একটি জাতি শিক্ষা দীক্ষায় কী পরিমাণ অগ্রগতি লাভ করেছে তার উপর নির্ভর করে বলে দেয়া যায় জাতিটি কতটা উন্নত। এই কথাটিকে এভাবেও বলা যায়, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিতে যারা অগ্রগামী তারা তত উন্নত। এই কথাটিকে শক্তি ব্যবহারের পরিমাণ দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায়। একটি জাতি বা সভ্যতা কত পরিমাণ শক্তি ব্যবহার করছে এবং কত পরিমাণ শক্তি আহরণ করতে পারছে তা দিয়ে বলা যায় সভ্যতাটি কত উন্নত।
পৃথিবীর অভ্যন্তরে থাকা ছোট ছোট জাতিগুলোকে একে অপরের সাথে তুলনা করার জন্য হয়তো শিক্ষা দীক্ষা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তিই সবচেয়ে উপযুক্ত মাপকাঠি। কিন্তু ভিনগ্রহে থাকা বুদ্ধিমান সভ্যতাকেও যদি বিবেচনায় আনা হয় তাহলে এর হিসাব কীভাবে করতে হবে? পৃথিবীর গণ্ডি পেরিয়ে মহাজাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যখন কোনো সভ্যতাকে বিবেচনা করা হবে তখন সবচেয়ে উপযুক্ত মাপকাঠি হচ্ছে শক্তি ব্যবহারের পরিমাণ। যে গ্রহের বাসিন্দারা যত বেশি শক্তি ব্যবহার করে তারা তত উন্নত। যে নক্ষত্র পরিবারে যত বেশি শক্তি ব্যবহার করা হয় সে নক্ষত্র তত বেশি উন্নত। যে গ্যালাক্সিতে যত বেশি শক্তি ব্যবহার করা হয় সে গ্যালাক্সি তত বেশি উন্নত। আর অধিক শক্তি অর্জন করতে হলে শিক্ষা দীক্ষা, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিতে অধিক পরিমাণ উন্নতি অর্জন করতে হবে। সেই হিসেবে কোনো মহাজাগতিক সভ্যতাকে শক্তি ব্যবহারের পরিমাণ দিয়ে যাচাই করা হলেও আদতে এখানে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি দিয়েই যাচাই করা হচ্ছে। শক্তি ব্যবহারের বিষয়টি শিক্ষা, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিকে একসাথে পেচিয়ে নিয়েছে।
১৯৬৪ সালে নিকোলাই কার্দাশেভ নামে একজন রাশিয়ান জ্যোতির্বিদ মহাজাগতিক উন্নত সভ্যতাকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করেন। কর্মসূত্রে তিনি ভিন গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণী অনুসন্ধানের কাজে যুক্ত ছিলেন। মহাজাগতিক বুদ্ধিমান প্রাণী অনুসন্ধান করার সময় তিনি এই শ্রেণীবিভাগটি প্রণয়ন করেন। এই শ্রেণীবিন্যাস অনুসারে মহাজাগতিক সভ্যতা তিন ধরনের- টাইপ ওয়ান, টাইপ টু এবং টাইপ থ্রি সভ্যতা। তার প্রস্তাবিত শ্রেণীবিন্যাসকে তার নাম অনুসারে ‘কার্দাশেভ স্কেল’ নামে ডাকা হয়। পরবর্তীতে অন্যান্য বিজ্ঞানীরা এই শ্রেণীবিভাগে কিছু পরিবর্তন এনে আরো দুটি ‘টাইপ’ যুক্ত করে মোট পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করেন।
