- কর্মক্ষেত্রে সারাদিন ভালো সময় কাটালেন। কিন্তু এক সহকর্মী মাত্র কয়েক সেকেন্ড আপনাকে নিয়ে বাজে কিছু একটা বলল, যার কারণে মনে করলেন পুরো দিনটাই বাজে গেল। সারাদিনের ভালোভাবে কাটানো সময়গুলোর চেয়ে ওই কয়েক সেকেন্ডের কথাই বেশি মনে রাখলেন।
- কারো নামে ইতিবাচক কোনো কথা শুনলে সেটা অনেক সময় বিশ্বাস না করলেও তার নামে নেতিবাচক কথা শুনলে সেটা বিশ্বাস করতে সময় লাগে না।
- ৫০০ টাকা আয় করে যতটা খুশি হবেন, ৫০০ টাকা হারিয়ে ফেললে তার চেয়ে বেশি দুঃখ পান।
- অফিস থেকে পারফরম্যান্স রিভিউ পেয়েছেন, যেখানে আপনাকে নিয়ে প্রায় ৭০ শতাংশ কথাই ইতিবাচক। বাকি অংশে কিছু দুর্বলতা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেখানে আপনার উন্নতি করা উচিত। আপনি ইতিবাচক দিকগুলো বাদ দিয়ে সেই দুর্বলতার দিকগুলো নিয়ে ভেবেই মন খারাপ করলেন।
- আপনার জীবনসঙ্গীর সাথে ঝগড়া হলো। তখন থেকে আপনি শুধু তার দোষগুলো নিয়েই ভাবতে থাকলেন। তার সাথে কাটানো আনন্দের সময়গুলো আপনার খুব একটা মনে আসে না।
- বন্ধুদের সামনে কয়েক বছর আগে অপমানজনক কিছু একটা করেছিলেন, যার কারণে তারা আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছিল। সেটা নিয়ে আপনি এখনো লজ্জা পান। অথচ তারা হয়তো সেটার কথা ভুলেই গিয়েছে।
- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দারুণ একটা বিষয় শেয়ার করলেন, সেটা নিয়ে সবাই খুব প্রশংসা করল কিংবা ইতিবাচক মন্তব্য করল। কিন্তু একজন গালি দিয়ে গেল। আপনি ইতিবাচক মন্তব্যগুলোর চেয়ে গালিটাকেই বেশি প্রাধান্য দিলেন।
উদাহরণগুলো দেখলে একটা সাধারণ বিষয় পরিলক্ষিত হবে। ইতিবাচক বিষয়ের চেয়ে নেতিবাচক বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া। সবার মাঝেই কমবেশ এ বিষয়টা আছে। আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া ইতিবাচক ঘটনাগুলোর চেয়ে নেতিবাচক ঘটনাগুলোকে বেশি মনে রাখি। এই ব্যাপারটাকে বলা হয় ‘নেগেটিভিটি বায়াস’ বা ইতিবাচকতা-নেতিবাচকতার অসমতা। নেগেটিভিটি বায়াসের কারণে আমরা শুধু নেতিবাচক বিষয়গুলোকে বেশি প্রাধান্যই দিই না, নেতিবাচকতার মধ্যেই বাস করা শুরু করি।
নেগেটিভিটি বায়াসের কারণে আমরা জীবনে ঘটে যাওয়া সুন্দর ঘটনাগুলোর চেয়ে ভয়াবহ ঘটনাগুলো বেশি মনে রাখি। প্রশংসার চেয়ে তিরস্কারগুলো বেশি মনে রাখি। এ কারণে কর্মক্ষেত্রে বা চাকরির পরীক্ষায় প্রথম দর্শনে আমাদের নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব রাখলে সেটা পরিবর্তন করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। একইরকম ইতিবাচক ঘটনার চেয়ে নেতিবাচক ঘটনাগুলোতে আমরা বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাই।
নেগেটিভিটি বায়াস বেশি দেখা যায় সংবাদপত্রের খবরের ক্ষেত্রে। টিভি কিংবা পত্রিকায় সাংবাদিকরা দেখা যায় নেতিবাচক খবর নিয়ে বেশি সরব থাকে। তারা কি তবে সবসময় রাগান্বিত মনোভাব নিয়ে থাকে? কিংবা আমাদের আশেপাশে ইতিবাচক ঘটনার চেয়ে নেতিবাচক ঘটনাই কি বেশি ঘটে?
