অ্যাপোলো ১৩ চন্দ্রাভিযান: দুর্ঘটনা মোকাবেলার গল্প || পর্ব ৮

পর্ব ৭ এর পর থেকে

কয়েক বছর আগে অ্যাপোলো-৯ এর গবেষণার সময় লুনার মডিউলের এ ধরনের পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা কাজ হয়েছিল, যদিও তা সে মুহূর্তের পরিস্থিতির ধারেকাছেও ছিল না। এছাড়া কখনোই পরীক্ষা করে দেখা হয়নি লুনার মডিউলে একজন মানুষ কত সময় জীবিত থাকতে পারে, যা যেকোনো লাইফবোটের ক্ষেত্রে শুরুতেই জানা উচিত। 

লুনার মডিউলকে লাইফবোট হিসাবে ব্যবহারের সম্ভাবনা এতটাই অস্বাভাবিক ছিল যে, চাঁদে পৌঁছানোর আগে লম্বা দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার সময় লুনার মডিউল যখন নিষ্ক্রিয় থাকত, তখন কন্ট্রোল রুমে এলএম (LM) কনসোলের সামনে কেউ থাকতেন না। সৌভাগ্যবশত দুর্ঘটনার সময় টেলমু হেসেলমেয়ার সেখানে ছিলেন। এর কিছুক্ষণ পর ক্রাঞ্জ লুপের মাধ্যমে জানান এলএম কনসোলের সামনে কাউকে থাকতে।

লুনার মডিউল সম্পর্কে হেসেলমেয়ারের শুরুর প্রতিক্রিয়া এতই শীতল ছিল যে তিনি রেট্রো (RETRO) অফিসারকে লুপের মাধ্যমে জানান, মিশন বাতিল করে সার্ভিস মডিউলে থাকা রকেট নিয়ে তখনই সরাসরি নভোচারীদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে। তাত্ত্বিকভাবে এটা তখনো সম্ভব ছিল। টেলমুর দৃষ্টিকোণ থেকে চাঁদকে ঘিরে চার দিন সময় নিয়ে আসার চেয়ে এভাবে দেড় দিনে নভোচারীদের ফিরিয়ে আনাই শ্রেয় ছিল।

দুর্ঘটনার পর কন্ট্রোল রুমে থাকা ফ্লাইট কন্ট্রোলার ও অন্যান্য নভোচারীরা; Image Source: NASA

তাদের এই কথোপকথন ছিল ভিন্ন একটি লুপে, যার টেলিফোন লাইন ফ্লাইট ডিরেকটরের সাথে যুক্ত মূল লুপের কথোপকথনকে বিরক্ত করত না। রেট্রোফায়ার অফিসাররা টেলমুর অনুরোধে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তখন রেট্রোফায়ার অফিসার ছিলেন দুজন। তখন দায়িত্বে থাকা স্পেন্সারের সাথে ছিলেন লিড রেট্রোফায়ার অফিসার চার্লস দিয়েত্রিখ। স্পেসক্রাফটের জরুরি প্রত্যাবর্তনের মূল দায়িত্ব ছিল দিয়েত্রিখের ওপরই। গোঁফওয়ালা লম্বা ভদ্রলোক দিয়েত্রিখ ছিলেন হিউস্টনের সেন্ট টমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। তিনি ১৯৬৪ সালে নাসায় যোগদান করেন।

তিনি তখন হেসেলমেয়ারকে বলেন, সে মুহূর্তে স্পেসক্রাফটি চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ বলের এত নিকটে যে, কমান্ড মডিউলকে সরাসরি পৃথিবীর দিকে আনতে হলে লুনার মডিউলকে ফেলে আসতে হবে। কারণ মূল রকেটটি পুরো স্পেসক্রাফটকে ফিরিয়ে আনার মতো শক্তিশালী ছিল না। এই কথোপকথন শোনা লিবারগট তখন জানিয়ে দেন, তিনি লুনার মডিউল ফেলে আসার মতো কোনো পরিকল্পনার অনুমোদন দেবেন না।

