পরিবেশের সাথে মানুষের দূরত্ব কি বাড়ছে?

আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন যে, কেন বেশিরভাগ লোকে বারান্দা বা বারান্দা থেকে দর্শনীয় স্থান রয়েছে এমন হোটেল রুম ভাড়া করতে পছন্দ করেন? যেসব রোগী তাদের হাসপাতালের বিছানা থেকে প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পান তারা অন্যদের চেয়ে দ্রুত কেন সুস্থ হয়ে উঠবেন? বা কেন এমন হয় যে বিষণ্নতা যখন আমাদের মনে উদ্বেগ নিয়ে আসে, তখন আমরা প্রকৃতির মাঝে জিনিসগুলো বের করার জন্য সময় কামনা করি?

Image Source: Booking

প্রকৃতির প্রতি আমাদের সখ্য পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকেই। প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকা নানা উপাদান আমাদের চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করে। সবুজ অরণ্যে হাঁটা বা রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে সৈকতের ধারে বেড়াতে যাওয়ার মাধ্যমে সুখ এবং শান্তির অন্তর্নিহিত অনুভূতি জাগ্রত করতে পারাটা নিছক কোনো আধ্যাত্মিক ব্যাপার নয়। প্রকৃতির নির্মল বাতাস কিংবা তার ভুবনমোহিনী সৌন্দর্য আমাদের চিন্তার পথ খুলে দেয়, প্রশান্ত করে অশান্ত মনকে। ‘পরিবেশ মনোবিজ্ঞান’ নামে মনোবিজ্ঞানের বিশেষ এক শাখা এই ব্যাপারগুলো প্রমাণ করার জন্য অনেক এগিয়ে গেছে।

Image Source: Frontiers

লেখক রিচার্ড লভ তাঁর বিখ্যাত বই ‘লাস্ট চাইল্ড ইন দ্য উডস’-এ ‘প্রকৃতি-ঘাটতি ডিসঅর্ডার’ বিষয়ে ধারণা দিয়েছেন। লুভের মতে, প্রকৃতি-ঘাটতিজনিত ব্যাধি মস্তিষ্কে উপস্থিত থাকাটা ব্যতিক্রম নয়; এটি প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে মানুষের সংযোগ হ্রাস করে। প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক সুস্থতার উন্নতি করে। এটি আমাদের ভেতর থেকে জীবিত বোধ করে এবং নগরায়ন, প্রযুক্তি বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাম্প্রতিক বিকাশের জন্য আমাদেরকে এর সাথে আপস করা উচিত নয়।

১৯৫৩ সালে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন আমেরিকান ইনস্টিটিউট অফ আর্কিটেক্টসের সহযোগিতায় একটি আর্কিটেকচারাল স্টাডি প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করে। এই প্রকল্পটি উত্তর আমেরিকার মানসিক হাসপাতালের ব্যবস্থার সমাধানের জন্য মনোচিকিত্সা, আচরণ বিজ্ঞান, পরিকল্পনা এবং নকশা সংক্রান্ত পেশাগুলোর একাধিক বিশেষজ্ঞকে একত্রিত করে। তারা হাসপাতালের পরিবেশের বিভিন্ন দিক, যেমন- আলো, রঙ, গোপনীয়তা এবং সামাজিক যোগাযোগের জন্য জায়গা তৈরির উপর মনোনিবেশ করতে শুরু করে এমনভাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠানের দেয়াল ছাড়িয়ে তত্ত্ব, পদ্ধতি এবং নকশাগুলো প্রভাবিত করতে পারে। এটি পরিবেশগত মনোবিজ্ঞানের নতুন ক্ষেত্রের চিন্তা-ভাবনা এবং বিকাশে সহায়তা করে, যা মানসিক অসুস্থতা রোধ করতে এবং নগর সঙ্কটের সময়কালে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রচারের জন্য নগরীর বিভিন্ন স্থানের কাজ এবং নকশায় অংশ নিয়েছিল।

পরিবেশ মনোবিজ্ঞান

মনোবিজ্ঞানের বিশেষায়িত এই শাখাকে ব্যক্তির আচরণ এবং অর্জিত জ্ঞানের মধ্যে অভিজ্ঞতা এবং তাত্ত্বিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা হিসেবে সংজ্ঞায়িত হয়। সারা বিশ্বেই এই বিষয়টি নিয়ে সময়ের সাথে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে।

পরিবেশ মনোবিজ্ঞান ধারণার ইতিহাস অবশ্য খুব বেশিদিন আগের নয়। ১৯১১ সালে উইলি হ্যালপেক নামে পোল্যান্ডের এক মনোবিজ্ঞানী সর্বপ্রথম পরিবেশ মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা দেন। তিনি পরিবেশের দুই বা ততোধিক উপাদান বা ঘটনার সাথে মানুষের যোগসূত্র সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন, যেগুলো নিয়ে পরবর্তীতে ষাটের দশকে কাজ শুরু হলেও এখনও স্বাধীন এবং পদ্ধতিগত জটিলতায় পরিবেশ বিজ্ঞানের এই শাখাটি স্বতন্ত্র হতে পারেনি।

