কল্পনা করুন তো, রাতে ঠিকমতোই ঘুমিয়েছিলেন নিজের ঘরে। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। নিজেকে আবিষ্কার করলেন ঘন জঙ্গলে, চারপাশে জমাট বাধা বিদঘুটে অন্ধকার, শিয়াল ডাকছে। আপনি কিভাবে এখানে এলেন সেটা হাজার চেষ্টাতেও মনে করতে পারছেন না। অথবা ঘুম ভাংলে দেখলেন গাড়িতেই বসে আছেন এবং গাড়িটি কোনো এক গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে উলটে পড়ে আছে। আপনি মনেই করতে পারলেন না যে, ঘুমিয়েছিলেন নিজের ঘরে অথচ জেগে উঠলেন ঘন জঙ্গলে বা ধাক্কা খাওয়া গাড়ির ভেতর। অনেকটা ভৌতিক কিংবা অনেকটা সিনেমার মতোই মনে হবে বিষয়টি। তবে যা ঘটেছে তা কিন্তু আপনিই ঘটিয়েছেন। কিন্তু কিভাবে সম্ভব?
ব্যোমকেশপ্রিয় মানুষেরা কলকাতা বাংলা আর্টফিল্ম ‘শজারুর কাঁটা’ দেখেননি, এমনটি হওয়ার কথা নয়। এই সিনেমায় প্রায়শ রাতে একের পর এক মানুষ খুন হয়ে যায়। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে প্রতিটি খুনই করা হয় শজারুর কাঁটা দিয়ে এবং পিঠের একটি বিশেষ অংশে এই কাঁটা বসিয়ে। তো ব্যোমকেশ বাবুর উপর এই তদন্তের ভার পড়লে অবশেষে তিনি খুনিকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন। কিন্তু যেটা রোমাঞ্চকর সেটা এই শজারুর কাঁটা নয়, ওটা ছিলো নিছক হাতিয়ার। রোমাঞ্চকর ব্যাপার হচ্ছে খুনি প্রবাল খুনের সময় টেরই পায় নি যে সে খুন করেছে বা করছে। ব্যোমকেশ বাবুর মতে প্রবাল ঘুমের ভেতরই এই খুন করেছে। এই অবস্থাকেই বলা যায় নিদ্রাভ্রমণ বা স্লিপওয়াকিং (Sleepwalking)। প্রেমিকাকে হারাবার দুশ্চিন্তা, নাটকদলের জন্য দুশ্চিন্তা ইত্যাদিই প্রবালকে এই সমস্যার সম্মুখীন করেছিলো। তাছাড়া শেক্সপীয়র তাঁর ‘ম্যাকবেথ’ নাটকেও স্লিপওয়াকিং সম্বলিত একটি দৃশ্য তৈরী করেছেন।
নাটকে বা সিনেমায় দেখে বিষয়টিকে অনেকটা ফিকশন মনে হলেও বাস্তবে স্লিপওয়াকিং-এর অনেক প্রমাণ পাওয়া যায় যার দুই-একটি ক্ষেত্রে ফলাফল সিনেমার মতোই ভায়াবহ পর্যায়ে গিয়েছে। মূলত ৪-৮ বছর বয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা সচরাচর দেখা গেলেও প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেও এই সমস্যা হতে পারে। এই লেখাটিতে থাকছে স্লিপওয়াকিং নিয়ে কিছু অজানা তথ্য।
স্লিপওয়াকিং বা নিদ্রাভ্রমণ কী?