দিয়েত্রিখ এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আরেকটি যুক্তি দেন, সার্ভিস মডিউলের মূল রকেটটির সর্বোচ্চ কার্যক্ষমতায় ব্যবহার করলেও এটা স্পেসক্রাফটের দিক পরিবর্তন তো করতেই পারবে না, বরং এর গতি কমিয়ে দেবে। ফলে এটা চাঁদে গিয়ে বিধ্বস্ত হবে। যদি এ রকম নাও হয়, রকেটকে ফুল থ্রাস্টে চালু করতে না পারলে স্পেসক্রাফট গিয়ে সেই চাঁদে বিধ্বস্তই হবে। তাছাড়া দিয়েত্রিখ স্পেসক্রাফটের কথোপকথনও শুনেছিলেন। তিনি সেখানের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার অবস্থা দেখে রকেট আদৌ চালু হবে কিনা সেটা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। হেসেলমেয়ার তখন আবার লুনার মডিউলের চার দিনের ভ্রমণের পরিকল্পনায় ফিরে যান। তিনি সাহায্যের জন্য নিকটবর্তী স্টাফ সাপোর্ট রুমে থাকা প্রকৌশলীদের দল স্পেসক্রাফট অ্যানালাইসিস টিমকে (SPAN) ডাকেন।

দিয়েত্রিখ সরাসরি প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা পুরোপুরি বাদ দেওয়ার আগে নিচ তলার আরটিসিসিতে তাদের কম্পিউটারে সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তনের পথ নির্ণয়ের সম্ভাবনা হিসাব করে দেখতে বলেন। তিনি মহাকাশযানের সমুদ্র-অবতরণের সময় নভোচারীদের উদ্ধার করার দায়িত্বে থাকা রিকভারি অপারেশন টিমকে সাতটি সম্ভাব্য অবতরণ স্থানের তালিকা দিয়ে রাখেন। কন্ট্রোল রুমের নিকটেই থাকা কাচে ঘেরা রিকভারি টিমের জরুরি অবস্থা নিয়ে প্রস্তুতি টেলমুর চেয়েও খারাপ ছিল। পূর্ববর্তী চন্দ্রাভিযানগুলোর সাফল্যে নাসা উদ্ধারকারী জাহাজের সংখ্যা কমিয়ে আনে।

কমান্ড মডিউলের ডায়াগ্রাম; Image Source: NASA

মারকারি ও জেমিনি প্রোগ্রামের সময় নভোচারীরা যখন পৃথিবীর কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করছিলেন, তখন পুরো পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বারোটির মতো উদ্ধারকারী জাহাজ ছিল। ফলে স্পেসক্রাফট যে স্থানেই অবতরণ করুক, উদ্ধারকারী জাহাজগুলো কয়েকশ মাইলের কাছাকাছিই ছিল।

যখন থেকে চন্দ্রাভিযান শুরু হলো, উদ্ধারকারী জাহাজের সংখ্যা কমে গেল। কারণ তখন স্পেসক্রাফটকে নির্দিষ্ট স্থানে অবতরণ করানোর মতো প্রযুক্তি এসে গেল। ফলে শুধুমাত্র ওই অক্ষাংশের কাছাকাছি অঞ্চলেই জাহাজ রাখা হতো। তাছাড়া উড়োজাহাজের মাধ্যমে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পৃথিবীর যেকোনো স্থানে ডুবুরি প্রেরণের মাধ্যমে স্পেসক্রাফট ক্যাপসুলের হ্যাচ খোলা সম্ভব ছিল।                

চাঁদ থেকে আসা একটা বিকল স্পেসক্রাফট উদ্ধারের জন্য ডুবুরির চেয়ে বেশি কিছু প্রয়োজন হবে, এতটা গুরুতর পরিস্থিতির কথা কেউ চিন্তাই করেননি। অ্যাপোলো-১১ যখন সফলভাবে চাঁদে অবতরণ করল, তখন থেকে স্পেসক্রাফট পুনরুদ্ধার অঞ্চলের সংখ্যা চারে নিয়ে আসা হলো। রিকভারি অফিসাররা এগুলোর নাম দিয়েছিলেন মধ্য-প্রশান্ত লাইন, পশ্চিম-প্রশান্ত লাইন, আটলান্টিক মহাসাগর লাইন ও ভারত মহাসাগর লাইন।

