
ইথিওপিয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে ১৯৭৪ সালে। একদল জুনিয়র সামরিক অফিসার আর পুলিশ কর্মকর্তারা মিলে উৎখাত করে তৎকালীন রাজাকে। তারা সোভিয়েত ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রতিষ্ঠা করে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। রাজতন্ত্রের সীমাহীন দুর্নীতি বন্ধ আর একীভূত সম্পদ বণ্টনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা এই রেজিম দ্রুতই জনসমর্থন হারাতে থাকে। বিভিন্ন প্রভাবকের উপস্থিতি আর গোষ্ঠী রাজনীতিতে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ হয়, বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠে সশস্ত্র গ্রুপ।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে ইথিওপিয়াতেও পতন হয় কমিউনিজমের, ১৯৯৪ সালে যাত্রা শুরু হয় ফেডারেল শাসনব্যবস্থার। গোষ্ঠী পরিচয়ের উপর ভিত্তি করেই তৈরি হয় ফেডারেল রিপাবলিক অব ইথিওপিয়ার কাঠামো। রাজ্যগুলোর নিয়ন্ত্রণও চলে যায় গোষ্ঠীপ্রধানদের হাতে। সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির সুযোগে আবারো একদলীয় শাসনব্যবস্থায় ঢুকে যায় এই ‘ল্যান্ড লকড’ দেশটি, আফ্রিকার দ্বিতীয় জনবহুল এ দেশটির শাসনক্ষমতা চলে যায় একটি ক্ষুদ্র স্বার্থগোষ্ঠীর কাছে।
রাজনৈতিক সংস্কার ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব
ইথিওপিয়া পৃথিবীর আদিমতম রাষ্ট্রগুলোর একটি, এখান থেকেই যাত্রা শুরু হয় আধুনিক মানুষ ‘Homo sapience’ এর। বর্তমানে ইথিওপিয়াতে বাস করে ৮০টিরও বেশি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর লোক। প্রচলিত আছে একশোরও বেশি ভাষা। এই বিপুল বৈচিত্র্য দেশটিতে সম্মিলন ঘটিয়েছে বহু জাতিগোষ্ঠীর, সম্মিলন ঘটিয়েছে বহু মতের, একই সাথে তৈরি হয়েছে পরিচয়ের রাজনীতির সুযোগ। ফলে, গত শতাব্দীর শেষ দশকে ফেডারেল শাসনব্যবস্থার যাত্রা শুরু হলেও, ইথিওপিয়া গোষ্ঠী পরিচয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা রাজনৈতিক সংঘাত থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে ক্ষুদ্র একটি অংশের হাতে, সম্পদও কেন্দ্রীভূত হয়েছে একই স্বার্থগোষ্ঠীর হাতে। ফলে, কৃষিনির্ভর ইথিওপিয়ান অর্থনীতি ব্যর্থ হয় জনগণের প্রত্যাশা মেটাতে। উচ্চ বেকারত্বের হার ক্ষুব্ধ করে তরুণদের। কৃষি উপকরণ নিয়ে রাজনীতি হতাশ করে কৃষকদের। ফলে, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ হয়েছে, হাজার হাজার নাগরিক হয়েছে রাজনৈতিক বন্দী।
ক্রমাগত আন্দোলন পট-পরিবর্তন করে ২০১৮ সালে ক্ষমতায় নিয়ে আসে ইথিওপিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আবে আহমেদকে, ক্ষমতায় এসেই যিনি ঘোষণা দেন রাজনৈতিক সংস্কারের। হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দীকে তিনি মুক্তি দেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকাশে উদ্যোগ নেন, সম্পর্ক স্থাপন করেন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইরিত্রিয়ার সাথে। রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ আর ইরিত্রিয়ার সাথে দীর্ঘদিনব্যাপী চলা সংঘাতের সমাধান আবে আহমেদকে ২০১৯ সালে এনে দেয় নোবেল শান্তি পুরস্কার।
ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক সংস্কার আর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তৈরির বিকাশের চেষ্টা করলেও আবে আহমেদ শুরু থেকেই রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। কমিউনিজম পরবর্তী যুগে রাষ্ট্রকাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে থাকা টাইগ্রে জাতিকে ক্ষমতার বলয় থেকে বের করে দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে নিয়েছেন একের পর এক আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ। মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬ শতাংশ হলেও, ক্ষমতার প্রভাবে অর্থ আর অস্ত্রের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ আছে টাইগ্রেদের হাতে, আছে নিজেদের মিলিশিয়া গ্রুপও।
গত সপ্তাহে টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফোর্স আক্রমণ করে ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সকে, দখল করে নেয় ফেডারেল সামরিক বাহিনীর ঘাঁটি। আবে আহমেদের নেতৃত্বে ফেডারেল সরকার এই আক্রমণকে আখ্যায়িত করেছে রাষ্ট্রকাঠামোর প্রতি আঘাত হিসেবে, সামরিক বাহিনীর প্রধানকে পরিবর্তন করে দ্রুতই সামরিক অভিযান শুরু করেছে টাইগ্রে মিলিশিয়া ফোর্সের বিরুদ্ধে। পালটা জবাব আর হতাহতের সংখ্যা ইঙ্গিত দিচ্ছে, বড় হতে পারে এই সংকট, হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী।
সংঘাত কি গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিবে ইথিওপিয়াকে?
ক্রমাগত রাজনৈতিক সংঘাত আর রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাওয়া ইথিওপিয়ার গত সপ্তাহের সংঘাত উদ্বিগ্ন করেছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের, সম্ভাবনা তৈরি করেছে নতুন করে বড় মাত্রায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার। গত শতাব্দীতে এক গৃহযুদ্ধেই দশ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে ইথিওপিয়াতে, গৃহযুদ্ধের কারণে হওয়া দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারায় আরো প্রায় দশ লাখ মানুষ। ইথিওপিয়াতে নতুন করে ছড়িয়ে পড়া ফেডারেল সরকার ও টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফোর্সের মধ্যকার এই সংঘাত গৃহযুদ্ধে রূপ নিতে পারে। কারণ-
প্রথমত, ইথিওপিয়ার জাতিগত সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ইথিওপিয়ার দীর্ঘ ইতিহাসে জাতিগোষ্ঠীগুলো নিজেদের মধ্যে জমির অধিকার নিয়ে সংঘাতে জড়ায়, পানির উৎসের উপর আধিপত্য নিয়ে সংঘাতে জড়ায়, সংঘাতে জড়ায় রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ আর আঞ্চলিক আধিপত্য নিয়েও। সম্প্রতি সংঘাতের জায়গা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে শিক্ষার ভাষা আর রাষ্ট্রীয় কাজের ভাষাকেন্দ্রিক বিভাজনও। ওরোমিয়া জাতিগোষ্ঠীর নেতৃত্বাধীন বর্তমান প্রগ্রেসিভ পার্টির সাথে টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফোর্সের সংঘাত এই ঐতিহাসিক সংঘাতগুলোরই রাজনৈতিক রূপ।
দ্বিতীয়ত, এই বছর সেপ্টেম্বরে কথা ছিল ইথিওপিয়াতে ফেডারেল সরকারের নির্বাচন হওয়ার, কথা ছিল রাজ্যগুলোর আঞ্চলিক পার্লামেন্টেরও নির্বাচন হওয়ারও। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ না নিলেও করোনাভাইরাসের দোহাই তুলে আবের নেতৃত্বাধীন ফেডারেল সরকার নির্বাচন পিছিয়ে দেয়। অন্যদিকে, যথাসময়ে নির্বাচন হয় টাইগ্রেতে। এই নির্বাচনকে ফেডারেল সরকার অবৈধ ঘোষণা করে, টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফোর্স অসংবিধানিক আখ্যায়িত করে ফেডারেল সরকারকে। অর্থাৎ, সেপ্টেম্বরে টাইগ্রেতে অনুষ্ঠিত নির্বাচন ফেডারেল সরকারকে বৈধতার সংকটে ফেলে দেয় এবং টিপিএলএফের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। এই মুখোমুখি অবস্থানের কারণেই উত্তেজনা ছড়িয়েছে। যুদ্ধে দুই পক্ষের অবস্থান সংকটকে দীর্ঘায়িত করার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