Image Source: Medium

পরিবেশ মনোবিজ্ঞানের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয় এগন ব্রুনসিক এবং কার্ট লিউইনকে। যদিও এই দুজনের এই বিষয়ের উপর এমন কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ নেই যেটি পরিবেশ মনোবিজ্ঞানে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যথেষ্ট, তবুও ভৌত পরিবেশের সাথে মনোবিদ্যা এবং মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের যোগসূত্র সম্পর্কিত তাদের ধারণাগুলো পরবর্তীতে পরিবেশ মনোবিজ্ঞানের বিস্তৃতিতে অবদান রেখেছে।

ব্রুনসিক বিশ্বাস করতেন, শারীরিক পরিবেশ মানুষের সচেতনতার বাইরে মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়াগুলোকে প্রভাবিত করে। তিনি এমন গবেষণার পক্ষে জোরালোভাবে সমর্থন করেছিলেন যেখানে পরিবেশের সমস্ত দিক অন্তর্ভুক্ত করে ব্যক্তিকে বোঝার চেষ্টা করা হবে। লিউইন ভৌত পরিবেশের পরিবর্তে সামাজিক বা আন্তর্জাতিক প্রভাবগুলোর প্রতিই মনোযোগী ছিলেন। তিনি শিক্ষার্থীদের তার এই ভাবনাগুলোকে প্রসারিত করতে অনুপ্রাণিত করতেন। তার দুই ছাত্র বার্কার এবং ব্রোনফেনব্রেনার পরবর্তীতে পরিবেশগত মনোবিজ্ঞানের অগ্রদূত হিসেবে অবদান রাখেন।

সেই সময়ে খুব ধীরগতিতে বিষয়টি নিয়ে চর্চা হতো। বেশিরভাগ গবেষণাই হতো বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ কীভাবে মানুষের উপলব্ধি এবং আচরণকে প্রভাবিত করে সেসব নিয়ে। তাই সেসময় শাখাটি ‘আর্কিটেকচারাল সাইকোলজি’ হিসেবেই আলোচিত ছিল।

পরিবেশ মনোবিজ্ঞানের দ্রুত বিকাশের পালাবদল শুরু হয় ১৯৬০ এর শেষের দিকে যখন মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি হতে শুরু হয়েছিল। এর ফলশ্রুতিতে স্বাস্থ্যকর এবং পরিবেশগত আচরণের ব্যাখ্যা এবং পরিবর্তন সম্পর্কিত টেকসই পরিবেশ নিয়ে অধ্যয়ন শুরু হয়।

সাম্প্রতিককালে এই বিষয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। ভারতীয় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মধুলিনা রায় চৌধুরী নেদারল্যান্ডভিত্তিক মনোরোগ বিষয়ক এক ওয়েবসাইটে লেখা এক ব্লগে এমন কিছু গবেষণার উল্লেখ করেছেন।

১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন এবং অস্ট্রেলিয়ার মনোবিজ্ঞানীদের একটি দল অনুসন্ধান করেছে কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনগুলো মানুষের ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করে তা নিয়ে। ফলাফলগুলো ইঙ্গিত দেয়, ২২-২৪ ডিগ্রি অবধি তাপমাত্রাসহ একটি মাঝারি জলবায়ুতে যারা বাস করে, তারা মিশ্রতা, উন্মুক্ততা, বহির্মুখী রূপান্তর এবং সম্মতির মতো ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যগুলোতে ভালো ফল দেখিয়েছে।

২. বিজ্ঞানী রায়ান ল্যাম্বার, মাইলস রিচার্ডসন, ডেভিড শেফিল্ড ২০১৭ সালে তাদের প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধে বলেছেন, প্রকৃতির নিকটবর্তী হওয়া ইতিবাচক আবেগকে উস্কে দেয়। বহিরাগত ক্রিয়াকলাপ, যেমন- পাহাড় বেয়ে ওঠা, বাগান করা বা পাখি দেখা, প্রকৃতির সাথে মনের সম্পর্ক দৃঢ় করে এবং সুখের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।

৩. অধ্যাপক হেলেন লকহার্ট তার এক গবেষণায় ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে এক আধ্যাত্মিক সম্পর্ক রয়েছে, যেটি সামাজিক-পরিবেশগত সঙ্কটের ফলে আজ হুমকির মুখে পড়েছে।

একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ এবং বন উজারের মতো ঘটনাগুলো স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের মতো বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর জন্য ক্রমেই হুমকি হয়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসকল সমস্যার মূলে রয়েছে মানুষের আচরণ।

পরিবেশগত এতসব সমস্যার বিপরীতে মানুষের আচরণ পরিবর্তন করার উপায় সন্ধান করে একই সাথে মানুষের মঙ্গল ও জীবনমানের পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে পরিবেশ মনোবিজ্ঞান। সেই লক্ষ্যে মনোবিজ্ঞানীরা কাজ করছেন, হচ্ছে বিস্তর গবেষণা, বাড়ছে এই ক্ষেত্রের সম্ভাবনা। আগামীর দিনগুলোতে আমরা হয়তো পরিবেশ মনোবিজ্ঞানের মাধ্যমে পরিবেশকে বুঝতে পারার পথটাকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারবো, পরিবেশগত জটিলতা আর মানুষের স্বার্থপর মনোভাবের দূরত্ব কমিয়ে বাসযোগ্য এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখবো আগামী প্রজন্মের জন্য।

Related Articles

Exit mobile version