ডানকার্ক: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অলৌকিকতম ঘটনার ধ্রুপদী এক চিত্রায়ণ

সুবিশাল ধু ধু এক সাগরতীর, জায়গার নাম ডানকার্ক। সেখানে বাড়ি ফিরবার জন্য অপেক্ষা করছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চার লাখ সেনা, কখন জাহাজ আসবে আর তারা ফিরবে দেশে। কিন্তু বলা নেই কওয়া নেই, শত্রুপক্ষ এই উন্মুক্ত সাগরতীরেই বোমা আর গুলি ছুড়তে শুরু করল। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি লাখ লাখ মানুষ। কিন্তু তখনই ঘটলো এক অলৌকিক ঘটনা। আর এ ঘটনা নিয়েই সিনেমার জাদুকর ক্রিস্টোফার নোলান বানিয়েছেন ‘ডানকার্ক’ মুভিটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া মন্ত্রমুগ্ধকর এ সত্য ঘটনা দেখা শেষ করে আপনি মনের অজান্তেই একে হয়ত দশে দশ দিয়ে ফেলবেন। তবে যদি এখনো দেখে না থাকেন, তবে মুভিটি দেখবার আগে যে যে বিষয় জানা জরুরী সেগুলো পেয়ে যাবেন আজকের লেখাতেই, আর থাকছে না কোনো স্পয়লার।

ডানকার্ক মুভির একটি পোস্টার; ছবিসূত্রঃ আইএমডিবি

চলুন একটু পেছনের কাহিনী জেনে আসা যাক। ঘটনাটা ১৯৪০ সালের ২৬ মে থেকে ৪ জুন পর্যন্ত চলেছিল। ঘটনাস্থল সমুদ্রতীরে, উত্তর ফ্রান্সের ডানকার্কে। সেখানে আটকা পড়া প্রায় চার লাখ মিত্রবাহিনী সেনাকে উদ্ধার করবার জন্য যে অপারেশন চালানো হয়েছিল, তার নাম ছিল অপারেশন ডায়নামো। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সত্যি সত্যি এতগুলো মানুষকে বাঁচানো গিয়েছিল হিটলারের বাহিনীর হাত থেকে, এজন্য এটা পরবর্তীতে ‘মিরাকল অফ ডানকার্ক’ নামে পরিচিত হয়।

ফ্রান্সের যুদ্ধে যখন জার্মান বাহিনী বিপুল সংখ্যক ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, বেলজিয়ান ও কানাডীয় সেনাকে ঘিরে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, তখন হাউজ অফ কমন্সে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল সে ঘটনাকে ‘চূড়ান্ত সামরিক বিপর্যয়’ বলে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর শিকড় আর মাথা ডানকার্কে আটকা পড়ে আছে, মৃত্যুর অপেক্ষায়। উদ্ধারের পর তাঁর সুবিখ্যাত “আমরা সাগরবেলায় যুদ্ধ করব” বক্তৃতায় তিনি এ ঘটনাকে অলৌকিক আখ্যা দেন। মুভিটি দেখলে সত্যি সত্যি আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন কতটা অলৌকিক ছিল তাদের বেঁচে যাওয়াটা।

১৯৪০ সালে ডানকার্কের বিচে সৈন্যরা; ছবিসূত্রঃ গার্ডিয়ান

১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে জার্মানির নাৎসি বাহিনী পোল্যান্ডে অনুপ্রবেশ করে। তখন ফ্রান্স আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং জার্মানির উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। ফ্রান্সকে সাহায্যের জন্য ব্রিটিশ বাহিনী প্রেরণ করা হয়। ১৯৪০ সালের এপ্রিলে জার্মানি ডেনমার্ক আর নরওয়ে আক্রমণ করে। এরপর মে মাসে আক্রমণ করে বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস এবং ফ্রান্স। ২১ মের মাঝে জার্মান বাহিনী সেখানে যুদ্ধরত বিইএফ (ব্রিটিশ এক্সপেডিশনারি ফোর্স)-কে ঘিরে ফেলে। এছাড়াও বেলজিয়ান বাহিনীর যা বাকি ছিল ও ফ্রান্সের তিনটি বাহিনীকে বিইএফ-এর সাথেই উত্তর ফ্রান্সে কোণঠাসা করে ফেলে নাৎসিরা। বিইএফ বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল ভাইকাউন্ট গোর্ট সিদ্ধান্ত নিলেন এখন এখান থেকে না পালালে বিপদ। তাই তাঁর বাহিনীসহ স্বদেশে ফিরবার জন্য তিনি কাছেই বন্দর এলাকা ডানকার্কে যাবার আদেশ দিলেন, সেখানে জাহাজ ভিড়তে পারবে এবং সেনারা জাহাজে করে ফিরে যেতে পারবে।

