দ্বন্দ্ব আর সংঘাতের মানবজাতির ইতিহাসে কোনো গোষ্ঠী বা জাতিকে বাস্তুচ্যুত করা, দেশত্যাগে বাধ্য করার ইতিহাস আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। ইহুদিদের বাস্তুচ্যুতির পরে মানবসভ্যতার ইতিহাসে আরো হাজারো বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে, মানুষকে বাধ্য করেছে নিজের শেকড় আর আবাসভূমি ছেড়ে নতুন ঠিকানা সন্ধানে।
আধুনিককালেও যুদ্ধ আর সংঘাতের কারণে অহরহ ঘটছে বাস্তুচ্যুতির ঘটনা । গৃহযুদ্ধের কারণে সিরিয়া থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ৬৭ লাখ মানুষ, যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান যুদ্ধে বাস্তুচ্যুত হয়েছে ২৭ লাখ আফগান। এর পাশাপাশি রাষ্ট্রকাঠামো আর শাসকদের সংকটে সোমালিয়া থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৯ লাখ সোমালীয়, দক্ষিণ সুদানের সংখ্যাটা ২৩ লাখ। আর নিকট অতীতে রাষ্ট্র কর্তৃক সবচে বড় বাস্তুচ্যুতির ঘটনাটি ঘটিয়েছে মিয়ানমার, ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে বাস্তুচ্যুত করেছে রাখাইন থেকে, সেনাবাহিনীর সাথে জাতিগত সংঘাত চলছে আরো কয়েকটি গোষ্ঠীর।
এর বিপরীতে আরো একটি গল্প আছে। অতীতে বাস্তুচ্যুত মানুষেরা ছড়িয়ে পড়তো নগর রাষ্ট্রগুলোতে, শক্তিশালী সীমান্ত না থাকায় মধ্যযুগেও এই প্রক্রিয়া রাষ্ট্রকাঠামোতে খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি। আধুনিক কালে জাতিরাষ্ট্র উদ্ভবের ফলে সীমানার ধারণা পোক্ত হয়েছে, ফলে এই বাস্তুচ্যুত মানুষেরা বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়ে পরিচিত হয়েছেন শরণার্থী নামে, অর্থনৈতিক, সামাজিক আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট মিলিয়ে তারা আবির্ভূত হয়েছে ‘ক্রাইসিস’ হিসেব, তৈরি করেছেন ‘শরণার্থী সমস্যা’।
আধুনিক এই যুগে সবচেয়ে বড় শরণার্থী সমস্যার শিকার ইউরেশিয়ার দেশ তুরস্ক। ৪০ লাখ শরণার্থী নিয়ে বিশ্বের সবচে’ বেশি শরণার্থীকে আশ্রয়দাতা দেশ তুরস্ক।
যেভাবে তৈরি হলো তুরস্কের শরণার্থী সমস্যা
সালটা ১৯৭৯। ইরানে তখন চলছে ইরান বিপ্লব। আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্রের সর্বশেষ শাহের শাসনের সমাপ্তি ঘটাতে বিপ্লব করছে ইরানের মানুষ। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শাহও লেলিয়ে দিয়েছেন সামরিক বাহিনী, কুখ্যাত পুলিশ বাহিনী ‘সাভাক’। রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতায় ইরান থেকে তুরস্কে শরণার্থী আসা শুরু হয়। এর একটা বড় অংশ ছিল ইরানি কুর্দিরা। ধর্মীয় পরিচয়ের দিক থেকে শিয়া মুসলিম বেশি হওয়ার পরেও ভাষার ভিত্তিতে স্বাধীন কুর্দিস্তান চাওয়ায় বিপ্লবের নেতৃবৃন্দের সাথে রাজনৈতিক দূরত্ব তৈরি হয়, ফলে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য ছুটতে হয় তুরস্কের দিকে।
এরপর বড় আকারের শরণার্থী আসার প্রেক্ষাপট শুরু হয় ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময়। এক দশক ধরে চলা যুদ্ধের সময় তুরস্কে শরণার্থী হিসেবে প্রবেশ করেছে লাখো ইরাকি। এদের অনেকে ইউরোপগামী হয়েছে, অনেকে তুরস্কের নাগরিকত্বও পেয়েছে। এরপরও, তুরস্কে এখনও ১ লাখ ৪২ হাজার ইরাকি শরণার্থী আছে।
উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ও শরণার্থী এসেছে তুরস্কে আরেক দফা। এসেছে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম’ শুরুর পরেও। তুরস্কে এখন আফগান শরণার্থীর সংখ্যা ১ লাখ ৭২ হাজার।
