“যদি কখনো গতির কারণে আমার মৃত্যু হয় তাহলে তোমরা কেঁদো না, কারণ আমি মৃত্যুর সময় হাসছিলাম!” – পল ওয়াকার
গাড়ি প্রেমিকদের নিকট গাড়ির নতুন নতুন মডেল তাদের নিত্যনতুন প্রযুক্তিগত উন্নতি কিংবা চোখ ধাঁধানো ডিজাইনের জন্য যতটা না আকর্ষণীয়, তার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় তাদের গতি। পৃথিবীতে কোনো কিছুই স্থির নেই। সবকিছু সর্বত্র গতিময়। গতি ছাড়া আদতে নিত্যদিনের প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বে টিকে থাকাই দায়। অস্তিত্বের প্রয়োজনেই মানুষ প্রতিনিয়ত ছুটছে এবং সেই ছোটার গতি সর্বদাই তার পাশেরজনের চেয়ে কিছুটা হলেও বেশি রাখার লক্ষ্য থাকে সকলের। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে অবশ্যই নিজের চলার গতি অন্যদের চেয়ে বেশি হতে হবে। ঠিক যেমন ফর্মুলা ওয়ানে গাড়িগুলো দুর্বার গতিতে ছুটে চলে একে অপরকে টেক্কা দিয়ে।
জীবনে ছুটে চলার এই প্রতিযোগিতা সম্ভবত প্রতিদিনই সবচেয়ে বেশি চলে মহাসড়কগুলোতে। হ্যাঁ, ব্যস্ত সড়কে কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। বরং সামান্য সময় বাঁচাতে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ একের পর এক ওভারটেক করে চলে। আর এতে করে প্রতিদিন সড়কে ঝরে যায় কত প্রাণ তার হিসাব আছে? কিন্তু তাতে কি? গতির নেশা মানুষের একটুও কমে না। বরং বেড়েই চলেছে এক চিরন্তন ধারায়। সাধারণ মানুষ থেকে হলিউডের তারকারা পর্যন্ত গতির প্রেমিক। বলিউডের সাইফ আলি খান কিংবা হলিউডের পল ওয়াকারের গতি প্রেমের কথা কে না জানে? আর প্রিয় তারকাদের এই গতি প্রেম রোমাঞ্চ ছড়ায় সাধারণের মনেও। হোক না পল ওয়াকারের মৃত্যু গতির জন্যই! গতিময় জীবনকে আরো গতিময় করতে তাই গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলোও পাল্লা দিয়ে তৈরি করে চলেছে সব দুরন্ত গতির গাড়ি। এরকমই পাঁচটি গাড়ি সম্পর্কে আমরা জানবো আজ, যেগুলো সাধারণ ‘কার’ নয়, ‘সুপার কার’ হয়ে উঠেছে তাদের গতির জন্য।
৫) এসএসসি আল্টিমেট এরো; সর্বোচ্চ গতি- ৪১২ কিলোমিটার/ঘন্টা
২০০৭ সালে আমেরিকার শেলবি সুপার কারস তথা এসএসসি নর্থ আমেরিকা কোম্পানি বাজারে নিয়ে আসে এসএসসি আল্টিমেট এরো, যা ঘন্টায় সর্বোচ্চ ৪১২ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে। ফোরহুইল মিড-ইঞ্জিন (যে গাড়ির দহন ইঞ্জিন ঠিক মধ্যস্থলে থাকে) এই গাড়িটি বাজারে আসার পর তিন বছর গিনেস বুকে দ্রুততম গাড়ির রেকর্ড ধরে রাখে। কিন্তু ২০১০ এর বুগাত্তি ভ্যারনের রেকর্ড কোনো এক অজানা কারণে ২০১৩ সালে বাতিল ঘোষণা করে গিনেস কর্তৃপক্ষ এবং এই আল্টিমেট এরোকে পুনরায় সবচেয়ে দ্রুতগতির গাড়ির মুকুট পরিয়ে দেয়া হয়। তবে এবার মাত্র পাঁচদিনের মাথায়ই মুকুট হারায় এই গাড়িটি। যা-ই হোক, গাড়িটি বাজারে ছাড়ার সময় একমাত্র গাড়ি হিসেবে ঘন্টায় ৪০০ কিলোমিটারের মাইলফলক পেরিয়ে গিয়ে বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল। অন্যদিকে এর টার্বোচার্জড ভি-এইট ইঞ্জিন সর্বোচ্চ ১,২৮৭ হর্সপাওয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন, যা ২০০৭ সালের প্রেক্ষাপটে বিস্ময়কর! চলতে শুরু করার মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই সর্বোচ্চ গতিতে পৌঁছাতে সক্ষম এই গাড়িটি। অধিকাংশ গাড়িপ্রেমী এই গাড়ি সম্পর্কে ইতিবাচক কথা বললেও, এর একমাত্র সীমাবদ্ধতা, যার জন্য একে সমালোচিত হতে হয়েছিল, তা হচ্ছে ইলেকট্রিক ড্রাইভিং ফিচারের অনুপস্থিতি। এই গাড়িটি যদি আপনি কিনতে চান, তাহলে বাংলাদেশি টাকায় আপনাকে খরচ করতে হবে মাত্র ৬ কোটি টাকা, অবশ্যই ভ্যাট এবং ট্রানজিট খরচ বাদে!