তৃতীয়ত, আবে আহমদে প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসার পরে রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও, ক্ষমতার বলয় থেকে দূরে সরিয়ে দেন টাইগ্রেদের। প্রভাবশালী টাইগ্রে নেতারা রাজনৈতিক অবমূল্যায়নের শিকার হন। শিকার হন রাজনৈতিক হয়রানির। টাইগ্রেদের অনুগত আমলাতন্ত্রে চলে ব্যাপক ধর-পাকড়, দুর্নীতির অভিযোগে অনেক আমলাকে করা হয় বরখাস্ত। অর্থাৎ, ফেডারেল সরকার ও টিপিএলএফের সংঘাতে ক্ষমতার দখলের ব্যাপারটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে এবং অদূর ভবিষ্যতে ইথিওপিয়ার ফেডারেল গঠন ক্ষমতার বণ্টন করতে পারবে, এমন সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ, সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হবে।
চতুর্থত, ইথিওপিয়ার গৃহযুদ্ধের ইতিহাস আছে। গত শতাব্দীতে কমিউনিস্ট সরকারের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়িয়েছিল বিভিন্ন গোষ্ঠী। ১৯৭৪ সালে শুরু হওয়া এই সংঘাত রূপ নেয় ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে, প্রাণ যায় প্রায় ১০ লাখ মানুষের। গৃহযুদ্ধের ফলে আরেকটি দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয় ইথিওপিয়া, গৃহহীন হয় প্রায় দুই লাখ মানুষ। স্নায়ু-যুদ্ধকালের এই গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলো। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, সংঘাতপূর্ণ এসব দেশের প্রবণতা আছে বারবার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার। অর্থাৎ, ইতিহাসের ঘটনাবলি প্রভাবিত করবে ইথিওপিয়ার সংঘাতে ক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলোর গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে।
পঞ্চমত, রাষ্ট্রকাঠামো হিসেবে ইথিওপিয়ার সুদীর্ঘ ইতিহাস থাকলেও, জাতিরাষ্ট্রের যুগে এসে ইথিওপিয়া ব্যর্থ হয়েছে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়া ঘটাতে। ফলস্বরূপ, ইথিওপিয়া থেকে ভেঙে গত শতাব্দীর শেষদিকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে ইরিত্রিয়ার। ইথিওপিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় টাইগ্রে তুলনামূলকভাবে অগ্রসর এবং তাদের কাছে আছে বিপুল অস্ত্রের সরবরাহ। ফলে, টিপিএফএল ইরিত্রিয়ার মতো স্বাধীনতার লক্ষ্য ঠিক করলে নিশ্চিতভাবেই ফেডারেল সরকারের সাথে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে যেতে হবে, ধাবিত হতে হবে গৃহযুদ্ধের দিকে।
ষষ্ঠত, ভূরাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরাশক্তির হস্তক্ষেপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে আবে আহমেদের নীলনদের উপর বাঁধ নির্মাণকে কেন্দ্র করে ‘হর্ন অব আফ্রিকার’ রাজনীতি নতুন সমীকরণের সামনে পড়েছে, জড়িয়ে গেছে মিসরের মতো প্রভাবশালী দেশও। ফলে, ফেডারেল সরকার ও টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফোর্সের এই সংঘাতকে সামনে রেখে বিভিন্ন প্রভাবশালী রাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থকে আদায় করে নিতে চাইবে। ফলে, দীর্ঘ হবে এই সংঘাত, হতে পারে গৃহযুদ্ধও।