Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অন্তহীন: একটি নান্দনিক চারুকর্ম

ভারতীয় অনেক বাংলা ছবিই বাংলাদেশে যথেষ্ট জনপ্রিয় ও অপার বিনোদনের উৎস, বিশেষ করে বাংলা আর্ট ফিল্মগুলোর আলাদা আকর্ষণ আছে রুচিশীল দর্শক শ্রেণীতে। এসব ছবির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এরা জীবনের একেবারে সাদামাটা, মুখোশহীন রূপটি তুলে আনে, রোজকার জীবনে যা কিছু ঘটে, রোজকার কষ্ট, সুখ, হতাশা, ভালোলাগা, সমস্যা, ক্ষেত্র বিশেষে উত্তরণের পথও তুলে ধরা হয় এসব ছবিতে। তাই খুব সহজেই ছবিগুলোকে দর্শক সংযুক্ত করতে পারেন নিজেদের সাথে। আর্ট ফিল্মের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এর ‘আর্টিস্টিক’ বা শিল্পায়িত উপস্থাপন। এমন একটি শিল্পগুণবিশিষ্ট ছবি ‘অন্তহীন’। ২০০৯ সালের ২৩ জানুয়ারি মুক্তি পাওয়া পরিচালক অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরীর ‘অন্তহীন’ অগণিত শিল্পপ্রিয় মানুষের অসম্ভব পছন্দের একটি ছবি।

অন্তহীন…; source: twitter.com

সুদক্ষ ও করিৎকর্মা সব তারকার সমন্বয়ে ‘অন্তহীন’ যেন হয়ে উঠেছে তারার মেলা। অপর্ণা সেন, কল্যাণ রায়, শর্মিলা ঠাকুরের মতো গুণী প্রবীণদের পাশাপাশি রয়েছেন আধুনিক কালের সব্যসাচী অভিনেতা রাহুল বোস। অন্তহীনের অন্যতম অনুদান আরেক কুশলী অভিনেত্রী রাধিকা আপ্তেকে আবিষ্কার। পারমিতা চরিত্রে ছোট চুলের অপর্ণা সবসময়ের তুলনায় আরও বেশি সুন্দর ও তারুণ্যে ভরা। অপর্ণার বাস্তব জীবনের জীবনসঙ্গী কল্যাণ রায় রয়েছেন অপর্ণার স্বামীর চরিত্রেই। অসাধারণভাবে মানিয়ে নিয়েছেন তিনি চরিত্রটির সাথে। অভীক চরিত্রে রাহুল বোস ও বৃন্দা চরিত্রে রাধিকা কেমন করেছেন, সেটা দর্শকদের নিজেদের বিশ্লেষণের জন্যই তোলা থাক। অভীকের পিসির চরিত্রে শর্মিলা ঠাকুরের অভিনয় দেখে নস্টালজিক হয়ে যেতে হয়…; সেই স্বাদ, সেই শৈলী!

বৃন্দা রূপে অনন্যা রাধিকা; source: dailymotion.com

‘অন্তহীন’ মানবিক সম্পর্কের গল্প; কিংবা সম্পর্কের উর্ধ্বে উঠে এক বেনামী টান বা বন্ধুত্বের মায়াডোরের গল্পও বলা যায়। সংলাপে, কথনে, কাহিনীর উত্থান পতনে এতে বারবার উঠে এসেছে একজন বন্ধুর গুরুত্ব। যে সময়ে প্রযুক্তি আর পুঁজিবাদের কবলে পড়ে মানুষ অপরের থেকে শুধু দূরেই সরে যাচ্ছে, তখন ‘অন্তহীন’ মনে করিয়ে দেয় যে তুমিও মানুষ, সঙ্গীহীন একেকটা ব্যক্তিগত বালুচরে তুমি নিতান্তই অসহায়, দিনশেষে সেটাই তোমার পরিচয়। তাই সময় থাকতে আঁকড়ে ধরো, নয়তো অপেক্ষা গড়াবে অন্তহীনে। এই কথাটাই পারোদির কন্ঠে উঠে আসে, “…বুঝতে শিখবি… নিজেকে, অন্যদের, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে রে!”

তারুণ্যে ভরা অপর্ণা; source: tribuneindia.com

বিয়ে নিয়ে সাধারণ সেই প্রশ্ন উঠে এসেছে এতে, “ডু ইউ বিলিভ ইন ম্যারেজ?” সময়ের পরিবর্তনের সাথে বিয়ে নামক সামাজিক বন্ধনটি হয়ে গেছে ভঙ্গুর, অনিশ্চিত, একইসাথে অবোধগম্য। কিন্তু বদলায়নি মানুষের মানুষকে আঁকড়ে ধরার চিরদিনের বিকল্পহীন বাসনা। তিনটি জোড়া দেখা যায় এই ছবিতে। এর মধ্যে আছেন পারমিতা (পারো) আর রঞ্জন (রঞ্জু), যারা আলাদা থাকেন। বিয়েটা কাজ করেনি, কিন্তু তারপরেও রোজ ফোনে কথা হয়, প্রায়ই দেখা হয়, একে অপরের নৈমিত্তিকতা হয়ে আছেন এখনও। রঞ্জুর রেইনকোটটা এখনও খুঁজে দিয়ে যান পারো। পারোর আঁকা ছবিগুলো এখনও শোভা পায় রঞ্জুর ঘরের দেয়ালে, কিন্তু কী এক অদৃশ্য দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে দুজনের মাঝখানে, অভিমান জমে জমে অলঙ্ঘ্য পাহাড় হয়ে আছে।