আসলে সেরকম কিছু নয়। একাধিকবার গবেষণায় দেখা গেছে ইতিবাচক খবরের চেয়ে আমরা নেতিবাচক খবরের প্রতি বেশি আকর্ষিত হই। অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ পুরষ্কার জেতার খবরের চেয়ে নায়িকার ডিভোর্সের খবরে বেশি ক্লিক যায়। ‘হাসি’, ‘আনন্দ’, ‘বাচ্চা’ এসব শব্দের চেয়ে ‘যুদ্ধ’, ‘ক্যানসার’, ‘বোমা’ এসব শব্দ আমাদের বেশি উত্তেজিত করে। সাংবাদিকরা যখন দেখে আমরা তাদের ইতিবাচক খবরগুলো খুব একটা গুরুত্ব দেই না, তখন তারা অপ্রয়োজনীয়ভাবে হলেও নেতিবাচক খবরগুলো বেশি প্রচার করে। আর যেহেতু নেতিবাচক খবর দ্রুত ছড়ায়, খবরের কাটতিও তখন ভালো হয়।
নেগেটিভিটি বায়াস থাকার কারণ
নেতিবাচক প্রবণতা সেই আদিমযুগ থেকেই চলে আসছে। আমাদের পূর্বপুরুষরা যখন শিকারে বের হতো, তাদের সবসময় নিজের জীবন রক্ষার ব্যাপারে সজাগ থাকতে হতো। সম্ভাব্য আক্রমণ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হতো। তখন নেতিবাচক দিক নিয়ে চিন্তা করা ছিল জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন। যারা বিপজ্জনক কাজ বেশি করত ও সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে সচেতন থাকত, তারাই টিকে থাকত। তাদের জিনগুলোই পরবর্তীতে আমাদের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে।
এ কারণেই আমরা সুন্দর নীল আকাশের নিচে সবুজ মাঠের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ যদি মানুষের তাজা রক্ত পড়ে থাকতে দেখি, তখন আমাদের মনোযোগ নীল আকাশ আর সবুজ মাঠের চেয়ে রক্তের দিকেই বেশি কেন্দ্রীভূত হবে। কারণ আমরা তখন নিজেদের সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে চিন্তা করব এবং টিকে থাকার চেষ্টা করব।
এছাড়া বায়াস থাকার সম্ভাব্য ফলাফলও একটা প্রভাব রাখে। আমরা একটা ইতিবাচক খবর অগ্রাহ্য করলে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু নেতিবাচক খবর অগ্রাহ্য করলে সেটা আমাদের জীবন-মরণ প্রশ্ন হয়ে উঠতে পারে। যেমন একটা কুকুর কোনো মানুষের জীবন বাঁচানোর খবরে আমরা মনোযোগ না দিলে হয়তো তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু একটা ঘুর্ণিঝড়ের সতর্কবার্তা গুরুত্ব না দিলে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নেগেটিভিটি বায়াস দুধের শিশু থাকা অবস্থা থেকেই শুরু হয়। একেবারে শুরুর দিকে শিশুরা ইতিবাচক মুখভঙ্গি ও কণ্ঠের প্রতি বেশি মনোযোগ দেখায়। কিন্তু এক বছর বয়স হওয়ার দিকে যত এগিয়ে যেতে থাকে, তত তাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু পরিবর্তন হতে থাকে। শিশুদের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করে দেখা যায় ছয় মাস বয়সের পর থেকে তাদের মস্তিষ্ক নেতিবাচক বিষয়ের প্রতি বেশি মনোযোগী হয়। কোনো কোনো শিশুর ক্ষেত্রে দেখা যায় অন্যদের সাথে সামাজিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নেগেটিভিটি বায়াস তিন মাস বয়স থেকেই শুরু হয়।
নেগেটিভিটি বায়াসের প্রভাব
নেগেটিভিটি বায়াসের কারণে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে বিরাট প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে যাদের সাথে আমাদের অনেকদিন ধরে পরিচয় আছে তাদের সাথে। সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক মন্তব্যগুলোর প্রভাব থাকে বেশি। তাই আগে থেকেই নির্দিষ্ট করে রাখা প্রয়োজন অপর সঙ্গী কোন বিষয়গুলোতে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয় এবং সে অনুযায়ী সতর্ক থাকতে হয়।
