অ্যাপোলো ১৩ চন্দ্রাভিযান: দুর্ঘটনা মোকাবেলার গল্প || পর্ব ৫ এর পর থেকে
লিবারগট তখনো নিষ্ক্রিয় থাকা দুই জ্বালানি কোষকে পুনরজ্জীবীত করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি ক্রাঞ্জের কাছে সুপারিশ করেন, এই কোষগুলোকে বাস থেকে আলাদা করার জন্য। তিনি চাইছিলেন অকার্যকর যন্ত্রপাতিগুলোকে কার্যকরগুলো থেকে সরিয়ে আনতে। ক্রাঞ্জ তখনো সতর্ক পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছিলেন। একসাথে সবদিকে ঝামেলা করতে চাচ্ছিলেন না। শুধুমাত্র এক নাম্বার জ্বালানি কোষকে বিচ্ছিন্ন করতে রাজি হলেন, যেটা মেইন বাস এ’র সাথে যুক্ত ছিল। তার চিন্তাভাবনা ছিল পুরো সিস্টেমকে একটি একটি করে আলাদা করে মূল সমস্যার উৎস বের করা।
ইতোমধ্যে লিবারগট লাভেলের কাছে অনুরোধ করেন বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা সম্পর্কিত সকল হিসাব পড়ে শোনাতে, যেন গ্রাউন্ডে থাকা ফ্লাইট ডিরেক্টররা মিলিয়ে দেখতে পারেন একই তথ্য পাচ্ছেন কী না। লাভেল অবশেষে অক্সিজেন ট্যাঙ্কের চাপের পরিমাণ দেখতে পেলেন। তিনি বলেন, “আমাদের ২ নাম্বার অক্সিজেন ট্যাঙ্কের চাপ শূন্য দেখাচ্ছে। আপনারাও কি তাই দেখতে পাচ্ছেন?”
তিনি তখন তার সিট থেকে ভেসে উঠলেন এবং জানালার দিকে মুখ রাখলেন যেন সার্ভিস মডিউলের দিকে চোখ রাখতে পারেন। সেখানে দেখেন পাতলা মেঘের মতো বাষ্প উড়ে বাইরে যাচ্ছে। লাভেল তখন বলেন,
আমার কাছে মনে হচ্ছে এখান থেকে ছিদ্র দিয়ে কিছু বের হচ্ছে। কিছু একটা বাইরে মহাকাশে বেরিয়ে যাচ্ছে।
এবার তিনি বুঝতে পারলেন কেন স্পেসক্রাফটকে স্থির রাখা যাচ্ছিল না। ছিদ্র দিয়ে গ্যাস বের হওয়ার কারণে এটা স্পেসক্রাফটকে রকেটের মতোই গতি প্রদান করছিল।
বিস্ফোরণের পর পেরিয়ে গেছে ১৩ মিনিট। ক্যাপকম লাউজমার কাছে এটা ছিল সবচেয়ে শীতল অনুভূতির মুহূর্ত। লাভেলের কণ্ঠ শান্ত শোনালেও তিনি যে পরিস্থিতির কথা বলছিলেন, সেটা সমুদ্রে ডুবন্ত জাহাজের ক্যাপ্টেনের মতোই। কিন্তু নভোচারীরা আর্কটিক সাগরের মতো প্রতিকূল সাগরে ঝাঁপ দেওয়ার মতো অবস্থায়ও ছিলেন না।
লাভেল নিশ্চিত ছিলেন ফুটো দিয়ে বাইরে যা বের হচ্ছে তা গ্যাস। কারণ মহাকাশে তরল পদার্থ দলার সৃষ্টি করে, পাতলা মেঘের চাদর না। তিনি এটাও নিশ্চিত ছিলেন এই গ্যাসটি হচ্ছে অক্সিজেন। তখন তিনি দেখেন শুধু দুই নাম্বার অক্সিজেন ট্যাঙ্কের চাপই শূন্য হয়নি, অন্য ট্যাঙ্কটির চাপও কমে যাচ্ছে। তখন এক নং ট্যাঙ্ক থেকেই অক্সিজেন বের হয়ে যাচ্ছিল। লাভেল তখন অনুভব করেন, পুরো কমান্ড মডিউলই নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার!
