ভ্যতার ঊষালগ্নে আমলাতন্ত্র
লিখন পদ্ধতির আবিষ্কারের সাথে আমলাতন্ত্রের উদ্ভবের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। লিখন পদ্ধতি আবিষ্কারের পর সবকিছু একটি হিসাবের মধ্যে আনা সম্ভব হয়েছিল। দলপতি বা সমাজপতিরা তখন তাদের শাসনকৃত ভূখণ্ড এবং প্রজাদের উৎপাদন, রাজকর, বণ্টনকৃত ভূমি প্রভৃতি বিষয়ের রেকর্ড রাখা শুরু করেন। মাটির ফলকে সেসব লিপিবদ্ধ করে বড় বড় রেকর্ডরুমে সেগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবেই একটি অক্ষরজীবী গোষ্ঠীর জন্ম হয়। তাদের কাজ ছিল দরকারি তথ্য লিখে সংরক্ষণ করা এবং প্রয়োজনমত সেগুলো পেশ করা। আজ থেকে প্রায় ৫৫০০ হাজার বছর আগে প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতায় শাসকগণ এরকম একটি অক্ষরজীবী করণিক গোষ্ঠীকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন শস্য ও পারিতোষিকের হিসেব রাখার জন্য।
প্রাচীন মিসরে ফারাওদের আমলেও একটি শক্তিশালী আমলাতন্ত্রের দেখা মেলে। সে যুগে ফারাওদের প্রজাদের সম্মুখে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হতো ঈশ্বর বা ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে। পুরো মিসরের সব জমি-জমার মালিক ছিলেন ফারাওরা। প্রজাদের মাঝে জমি ইজারা দেওয়া হতো। ফারাওদের প্রতিনিধিরাই মাথাপিছু ইজারাকৃত জমির পরিমাণ, সেখানে কোন ফসল ফলাতে হবে, কতটুকু সরকারের ঘরে জমা দিতে হবে এসব নির্ধারণ করে দিতেন। একটা গাছ কাটতেও সরকারের অনুমতি নিতে হতো। বর্তমানে প্রচলিত ট্রেড লাইসেন্সের মতো সে যুগে মিসরে ব্যবসা শুরু করার আগে ব্যবসায়িক অনুমতিপত্রের প্রয়োজন হতো। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার পরে কাঁচামাল ক্রয় থেকে শুরু করে পণ্যের বিপণন সব ধাপেই ফারাওদের প্রতিনিধিরা ট্যাক্স বসাতো।
এবার রোমান সাম্রাজ্যের দিকে তাকানো যাক। রোমকরা একটি হায়ারার্কিক্যাল প্রতিনিধিগোষ্ঠী গঠন করেছিল যাদের ব্যবহার করে মাঠপর্যায়ে শাসনকার্য পরিচালনা করা হতো। উন্নততর প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বারবার প্রশাসনে সংস্কার সাধন করা হয়। এক্ষেত্রে রোমান সম্রাট ডিওক্লেটিয়ানের সংস্কার বিশেষ প্রণিধানযোগ্য।
নিম্নবর্গের একটি পরিবার থেকে উঠে এসে সম্রাট বনে যাওয়া ডিওক্লেটিয়ান প্রশাসনে ব্যাপক সংস্কার সাধন করেছিলেন। তিনি দেশকে ছোট ছোট কিছু ইউনিটে বিভক্ত করে একেকজন প্রতিনিধির হাতে দ্বায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। ফলে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক দিয়েই রোমানরা উন্নততর হতে থাকে।
প্রাচীন চীনে আমলাতান্ত্রিক বিকাশ
এশিয়াতে আমলাতান্ত্রিক ইতিহাসের প্রসঙ্গ টানলে প্রাচীন সামন্তবাদী চীনের আমলাতন্ত্রের কথা বলতেই হবে। চীন যুগে যুগে বিভিন্ন বংশের দ্বারা শাসিত হয়েছে। একেক রাজবংশ প্রশাসনে একেক ধরনের সংস্কার সাধন করেছে। প্রাচীন চীনে আমলাদের যোগ্যতার মাপকাঠি ছিল রাজার প্রতি আনুগত্য। রাজা নিজের পছন্দ অনুযায়ী আমলাদের নিয়োগ দিতেন।