হিটলারের মনে যদি এই মিত্রবাহিনী ধ্বংস করে দেবার ইচ্ছে থেকে থাকত তবে তিনি সবচেয়ে বড় ভুলটা করেন ১৯৪০ সালের ২২ মে; সেদিন তাঁর অনুমতিতে জার্মান হাই কমান্ড পদাতিক বাহিনীকে থেমে যেতে বলে। তাই এই সেনা প্রত্যাহার ঠেকানোর ভার কেবল জার্মান এয়ার ফোর্সের হাতে রইল। তাদের মোকাবিলা করল ব্রিটিশ এয়ার ফোর্স। যদি তখনই মিত্রবাহিনীর উপর আক্রমণ চালানো হতো তবে, হয়ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিরাই বিজয়ী হতো।

আর্কাইভ ছবিতে ডানকার্কের বিচ থেকে সৈন্যরা জাহাজে উঠছে; ছবিসূত্রঃ গার্ডিয়ান

কিন্তু ২৬ মে সেই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ওদিকে প্রথম দিনে মাত্র ৭৬৬৯ জন সেনা দেশে ফিরতে পারে। কিন্তু তখনই কোণঠাসা মিত্রবাহিনীকে চেপে ধরে নাৎসি বাহিনী। কোথায় যাবে মিত্রবাহিনীর সেনারা? একদিকে সাগর, আর অন্যদিকে জার্মান বাহিনী। আর উপর থেকে বোমা ফেলছে জার্মান এয়ারফোর্স। সাগর তীরে দাঁড়িয়ে চার লক্ষ সৈন্য!

অথচ অষ্টম দিনের মাঝেই ৩,৩৮,২২৬ জন সৈন্য দেশে ফেরার পথে! কীভাবে তাঁরা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এলেন? কীভাবে রক্ষা পেলেন? কেবল একটা বাক্যেই সেটা বলা যায়, যেটি ডানকার্ক মুভির ট্যাগলাইন-

“400,000 MEN COULDN’T GET HOME, SO HOME CAME FOR THEM”

Tagline-টি সহ একটি পোস্টার; ছবিসূত্রঃ আইএমডিবি

কিন্তু তারপরেও ৬৮,০০০ সেনাকে হারাতে হয়। ফেলে যেতে হয় অস্ত্রপাতি, ট্যাংক ইত্যাদি।

মুভিটি দেখবার সময় হ্যান্স জিমারের মনোমুগ্ধকর মিউজিকের সাথে সাথে আপনি পৌঁছে যাবেন ১৯৪০ সালের সেই ডানকার্কের সমুদ্রতীরে, যেখানে আতংকে রয়েছেন লাখ লাখ সেনা। নোলানের অন্য মুভিগুলোর তুলনায় এটির দৈর্ঘ্য বেশ কম, মাত্র ১ ঘণ্টা ৪৬ মিনিট। আর এ মুভির মাধ্যমে ওয়ান ডিরেকশন ব্যান্ডের গায়ক হ্যারি স্টাইলসের অভিনয় অভিষেক হলো। আর পাইলট হিসেবে টম হার্ডির অনবদ্য অভিনয়ের কথা তো বলতেই হয়, আর কিলিয়ান মার্ফি তো আছেনই।

তবে একটা ব্যাপার বলতেই হয়, ডানকার্ক মুভিটি কিন্তু গতানুগতিক War Movie নয়, বরং যুদ্ধের ময়দানে একজন কী অনুভব করতে পারে সে অনুভূতি আপনাকে দেবার জন্য এক ফিল্ম। কোনো চরিত্রের Backstory এখানে দেয়া হয়নি, শুধু সে মুহূর্তে তাঁরা কতটা আতংকে আছেন সেটাই এ মুভির উপজীব্য।