অ্যাপোলো-১৩ মিশনের সময়ও রিকভারি অফিসাররা এই চারটি অঞ্চলই পরিকল্পনায় রেখেছিলেন। কিন্তু এগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র মধ্য-প্রশান্ত লাইনের কাছেই জাহাজ ছিল। যখন রিকভারি অফিসারদের বলা হলো তালিকায় থাকা সাতটি অঞ্চলের যেকোনো স্থানে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে উদ্ধার বাহিনীর প্রয়োজন হতে পারে, তখন তারা কাজে নেমে গেলেন। প্রথমে তারা ফোন করলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে এই অঞ্চলগুলোর কাছাকাছি কোনো আমেরিকান নৌবাহিনীর জাহাজ আছে কিনা খোঁজ নিতে। তাছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের নৌবাহিনী ও পণ্যবাহী জাহাজের খোঁজও নিতে থাকলেন। বারোটি দেশ জাহাজ দিয়ে সাহায্য করে। তবে কাছাকাছি থাকা ইউএসএস আমেরিকা জাহাজটিই নভোচারীদের উদ্ধার করে। জাহাজটি তখন কেবল পুয়ের্তো রিকো ছেড়ে যায় এবং লক্ষ্যস্থানে পৌঁছাতে ২৪ ঘণ্টা সময় নেয়।

বিস্ফোরণের এক ঘণ্টা নয় মিনিট পর ব্ল্যাক টিম স্পেসক্রাফটের দায়িত্ব হোয়াইট টিমের হাতে তুলে দেয়। এর কয়েক মিনিট আগে ক্রাঞ্জ লুপ টেলিফোনের মাধ্যমে টেলমু (TELMU) আর রিকভারি অফিসারদের সরাসরি স্পেসক্রাফটকে পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনের কথা ভুলে যেতে বলেন। তারা সার্ভিস মডিউলে থাকা রকেটের অবস্থা সম্পর্কে জানতেন না। লুনার মডিউলে থাকা মূল রকেটের প্রতিই তাদের বেশি আস্থা ছিল। চাঁদকে ঘিরে স্পেসক্রাফটকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়। এতে রিকভারি রুম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

অ্যাপোলো-১৩ এর লুনার মডিউল; Image Source: Wikimedia Commons

ক্রাঞ্জ সিদ্ধান্ত নিলেন এই সঙ্কটময় মুহূর্তেও শিফট পরিবর্তন করবেন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন তাদের পক্ষে যতটুক করা সম্ভব তারা করেছেন। এখন দরকার আরেকটি সতেজ টিম। ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা যেকোনো পরিস্থিতিতে নতুন টিমের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে গর্ববোধ করতেন। ফ্লাইট নিয়ন্ত্রণ বিভাগের প্রধান হিসাবে ক্রাঞ্জ অনেক সময় দিয়েছেন এক শিফটের সাথে অন্য শিফটের ‘সিদ্ধান্তের অভিন্নতা’ বজায় রাখতে। এতে করে বিভিন্ন শিফটের হস্তান্তর প্রক্রিয়া সহজ হয় এবং মিশন কন্ট্রোল থেকে নভোচারীদের সাথে যোগাযোগও সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।

প্রতিটি ফ্লাইট কন্ট্রোলার দলেরই একজন করে প্রধান ছিলেন। যেমন- রেট্রো প্রধান, গাইডো প্রধান, ইইকম প্রধান। তারা সরাসরি ক্রাঞ্জের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতেন। ক্রাঞ্জ খেয়াল করতেন অফিসে একই কাজ তারা বিভিন্ন টিমের হয়ে করলেও নিজেদের মধ্যে তাদের জানাশোনা ভালো ছিল। তাদের কাজের ধরন সম্পর্কেও ভালো ধারণা ছিল। ক্রাঞ্জ সবসময় তাদের মধ্যে পরিচিতি থাকাটাকে উৎসাহ দিতেন। তিনি মনে করতেন নভোচারীদের চেয়েও ফ্লাইট কন্ট্রোলারদের মধ্যে সম্পর্কের বন্ধন ভালো ছিল। তারা নিজেদের মধ্যে প্রায়ই ফুটবল খেলতেন। নভোচারীরাও তিন জনের দলে বিভক্ত হয়ে খেলাধুলা করতেন।      

