ফার্মি প্যারাডক্স – কার্দেশভ স্কেল
ফার্মি প্যারাডক্স – মহাবিশ্বে বুদ্ধিমান প্রাণের সন্ধানে লেখায় আমরা হিসেব করেছি ঠিক এই মুহুর্তে আমাদের মহাবিশে কতগুলো উন্নত সভ্যতা থাকতে পারে। আজকের লেখায় আমরা মহাবিশ্বের বয়সের সময়রেখায় মহাবিশ্বে বুদ্ধিমান সভ্যতার সংখ্যা তাদের সম্ভাব্য লেভেল নিয়ে ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করবো।
মহাবিশ্বের বয়সের হিসেবে আমাদের সূর্য কিন্তু একেবারে নবীন। সে সাথে আমাদের পৃথিবীও। বয়স মাত্র ৪.৫৪ বিলিয়ন বছর। সূর্য থেকে অনেক অনেক বেশি বয়সী নক্ষত্রও আছে। তো সে তারার গ্রহও নিশ্চয়ই অনেক বয়সী। এখন আলোচনার সুবিধার্থে এরকম বুড়ো একটা গ্রহের কথা ধরে নেই যার বয়স ৮ বিলিয়ন বছর। গ্রহটার নাম দিলাম ‘এক্স’।
এখন ধরা যাক পৃথিবীর মতো এক্সের জীবনে ঘটে গেছে একই কাহিনী। পৃথিবীর মতো ১ বিলিয়ন বছর পরে এক্সে উদ্ভব হয়েছে প্রাণের। এবং জন্মের ৪.৪৫ বিলিয়ন বছর পর সেখানেও এসেছে মানুষের মতো উন্নত প্রাণী। এ হিসেবে আমাদের সভ্যতা যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আজ থেকে ৩.৪ বিলিয়ন বছর আগে এক্সের সেই সভ্যতাও প্রযুক্তি, বুদ্ধিমত্তায় একই স্থানে দাঁড়িয়ে। এবার ভাবুন তো এখন থেকে ১০০০ বছর পরে মানব সভ্যতা বুদ্ধিভিত্তিক এবং প্রাযুক্তিক উৎকর্ষতায় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, যেখানে গত ১০০ বছরের উন্নতি আমাদের হতবাক করে। যদি ১ মিলিয়ন বছরের বিবেচনা করি তবে তখনকার সভ্যতার কাছে আমরা এখনকার শিম্পাঞ্জি সমাজের সাথে তুলনীয় হবো। আর এক্সের সেই সভ্যতা এখন আমাদের থেকে ৩.৪ বিলিয়ন বছর এগিয়ে!
কোন স্তরে আছে তাদের বুদ্ধিমত্তা? কোন স্তরে আছে তাদের সভ্যতা? সোভিয়েত জ্যোতির্বিদ নিকোলাই কার্দেশভ ১৯৬৪ সালে এসব উন্নত সভ্যতা বুঝার জন্য এদের ৩টি শ্রেণিতে ভাগ করেন। পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা একে ৫টি শ্রেণিতে উন্নীত করেন। তো এক্সের সভ্যতার বর্তমান অবস্থা বুঝার আগে এই শ্রেণিবিভাগটা একবার দেখা যাক।
আগেই বলে রাখি এই শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে কোন সভ্যতা কতটুকু শক্তি ব্যবহার করতে পারে সেই দক্ষতার উপর। প্রথম শ্রেণির সভ্যতা তার নিজ গ্রহের সব শক্তি নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারবে। সে অনুযায়ি আমরা কিন্তু এখনো বেশ দূরেই আছি। শক্তির জন্য আমাদের এখনো মৃত উদ্ভিদ, প্রাণীর উপর নির্ভর করতে হয়। মৃত উদ্ভিদ, প্রাণী বছরের পর বছর মাটির তলে চাপা পড়ে যে ভষ্মে পরিণত হয় সেই তেল, সেই কয়লা সেই গ্যাস ব্যবহার করে আমরা এখনো চলি। পৃথিবীর আগ্নেয়গিরি, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়কে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যেদিন আমরা সম্পূর্ণ দক্ষভাবে শক্তি আহরণ করতে পারবো সেদিন আমরা প্রথম শ্রেণির সভ্যতায় পরিণত হবো। আর এজন্য এখনকার থেকে ১ লক্ষ গুণ বেশি শক্তি আহরণ করা শিখতে হবে আমাদের।
জনপ্রিয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সাগান হিসেব করে দেখেছেন, আমরা মানুষ এখন ০.৭ প্রথম শ্রেণির সভ্যতা। অন্যদিকে বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী মিচিও কাকুর ধারণা আমরা আগামি ১০০ – ২০০ বছরের মধ্যে প্রথম শ্রেণির সভ্যতায় পরিণত হবো। কী আফসোস, আরেকটু আগে হলে আমরাও নিজেদের প্রথম শ্রেণির বলতে পারতাম। আরে ব্যাপার না, আমরা না পারি তো কী হয়েছে, আমাদের নাতি – নাতনিরা তো পারবে!