ক্যাপকমের মতো অন্য ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা এই পূর্বাভাস দেখতে পাননি। ধাপে ধাপে তাদের কাছে যখন প্রকৃত বিপর্যয় উন্মোচিত হয়, তখন পুরো বিষয়টা অবিশ্বাস্য মনে হয়। এরকম মনে হওয়ার একটা কারণ হচ্ছে ট্যাঙ্কের বিস্ফোরণটা যে মরণঘাতি ছিল, সেটা তারা এড়িয়ে গিয়েছিলেন। লিবারগটের কাছে মনে করেছিলেন এটা নিরীহ কোনো ফুটো হওয়ার ঘটনা। কিন্তু দুই নাম্বার অক্সিজেন ট্যাঙ্কের ছিদ্র হওয়া যে বিস্ফোরিত হওয়ার মতো ঘটনা ছিল সেরকম কোনো সন্দেহই তিনি করেননি।
তখন মূলত দুই ট্যাঙ্কের মাঝখানের স্থানে থাকা নল আর ভালভগুলো ছিঁড়ে যায়, যা ম্যানিফোল্ড নামে এক জায়গায় ছিল, যেখানে নলগুলো পরস্পরের সাথে যুক্ত ছিল। এতে এক নাম্বার ট্যাঙ্ক থেকে ধীরে ধীরে অক্সিজেনের অপসারণ হতে থাকে।
ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা আরেকটি বিষয়ে জানতেন না। সেটা হচ্ছে স্পেসক্রাফটের ঝাঁকুনির কারণে এক ও তিন নাম্বার জ্বালানি কোষের রিয়েকট্যান্ট ভালভগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ট্যাঙ্ক থেকে এ দুইটি জ্বালানি কোষে অক্সিজেন আসা বন্ধ হয়ে যায়। এটাই ছিল বিদ্যুৎ না থাকার তাৎক্ষণিক কারণ। কমান্ড মডিউল ও সার্ভিস মডিউলের বিদ্যুৎ ততক্ষণ সময়ই থাকবে, যতক্ষণ এক নাম্বার অক্সিজেন ট্যাঙ্ক থেকে দুই নাম্বার জ্বালানি কোষে অক্সিজেন আসতে থাকবে।
নভোচারীরা সার্ভিস মডিউলে থাকা অক্সিজেন দিয়েই নিজেদের শ্বাস নেওয়ার কাজ চালাচ্ছিলেন। লিবারগটের তখন আশঙ্কা করেন নভোচারীদের শ্বাস নেওয়ার মতো অক্সিজেনের সঙ্কট দেখা যাবে। তিনি যদিও এ রকম পরিস্থিতি হওয়ার সম্ভাবনা আমলে আনতে চাইলেন না। কারণ এক নাম্বার অক্সিজেন ট্যাঙ্কের স্থায়িত্ব সম্পর্কে তার আস্থা ছিল। ক্রাঞ্জ তখন লুপের মাধ্যমে ফ্লাইট কন্ট্রোলারদের শান্ত থাকতে বলেন। তিনি বলেন, অনুমানের উপর নির্ভর করতে থাকলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকেই যাবে। লিবারগট তখন নিশ্চিত হতে চাইলেন কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি আছে কিনা।
নভোচারীদের মধ্যে ততক্ষণে অবশ্য বিষয়টি নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি ছিল না। হাইস পরবর্তীতে এই পরিস্থিতি নিয়ে বলেন,
গ্রাউন্ডের লোকরা হয়তো এটা বিশ্বাস করতে পারছিল না, কিন্তু আমরা চোখের সামনেই সব দেখতে পাচ্ছিলাম। ঘটনাটা হচ্ছিল কোনো বাড়িতে বাতির ফিউজ গলে যাওয়ার মতো। তখন বাতি জ্বলা বন্ধ হয়ে যায়। বাড়ির ভেতর যদি আপনি থাকেন, তাহলে আপনি সেটার ক্ষতি ভালো বুঝতে পারেন। আমরা অক্সিজেনের বিপর্যয় বিশ্বাস করেছিলাম, কারণ আমরা চোখের সামনে সেগুলো ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে যেতে দেখছিলাম। গ্রাউন্ডের ওরা হয়তো তখন আশা করছিল, এটা যেন কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি হয়। কিন্তু আমরা অক্সিজেনের হিসাবে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, এক ট্যাঙ্কে অক্সিজেনের কোনো চাপই নেই, অন্য ট্যাঙ্কে চাপ কমে যাচ্ছে। এতে আর বুঝতে বাকি থাকে না কী হয়েছিল।