স্লিপওয়াকিং বা নিদ্রাভ্রমণ (বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় Somnambulism অথবা Noctambulism) বলতে বোঝায় ঘুম এবং ভ্রমণের অর্থাৎ চলাফেরার যৌগিক রূপ। সহজে বলতে গেলে ঘুমের ভেতর স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করা, যদিও সেটা স্বাভাবিক না। চিকিৎসকেরা একে প্যারাসোমনিয়া (Parasomnia) গোত্রভূক্ত করে থাকেন। প্যারাসোমনিয়া একটি ঘুম সংক্রান্ত ব্যাধিগোত্র, যেখানে মূলত ঘুমের ভেতর মানুষের বিভিন্ন আচরণগত বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়ে থাকে; যেমন ঘুমের ভেতর কথা বলা, চলাফেরা করা, কাঁদা, দাঁত কিড়মিড় করা ইত্যাদি। তবে এক্ষেত্রে সব সময় গভীর ঘুমেরও আবশ্যকতা নেই। আধা ঘুম, পূর্ণ ঘুম অথবা ঘুম থেকে জেগে ওঠার পূর্বমুহূর্তেও এসব ঘটনা ঘটতে পারে।
তবে স্লিপওয়াকিং সাধারণত গভীর ঘুমের সময়েই হয়ে থাকে, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় Slow Wave Sleep Stage (SWSS)। এই সময়ে ঘুমন্ত ব্যক্তির চেতনা থাকে খুবই ক্ষীণ, অর্থাৎ বাহ্যিক জগৎ থেকে বলা যায় প্রায় সম্পূর্ণ যোগাযোগবিহীন। কিন্তু একই সময়ে স্লিপওয়াকিং-এ আক্রান্ত ব্যক্তি মনের অজান্তেই এমন কাজ করে ফেলেন, যা দেখে বোঝার উপায় থাকে না যে তিনি জেগে আছেন না ঘুমিয়ে আছেন। যেমন- তিনি বিছানার উপর উঠে বসলেন, তারপর বাথরুমে গেলেন কিংবা রান্নাঘরে গেলেন অথবা গাড়ি ড্রাইভিং এর মতো বিপদজনক কাজও করে ফেলতে পারেন!
স্লিপওয়াকিং এর ক্ষেত্রে এই রোগে (অবশ্য একে রোগ বলা যাবে কিনা এ নিয়ে মতবিরোধ আছে) আক্রান্ত ব্যক্তির ঘুমন্ত অবস্থায় করা কাজগুলো পুনরাবৃত্তিক ধরণের হয়ে থাকে। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি ঘুমের ভেতর তার রান্নাঘর পর্যন্ত যদি যান, তবে পরে প্রায় প্রতিবারই তার রান্নাঘরে যাওয়ার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি। যদিও ঘুমন্ত অবস্থায় সাধারণ কাজ করার কথা থাকলেও, রিপোর্টে দেখা যায় মাঝেমধ্যে কিছু জটিল আচরণও ওই ব্যক্তি করতে পারেন।
সব থেকে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি জানতেই পারেন না যে তিনি আসলে কি করছেন বা করেছেন। কারণ প্রায় অচেতন অবস্থায় করা কাজ যেমন তিনি অনুভব করতে পারেন না, তেমনি মস্তিষ্ক এই কাজের কোনো স্মৃতি রাখতে পারে না। কারণ এই সময় মস্তিষ্কের চেতনার অংশ বিশ্রাম অবস্থায় থাকে। অর্থাৎ বিষয়টি তার কাছে অজানাই থেকে যায়। কিন্তু তাদের চোখ খোলা থাকতে পারে। যদিও দেখে মনে হতে পারে মদ্যপান বা ঘুমের কারণে ঢুলছেন।
গবেষণায় দেখা যায় যে, স্লিপওয়াকিং এর সময়কাল সর্বনিম্ন ৩০ সেকেন্ড থেকে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট পর্যন্ত হয়ে থাকে। সাধারণত রাতের প্রথম তৃতীয়ার্ধে এই সমস্যাটি ঘটতে দেখা যায়। কারণ এই সময়ই ঘুম গভীর হতে থাকে এবং যদি এই ধরণের অবস্থার সৃষ্টি হয়েই থাকে তবে প্রতি রাতে একবারই হয়।
স্লিপওয়াকিং-কে ২টি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম ক্ষেত্রে আছে ঘুমের ভেতর চলাফেরার করার সাথে সাথে ঘুম সংক্রান্ত খাওয়া-দাওয়া (Sleep-eating)। এই ক্ষেত্রে ঘুমের ভেতরই ব্যক্তি খাওয়া-দাওয়া করতে পারে। ধারণা করা হয় অতিরিক্ত মানসিক চিন্তা করা বা ঘুমের ওষুধ (যেমন Ambien) ব্যবহারের কারণে এ ধরণের সমস্যা হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে রান্না করে খাওয়ারও প্রবণতা দেখা যায়। দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্ষেত্রে দেখা যায় ঘুমের ভেতর ঘুম সংক্রান্ত যৌন আচরণ (বা sexsomnia)।
পরিসংখ্যান কী বলে?
পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ৫ থেকে ১২ বছর বয়সের শিশুদের মধ্যে প্রায় ১৫% শিশুই ঘুমের ভেতর ভ্রমণ করে এবং কারো কারো ক্ষেত্রে এই সমস্যা আস্তে আস্তে প্রকট হতে থাকে। পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৮-১৯% মানুষই স্লিপওয়াকার (Sleepwalker), যাদের মধ্যে শিশু-কিশোর এবং পূর্ণবয়স্ক মানুষ আছে- প্রায় ৬.৯% মেয়ে শিশু, ৫.৭% ছেলে শিশু, ৩.১% পূর্ণবয়স্ক মহিলা এবং ৩.৯% পূর্ণবয়স্ক পুরুষ। সবথেকে বেশি স্লিপওয়াকিং এর রেকর্ড আছে ১১ থেকে ১২ বছর বয়সের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে, যা প্রায় ১৬.২%।
গবেষণায় দেখা যায় শিশু (যাদের বয়স ২ থেকে ১২ বছর) ও প্রাপ্তবয়স্করা রাতের ৮০%-ই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে, যেখানে ২ বছর বা তার কম বয়সের বাচ্চাদের (Infant) ক্ষেত্রে এই পরিমাণ ৫০%। দুশ্চিন্তাজনিত কারণে কোনো মানুষের স্লিপওয়াকিং-এর সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা সাধারণ মানুষের থেকে ৩.৫ গুণ হয়ে থাকে।
স্লিপওয়াকিং এর কারণ
স্লিপওয়াকিং এর সঠিক কারণ জানা এখনও সম্ভব না হলেও গবেষক ও চিকিৎসকের ধারণমতে বেশ কয়েকটি কারণ পাওয়া যায়। যদিও কারণগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে এখনো প্রমাণিত নয়। অর্থাৎ এই কারণগুলো এখনো প্রকল্পিত (Hypotheses) হিসেবে ধরে নেয়া হয়। ধারণা করা হয় সঠিক সময়ে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের পূর্ণতার অভাবে এই সমস্যা হতে পারে। এই সমস্যা প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে শিশুদের মধ্যে বেশি লক্ষ্য করা যায়।
স্লিপওয়াকিং-কে গবেষকরা তৃতীয় পর্যায়ের (Stage-3) Rapid Eye Movement (REM) Disorder ধরণের ঘুমের কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। REM ঘুমের সময় সাধারণত আমরা স্পষ্টভাবে স্বপ্ন দেখে থাকি। এই সময়ে মস্তিষ্কের মোটর অংশ বাঁধাপ্রাপ্ত হয় এবং এর ফলে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো হঠাৎ ঝাঁকি খায় যা পরবর্তীতে জটিল গতিবিধির সৃষ্টি করে। এতে করে ব্যক্তি তার স্বপ্ন অনুযায়ী অবচেতনভাবে হাঁটাচলা করে থাকে। আবার শিশুদের ক্ষেত্রে Stage-3 তে বৃদ্ধি হরমোন নিঃসৃত হয়ে থাকে। যতই বয়স বাড়ে, এই হরমোন নিঃসরণের পরিমাণ তত কমে যেতে থাকে। মূলত শিশুদের ক্ষেত্রে এই Stage-3 হরমোনের কারণেই স্লিপওয়াকিং এর মাত্রা বেশি দেখা যায়।
আরো জানা যায় যে, এই সমস্যাটি বংশানুক্রমিক ভাবে প্রবাহিত হতে পারে, অর্থাৎ জীনগত হয়ে থাকে। যেমন কোনো ব্যক্তির পিতা-মাতা, ভাই অথবা বোনের যদি এই সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে ওই ব্যক্তির স্লিপওয়াকিং এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সাধারণ মানুষের থেকে ১০ গুণ বেশি হয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে প্রায় ৪৫% শিশু যারা স্লিপওয়াকিং এ আক্রান্ত, তাদের পিতা-মাতার যেকোনো একজন এই সমস্যায় আক্রান্ত। এই পরিমাণ ৬০% পর্যন্ত হতে পারে যদি পিতা-মাতার দুজনই স্লিপওয়াকিং সমস্যায় ভোগে।