এ পরম্পরার কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে হান সাম্রাজ্যের আমলে। হান বংশীয় সম্রাট উয়েন প্রথম আমলা নিয়োগ পরীক্ষা চালু করেন। তৎকালীন চীনে কনফুসিয়াসের শেখানো দর্শন পরিবার থেকে রাজদরবার সবখানেই চর্চা হতো। কনফুসিয়াস আমলাতন্ত্রকে তুলনা করতেন ধ্রুবতারার সঙ্গে। তিনি বলেছেন, “এ তারকা স্থির থাকে এবং সব তারকা এর নির্দেশে চলে।” কনফুসিয়াস মনে করতেন জ্ঞানের ভিত্তিতে সরকার পরিচালিত হলে জনগণ বেশি সমৃদ্ধ হবে।
কিন্তু এ মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন আরেক চীনা দার্শনিক লাওজু। তিনি ভাবতেন, জ্ঞানের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হলে একটি জনবিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী রাষ্ট্রের একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করতে থাকে। সম্রাট উয়েনের পরে সম্রাট ঊ আমলাতান্ত্রিক নিয়োগে কনফুসিয়াসের দর্শনকেই একমাত্র মানদণ্ড করেননি। তিনি মূলধারার শাসনব্যবস্থা থেকে কনফুসীয়বাদকে আলাদা করেন এবং একটি নতুন মানদণ্ড নির্ধারণ করেন নিয়োগ পরীক্ষার যাকে বলা হত জায়োলিয়ান। পরে অবশ্য এটিও বাতিল হয়েছিল।
এভাবে পরিমার্জিত হতে হতে চীনে একটি আদর্শগত নিয়োগ পদ্ধতির প্রচলন হয়। একে ইম্পেরিয়াল নিয়োগ পরীক্ষা বলা হতো। বর্তমানে বাজারে সিভিল সার্ভিস নিয়োগ পরীক্ষার যে কোচিং সেন্টারগুলো প্রচলিত রয়েছে শুনলে চোখের ভুরু কপালে ঠেকবে- সে যুগে চীনেও এধরনের কোচিং সেন্টারের প্রচলন ছিল। রাজ অমাত্যের অনেকেই সেগুলো পরিচালনা করতেন। পদপ্রার্থীরা সেখানে শিক্ষালাভ করে ইম্পেরিয়াল নিয়োগ পরীক্ষায় বসত। ১৯০৫ অবধি সামন্তবাদী চীনে এ ধরনের নিয়োগ পরীক্ষার প্রচলন ছিল।
প্রাচীন ভারতে আমলাতান্ত্রিক প্রসঙ্গ
এবার ভারতের আমলাতন্ত্রের প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রাচীন ভারতের রাজনীতি, প্রেক্ষাপট, অর্থনীতি, প্রশাসন ব্যবস্থার উপর লিখিত অনবদ্য একটি বই চাণক্যের অর্থশাস্ত্র। চাণক্য ছিলেন তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। রাজনীতি ও অর্থনীতির ব্যাপারে মহাপণ্ডিত। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রশাসন ব্যবস্থাকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।
রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি লিখেছিলেন। অর্থশাস্ত্রে সে আমলের আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতার ব্যাপারে বিস্তর আলোচনা করা হয়েছে। সে যুগে আমলাতন্ত্র ছিল সোপানকেন্দ্রিক। পিরামিডের সর্বোচ্চ চূড়ায় অবস্থান করতেন একজন আমলা বা অমাত্য যাকে রাজা বিশ্বাস করে নিযুক্ত করতেন। রাজার প্রতি আনুগত্যই ছিল তখনকার আমলাদের যোগ্যতার মাপকাঠি। রাজার সাথে সরাসরি সম্পর্কের দরুন আমলারা প্রচুর সুযোগ-সুবিধা ও বেতন-ভাতা গ্রহণ করতেন। পদসোপানের যে যত নিচে অবস্থান করত তার বেতন ছিল তত কম। সর্বোচ্চ বেতন ছিল সর্বনিম্ন বেতনের প্রায় ৮০০ গুণ। সে আমলে একজন ম্যাজিস্ট্রেট একজন অদক্ষ শ্রমিকের চেয়ে ১৩৩ গুণ বেশি বেতন পেতেন।