টাইপ ওয়ান বা প্রথম শ্রেণীর সভ্যতা হচ্ছে সে সকল সভ্যতা যারা তাদের গ্রহে আপতিত সকল শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করতে পারবে। যেমন সূর্য থেকে প্রতিনিয়ত প্রচুর পরিমাণ শক্তি আপতিত হচ্ছে পৃথিবীতে, কিন্তু মানবসভ্যতা এই আপতিত শক্তির খুব অল্প পরিমাণই ব্যবহার করতে পারছে। পৃথিবী যদি কোনোদিন তার পৃষ্ঠে আপতিত সকল শক্তি সংগ্রহ করতে পারে তাহলে তারা প্রথম শ্রেণীর সভ্যতায় উন্নীত হবে। একই কথা অন্যান্য গ্রহে বসবাসকারী প্রাণীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
শুধু শক্তি সংগ্রহ ও ব্যবহার করাই শেষ নয়। যারা প্রথম শ্রেণীর সভ্যতায় উন্নীত হবে তারা তাদের গ্রহটিকে নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। যেমন ভূমিকম্প, সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, আগ্নেয়গিরি ইত্যাদি থেকে সৃষ্ট দুর্যোগ মানুষ এখনো প্রতিহত করতে পারে না। প্রথম শ্রেণীর সভ্যতায় উন্নীত হতে পারলে মানুষ এমন ক্ষমতার অধিকারী হবে যা দিয়ে এধরনের অতীব শক্তিশালী দুর্যোগকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। ইচ্ছে করলেই ঘূর্ণিঝড়কে থামিয়ে দিতে পারবে, ইচ্ছে করলেই ভূমিকম্পকে দমিয়ে দিতে পারবে।
আমাদের বর্তমান প্রজন্মের জন্য এটা দুঃখজনক যে আমাদের পৃথিবী অন্তত প্রথম শ্রেণীর সভ্যতাতেও উন্নীত হতে পারেনি। মানুষ এখনো অনেকাংশে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মৃত প্রাণীর উপরই নির্ভরশীল। হাজার হাজার বছর আগে প্রাণী ও উদ্ভিদ মরে গিয়ে ধীরে ধীরে যে জীবাশ্ম জ্বালানী তৈরি করেছে তার উপর ভর করেই দাঁড়িয়ে আছে মানুষের বর্তমান সভ্যতা। তেল, গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি সবই সেই হাজার হাজার বছর আগের মৃত প্রাণী ও উদ্ভিদের পচে যাওয়া দেহাবশেষ থেকে আসে।
তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে মানুষ এই মজুত থাকা শক্তিকেও শতভাগ উত্তোলন করতে পারছে না। প্রথম শ্রেণীর সভ্যতার আরো একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নক্ষত্র থেকে আপতিত শক্তির পাশাপাশি তাদের গ্রহে বিদ্যমান সকল শক্তিকেও উত্তোলন ও ব্যবহার করতে পারবে। এই তালিকার মাঝে আছে বায়ু শক্তি, পৃথিবী অভ্যন্তরের তাপ শক্তি, পানির শক্তি, সঞ্চিত শক্তি ইত্যাদি।
উইন্ড মিল বা অন্য কোনো প্রক্রিয়া ব্যবহার করে বায়ুর প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে শক্তি উৎপাদনের ধারণা বেশ প্রচলিত জিনিস। পৃথিবীর অভ্যন্তরে যে শক্তি আছে সেগুলোকে ব্যবহার করার ধারণা এখনো প্রচলিত নয়। পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগটা উত্তপ্ত তরলের মতো টগবগে অবস্থায় আছে। উত্তাপের চোটে লোহার মতো কঠিন পদার্থও সেখানে গলিত অবস্থায় থাকে। এই বিপুল পরিমাণ তাপশক্তিকে ব্যবহার করা সম্ভব। পৃথিবীর কিছু এলাকায় ভূতাপীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র বা জিওথার্মাল পাওয়ার প্লান্ট নামে এই শক্তি ব্যবহারের প্রক্রিয়া শুরুও হয়েছে। কিন্তু তা এখনো প্রাথমিক অবস্থায় আছে।
