আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সোভিয়েত সাবমেরিনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে আমেরিকান নেভি বেশ কিছু স্থাপনা নির্মাণ করে। সেসব স্থাপনায় বসানো ছিল হাইড্রোফোন যন্ত্র, যা দিয়ে সমুদ্রের গভীরে সূক্ষ্মতম শব্দ শনাক্ত করা যেত। সোভিয়েত সাবমেরিনগুলো মূলত চলাচল করতো ২০-৫০ হার্জ শব্দ-সীমায়। হাইড্রোফোনগুলো যেন এই সীমার কাছাকাছি শব্দ শনাক্ত করতে পারে, তাদেরকে এমনভাবে বানানো হয়েছিল। তবে সাবমেরিনের পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলের তিমির শব্দ ট্র্যাক করতেও সক্ষম হয়েছিল যন্ত্রগুলো। তিমি মূলত ১০-৪০ হার্জ সীমার শব্দ উৎপাদন করে থাকে। আমেরিকা-সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার টানাপড়েন যখন শিথিল হয়ে যায় তখন এ যন্ত্রগুলো মেরিন লাইফের গবেষণায় দিয়ে দেওয়া হয়।
সময়টা ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর। ম্যাসাচুসেটস অঞ্চলের এক মেরিন লাইফ গবেষণাকেন্দ্র যার বর্তমান নাম Woods Hole Oceanographic Institution (WHOI), এর একজন গবেষক বিল ওয়াটকিনসন হঠাৎ করেই রাডারে একটি অদ্ভুত এবং অপ্রত্যাশিত শব্দ ধরে ফেলেন। তাকে দ্বিধায় ফেলে দেয় শব্দের কম্পাংক। কম্পাংক ছিল ৫২ হার্জ। এটা কি কোনো যুদ্ধ সাবমেরিন? কিন্তু যে সময়ের কথা তখন স্নায়ুযুদ্ধের শেষ হয়ে গেছে। ফলে সাবমেরিন হওয়ার কথা নয়। তবে এটা কী? কোনো জলজ প্রাণীর শব্দ? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে কোন প্রাণী এমন কম্পাংকে শব্দ তৈরি করে? নেশায় পেয়ে বসলো তাকে। ৫২ হার্জের শব্দ নিয়ে নেমে পড়লেন গবেষণায়।
বিল ওয়াটকিনসন কর্তৃক রেকর্ডকৃত ৫২ হার্জের শব্দ–
দীর্ঘদিন ওয়াটকিনসন এই শব্দের উৎসের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন। খেয়াল করেন, সে অঞ্চলের নীল তিমি ও ফিন তিমি যে গতিপথ অনুসরণ করে চলে, শব্দের উৎসটিও একই পথেই চলছে। তার মানে, হতে পারে এটি একটি তিমি। কিন্তু নীল তিমি সাধারণত ১০-৪০ হার্জ সীমার মধ্যে শব্দ উৎপাদন করে থাকে। আর ফিন তিমির শব্দের সীমা ২০ হার্জ। কিন্তু এই এর সীমা অনেক উপরে। তিনি আরো বিস্তৃত অঞ্চলের খুঁজে দেখেন, অন্য কোনো উৎস থেকেই ৫২ হার্জের সেই বিশেষ শব্দটি পাওয়া যাচ্ছে না। এত বিশাল অঞ্চলে ৫২ হার্জের শব্দ উৎপাদনকারী উৎস কেবলমাত্র এটিই।
শব্দটি প্রতি বছরের আগস্ট মাস হতে রাডারে ধরা পড়তো, ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি মাসের দিকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পাওয়া যাত, ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে ধীরে ধীরে রাডারের সীমা হতে দূরে চলে যেত। ওয়াটকিনসন গবেষণা চালিয়ে যান। বছরের পর বছর কেবলমাত্র সেই একটি শব্দের উৎসের খোঁজ করতে থাকেন তিনি। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলে তার এই গবেষণা। ২০০৪ সালে তার মৃত্যুর পর তার সহ-গবেষক ম্যারি অ্যান ডাহের ScienceDirect জার্নালে প্রকাশ করেন এ সম্পর্কিত একটি গবেষণাপত্র।
প্রকাশের পর তা আলোড়ন তোলে মেরিন লাইফে। সবাই ধরে নেয় এটি এমন একটি তিমি যে সমুদ্রে একা ভ্রমণ করছে। শব্দ-সীমার ভিন্নতার কারণে তার ডাক শুনতে পারবে এমন কোনো তিমি সমুদ্রে নেই। ফলে এই ব্যাপারটি পরিচিত হয়ে যায় পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম তিমির ডাক হিসেবে। শব্দের কম্পাংক ৫২ হার্জ হওয়ায় কেউ কেউ এটিকে 52-hertz whale হিসেবেও আখ্যায়িত করেন।