এদিকে দ্বিতীয় শ্রেণির সভ্যতা তার সূর্যের সব শক্তি ব্যবহার করতে পারবে। ঠিক কীভাবে এরা এই কাজ করবে ভাবতেই তো মাথার চুল ছিড়ে ফেলার দশা। কীভাবে করবে সে চিন্তায় যাওয়ার আগে এদের ক্ষমতা নিয়ে কিছু বলা যাক। মনে করি মানব সভ্যতা কোনো না কোনো একটা উপায়ে অনেকদিন টিকে থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির সভ্যতায় উন্নীত হয়েছে। আর সে সময়টায় হঠাৎ দেখা গেল চাঁদের মতো বিশালাকৃতির একটি উল্কাপিন্ড এসে আঘাত হানছে পৃথিবীকে। এ পরিমাণ প্রাযুক্তিক উৎকর্ষতা দিয়ে মুহুর্তেই এই উল্কাপিন্ডকে বাষ্পায়িত করে দিতে পারবো আমরা। আর তা না করে এমনও করতে পারি কক্ষপথ থেকেই একটু সরিয়ে নিলাম পৃথিবীকে। কী বলেন? তাও যদি না চান তবে শনি, বৃহস্পতিকে এক আধটু সরিয়ে নিলেন আর কি! ক্ষমতা না হয় বুঝা গেল কিন্তু পুরো নক্ষত্রের শক্তি কীভাবে ব্যবহার করা যায়? আর এর জন্য বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বেশি পছন্দের যে জিনিসটা সেটা হলো ডাইসন স্ফিয়ার। এটা আসলে একটা বিশাল গোলাকার সোলার প্যানেল। দ্বিতীয় শ্রেণির সভ্যতায় পরিণত হওয়ার আগে হয়তো আমরা এরকম কিছু একটা বানাবো। এই সোলার প্যানেলের গোলকটা বানানো হবে সূর্য, বুধ, শুক্র, পৃথিবী এবং মঙ্গলকে এর ভেতরে রেখে।
সূর্যের বিকিরিত সকল শক্তি এ গোলকে শোষিত হয়ে প্রক্রিয়াজাত হয়ে শুধু ব্যয় হবে পৃথিবীর জন্য। কিছু শক্তি অবশ্য এই ডাইসন স্ফিয়ার বিকিরণও করবে। তবে সেটা আমরা খালি চোখে দেখবো না। কারণ সে বিকিরণ হবে অনেকটা অবলোহিত তরঙ্গের মতো।
আর এজন্য আমাদের আশেপাশে কোনো দ্বিতীয় শ্রেণির সভ্যতা থাকলে আমরা তাদের দৃশ্যমান আলোতে দেখবো না। এজন্য অবলোহিত তরঙ্গ ধরতে পারে এমন দূরবীন ব্যবহার করতে হবে।
এবার তৃতীয় শ্রেণির সভ্যতার কথা শুনুন। এরা শুধু নিজের সূর্যই নয় বরং পুরো ছায়াপথের সব শক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা রাখে। ছায়াপথ জুড়েই এরা উপনিবেশ স্থাপন করবে। শক্তির বিচারে এরা দ্বিতীয় শ্রেণির সভ্যতা থেকে ১০ বিলিয়ন গুণ বেশি শক্তি আহরণ করতে পারবে।