এ ধরনের প্রশাসনে তাই আমলাদের ব্যাপক দুর্নীতি করার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। চাণক্য সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতিকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন। প্রথমটি ছিল সরকারকে ফাঁকি দেওয়া, পরেরটি ছিল জনসাধারণের অর্থ আত্মসাৎ করা। চাণক্য তার বইয়ে সরকরি অর্থ আত্মসাতের ৪৮টি পন্থার কথা উল্লেখ করেছিলেন এবং একেক ধরনের শাস্তি নির্ধারণের বিধান দিয়েছিলেন।
মুঘল প্রশাসনে আমলাতান্ত্রিকতা
এ ধারা পরবর্তী শাসকদের আমলেও কিছু কিছু অব্যাহত ছিল। মুঘলদের আমলে সাম্রাজ্যের আয়তন বাড়ার সাথে সাথে আমলাতন্ত্রের আকার ও নিরবচ্ছিন্নতা বাড়তে থাকে। মুঘলরা পুরো সাম্রাজ্যকে কয়েকটি সুবা বা প্রদেশে ভাগ করেছিল। সুবাগুলোকে আবার ভাগ করা হয়েছিল কয়েকটি জেলায়। জেলাকে তখন বলা হতো সরকার। এলাকার প্রধান শহরের নামানুসারে সরকারের নামকরণ করা হতো। সীমানা নির্ধারণে গুরুত্ব দেওয়া হতো ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক সীমারেখার উপর।
আকবরের শাসনামলে সুবা-এ-বাংলাকে ১৯টি সরকারে বিভক্ত করা হয়েছিল। সরকারের শাসনকাঠামো সুবা বা প্রদেশের আদলেই স্বয়ংসিদ্ধ করে তৈরি করা হয়েছিল। আকবর সুবার প্রধানের পদ করেছিলেন সিপাহসালার। জাহাঙ্গীরের সময় সুবাপ্রধানের পদটির নামকরণ করা হয় সুবাদার। আওরঙ্গজেবের আমলে করা হয় নাজিম। সুবার প্রশাসনে সুবাদারের নিচের পদটি ছিল দেওয়ান। তার অবস্থান সুবাদারের নিচে হলেও তিনি সুবাদারের অধীনস্থ ছিলেন না। তিনিও সরাসরি সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হতেন। দেওয়ান ছিলেন সুবার রাজস্ব ও অর্থবিভাগের প্রধান কর্মকর্তা। পাশাপাশি কৃষি ও কৃষকের উন্নতি বিধানের দ্বায়িত্বটিও তাকে পালন করতে হতো। বখশীর দ্বায়িত্ব ছিল সেনাবিভাগের তদারকির।
আলেম, আউলিয়া, সুফি ও পন্ডিত ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষণ এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানাদির তদারকির ভার থাকত সদরের ওপর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নগরীর পাহারার কাজ করতেন কোতওয়াল। সংবাদ ও ঘটনা লিখনের দ্বায়িত্ব পালন করতে হত ওয়াকিয়ানবিশকে। নৌবাহিনীর অধ্যক্ষের পদকে বলা হত মীরবাহর। তার কোনো প্রশাসনিক ক্ষমতা ছিল না। সামরিক প্রয়োজনে তাকে নিয়োগ দেওয়া হতো।
ব্রিটিশ ভারতে আমলাতন্ত্র
আমলাতন্ত্রের সর্বোচ্চ উৎকর্ষ সাধিত হয় ব্রিটিশ আমলে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা প্রদেশ দখল করার পরে দ্বৈত শাসন প্রবর্তন করলে তখনও রবার্ট ক্লাইভ পুরোনো ধাঁচের আমলাতন্ত্রের সাহায্যেই শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংস এসেই আমলাতন্ত্রকে ঢেলে সাজানো শুরু করেন। তিনি কোম্পানি ও স্থানীয় প্রশাসনের মেলবন্ধনে একটি নতুন আমলাতন্ত্রের প্রবর্তন করেন যেখানে শ্বেতাঙ্গদের জন্য সংরক্ষণ করা হয় উচ্চতর পদগুলো। নিচের পদগুলোতে স্থানীয়দের নিয়োগ দেওয়া হত।
এভাবে একটি বেনিয়া আমলাতন্ত্রের সূচনা হয়। এরা কোম্পানির স্বার্থ সংরক্ষণের কাজে ব্রতী হয়। এদের নিয়োগ দিত ইংল্যান্ডের ‘কোর্ট অব ডাইরেক্টরিস’ নামক একটি কর্তৃপক্ষ। কোর্ট অব ডাইরেক্টরিস অল্পবয়সী তরুণদের কোম্পানির সিভিল সার্ভিসে নিয়োগ দিত। নিয়োগপ্রাপ্ত সদস্যরা প্রবেশনারি বা শিক্ষানবিস হয়ে কয়েক বছর কাজ করার পর পাকাপাকিভাবে কোম্পানির সিভিল সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত হতো। এ সময় কোর্ট অব ডাইরেক্টরিস এর বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তোলা হয়।