ফ্লাইট কন্ট্রোলারদের অক্সিজেন সমস্যা নিয়ে গুরুত্ব না দেওয়ার প্রধান কারণ ছিল এরকম ঘটনা তখন চিন্তারই বাইরে ছিল। এটা ছিল অনেকটা আমেরিকান জাতির আরেকটি সবচেয়ে বড় প্রযুক্তির বিস্ময় টাইটানিকের ডুবে যাওয়ার মতো ঘটনা। প্রচার করা হচ্ছিল জাহাজটি কোনো দিন ডুববে না। কারণ এটি অনেকগুলো জলরোধী বগি দিয়ে বিভক্ত ছিল। কিন্তু আইসবার্গের সাথে ধাক্কা লাগায় এগুলো টুকরো টুকরো হয়ে যায় এবং জাহাজটি ডুবে যায়।
পরবর্তীতে অ্যাপোলো ১৩ মিশন নিয়ে নাসার এক প্রকৌশলীর মন্তব্য ছিল অনেকটা টাইটানিকের ঘটনার মতোই। তিনি বলেন, “কেউ চিন্তাই করেনি স্পেসক্রাফটের দুটি জ্বালানি কোষ আর দুটি অক্সিজেন ট্যাঙ্ক নষ্ট হয়ে যাবে। এটা ছিল অসম্ভব!”
লিবারগট নিজেই সে ঘটনার পর লিখেন,
আমাদের কেউ যদি সিমুলেটরে এই পরিস্থিতিতে ফেলত, আমরা তখন বলতাম, ‘আপনি খুব অবাস্তব চিন্তা করছেন!’
ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা কিছু সময়ের জন্য দুই দিকেই সমাধানের চেষ্টা করেছেন। তারা একই সাথে চন্দ্রাভিযান চালু রাখছিলেন এবং সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। নভোচারীরা স্পেসক্রাফটের ছিদ্রের কথা উল্লেখ করার চার মিনিট পর লিবারগট ক্রাঞ্জের কাছে সুপারিশ করেন, ক্রুরা যেন কমান্ড মডিউলে ব্যবহার করা বৈদ্যুতিক শক্তির পরিমাণ কমাতে থাকেন। এতে কার্যকর থাকা বাসটির ওপর চাপ কমবে। কারণ এটার বিদ্যুতও কমে যাচ্ছিল।
লিবারগট ক্রাঞ্জকে বলেন নভোচারীরা যেন ‘ইমার্জেন্সি পাওয়ার ডাউন চেকলিস্ট’ এর পঞ্চম পৃষ্ঠার শুরুর অর্ধেকের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করেন। এখানে যন্ত্রপাতিগুলোর সংযোগ ক্রম অনুযায়ী বন্ধ করার নির্দেশনা দেওয়া ছিল, যেন একটি যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল অন্য কোনো যন্ত্র আগেই বন্ধ করে না দেওয়া হয়। ওই মুহূর্তে এটা করে থাকলে পরিস্থিতি কিছুটা সহজ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। স্পেসক্রাফটে নভোচারীরা তাদের নির্দেশনা বের করার জন্য ২০ পাউন্ডের নির্দেশনার কাগজগুলো উল্টে খুঁজে বের করা দরকার ছিল।