নদীর মাঝে বাধ দিয়ে পানির স্রোতকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা অনেক প্রচলিত। নদীর পানি প্রবাহকে ব্যবহার করে যেমন বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করা যায় তেমনই সমুদ্রের স্রোতকে ব্যবহার করেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। পুরো পৃথিবীর চার ভাগের তিনভাগই দখল করে আছে সমুদ্র। অনেক দেশে জোয়ার ভাটাকে ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করাও হচ্ছে। কিন্তু এই দিকটিও প্রাথমিক অবস্থাতেই আছে।
আর পেট্রোলিয়াম তথা তেল, গ্যাস, কয়লা তো আছেই। মানব সভ্যতা এই সঞ্চিত শক্তিকেই ব্যবহার করছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু মানব সভ্যতা এই ধাপেও পিছিয়ে আছে। এখানেও সম্পূর্ণরূপে তাদেরকে ব্যবহার করতে পারছে না। তবে মানব সভ্যতা আটকে নেই। কোনোপ্রকার অবনতিও নেই। ক্রমান্বয়ে উন্নতি হচ্ছে। উন্নয়নের এই ক্রম ঠিক থাকলে একদিন না একদিন মানুষ প্রথম শ্রেণীর সভ্যতায় আরোহণ করতে পারবে।
বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান দার্শনিক কার্ল সেগান হিসাব করে দেখিয়েছেন মানুষ বর্তমানে ০.৭ শ্রেণীর সভ্যতায় আছে। মানে প্রথম শ্রেণীর সভ্যতার খুব কাছাকাছি। আরের জনপ্রিয় পদার্থবিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান বক্তা মিচিও কাকুর ধারণা আগামী একশো থেকে দুইশো বছরের মাঝে পৃথিবী প্রথম শ্রেণীর সভ্যতায় উন্নীত হবে। ততদিনে মনে হয় না বর্তমান প্রজন্মের কেউ আর বেঁচে থাকবে।
টাইপ টু বা দ্বিতীয় শ্রেণীর সভ্যতার প্রাণীরা তাদের নক্ষত্রের সকল শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করতে পারবে। সূর্য থেকে উপরে-নীচে চারদিকে বিরামহীন তাপ ও আলোক শক্তি বিকিরিত হচ্ছে। এর অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটা অংশ এসে পড়ছে পৃথিবীতে। অত্যন্ত ক্ষুদ্র অংশটিই মানুষ ব্যবহার করে শেষ করতে পারছে না। সমস্ত শক্তি ব্যবহার করার সামর্থ্য হলে মানুষের ক্ষমতা যে কী পরিমাণ বাড়বে তা ভাবতে গেলেও মনের জোর লাগে।
ঠিক কীভাবে একটি নক্ষত্রের সকল শক্তি আহরণ করা যাবে তা এখনো ধোঁয়াশার মাঝে আছে। প্রস্তাবিত বেশ কয়েকটি ধারণার মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয়টি হচ্ছে পুরো নক্ষত্রের চারদিক ঘিরে একটি বৃহৎ গোলক তৈরি করা হবে। এই গোলকের মাধ্যমে নক্ষত্রের প্রায় সকল শক্তি সংগ্রহ করা হবে এবং ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করে গ্রহে স্থানান্তর করা হবে। এ ধরনের গোলক পৃথিবীর আকৃতির তুলনায় ৬০০ মিলিয়ন গুণ বড় হবে। জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রিমান ডাইসন এধরনের গোলকের ধারণা প্রদান করেছিলেন। তার নামানুসারে একে ডাইসন গোলক (Dyson Sphere) বলা হয়। মানব সভ্যতা যদি কোনোদিন সূর্যের চারদিকে ডাইসন গোলক স্থাপন করার সমর্থ অর্জন করে তাহলে তারা অকল্পনীয় ক্ষমতার অধিকারী হবে।