কোর্ট অব ডাইরেক্টরিস প্রদত্ত সনদের উপর ভিত্তি করে নিয়োগ দেওয়া হতো বলে এই সিভিল সার্ভিসকে বলা হতো সনদী সিভিল সার্ভিস (সিসিএস)। সিসিএসদের উচ্চতর পদগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হতো। আর, স্থানীয়দের নিয়োগ দিত ফোর্ট উইলিয়াম কর্তৃপক্ষ। তাদের বলা হতো অসনদী সিভিল সার্ভিস। নামমাত্র বেতনে তাদের নিযুক্ত করা হতো। অন্যদিকে, সনদীদের বেতন ভাতা অল্প হলেও তাদের ছিল ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের সুযোগ এবং অঘোষিত কমিশন। ফলত, তৎকালীন অনেক সনদী সিভিল সার্ভেন্টের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার উপক্রম হয়।
এভাবে কয়েক বছর পার হয়। লর্ড কর্নওয়ালিস লাট হয়ে আসার পরে সিভিল সার্ভেন্টদের সত্যিকারের পেশাদার কর্মচারীতে পরিণত করেন। তিনি অফিসারদের ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের সুযোগ বন্ধ করে দেন। কিন্তু তাদের আকর্ষণীয় বেতন, প্রশাসনিক ক্ষমতা ও বহুল সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়।
ইংল্যান্ড থেকে কোনো অফিসার আসার আগে তাকে প্রশাসনিক সার্ভিস বা ব্যবসায়িক বৃত্তি যেকোনো একটিতে চয়েসের মাধ্যমে আসতে হতো। লর্ড কর্নওয়ালিস আরেকটি কাজ করেন। তিনি স্থানীয় ভারতীয়দের মনে করতেন প্রশাসন পরিচালনায় অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজ। তাই, তার আমল থেকে ভারতীয়দের অসনদী সিভিল সার্ভিসের মাধ্যমে নিয়োগদান বন্ধ করে দেওয়া হয়। চাকরির বিধি-বিধান ও কাঠামো সম্বলিত সিভিল সার্ভিস ম্যানুয়াল ১৭৯৩ এর চার্টার অ্যাক্টে সংযোজিত করা হয়। তার এ সংস্কারের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে ভারতে একটি পেশাদার আমলাশ্রেণির গোড়াপত্তন হয়। কোম্পানির দুর্নীতি অনেকাংশে কমে যায় এবং দখলিকৃত উপনিবেশের আয়তন দিনদিন বৃদ্ধি পায়।
১৭৯৩ থেকে ১৮৩৩ পর্যন্ত এভাবেই চলে। কিন্তু স্থানীয়দের দূরে রেখে কোম্পানির নতুন দখলকৃত ভূখণ্ডে প্রশাসন পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়ে। কোম্পানির বাজেট বাড়তে থাকে কিন্তু আনুপাতিক হারে রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয় না। লর্ড ওয়েলেসলি এ ব্যবস্থার প্রতিকার করলেন আবার অসনদী সিভিল সার্ভিস চালুর মাধ্যমে। তিনি বিচার বিভাগীয় সদর আমিন পদ সৃষ্টি করলেন। লর্ড বেন্টিংকের আমলে শ্বেতাঙ্গ অফিসারদের আপত্তি উপেক্ষা করে মুখ্য সদর আমিন ও ডেপুটি কালেক্টর পদ সৃষ্টির মাধ্যমে স্থানীয়দের প্রশাসনে সংযুক্তিকরণ আরো বাড়ানো হয়।