তুরস্কে শরণার্থী সমস্যা প্রকট আকার ধারণ আরব বসন্তের প্রভাবে সিরিয়ান গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার পরে। আসাদপন্থী আর বিদ্রোহীদের যুদ্ধের ফলে সিরিয়া থেকে বাস্তুহারা হয় ৬৭ লাখ মানুষ, যার ৩৬ লাখই পাড়ি জমিয়েছে তুরস্কে। তৈরি হয়েছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আর সামাজিক সমস্যা।
শরণার্থী সমস্যা ও তুরস্ক
ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের দেশ তুরস্ককে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই শরণার্থী সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, নিশ্চিত করতে হচ্ছে শরণার্থীদের মৌলিক চাহিদাগুলো। এরদোয়ানের সরকারের সবসময় চেষ্টা ছিলো শরণার্থীদের মানবিক জীবন নিশ্চিত করা। কেন্দ্র এবং স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে শরণার্থীদের সামাজিক সমর্থন নিশ্চিতে সহযোগিতা করেছে, স্বাধীনভাবে ব্যবসা খোলার অনুমতি দিয়েছে, সহযোগিতা করেছে ইউরোপে আশ্রয়প্রার্থীদেরও। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বেসরকারি সংস্থাগুলো, তৈরি করেছে সামাজিক আত্মীকরণের সুযোগ।
তবুও, বিপুল শরণার্থীদের এ সুযোগগুলো নিশ্চিত করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে স্থানীয় আর কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে। নাগরিকদের ওপর বেড়ে যাচ্ছে করের বোঝা, সংকুচিত হয়েছে স্বাস্থ্য আর নাগরিক সুবিধার মতো বিষয়গুলোও। ফলে, সরকার থেকে পূর্ণ চেষ্টার পরেও শরণার্থী সমস্যার প্রভাব পড়েছে তুরস্কের সামাজিক জীবন আর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। তৈরি করেছে নিরাপত্তা সংকট, ফলে রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নের মুখে আছে এরদোয়ান সরকারের গৃহীত নীতিগুলো।
সামাজিক সমস্যা
বিপুল সংখ্যক শরণার্থীদের তুরস্ক সরকারের চেষ্টার পরেও শরণার্থী শিবিরে রাখা সম্ভব হয়নি। ৪ মিলিয়ন শরণার্থীর মাত্র ২.৫% আছে এখন শরণার্থী শিবিরগুলোতে। আবার, একটা বিশাল অংশ এসেছেন অবৈধ পথে, রেজিস্ট্রেশন করেননি রিফিউজি ক্যাম্পে। সবমিলিয়ে জীবিকার প্রয়োজনে অনেক সময় নিজ তাগিদেই শরণার্থীরা ছড়িয়ে পড়েছে তুরস্কের বিভিন্ন প্রান্তে, স্থানীয়দের সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টাও হচ্ছে। ফলে তুরস্ক সরকারের চেষ্টার পরেও স্থানীয় আর শরণার্থীদের মধ্যে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
প্রথমত, অধিকাংশ শরণার্থীদের সুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পড়েছে সীমিত বাজেটে কাজ করা মিউনিসিপালিটিগুলোর উপর। ক্রমাগত নতুন শরণার্থীর আগমন আবার নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে তাদের। ফলে, মিউনিসিপালিটিগুলো স্থানীয়দের নাগরিক সেবাগুলো আগের মতো দিতে পারছে না।
দ্বিতীয়ত, সিরিয়া থেকে আসা মোট শরণার্থীর ৪৪ ভাগই শিশু। এই বিশাল অংশের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিশ্চিত করতে তুরস্কের শিক্ষাক্ষেত্রে চাপ তৈরি করছে, সংকট তৈরি করেছে শিক্ষার মানে।
তৃতীয়ত, সরকারের পক্ষ থেকে সাংস্কৃতিক আত্মীকরণের প্রচেষ্টা থাকলেও কর্মসংস্থান, বাসস্থান আর নাগরিক সুবিধার ইস্যুগুলোতে স্থানীয়দের সাথে শরণার্থীদের একটা প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে, যার নেতিবাচক প্রভাবই সমাজে বেশি কাজ করছে।
অর্থনৈতিক সংকট