ফ্লাইট কন্ট্রোলারদের সবচেয়ে দক্ষতার পরিচয় দিতে হতো সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে নতুন দলের হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার সময়। লিবারগট যখন নতুন ইইকমের হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, তার কাছে মনে হচ্ছিল মুখ দিয়ে কথাই বের হচ্ছে না। তিনি নিজেকে ভাগ্যবান ভাবছিলেন এর আগেই কথা বন্ধ না হয়ে যাওয়ায়। এর আগে অ্যাপোলো-১০ এর জ্বালানি কোষ যখন নষ্ট হয়ে যায় কিংবা অ্যাপোলো-১২ এর স্পেসক্রাফট বজ্রপাতের আঘাতের শিকার হয়, তখনো তিনি দায়িত্বে ছিলেন। তার মুখের জবান হয়তো সত্যিই বন্ধ হয়ে যেত, যদি তিনি জানতেন যে ক্রায়োজেনিক আলোড়নের নির্দেশ দিয়েছিলেন নভোচারীদের, সেটার কারণেই অক্সিজেন ট্যাঙ্কের বিপর্যয় আরো ত্বরান্বিত হয়েছিল। অবশ্যই সেখানে তার কোনো দোষ ছিল না। পরবর্তীতে তিনি যখন বিষয়টা জানতে পারেন, তিনি এটা নিয়ে মন্তব্য করেন, যদি এটাকে সেভাবেই রেখে আসতেন, পরবর্তী ইইকমের দায়িত্ব পালনের সময় অক্সিজেন ট্যাঙ্ক বিস্ফোরিত হতো।

লিবারগট তখন ক্রাঞ্জ ও হোয়াইট টিমের অন্যান্য সদস্যদের সাথে তৃতীয় তলার সভা কক্ষে যান, যেটা ছিল স্টাফ সাপোর্ট রুমগুলোর একটা। সেখানে ক্রাঞ্জ ও তার দলের সবাই সারা রাত ধরে গত কয়েক ঘণ্টার ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করেন। সেখান থেকে তারা আরো কী কী জানতে পারেন এবং মিশন নিরাপদে সমাপ্ত করতে নতুন কী কী পরিকল্পনা নেওয়া যায়, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করেন।

কন্ট্রোল রুমে ক্যাপকম লাউজমা; Image Source: NASA

ব্ল্যাক টিম হোয়াইট টিমের কাছ থেকে এতই সাবলীলভাবে দায়িত্ব বুঝে নেয় যে, স্পেসক্রাফটে থাকা নভোচারীরা টেরই পাননি এদিকে যে শিফট পরিবর্তন হয়েছে। নতুন ফ্লাইট ডিরেক্টর গ্লিন লানি ক্রাঞ্জের মতোই কমান্ড মডিউলে বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে থাকেন। একই সাথে কার্যকর থাকা অক্সিজেন ট্যাঙ্কের চাপও স্বাভাবিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। একটা অসম্ভব সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছিল যে, দুই নাম্বার জ্বালানি কোষটি নষ্ট হয়ে থাকতে পারে। লানি তখন এই কোষের ভালভ বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। হাইস তখন আগের মতোই দুই বার নিশ্চিত হয়ে নিলেন নির্দেশনাটি। হাইস ভালভ বন্ধ করেও কোনো কিছুর পরিবর্তন দেখতে পেলেন না। তিনি তখন কমান্ড মডিউলের ওপর হাল ছেড়ে দিলেন। তিনি এই প্রসঙ্গে বলেন,

সে মুহূর্তে আমার কাছে এটা মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কমান্ড মডিউল নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার। আমি তাই সেখানে আমার অবস্থানের ওপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলি এবং লুনার মডিউলের দিকে যাত্রা আরম্ভ করি।

(এরপর দেখুন পর্ব ৯ এ)

Related Articles

Exit mobile version