কোনো জাতি দ্বিতীয় শ্রেণীর সভ্যতায় উন্নীত হলে তারা অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারবে। যেমন ধরা যাক মানুষ প্রথম শ্রেণী পেরিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত হয়েছে। এমন অবস্থায় চাঁদের সমান কোনো গ্রহাণু বা কোনো মহাজাগতিক বস্তুর সাথে যদি পৃথিবীর হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তাহলে মানুষ চাইলে উপগ্রহের সমান ঐ বস্তুটিকে দূর থেকেই গলিয়ে বাষ্প করে দিতে পারবে। কিংবা হাতে যদি যথেষ্ট পরিমাণ সময় থাকে তাহলে পুরো পৃথিবীটিকেই তার কক্ষপথ থেকে অনেকখানি দূরে সরিয়ে দিতে পারবে। তাহলে মহাজাগতিক ঐ বস্তুর গতিপথে পৃথিবী থাকবে না ফলে সংঘর্ষও হবে না। অনেকটা গ্রহ নক্ষত্রের মহাজাগতিক লুকোচুরি খেলার মতো।
এই দুটি ছাড়া অন্য কোনো পন্থা কি নেই মানুষের জন্য? যদি ধরে নেয়া হয় পৃথিবীর সাথে মহাজাগতিক বস্তুর সংঘর্ষ হয়েই গেল তারপরেও মানুষ পৃথিবীর সকল প্রাণী স্থানান্তর করে নিয়ে যেতে পারবে মঙ্গল বা বৃহস্পতিতে।
উল্লেখ্য, মহাজাগতিক বস্তুর এধরনের সংঘর্ষের ফলে পুরো পৃথিবীর মানবসভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। ২৩১ থেকে ২৪৩ মিলিয়ন বছর আগে ডায়নোসরদের একটা রাজত্ব ছিল পৃথিবীতে। জলে, স্থলে ও আকাশে ডায়নোসরদের অনেক প্রজাতি বসবাস করতো। ধারণা করা হয়, পৃথিবীর সাথে এক উল্কাপিণ্ডের সংঘর্ষের ফলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে ডায়নোসরদের সকল প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
কোনো মহাজাগতিক সভ্যতা দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত হলে তারা তাদের নক্ষত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। নক্ষত্রের শক্তি উৎপাদিত হয় তার অভ্যন্তরে সংঘটিত নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে। যদি নক্ষত্রের ফিউশন বিক্রিয়ার প্রক্রিয়ায় কোনো ত্রুটি দেখা দেয় তাহলে তারা সেটিকে মেরামত করে দিতে পারবে। নক্ষত্র থেকে যদি তাদের চাহিদার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ শক্তি না পায় তাহলে সেখানে কল্পনাকে শ্লথ করে দেয় এমন অতি-শক্তিশালী রিঅ্যাকটর স্থাপন করে তাদের প্রয়োজন পুষিয়ে নিতে পারবে। কিংবা নক্ষত্রকে আরো কার্যকরী ও আরো ক্ষমতাবান করতে আশেপাশের কোনো গ্যাস জায়ান্টকে নিয়ে এসে কাজে লাগাতে পারে।
নক্ষত্রের শক্তির প্রধান কাঁচামাল হাইড্রোজেন। গ্যাস জায়ান্ট প্রচুর হাইড্রোজেনের সমন্বয়ে গঠিত হয়। নক্ষত্রে যদি হাইড্রোজেনের অভাব দেখা দেয় তাহলে গ্যাস জায়ান্টের মাধ্যমে সেই অভাব পূরণ করতে পারবে দ্বিতীয় শ্রেণীর সভ্যতা। যেমন আমাদের সৌরজগতের বৃহস্পতি গ্রহ একটি গ্যাস জায়ান্ট। ভবিষ্যতে প্রয়োজন পড়লে বৃহস্পতিকে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