কিন্তু কেবল জীনগত কারণেই যে এই সমস্যা দেখা দেবে এমন না। বাহ্যিক পরিবেশের প্রভাবে বা মানসিক সমস্যার কারণেও এই সমস্যা হতে পারে। এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আরো কিছু কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- (১) অপর্যাপ্ত ঘুম, (২) বিশৃঙ্খল পরিবেশে ঘুমানো, (৩) অতিরিক্ত অবসাদ, (৪) মদ্যপান, (৫) ঘুমের ওষুধ সেবন ইত্যাদি। কতিপয় ক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যাও এই সমস্যার সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকতে পারে। যেমন- (১) হৃদস্পন্দনজনিত সমস্যা, (২) অতিরিক্ত জ্বর, (৩) রাত্রিকালীন অ্যাজমা বা হাঁপানি বা হৃদরোগের সমস্যা, (৪) ঘুমানোর সময় দম আটকে যাওয়ার সমস্যা কিংবা (৫) মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা (যেমন ভয়ভীতি)
উপসর্গ
স্লিপওয়াকিং এর সমস্যা মূলত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন অবস্থায় হয়ে থাকলেও কখনো কখনো হালকা ঘুমের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। অনেকে আবার একে অ্যালকোহল বা মাদক সেবনজনিত সমস্যার সাথে মিলিয়ে ফেলেন। কারণ সেক্ষেত্রেও স্মৃতিবিলোপের (amnesia) সম্ভাবনা থেকে থাকে যা স্লিপওয়াকিং এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। তবে মাদক সেবনজনিত সমস্যার ক্ষেত্রে ব্যক্তির চেতনা থাকে অনেকখানি, ফলে সহজেই সে সাড়া দিতে পারে।
যেহেতু স্লিপওয়াকিং এ আক্রান্ত ব্যক্তির ঘুমন্ত অবস্থায় ভ্রমণকালের কোনো স্মৃতি থাকে না, ফলে সে হয়তো কখনো কখনো জানতেই পারে না তার সমস্যা কি। এক্ষেত্রে রোগ ধরবার উপায় কেবল পাশের মানুষটিরই থাকে, অর্থাৎ পিতা-মাতা বা সাথে থাকা বন্ধুই সমস্যাটি জানতে পারে।
এই ব্যাধির উপসর্গ খুব সহজে চিহ্নিতও করা যায় না। কারণ ঘুমিয়ে থাকলেও তার চলাফেরা স্বাভাবিক মানুষের মতো হয়ে থাকে এবং একই সাথে চোখ খোলা থাকে। তবে ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, চোখজোড়া ঘুমে অনেকটাই আচ্ছন্ন এবং খুব সম্ভবত চোখের পলক পড়ে না। এই অবস্থায় তাকে কোনো প্রশ্ন করা হলে সাড়া পাওয়া যায় না বা সাড়া পাওয়া গেলেও সাড়া দিতে অনেক সময় নিয়ে থাকে।
যাদের এই সমস্যা খুব পুরাতন হয়ে যায়, তারা বেশ তাড়াতাড়িই জেগে ওঠে। কিন্তু যারা এই সমস্যায় নতুন আক্রান্ত হয়, তারা সহজে জেগে উঠতে পারে না। স্লিপওয়াকিং এর সময়ে আরো কিছু লক্ষণ দেখা যায় যার মধ্যে আছে (১) ঘুমের ভেতর কথা বলা, (২) অযাচিত আচরণ যেমন বিছানায় প্রস্রাব করা (যেহেতু সমস্যাটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে) কিংবা (৩) ঘুমের ভেতরই চিৎকার করা ইত্যাদি।
চিকিৎসা বা প্রতিকার
সাধারণত স্লিপওয়াকিং এর প্রতিরোধ বা প্রতিকারের জন্য এখনো কোনো সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি নেই। তবে স্বাস্থ্যকরভাবে ও নিয়ম মেনে সঠিক সময়মতো পর্যাপ্ত ঘুমের অভ্যাস করলে আস্তে আস্তে এই সমস্যা থেকে মুক্তি লাভ হতে পারে। যদি কেউ উপলব্ধি করে যে, তার স্লিপওয়াকিং এর সমস্যা দেখা দিচ্ছে, তাহলে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে পারে।