ধারণা করা হয় চতুর্থ শ্রেণির সভ্যতা পুরো মহাবিশ্বের সব শক্তিই ব্যবহারে সক্ষম হবে। স্থান-কালকে এরা নিজেদের ইচ্ছামতো পরিবর্তন করতে পারবে। এমনকি কৃষ্ণবিবরের ঘটনা দিগন্তের ভেতরও হতে পারে এদের বসবাস।
সবশেষে পঞ্চম শ্রেণির সভ্যতা শুধু এই মহাবিশ্ব নয়, সকল মহাবিশ্বের সকল শক্তিই ব্যবহার করতে পারবে। অকল্পনীয় ক্ষমতার অধিকারী এই সভ্যতা হবে অনেকটা ঈশ্বরের মতো। আমাদের মহাবিশ্বের পদার্থবিজ্ঞানের যে কোনো সূত্রের ব্যাঘাত ঘটিয়ে অন্য কিছু করে ফেলতে সক্ষম হবে এই পঞ্চম শ্রেণির সভ্যতা!
না, থাক আমরা আর না আগাই। ফিরে যাই ৮ বিলিয়ন বছর বয়সী এক্সের কাছে। এখানকার সভ্যতা আমাদের বর্তমান সভ্যতা থেকে ৩.৪ বিলিয়ন বছর অগ্রগামী। এই সভ্যতা যদি কোনো উপায়ে নিজেদের তৃতীয় শ্রেণির সভ্যতা পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারে তবে এতদিনে পুরো আকাশগঙ্গা ছায়াপথই তাদের করতলে থাকার কথা। মজার ব্যাপার হলো প্রযুক্তির খুব বেশি উন্নতি না ঘটিয়েও কিন্তু আকাশগঙ্গার মতো একটা ছায়াপথের সব গ্রহে উপনিবেশ স্থাপন করতে খুব বেশি সময় লাগার কথা না। চলুন একটা ছোট হিসেব কষে বের করে ফেলা যাক।
ধরি মঙ্গলের মতো একটা গ্রহে আমাদের উপনিবেশ স্থাপন করতে আরো ২০০ বছর লাগবে। সেখানে গিয়ে আরো ৩০০ বছরের মধ্যে মঙ্গলের কাঁচামাল ব্যবহার করে আমরা বৃহস্পতি আর শনির দিকে পা বাড়ালাম এরকম আরো দুটো মহাকাশযান বানিয়ে। যে মহাকাশযান হবে আন্তঃগ্রহ পরিভ্রমণে সক্ষম। সেখানে হয়তো প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষ একটা নভোযানে থাকতে পারবে। তো প্রতি ৫০০ বছরে যদি এভাবে কোনো একটি গ্রহ থেকে অন্য দুই গ্রহের দিকে নভোযান পাঠানো যায় তবে পুরো ছায়াপথ আমাদের অধিকারে আনতে সময় লাগবে মাত্র ৩.৭৫ মিলিয়ন বছর।
আর মহাবিশ্বের বিলিয়ন বছরের টাইম স্কেলে ৩.৭৫ মিলিয়ন বছর কিন্তু কিছুই নয়। আর এর মধ্যে যদি আমাদের হিসেবকৃত ১ লক্ষ বুদ্ধিমান সভ্যতার ১% ও কোনোভাবে তৃতীয় শ্রেণির সভ্যতায় পরিণত হতে পারে, তবে আমাদের আকাশগঙ্গাতেই পুরো ছায়াপথ উপনিবেশ স্থাপন করতে পারে এমন সভ্যতার সংখ্যা হবে ১০০০। এত এত মাতব্বর একসাথে একই জায়গায় আছে অথচ কেউ আমাদের দেখতেও আসবে না, আমরাও তাদের উপস্থতি একবারের জন্যও টের পাবো না, তা কি হয়? তাহলে ওরা কোথায়?