২০১৬ সালে ট্যাবির নক্ষত্র নামে একটি নক্ষত্র নিয়ে সারা বিশ্বে বেশ তোলপাড় হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা এমন একটি নক্ষত্রের খোঁজ পেয়েছেন যার চারপাশে রহস্যময় কিছু স্থাপনা আছে। কেউ কেউ ধার করছেন এই স্থাপনা আসলে ডাইসন গোলকের মতো কোনো কিছু। তবে এখনো প্রতিষ্ঠিত সত্য নয়।
ডাইসন গোলক অন্য একটি দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কোথাও যদি ডাইসন গোলক সদৃশ কোনো স্থাপনার দেখা পাওয়া যায় তাহলে ধরে নিতে হবে সেখানে নিশ্চিত এলিয়েনের অস্তিত্ব আছে। এখানে আরেকটা প্রশ্নও দেখা দেয়। ডাইসন গোলকের মাধ্যমে পুরো নক্ষত্রকে যদি ঢেকে ফেলা হয় তাহলে কীভাবে তাদের দেখা পাওয়া যাবে? পুরো নক্ষত্র ঘিরে ফেললেও অবলোহিত তরঙ্গ আকারে কিছু বিকিরণ ঠিকই বের হয়ে আসবে গোলক ভেদ করে। সেজন্য এধরনের স্থাপনা খুঁজে পেতে হলে অবলোহিত তরঙ্গ শনাক্ত করতে পারে এমন টেলিস্কোপ ব্যবহার করতে হবে।
টাইপ থ্রি বা তৃতীয় শ্রেণীর সভ্যতার কাছে দ্বিতীয় শ্রেণীর সভ্যতা একেবারেই নস্যি। এই পর্যায়ের সভ্যতা শুধু নিজেদের নক্ষত্রই নয়, তাদের পুরো গ্যালাক্সির শক্তিই ব্যবহার করতে সক্ষম। গ্যালাক্সি জুড়ে সকল নক্ষত্রে তারা উপনিবেশ গড়ে নেবে এবং একটি শক্তিশালী নাক্ষত্রিক নেটওয়ার্ক তৈরি করবে। অনেকটা আজকের ক্লাউড কম্পিউটিং সিস্টেমের মতো। অনেকগুলো ছোট ছোট কম্পিউটার একত্রে যুক্ত হয়ে একটি বৃহৎ ও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করে।
তৃতীয় শ্রেণীর সভ্যতায় উন্নীত প্রাণীরা স্বাধীন ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে চলাচল করতে পারবে। কোনো প্রাণীর পক্ষে এক নক্ষত্র থেকে আরেক নক্ষত্রে ভ্রমণ করা অনেক চ্যালেঞ্জিং। ঠিক কীভাবে তারা এই ক্ষমতা অর্জন করবে তা বলা বেশ কষ্টকর। ধারণা করা হয় সেই সভ্যতার প্রাণীরা হবে সাইবর্গ ধাঁচের। প্রাণ ও যান্ত্রিকতার মিশেলে তারা এমন ক্ষমতার অধিকারী হবে যে, যেকোনো পরিস্থিতিতে তারা খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। কিংবা যেকোনো ধরনের জটিল কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করতে পারবে। হাজার হাজার বছরের শারীরিক ও যান্ত্রিক বিবর্তনে তারা এই ক্ষমতা অর্জন করবে।
পুরো গ্যালাক্সিতে ছড়িয়ে দেবার জন্য তারা বিশেষক ধরনের রোবট বাহিনী তৈরি করতে সক্ষম হবে। এই রোবট বাহিনী নিজেরা নিজেরাই নিজেদের আদলে নতুন নতুন রোবট তৈরি করতে পারবে। নব-নির্মিত রোবটগুলোকে ছড়িয়ে দেয়া হবে দূর দূরান্তের নক্ষত্রে। এভাবে নক্ষত্রের পর নক্ষত্র চলে আসবে তৃতীয় শ্রেণীর সভ্যতার প্রাণীদের হাতে।
শক্তির পরিমাণের দিক থেকে তুলনা করলে এরা দ্বিতীয় শ্রেণীর সভ্যতার চেয়ে ১০ বিলিয়ন গুণ বেশি শক্তি আহরণ করতে পারবে। এমনকি বিশেষ প্রক্রিয়ায় এরা ব্ল্যাকহোল থেকেও শক্তি বের করে নিয়ে আসার ক্ষমতা রাখে। এখানেই শেষ নয়, উপযুক্ত স্থানে শক্তির জন্য আস্ত একটি নক্ষত্র তৈরি করে ফেলার ক্ষমতাও তারা রাখে।