৮২ মিলিয়ন মানুষের দেশ তুরস্কের জিডিপির আকারটাও বিশাল, ২.৩ ট্রিলিয়ন। মাথাপিছু আয়ও বেশ ভালো, ২৮,৯৫৬ মার্কিন ডলার। শরণার্থী সমস্যায় এই বিশাল অর্থনীতিও প্রভাবিত হচ্ছে।
বিপুল শরণার্থী প্রবেশের ফলে তুরস্কের শ্রমবাজারে তারা নিজেদের প্রবেশ ঘটিয়েছে, জীবিকার প্রয়োজনে তারা শ্রম বিক্রি করছে কম মূল্যে। ফলে স্থানীয়দের মধ্যে বেকারত্বের হার দুই সংখ্যায় পৌঁছেছে, বর্তমানে যা ১০.৯ %।
আবার শরণার্থীরা আসার পর থেকে বড় একটা গ্রাহক সংখ্যা তৈরি হয়েছে। ফলে প্রতিনিয়তই বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম, শরণার্থীদের পাশাপাশি জীবনধারণ কঠিন হয়ে যাচ্ছে মধ্য আর নিম্নবিত্ত তুর্কিদের জন্যও। হেরিটেজের রিপোর্টে তুরস্কের মুদ্রাস্ফীতির হার ১৬.৩%, প্রমাণ করে অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করছে শরণার্থী সমস্যা। সুখবর নেই বাণিজ্য স্বাধীনতার সূচকে, বেড়েছে করের বোঝা। বিনিয়োগেও নেই কোনো ইতিবাচক কোনো খবর।
তবে ইতিবাচক দিকও আছে তুরস্কের অর্থনীতির জন্য। অনিশ্চয়তা আর অনিরাপদ স্বদেশ ছেড়ে আসার সময় শরণার্থীরা শুধু নগদ অর্থই নিতে আসতে পেরেছেন তুরস্কে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর সুফল পাচ্ছে ব্যাংকিং সেক্টর। কয়েক বিলিয়ন ডলারের ব্যাংক সঞ্চয়ের পাশাপাশি শরণার্থীরা গত পাঁচ বছরে খুলেছেন ১০ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ফলে তৈরি হয়েছে প্রায় লাখখানেক কর্মসংস্থানের সুযোগ।
নিরাপত্তা সংকট
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্কে অপহরণ, ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে, একইসাথে বাড়ছে গুম, হত্যার মতো অপরাধের ঘটনাও। এর একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যাবে সংঘবদ্ধ অপরাধের উপর Turkish General Directorate of Security এর প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে। ২০১৬ সালে তুরস্কে সংঘবদ্ধ অপরাধের ঘটনা ঘটেছিলো ৩২টি, পরের বছর প্রায় তিনগুণ বেড়ে হয় ৯৯টি। ২০১৮ সালে এমন অপরাধের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পায়, হয় ১৬২টি। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অপরাধীর সংখ্যা আর আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে।
মূলত, কর্মসংস্থানের সুযোগ না পাওয়া আর অবৈধভাবে আসা শরণার্থীরাই এই ধরনের অপরাধে সহজে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে, তুরস্কের জনজীবনের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ছে, বাড়ছে নিরাপত্তা ব্যয়।
তুরস্ক কী করতে পারে
দ্রুততম সময়ে সকল শরণার্থীর রেজিষ্ট্রেশন সমাপ্ত করে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনের সহযোগিতায় শরণার্থীদের স্বাস্থ্য আর শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে তুরস্ক। পর্যাপ্ত বাজেট আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিতে পারে মিউনিসিপালিটিগুলোকে। নেতৃত্ব তুলে আনতে পারে শরণার্থীদের মধ্যে থেকে, যারা দীর্ঘমেয়াদে মূল দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
নিকট অতীতে শরণার্থী সমস্যার কোনো গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান দেখা যায়নি। তুরস্ককেও এই সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে বহন করতে হচ্ছে, সবচেয়ে বেশি শরণার্থীর দেশ সিরিয়াতেও সংঘাত সমাপ্তির কোনো লক্ষণ নেই। ফলে বাধ্য হয়েই তুরস্ককে শরণার্থী সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নিয়ে ভাবতে হবে।