৪) বুগাত্তি শিরন; সর্বোচ্চ গতি- ৪২০ কিলোমিটার/ঘন্টা
জনপ্রিয় অনলাইন গেম নিড ফর স্পীড যারা খেলেছেন, তাদের নিকট বুগাত্তি ভ্যারন কিংবা বুগাত্তি শিরন নাম অত্যন্ত জনপ্রিয়। কেননা এই বুগাত্তি শিরন গাড়িটি ঘন্টায় সর্বোচ্চ ৪২০ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম এবং এই গতিতে উন্নীত হতে এর সময় লাগে মাত্র ৩২ সেকেন্ড। এর কোয়াড টার্বোচার্জড ইঞ্জিনের ক্ষমতা ১,৪৮০ হর্সপাওয়ার। এর বাহ্যিক গঠন তৈরি হয়েছে শক্তিশালী কার্বন ফাইবার দিয়ে যার দৃঢ়তা ৫০ হাজার নিউটন/মিটার! ফ্রান্সের বিখ্যাত ‘বুগাত্তি অটোমোবাইলস এস.এ.এস’ কোম্পানি এই গাড়িটি বাজারে আনে ২০১৬ সালে। বাজারে আসার পর থেকেই স্পোর্টস গাড়ি হিসেবে এখনো পর্যন্ত নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে এই গাড়িটি। গাড়িটির বাজারমূল্য ২০ কোটি টাকা!
৩) বুগাত্তি ভ্যারন সুপার স্পোর্ট; সর্বোচ্চ গতি- ৪৩১ কিলোমিটার/ঘন্টা
আবারো চলে আসছে বুগাত্তির কথা। তবে এবার ভ্যারন সুপারস্পোর্ট নামে, যা কিনা শিরনেরই আগের একটি মডেল। শিরন মূলত ভ্যারনেরই একটি উন্নত মডেল। তাই বুগাত্তি শিরনকে অনেকে ভ্যারনের ‘ছেলে’ও বলে থাকে! ২০১০ সালে ফ্রান্সের বুগাত্তি অটোমোবাইলস বাজারে আনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এই স্পোর্টস গাড়িটি। বাজারে এসেই গাড়িটি গিনেস বুকে আল্টিমেট এরোর স্থান দখল করে সর্বোচ্চ গতির গাড়ি হিসেবে রেকর্ড করে। ২০১৩ সালে কিছু টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে গিনেজ কর্তৃপক্ষ এই স্বীকৃতি বাতিল করা পর্যন্ত নিজের স্থান ধরে রেখেছিল ভ্যারন। ১,২০০ হর্সপাওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন এই গাড়ির ডব্লিউ-১৬ কোয়াড টার্বোচার্জড ইঞ্জিন একে ৩৬ সেকেন্ডে সর্বোচ্চ গতি এনে দেয়। স্পোর্টস কার হিসেবে এর জনপ্রিয়তা শীর্ষস্থানীয়। গাড়িটি কিনতে খরচ করতে হবে ২০ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা!