১৮৫৩-তে এসে কোর্ট অব ডাইরেক্টরিসের মুনশি বা শিক্ষানবিশ নিয়োগের ক্ষমতা বাতিল করে টি বি ম্যাকলের নেতৃত্বে গঠিত পাঁচ সদস্যের একটি কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী মেধার ভিত্তিতে সিভিল সার্ভিসে নিয়োগের সুযোগ প্রদানের উদ্দেশ্যে একটি স্থায়ী সিভিল সার্ভিস কমিশনার্স গঠন করা হয়। কমিশন প্রতিবছর একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতর প্রার্থীদের নাম কোর্টের কাছে সুপারিশ করত। ১৮ থেকে ২৩ বছরের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে বসবাসকারী যে কেউ এ পরীক্ষা বসতে পারত। পরীক্ষার মোট নম্বর ছিল ১২৫০। নিয়োগ পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার পর প্রার্থীদের অক্সফোর্ডে ২ বছরের কঠোর প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে তবেই পদায়ন করা হতো।
১৮৫৮ তে শিক্ষানবিশদের প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল ১ বছর। ১৮৬৬ তে সেটি বাড়িয়ে দুবছর করা হয়। ১৮৭৬ এ আবার কমিয়ে ১ বছর করা হয় যেটি পরাধীন ভারতের সর্বশেষ আইসিএস ব্যাচ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। প্রশিক্ষণকালে তাদের পদায়নকৃত অঞ্চলের ভাষাসহ অন্য দুটো ভারতীয় ভাষায় পারদর্শী করে গড়ে তোলা হতো। এছাড়াও, তাদের পাঠ্যসূচিতে ছিল ভারতীয় সংস্কৃতি, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, ভূগোল, আইন ইত্যাদি। সিভিল সার্ভেন্টরা ছিলেন ভারতে ইংরেজ সরকারের প্রতিনিধি। তাদের কঠোর ও কঠিন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ প্রশাসক হিসেবে গড়ে তুলে উপনিবেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়োগ দেওয়া হতো। মেধাতালিকার উপরের দিকে অবস্থানকারী প্রার্থীদের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে নিয়োগ দেওয়ার বিধান ছিল।
এরপর থেকে সিভিল সার্ভিসে ভারতীয়করণ শুরু হয়। ১৮৬১ তে অসনদী সিভিল সার্ভিস বাতিল করে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ও ভারতীয়দের জন্য সাব-অর্ডিনেট এক্সিকিউটিভ সার্ভিস নামে নতুন এক সার্ভিস প্রবর্তিত হয় যার মাধ্যমে ডেপুটি কালেক্টর ও সাব ডেপুটি কালেক্টর পদে নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়। কয়েক বছর পরে স্ট্যাটুটরি সিভিল সার্ভিস নামে আরেকটি সার্ভিসের পত্তন করা হয়। এ সার্ভিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয় যে এখানে ব্রিটিশরাজ পুরোপুরি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে প্রার্থী নিয়োগ দিয়েছেন। হিন্দু ও অহিন্দু সব গোষ্ঠীর সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার আইচিসন কমিশন গঠন করে সিভিল সার্ভিসকে অধিকতর ভারতীয়করণের সুপারিশ প্রদানের লক্ষ্যে।
কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক প্রাদেশিক বা প্রভেন্সিয়াল সিভিল সার্ভিসের সূচনা করা হয়। আইচিসন কমিশনের সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়। সনদী সিভিল সার্ভিসকে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস বা আইসিএস নামকরণ করা হয়। শুরু হয় নতুন একটি যুগ। তখনও সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা হতো শুধু লন্ডনে। ভারতীয়দের দাবির মুখে ১৯২২ এ ভারতের উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ ও লন্ডনে যুগপৎভাবে আইসিএস পরীক্ষা গ্রহণ শুরু হয়। (চলবে…)