ক্রাঞ্জ তখনো হাল ছাড়তে চাচ্ছিলেন না। তিনি চাঁদে অবতরণের সম্ভাবনা তখনো বিবেচনা করছিলেন। তাই তিনি চাচ্ছিলেন না এমন কোনো যন্ত্র নিশ্চল করে দিতে যা চাঁদে অবতরণ করতে বাধা দেয়। ক্রাঞ্জের মতো লিবারগটও মিশন বাঁচিয়ে রাখার চিন্তা করছিলেন। তিনি যন্ত্রের সংযোগ বন্ধ করার পাশাপাশি এক নাম্বার অক্সিজেন ট্যাঙ্ক থেকে বেশি অক্সিজেন পাওয়ার উপায় নিয়ে ভাবছিলেন, যেন পুনরায় বিদ্যুৎ পাওয়া যায়।
কমান্ড মডিউলের বিদ্যুৎ ঘাটতি তখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুনরায় প্রবেশের জন্য বরাদ্দ ব্যাটারি দিয়ে পূরণ করার চেয়েও বেশি হয়ে যাচ্ছিল। লিবারগট তাই নভোচারীদের নির্দেশ দেন ব্যাটারির সংযোগ বন্ধ করতে। তিনি হঠাৎ ভীত হয়ে পড়েন আদৌ কিছু করতে পারবেন কী না। কমান্ড মডিউলের বিদ্যুৎ সংযোগ পুরোপুরি চলে যাওয়া তখন কেবল সময়ের ব্যাপার মনে হচ্ছিল। সেক্ষেত্রে নভোচারীদের পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য লুনার মডিউলকে লাইফবোট হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। এরপর পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের ঠিক পূর্বে লুনার মডিউল ত্যাগ করে নিষ্ক্রিয় কমান্ড মডিউলে যেতে হবে। তারপর সেটি দিয়ে পৃথিবীতে প্রবেশের উপায় খুঁজতে হবে। কারণ অ্যাপোলো-১৩ স্পেসক্রাফটের এই অংশটিই অত্যাধিক তাপরোধী অংশ ছিল।
যদি তাদের এটি করার প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে পৃথিবীতে পুনরায় প্রবেশের জন্য রাখা ব্যাটারি কার্যকর থাকতে হবে। এ কারণে লিবারগট সার্ভিস মডিউলে অক্সিজেন সরবরাহ আলাদা রাখতে বলেন। ক্রাঞ্জ তখনো এক নাম্বার ট্যাঙ্কের অক্সিজেন সংরক্ষণ করতে চাচ্ছিলেন। তিনি লিবারগটকে এ অবস্থার পরিবর্তনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলেন। ইইকম তখন জবাব দেন, তিনি এখন পৃথিবীতে পুনঃপ্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সংরক্ষণ করাই বেশি জরুরি মনে করছেন। ক্রাঞ্জ তখন লিবারগটের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন।
যেকোনো জাহাজের ফুটো হওয়ার ঘটনার মতো অ্যাপোলো-১৩ এর ঘটনাতেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছিল। একবার নভোচারীরা একটা সুইচ বন্ধ করলেন, সাথে সাথে অক্সিজেনের হিসাব দেখানো বন্ধ হয়ে গেল। লিবারগট দ্রুত তাদের এটা পুনরায় চালু করতে বলেন। এরকম পরিস্থিতি দেখে ক্রাঞ্জ তখন নভোচারীদের অনুরোধ করেন, তাদের সামনে থাকা দুটি ড্যাশবোর্ডে ২৫০টি যন্ত্র সম্পর্কে যত হিসাব আছে, সব গ্রাউন্ডে থাকা কন্ট্রোলারদের পড়ে শোনাতে। এতে তারা নিশ্চিত হতে পারবেন আসলেই তখন কী ঘটছে। নভোচারীরা রাত ৯টা ৫৯ মিনিটে পড়া শুরু করেন। তাদের পড়া শেষ হতে সময় লাগে ১০ মিনিট।