দ্বিতীয় জোড়া হলেন মিস্টার অ্যান্ড মিসেস মেহরা। একটি তিক্ত অতীত মাঝখানে রেখে একই সংসারে দুজন দুই মেরুতে অবস্থান করছেন দীর্ঘকাল। ব্যবসা, অবৈধ প্রজেক্ট, পার্টি, জাঁকজমকের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে ভালোবাসার ফসিল। একজন অপরজনকে মাইগ্রেনে ভুগতে দেখেন, কিন্তু ওষুধটা নিজ হাতে তুলে দেয়া হয় না।

তৃতীয় ও প্রধান জোড়াটি হলো এই ছবির মূল নায়ক-নায়িকা, অভীক আর বৃন্দা। কলকাতা পুলিশের জাঁদরেল অফিসার অভীক আর দাপুটে টিভি জার্নালিস্ট বৃন্দা বাস্তব জীবনে শুধুই আত্মীয়-বন্ধুদের সূত্রে পরিচিত; কিন্তু প্রযুক্তির কল্যাণকর ছোঁয়ায় ভার্চুয়াল দুনিয়ায় তারা একে অপরের অনেক বেশি পরিচিত। সেখানে তারা কেউ কাউকে চেনে না। ‘রাত জাগা তারা’ আর ‘বয় ইন দ্য বক্স’- এই তাদের পরিচয়। কোনো নাম জানা সম্পর্ক নয়, নিছক… কিছু একটা! তারা একে অপরের অবচেতনের সঙ্গী, চেনা আগন্তুক, ভালো লাগার শিহরণ, আর অন্তহীন অপেক্ষা। এই অপেক্ষার অন্ত হয়, নাকি অন্তহীনই রয়ে যায়, তার উত্তর জানতে হলে ছবিটি দেখতেই হবে। একই প্রযুক্তির প্রভাবে ব্যস্ত আর বিরক্ত হয়ে কাছের মানুষরা দূরে সরে যাচ্ছে, আবার সেই বিরক্তি আর অবসাদ থেকে একটু মুক্তি পেতে গিয়ে দূরের দুজন মানুষ একে অপরের বন্ধু হয়ে উঠছে- এই দুটো বিষয়ই প্রচ্ছন্নভাবে দর্শকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে।

শর্মিলা ঠাকুর; source: xossip.com

অন্তহীন অপেক্ষার আরও একটি ভালো চরিত্রায়ণ করা হয়েছে অভীকের পিসির চরিত্রটিতে। প্রবীণ শর্মিলা ঠাকুর নিজ মহিমায় ভাস্বর তার এই চরিত্রে। কবেকার কোন যৌবনে একটা ভুল ফোনকল, একটা অচেনা ভারি গলা, একটা জড়িয়ে যাওয়ার আর আড়ালে থেকেই হারিয়ে যাওয়ার গল্প জমে আছে তার স্মৃতির প্রকোষ্ঠে! “তুমি কি এখনও অপেক্ষা করে আছো?”- অভীকের এই প্রশ্নের জবাবটা এড়িয়ে গিয়ে পিসি তার অন্তহীন অপেক্ষার স্বরূপটিই প্রকট করে তোলেন। পিসির সেই পুরনো দিনের ল্যান্ডফোন আর অভীকের বর্তমানের সোশ্যাল নেটওয়ার্কে চ্যাট- শুধু সময় বদলানো একই কাহিনীর রূপান্তর।