নেগেটিভিটি বায়াস আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণেও প্রভাব রাখে, বিশেষ করে সেটা যদি হয় অর্থ সম্পর্কিত। অর্থ সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে আমরা একই অঙ্কের যে পরিমাণ অর্থ আয় করতে পারার সম্ভাবনা দেখি, তার চেয়ে বেশি প্রভাবিত হই একই অঙ্কের অর্থ হারানোর সম্ভাবনা দেখলে। আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পাওয়ার চেয়ে হারানোর মাত্রা প্রভাব রাখে বেশি।
কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে আমাদের মনোভাবেও নেগেটিভিটি বায়াস প্রভাব রাখে। একই ব্যক্তি সম্পর্কে আমরা ইতিবাচক ও নেতিবাচক খবর শুনলে নেতিবাচক বিষয়টাই আমরা মনে রাখি। তাকে ওই নেতিবাচক বিষয়গুলোর আলোকেই মূল্যায়ন করি।
নেগেটিভিটি বায়াস থেকে মুক্তির উপায়
নেগেটিভিটি বায়াস থেকে মুক্তি পাওয়া কি খুবই জরুরি? এটা কি বাস্তবসম্মত? অবশ্যই না। বিশেষ করে আমাদের কোনো কিছু অর্জন করতে গেলে সেটা পেলে আমরা যে পরিমাণ উপকার পাবো, তার চেয়ে না পেলে যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হবো, সেটা আমাদের বেশি অনুপ্রাণিত করে। যেমন- পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে সেটা আমাদের পরবর্তীতে যতটা সাহায্য করবে, সেটা ভাবার চেয়ে ফেল করলে কী পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হবো সেটা চিন্তা করলে পরীক্ষায় ভালো ফল করার সম্ভাবনা বেশি। তাছাড়া সমাজের অন্যায়ের দেখলে প্রতিবাদ কিংবা কোনো বিপদের পূর্বাভাস নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও নেগেটিভিটি বায়াস কাজে দেয়। তবে এ বায়াস যদি অতিরিক্ত হয়ে যায়, আমাদের মানসিক দিক দিয়ে খুব আতঙ্কিত করে তুলে। সেক্ষেত্রে এ বায়াসগুলো কিছুটা কমিয়ে আনার জন্য কাজ করা যেতে পারে।
নেগেটিভিটি বায়াস দূর করার জন্য নিজের সাথে নেতিবাচক কথা বলা কমিয়ে আনতে হবে। কারণ আমরা প্রায়ই “এটা আমার করা উচিত হয়নি”, “এ কথাটা না বললেও পারতাম” এসব চিন্তা করি। অতীত কখনো পরিবর্তন যায় না। তাই আমাদের উচিত এমন চিন্তার উদয় হলেই সাথে সাথে সেটা নিয়ে ভাবা বন্ধ করা।
কোনো একটা ঘটনা ঘটলে সেটার নেতিবাচকতার চেয়ে ইতিবাচক দিকগুলো গুরুত্ব দেওয়া। যেমন- আপনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনার সৃজনশীলতার কোনো একটা দিক সবার সাথে শেয়ার করলেন। সেখানে বেশিরভাগ মন্তব্য ইতিবাচক, কিন্তু দুই-একটা মন্তব্য নেতিবাচক। এসব ক্ষেত্রে নেতিবাচক মন্তব্যগুলোর চেয়ে ইতিবাচক মন্তব্যগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়াই ভালো।
যখনই নেতিবাচক কোনো ঘটনার কথা মনে পড়ে, সেটার মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নিতে ভিন্ন কিছু করা যেতে পারে। সেটা হতে পারে ভালো একটা বই পড়া, ব্যায়াম করা, ভালো গান শোনা ইত্যাদি। অর্থাৎ, নিজেকে সবসময় ব্যস্ত রাখা। নতুন কোনো অভ্যাস তৈরি করাও ভালো ফল এনে দিতে পারে।
যখন ইতিবাচক কোনো ঘটনা ঘটে সেগুলো নিয়ে বেশি ভাবা যেতে পারে। ইতিবাচক স্মৃতিগুলো দীর্ঘমেয়াদে মনে রাখলে আমরা নেগেটিভিটি বায়াস থেকে অনেকটাই দূরে থাকতে পারব।