তবে এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হতে হলে পদার্থবিজ্ঞানের দিক থেকে আপাত অসম্ভব কিছু বিষয়কে সম্ভব করতে হবে। যেমন প্রায় আলোর গততে ভ্রমণ করা, কার্যকর ওয়ার্প ড্রাইভ তৈরি করা, ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে সফল টেলিপোর্টেশন সম্পন্ন করা ইত্যাদিকে বাস্তবায়িত করতে হবে। বর্তমানে এগুলো বাস্তবতা থেকে অনেক অনেক দূর, বলতে গেলে প্রায় অসম্ভব বিষয়।
এরপর? মহাজাগতিক সভ্যতার উৎকর্ষতা পরিমাপের জন্য নিকোলাই কার্দাশেভ যখন বিশেষ মাপকাঠির প্রস্তাবনা করেছিলেন তখন কল্পনার কিছু সীমা ছিল। মনে করেছিলেন তৃতীয় শ্রেণীর সভ্যতা এত বেশি উন্নত যে এর বাইরে আর কোনো শ্রেণী তৈরি করার দরকার নেই। তৃতীয় শ্রেণীর সভ্যতাকে পেরিয়ে চতুর্থ শ্রেণীর সভ্যতায় পরিণত হওয়া অসম্ভবের চেয়েও আরো অসম্ভব।
তবে কল্পনাকে এগিয়ে নিতে যেহেতু কোনো বাধা নেই, তাই তৃতীয় শ্রেণীর পরের ধাপের সভ্যতা কেমন হবে তা হিসাব করতে সমস্যা কোথায়? সেই বিবেচনা থেকে বিজ্ঞানী কার্ল সেগান, মিচিও কাকু এবং রবার্ট মিলে কার্দাশেভ স্কেলকে আরো বিস্তৃত করেন।
টাইপ ফোর বা চতুর্থ শ্রেণীর সভ্যতা তাদের পুরো মহাবিশ্বের সকল শক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা রাখে। ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্তের ভেতরেও তারা বসবাস করতে সক্ষম। চাইলে আস্ত একটা গ্যালাক্সিকে উল্টেপাল্টে নেড়েচেড়ে দেখতেও তারা সক্ষম। পুরো মহাবিশ্বকে শাসন করার জন্য এত পরিমাণ সামর্থ্য তারা কীভাবে অর্জন করবে তা এখন পর্যন্ত কেউ বলতে পারে না। বর্তমান পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই পর্যায়ে উন্নীত হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। হতে পারে তারা এমন কোনো প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেবে যা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি।
টাইপ ফাইভ বা পঞ্চম শ্রেণীর সভ্যতার ক্ষমতা হবে ঐশ্বরিক। নিজেদের মাল্টিভার্সকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকবে তাদের হাতে। এক মহাবিশ্ব থেকে আরেক মহাবিশ্বে তারা শক্তি স্থানান্তর করে নিতে পারবে। এটা কীভাবে সম্ভব হবে তা ভাবতে গেলে মাথার অর্ধেক চুল খসে যাবে। উল্লেখ্য মাল্টিভার্স তত্ত্ব একটি প্রস্তাবিত মহাবিশ্বের মডেল। মাল্টিভার্স তত্ত্ব অনুসারে আমাদের এই মহাবিশ্বের মতো আরো অসংখ্য মহাবিশ্বের অস্তিত্ব আছে। অগণিত এই মহাবিশ্ব একত্রে একটি মাল্টিভার্সের অংশ।