২) হেনেসি ভেনম জিটি; সর্বোচ্চ গতি- ৪৩৪.৫ কিলোমিটার
বিশ্বের বিষাক্ততম সাপের বিষ বা ভেনোমও আপনার দেহে যে গতিতে ক্রিয়া করবে তার চেয়ে বেশি গতিতে চলতে পারে নির্বিষ এক ‘ভেনোম’! এর নাম হেনেসি ভেনোম জিটি। এই গাড়িটি ঘন্টায় সর্বোচ্চ ৪৩৪.৫ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম। গাড়ির বাজারে তুলনামূলক নতুন এই নাম নতুন বিস্ময়ও বটে। এই গাড়ির ৭.০ লিটার টুইন টার্বোচার্জড ভি-এইট ইঞ্জিনের ক্ষমতা ১,২৫০ হর্সপাওয়ার। এই গাড়ির প্রধান বিশেষত্ব হচ্ছে এর ত্বরণ। মাত্র ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে এর গতি ০ থেকে ৩২০ কিলোমিটার/ঘন্টা ছাড়িয়ে যায়! এর এই অস্বাভাবিক ত্বরণ সম্ভব করেছে এর অত্যাধুনিক ইন্টারকুলার সিস্টেম এবং ‘সিঙ্গেল ক্লাচ শিফট’ পদ্ধতি। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ‘হেনেসি পারফরমেন্স ইঞ্জিনিয়ারিং’ কোম্পানির এই গাড়িটি মূলত ‘লোটাস এক্সিজ’ নামক একটি স্পোর্টস কারের উন্নত সংস্করণ। ২০১৪ সালে এই গাড়িটি সর্বোচ্চ গতি এবং ত্বরণের রেকর্ড করে গিনেজ বুকে জায়গা করে নেয়। গতির বাইরেও আছে এর অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ইন্টেরিয়র ডিজাইন যা যে কাউকে মুগ্ধ করবে। তবে যা জানার পর আপনি আরো মুগ্ধ হবেন, তা হচ্ছে এর বাজারদর। বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গতির ভেনম জিটির মূল্য মাত্র ৯ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা, যা অন্যান্য দ্রুতগামী গাড়ির তুলনায় অনেক কম!
১) কোয়েনিগসেগ অ্যাগেরা আর; সর্বোচ্চ গতি- ৪৩৯ কিলোমিটার/ঘন্টা
বুগাত্তি, ফেরারি কিংবা ম্যাকলারেনের নাম যতটা পরিচিত, কোয়েনিগসেগের নাম তার অর্ধেক মানুষ জানে কিনা সন্দেহ রয়েছে। অথচ এই অ্যাগেরা আর মডেলের গাড়িটিই বর্তমান বিশ্বের দ্রুততম গাড়ি। খুব দ্রুত সময়ে এটি বাজারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের গাড়ির সাথে টেক্কা দিয়ে নিজের অবস্থান সর্বোচ্চ স্থানে নিয়ে গেছে। এর সর্বোচ্চ গতি ৪৩৯ কিলোমিটার/ঘন্টা যা ভেনোম জিটির চেয়ে ঘন্টায় ৫ কিলোমিটার বেশি। এর টার্বোচার্জড ভি-এইট ডওএইচসি প্রযুক্তির ইঞ্জিনের ক্ষমতা ১,১৪০ হর্সপাওয়ার। এই গাড়ির প্রস্তুতকারক নব্য সুইডিশ গাড়ি নির্মাণকারী কোম্পানি ‘কোয়েনিগসেগ’। ২০১১ সালে গাড়িটি বাজারে আসে এবং টপ গিয়ার ম্যাগাজিনে ‘হাইপার কার অব দ্য ইয়ার’ খেতাব লাভ করে। মাত্র ২১ সেকেন্ডে গাড়িটি ৩০০ কিলোমিটার/ঘন্টা গতিতে পৌঁছুতে সক্ষম। জনপ্রিয় ভিডিও গেম নিড ফর স্পীডের ২০১৪ সালের সংস্করণ রাইভালসে এই গাড়িটি প্রথম সংযোজিত হয় এবং সে বছর নির্মিত ‘নিড ফর স্পীড’ নামক হলিউড ছবিটিতেও এই গাড়িটি ব্যবহৃত হয়। ডুয়েল-ক্লাচ ট্রান্সমিশন শিফট, টারগা স্টাইলের ছাদ এবং কার্বন ফাইবার চাকা গাড়িটিকে করেছে অনন্য। গতির দিক দিয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেও মূল্যমানের দিক থেকে ভ্যারনের পেছনেই রয়েছে অ্যাগেরা আর। বাংলাদেশি টাকায় এর মূল্য ১৭ কোটি ৪০ লাখ।
এই গাড়িগুলো ছাড়াও ৯-এফএফ জিটি-৯, ম্যাকলারেন-এফ১, পাগান হুয়েরা ও জেনভো এসটি-১ এর মতো গাড়িগুলো দুর্দান্ত গতিসম্পন্ন। তবে সবচেয়ে দ্রুতগতির পাঁচটি গাড়ির তালিকা করতে গেলে উপরের গাড়িগুলোর নামই চলে আসে সবার আগে। তথাপি প্রতিটি গাড়িরই কোম্পানি এবং গিনেস কর্তৃপক্ষের সাথে গতি বিষয়ক কিছু কিছু বিতর্ক থাকার কারণে তালিকায় ভিন্নতা থাকতে পারে।