যদি ধরে নেওয়া হয়, শব্দের উৎসটি প্রকৃতপক্ষেই তিমির ছিল, তবে বলা যায় সেটি কোনো বিশেষ প্রজাতির তিমি। এ প্রজাতি ঐ অঞ্চলে আর নেই। কারণ কেবলমাত্র একটি উৎস হতেই ৫২ হার্জের শব্দটি আসছিল।
এই বিশেষ শব্দের পেছনে কিছু থিওরি দাঁড় করানো হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্যটি হলো, হয়তো এই তিমিটি নীল তিমি এবং ফিন তিমির সংকর প্রজাতি। ফলে তার জৈবিক গঠন পরিবর্তিত হওয়ায় শব্দের কম্পাংকেও পরিবর্তন এসেছে। কোনো কোনো বিজ্ঞানী তিমির এই একাকীত্বের বিষয়টি নাকচ করেন। তাদের ভাষ্যমতে, তিমিটিকে আমরা যতটা একাকী ভাবছি ততটা নাও হতে পারে। ঐ অঞ্চলের অন্যান্য তিমি ৫২ হার্জের শব্দ উৎপাদন করতে না পারলেও এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই যে তারা ঐ শব্দ শুনবে না। এমনও হতে পারে, অন্যান্য তিমি এই বিশেষ তিমিটির ৫২ হার্জের শব্দ শুনতে পায় এবং যোগাযোগও করতে পারে।
বিল ওয়াটকিনসনের মৃত্যুর পর এই গবেষণা খানিকটা ধীর হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ক্যালিফোর্নিয়ার Scripps Institution of Oceanography-র প্রফেসর জন হিলডেব্র্যান্ড ২০১০ সালে পুনরায় এটি নিয়ে গবেষণা করেন। তার একজন সহকারী শব্দের উৎসটিকে পুনরায় ট্র্যাক করেন। এবার শব্দটি হিলডাব্র্যান্ডের অফিস হতে মাত্র ৫-৬ মাইল দূরের সেন্সর থেকে ধরা পড়ে। যদিও শব্দের কম্পাংক ৫২ হার্জ থেকে খানিকটা কমে ৪৭-৪৮ হার্জ হয়েছিল। তবে তা স্বাভাবিক ছিল। কারণ তিমির বয়স বাড়ার সাথে সাথে শব্দের কম্পাংক কমে আসে। একইসাথে অনেক দূরের আরেকটি সেন্সরেও একই সময়ে এই কম্পাংকের আরেকটি শব্দ ধরা পড়ে। তার মানে এ ধরনের তিমি আরো আছে। এ থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে হয়তো বা নিঃসঙ্গতম তিমি হিসেবে আমরা যেটিকে বলে আসছিলাম, সেটি প্রকৃতপক্ষে নিঃসঙ্গ নয়।
পরবর্তীতে আমেরিকান চলচ্চিত্র নির্মাতা জশ যামেন এবং অভিনেতা আদ্রিয়ান গ্রেনিয়ের সিদ্ধান্ত নেন তিমিটিকে খুঁজে একটি ডকুমেন্টারি বানাবেন। এ উপলক্ষে তারা ফান্ড রেইজ শুরু করেন এবং ২০১৫ সালের অক্টোবরে শুরু করেন নতুন এক যাত্রা। যে যাত্রার মূল উদ্দেশ্য ছিল ৫২ হার্জের তিমিটিকে খুঁজে বের করা এবং বিশ্বের সামনে নিয়ে আসা। এই ডকুমেন্টারি The Loneliest Whale নামে সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে।
যদিও ফিফটি টু তিমিটিকে খুঁজে পাওয়া এখনো সম্ভব হয়নি। তবে এর মধ্য দিয়ে বের হয়ে এসেছে একটি তথ্য যা মেরিন ওয়ার্ল্ডকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সমুদ্রে লঞ্চ, স্টিমার, কার্গো শিপ প্রভৃতি চলাচল বৃদ্ধির কারণে শব্দের জঞ্জাল প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে। ফলে এই বিশাল সমুদ্রে আরো অসংখ্য তিমি প্রকৃতপক্ষে একা হয়ে পড়ছে। তাদের ডাক হারিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য যান্ত্রিক শব্দের দাপটে। ফলে নিজেদের শব্দকে আলাদা করার নিমিত্তে তিমি পরিবর্তন করছে তাদের নিজেদের শব্দের কম্পাংক।
এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি, আসলেই ৫২ হার্জের শব্দটি কোনো তিমি থেকে এসেছে কিনা। যদি আসেও, সমুদ্রে এই প্রজাতির তিমি একটিই কিনা সে প্রশ্নের উত্তরও মেলেনি। কোনো একসময় হয়তো ভেদ হতে পারে ফিফটি টু রহস্য। ততদিন আমাদের কাছে ফিফটি টু নাহয় এক নিঃসঙ্গ তিমির গল্প হিসেবেই থেকে যাক।