অন্তহীনের সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভ বলা যায় এর গানগুলোকে। প্লট আর চরিত্রদের অনুভূতির সাথে মিল রেখে তৈরি এই ছবির ৬টি গানই একেকটি মাস্টারপিস। দক্ষ সঙ্গীত পরিচালক শান্তনু মৈত্র (পরিণীতা, থ্রি ইডিয়টস, পিকে, মর্দানি, ওয়াজির, পিঙ্ক, মাদ্রাস ক্যাফেসহ আরও অনেক বিখ্যাত ছবির সঙ্গীত পরিচালক) তার পুরোটা ঢেলে দিয়েছেন এই ছবির সঙ্গীত পরিচালনায়। শ্রেয়া ঘোষাল, বাবুল সুপ্রিয়, অনিন্দ্য চ্যাটার্জী, শান এর মতো নামিদামি শিল্পীরা কন্ঠ দিয়েছেন অন্তহীনের গানগুলোতে। একেকটা গান তাই যেন একেকটা ‘মুঠোর রুমাল’ হয়ে উঠেছে, সুগন্ধ ছড়িয়ে প্রিয় হয়ে উঠেছে, বিমূর্ত শূন্যতাকে মূর্তিমান হাহাকারে পরিণত করেছে। ‘সকাল আসে না’ বা ‘ফেরারী মন’ এর সুরগুলো এক অবিচ্ছিন্ন নির্লিপ্ত কাতরতায় ভরিয়ে দেয় সমগ্র সত্ত্বা। ‘কথা ছিল হেঁটে যাবো ছায়াপথ’ এই লাইনটিই যেন হয়ে ওঠে চরিত্রগুলোর অনুচ্চারিত আক্ষেপ। চিরকালীন নিরন্তর এক আকুতি ফুটে ওঠে ‘আমার ভিনদেশী তারা’ গানে। অজান্তেই চোখ ভরে ওঠে, কারণ খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ হয় মন। এ শুধু এক অন্তহীন অন্ধকারের অন্তর্বর্তী শূন্যতায় নিজেকে সঁপে দেয়া। ভালো লাগে ‘যাও পাখি বলো’ গানটিও, শহরের বৃষ্টি দিনের এতোটা নান্দনিক উপস্থাপন বাংলা ছবিতে খুব কম পাওয়া যায়।

যাও পাখি বলো; source: youtube.com

অন্তহীনের চিত্রনাট্য ভূয়সী প্রশংসার যোগ্য। প্রতিটি চরিত্রকে একে একে যেভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় এবং কাহিনীর বেড়ে ওঠার সাথে সাথে যেভাবে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক প্রকাশিত হয়, তা অতিশয় দক্ষতার ও সূক্ষ্মতার সাথে করা হয়েছে। আরেকটি প্রশংসনীয় বিষয় হলো অন্তহীনের নান্দনিক ‘আর্ট ডিরেকশন’। অফিসের ডেস্ক থেকে শুরু করে নায়কের বারান্দা, যেখানে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোর উদ্ভাস; নায়িকার ঘরের কাঁচের দেয়াল যাতে বৃষ্টির ছাঁট লেগে ফুটে ওঠে কাঁচের গায়ের আঁকিবুকি আর নানান লেখা, সবই কেমন অন্যরকম সুন্দর।

মনকাড়া আর্ট ডিরেকশন; source: dailymotions.com

রঞ্জুকে একটি বইয়ের ভেতর পারো লিখেছিলেন, “কাছে এলে তোমাকে চেনা যায় না… ঝাপসা হয়ে যাও… যত দূরে যাও তত স্পষ্ট হয়ে ওঠো।” দূরে সরে যাবার জন্যে পারোর এটিই সবচেয়ে বড় কারণ ছিল। কিন্তু ছবির শেষ দৃশ্যে রঞ্জু যখন উতলা হয়ে পারোকে ফোন করে বলেন, “আমি কি তোমার কাছে কয়েকদিনের জন্যে বম্বেতে আসতে পারি? জাস্ট কয়েকদিনের জন্যে…”, তখন পরিষ্কার হয়ে যায় পারোর উপরোক্ত কথাগুলোর পাল্টা যুক্তি- কাছে এলে যদি ঝাপসাই হতে হয়, তবে এতটা কাছে এসো যাতে তোমার প্রতিটি রঙ স্পষ্ট করে দেখতে পাই।

IMDB তে 7.8 রেটিং পাওয়া ‘অন্তহীন’ ২০১০ সালে জাতীয় পুরষ্কার জিতে নেয়। এছাড়াও সেরা প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে শ্রেয়া ঘোষাল, সেরা চিত্রনাট্যের জন্য অভীক মুখার্জী, সেরা গীতিকার হিসেবে অনিন্দ্য চ্যাটার্জী ও চন্দ্রনীল ভট্টাচার্য জাতীয় পুরস্কার পান।

সেরা ভারতীয় বাংলা ছবির তালিকায় প্রথমদিকেই রাখতে হবে অন্তহীনকে। এখনও না দেখে থাকলে দেখে ফেলতে পারেন। রুচিশীল দর্শকের মনের গহীনে অনায়াসে জায়গা দখল করে নেবে এই অনিন্দ্য সৌন্দর্যের উৎসটি। যারা বিশ্বাস রাখেন বেনামী বন্ধুত্বে, বেহিসাবী ভালোবাসায়, নৈকট্যে আর অপেক্ষায়, তাদের সাথে ‘অন্তহীন’, অন্তহীন ভালোলাগার একটি ছবি হিসেবে আজীবন জড়িয়ে রইবে।

The Endless Wait; source: techtunes.com.bd

ফিচার ইমেজ: youtube.com

Related Articles