মার্জিতভাবে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্তই মহাজাগতিক সভ্যতার মাপকাঠির সমাপ্তি। এর পরের সভ্যতা কীরকম হতে পারে তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের সুস্পষ্ট কোনো সীমারেখা নেই। কারণ এই জগতের অনেক কিছুই বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো অজানা। যেমন একটা সময় পর্যন্ত মাল্টিভার্স সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের কোনো ধারণাই ছিল না। হিসেবে মাল্টিভার্সকে কল্পনা করে কোনো মাপকাঠি তৈরি করাও সম্ভব ছিল না। পরে মাল্টিভার্সের ধারণা প্রচলিত হলে বিজ্ঞানীরা তাকে কেন্দ্র করে মহাজাগতিক সভ্যতার একটি ধাপ কল্পনা করেছিলেন। তেমনই ভবিষ্যতে হয়তো এই এই মহাজগৎ সম্পর্কে এমন চমকপ্রদ কিছু ধারণার জন্ম হবে যা দিয়ে টাইপ ফাইভ সভ্যতার চেয়েও উন্নত সভ্যতা কল্পনা করা যাবে।
তারপরেও কেউ কেউ বর্তমানের জ্ঞান থেকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর সভ্যতা কল্পনা করে থাকে।
টাইপ সিক্স বা ষষ্ঠ শ্রেণীর সভ্যতা স্থান-কাল সহ আরো উচ্চ মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যদি এটা সময় নামক ভৌত প্রপঞ্চ তাদের কাছে কিছুই না। কোনো চেষ্টায় ব্যর্থ হলে সময়ের পেছনে গিয়ে আবার সেই কাজটি করতে পারবে। যেকোনো ধরনের চ্যালেঞ্জিং কাজ অসীম পরিমাণ সময় নিয়ে করতে পারবে। সময় নামক এক জিনিসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে যে কত পরিমাণ বিপ্লব করা সম্ভব তা লিখে শেষ করা যাবে না।
টাইপ সেভেন বা সপ্তম শ্রেণীর সভ্যতার কথাও মাঝে মাঝে বলা হতে থাকে। এদের কার্যপ্রণালী তো দূরের কথা এরা কী কী করতে পারবে তা-ই মানুষের কল্পনার বাইরে।
আবার ফিরে তাকাই আমাদের মানব সভ্যতার দিকে। মানব সভ্যতা এখনো পড়ে আছে শূন্য শ্রেণীর মাঝে। টাইপ ওয়ানে উন্নীত হতেই আরো অনেক দূর। তবে মানব সভ্যতা এখনো পিছিয়ে আছে তার মানে এই না যে তারা উন্নত হবে না। এই স্বপ্ন বর্তমান প্রজন্মের মানুষ দেখতেই পারে যে একসময় মানুষ হয়তো অনেক অনেক পথ পাড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর সভ্যতায় উন্নীত হবে। পৃথিবীর মানুষ পুরো মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে নিয়ন্ত্রণ করছে এমনটা ভাবলেও একধরনের সুখানুভূতি হয়।
তথ্যসূত্র
- The Kardashev Scale – Type I, II, III, IV & V Civilization, Futurism
- 7 Types of Advanced Cosmic Civilizations, Big Think
- How to Measure the Power of Alien Civilizations Using the Kardashev Scale, io9
- Types of Advanced Alien Civilizations According to the Kardashev Scale, UFOholic
- Kardashev, Nikolai Semenovich (1932- ), David Darling
- ফার্মি প্যারাডক্স: ওরা কোথায়, আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, মাসিক জিরো টু ইনফিনিটি, সেপ্টেম্বর ২০১৪
- থাকে শুধু অন্ধকার, ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, প্রকৃতি পরিচয় প্রকাশনী, ২০১৪
ফিচার ছবি- ড্রিমসটাইম/কালেকটিভ ইভোলিউশন