বাড়তি সতর্কতা হিসেবে ক্রাঞ্জ গ্লোবাল নেটওয়ার্ক ট্র্যাকিং ও স্পেসক্রাফটের সাথে যোগাযোগের জন্য অস্ট্রেলিয়ার ২৫০ ফুট উঁচু অ্যান্টেনা ডিপ স্পেস ডিশকে সংযুক্ত করার অনুরোধ জানান। এছাড়া মেরিল্যান্ডে অবস্থিত গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের কম্পিউটারগুলোও ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা হয়। এছাড়া তিনি অপারেশন উইংয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকা রিয়েল টাইম কম্পিউটার কমপ্লেক্সকে (আরটিসিসি) ফোনে জানান আরো একটি বড় আইবিএম কম্পিউটারের সংযোগ দিতে। কম্পিউটার কমপ্লেক্সের নাম ‘রিয়েল টাইম’ হওয়ার কারণ এর দ্রুত গতির কারণে। অ্যাপোলো ফ্লাইট গড়ে ৫৫ মিলিয়ন ডেটা প্রদান করে, যা এখানকার কম্পিউটার গ্রহণ করতে পারে। বেশিরভাগ নাসা প্রকৌশলীই মনে করেন, অন্য যেকোনো ক্ষেত্রের চেয়ে কম্পিউটার প্রযুক্তিতে আমেরিকার এগিয়ে থাকাই তাদের চাঁদে অবতরণ করতে সাহায্য করেছে বেশি।
আরটিসিসিতে থাকা কর্মীদের কাছে থাকা কনসোলগুলো অনেকটা উপরের তলায় থাকা কন্ট্রোল রুমের কনসোলগুলোর মতোই। প্রকৃতপক্ষে এই কর্মীরা ফ্লাইট কন্ট্রোলারদের মতোই ছিলেন। কাঁচের ঘেরা ঘরটিতে থাকা কম্পিউটারগুলো কর্মীদের তত্ত্বাবধানে ছিল। প্রতিটি কম্পিউটার ছিল দুই ডজন আয়তাকার ক্যাবিনেটে বিভক্ত, অনেকটা শোরুমে থাকা ফ্রিজের মতো। ফ্রিজের মতো এই কম্পিউটারগুলোকেও শীতল তাপমাত্রায় রাখতে হতো সর্বোচ্চ কার্যকারিতা ঠিক রাখার জন্য। সেখানে চারটি বড় কম্পিউটার ছিল, যার প্রত্যেকটি চাঁদে মিশন পরিচালনা করতে সক্ষম ছিল। পঞ্চম আরেকটি ছোট কম্পিউটার ছিল যা সিমুলেশনের জন্য ব্যবহৃত হতো।
সাধারণত একটি কম্পিউটার দিয়েই মিশন পরিচালনা করা হয়। তবে কিছু সঙ্কটময় সময়, যেমন- উৎক্ষেপণের সময়, চাঁদে অবতরণ ও পৃথিবীতে পুনঃপ্রবেশের সময়গুলোতে বিকল্প আরেকটি কম্পিউটার প্রস্তুত রাখা হয়। সেই দুর্ঘটনার রাতে বিকল্প কম্পিউটার স্পেসক্রাফট থেকে কোনো ডেটা সংগ্রহ করছিল না। এমনকি ওই রুমে থাকা তৃতীয় ও চতুর্থ বড় কম্পিউটারের মতো এটাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কাজে ব্যবহার করা হচ্ছিল। কারণ নাসার তখন বাজেট ঘাটতি ছিল। কম্পিউটার পরিচালনা করা ছিল তখন খুব ব্যয়বহুল।
তাছাড়া এর আগে মূল কম্পিউটারকে খুব বেশি প্রতিকূল অবস্থায় পড়তে হয়নি যার জন্য বিকল্প কম্পিউটারের প্রয়োজন হবে। যদি প্রয়োজন হতোও, মূল কম্পিউটার থেকে ২০ মিলিসেকেন্ডের মধ্যেই বিকল্প কম্পিউটারে ডেটা স্থানান্তর করা যেত, যা প্রকৃতপক্ষে অনেক কম সময়। এখন যদি মূল কম্পিউটারই অক্ষম হয়ে পড়ে, তাহলে ডেটা স্থানান্তর সম্ভব হবে না। ক্রাঞ্জকে এই ত্রুটি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছিল, কারণ তিনি ওই রাতে বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে অনেক সমস্যার মধ্যে ছিলেন।
(এরপর দেখুন ৭ম পর্বে)