এবার এ মুভি নিয়ে কিছু ব্যতিক্রমী তথ্য দেয়ার পালা। যুদ্ধের মুভিতে কম্পিউটার গ্রাফিক্স থাকবে না, তা কি হয়? কিন্তু নোলান তো এমনিতেই পছন্দ করেন না গ্রাফিক্সের ব্যবহার। তিনি চান সত্যিকারের জিনিস ব্যবহার করা হোক। এখানেও তাই হয়েছে। চার লাখ সেনা কীভাবে দেখাবেন নোলান? প্রায় ১,০০০ থেকে ১,৫০০ এক্সট্রা এই মুভিতে তিনি ব্যবহার করেন, আর বাকি কাজ চালান কার্ডবোর্ডের সেনা বানিয়ে। মুভিটিতে সত্যিকারের ৬২টি জাহাজ ব্যবহৃত হয়! এর মধ্যে ১২টি সেই ১৯৪০ সালের ডানকার্কে ব্যবহৃত সত্যিকারের নৌযান!

পরিচালক নোলান বুঝিয়ে দিচ্ছেন কাজ; ছবিসূত্রঃ আইএমডিবি

ডানকার্ক ছবির টাইটেল তিনটি রঙ দিয়ে লেখা। আকাশী নীল, গারো নীল আর কমলা- যার মানে আকাশ, সাগর আর ভূমি। এই তিন জায়গা থেকেই মুভির কাহিনী এগিয়ে যায়। নোলান ইচ্ছে করেই অপরিচিত আর নতুন অভিনেতাদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন, যাদের বয়স ডানকার্কের সেনাদের বয়সের কাছাকাছি। হ্যারি স্টাইলসকে কেন নোলান বাছাই করলেন- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি হ্যারি স্টাইলসকে হিথ লেজারের ডার্ক নাইটে জোকার হিসেবে বেছে নেয়ার সাথে তুলনা করে চমকে দেন! তবে হ্যারি স্টাইলস এখানে থাকবার কারণে নারী ভক্তের সংখ্যা বেশি বেড়ে গিয়েছিল শুটিং স্পটে, তাই তাঁর ব্যক্তিগত দেহরক্ষী রাখা হয়েছিল। মজার ব্যাপার, এই মুভিতে কোনো নারী অভিনেত্রী ছিলেন না বলবার মতো। পুরো মুভি জুড়েই কেবল পুরুষ!

ক্রিস্টোফার নোলান আর তাঁর স্ত্রী এমা থমাস ইংল্যান্ড থেকে ডানকার্ক নৌকাতে করে যান আবহটা পাবার জন্য। এতে তাদের লেগেছিল ১৯ ঘণ্টা! মুভির লন্ডন প্রিমিয়ারে ডানকার্কে বেঁচে যাওয়া ৩০ জন আমন্ত্রিত ছিলেন। তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কেমন লেগেছে মুভিটি। তাঁরা বলেছিলেন, মুভিটি নিখুঁতভাবে সেই ডানকার্কের ঘটনা তুলে ধরতে পেরেছে।

মুভি ইতিহাসে আগে কোনো মুভিতে এতগুলো নৌযান ব্যবহৃত হয়নি। বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, যেখানে ডানকার্কের ঘটনা ঘটেছিল সেই জায়গাতেই এই মুভির শুটিং করেছেন ক্রিস্টোফার নোলান!

এখানেই শুটিং হয় ডানকার্ক মুভির; ছবিসূত্রঃ আইএমডিবি

কিন্তু সবচেয়ে অবাক করা বিষয়টি হলো, এই মুভিটিতে মিত্রবাহিনীর সেনাদেরকে ঘিরে ফেলেছিল জার্মান সেনারা, অথচ পুরো মুভি জুড়ে একবারও কোনো জার্মান সেনাকে দেখানো হয়নি! এক ঝলক চোখে পড়লেও দেখা যায়নি কোনো চেহারা। নোলান চেয়েছিলেন মুভিটিতে দর্শক কেবল আতংকটা অনুভব করুক।

এখনো অদেখা থেকে থাকলে, এখুনি দেখে ফেলুন আইএমডিবি-তে 8.7 রেটিং পাওয়া এ মুভিটি। তাছাড়াও রটেন টম্যাটোসে ৯৩% ও মেটাক্রিটিকে ৯৪% স্কোর ডানকার্কের! কিন্তু এতে আসলে অবাক হবার কিছু নেই, ক্রিস্টোফার নোলান যে ছবির পরিচালক ও লেখক আর ডানকার্ক যে ছবির গল্প, সে ছবি কি সফল না হয়ে পারে?

ফিচার ইমেজ: IMDB

Related Articles

Exit mobile version