আবার মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা এই সমস্যার প্রতিকারে মনোবিশ্লেষণ পদ্ধতি বা সম্মোহন পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন। বয়ঃপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে সাধারণত এই সমস্যার সমাধান হিসেবে সম্মোহন (Hypnosis) পদ্ধতিরই আশ্রয় নেয়া হয়। আবার তারা (মনস্তত্ত্ববিদেরা) নিয়ম করে রাতে ঘুম ভাঙ্গা (Anticipatory waking) যেন স্লিপওয়াকিং এর সুযোগ না থাকে, মনকে কেন্দ্রীভূত করতে যোগব্যায়াম (Meditation) ইত্যাদির পরামর্শও দিয়ে থাকেন।
যেহেতু অতিরিক্ত অবসাদ বা দুশ্চিন্তা থেকে এই সমস্যা হতে পারে, ফলে সেক্ষেত্রে অবসাদ বা চিন্তামুক্ত হলেই এই সমস্যা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অবশ্য এক্ষেত্রে ফার্মাকোলজিক্যাল থেরাপি হিসেবে Sedative-hypnotics বা Anti-depressants ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয় যেখানে প্রথমটি প্রশান্তিমূলক ঘুমের জন্য এবং দ্বিতীয়টি দুশ্চিন্তা থেকে ব্যক্তিকে মুক্ত রাখার জন্য কার্যকর।
স্লিপওয়াকিং সম্পর্কিত কতিপয় ঘটনা
স্লিপওয়াকিং এর কারণে ব্যক্তির আহত হওয়ার সম্ভাবনা যেমন থাকে, তেমনি অন্য ব্যক্তির জন্যও তা মাঝেমধ্যে বিড়ম্বনার কারণ হতে পারে। এই সমস্যা কখনো কখনো খুন পর্যন্তও গড়াতে পারে। ফলে সহজেই স্লিপওয়াকিং-কে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অ্যালীবাই হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কারণ সেক্ষেত্রে স্লিপওয়াকিং-এর জন্য যেমন উপসর্গ নিরূপণের কোনো সঠিক উপায় নেই, তেমনি এর বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট আইন-কানুনও নেই।
১৯৬৩ সালে উত্তর আয়ারল্যান্ডের একজন বিচারক, লর্ড মরিস (John William Morris) স্লিপওয়াকিং এর বিষয়ে একটি আইন প্রণয়ন করেন, যেখানে বলা আছে যে প্রত্যেকটি ঘটনার ক্ষেত্রে সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু যদি এমন প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ব্যক্তি অপরাধমূলক কাজের সময়ে স্লিপওয়াকিং অবস্থায় ছিলো অর্থাৎ অবচেতন ছিলো, তাহলে তাকে সেই অপরাধের দায় থেকে মুক্ত করা হবে।
উদাহরণ হিসেবে কিছু ঘটনার কথা বলা যায় যেখানে স্লিপওয়াকিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে-
১) ১৮৪৬ সালে অ্যালবার্ট টিরেল (Albert Tirrell) নামক ব্যক্তি মারিয়া বিকফোর্ড নামক বোস্টন পতিতালয়ের একজন পতিতার খুনের মামলার ডিফেন্স হিসেবে স্লিপওয়াকিং এর কথা তুলে ধরে এবং অবশেষে মুক্তি পায়। যদিও মারিয়ার সাথে টিরেলের প্রণয়ের সম্পর্ক ছিলো, যার জন্য টিরেল তার স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। টিরেলই প্রথম ব্যক্তি যে মামলার ডিফেন্স হিসেবে স্লিপওয়াকিং-এর কথা আনে।
২) ১৯৮১ সালে স্টিভেন স্টেইনবার্গ (Steven Steinber) নামক ব্যক্তিকে তার স্ত্রীকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত করা হলেও ডিফেন্স হিসেবে স্লিপওয়াকিং-কে দাঁড় করালে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়।
৩) ১৯৯১ সালে বার্গেস (Burgess) নামক ব্যক্তিকে তার প্রেমিকার মাথায় ওয়াইনের বোতল দ্বারা আঘাত করার ঘটনায় অভিযুক্ত করা হলেও সিসি ক্যামেরা ফুটেজে তার অবচেতন ব্যবহার বা নিদ্রাভ্রমণ এর প্রমাণ পেয়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
৪) ১৯৯২ সালে কেনেথ পার্কস (Kenneth Parks) নামক ব্যক্তি তার শাশুড়িকে খুন করা ও শ্বশুরকে খুন করতে উদ্যত হওয়ার কারণে এবং আহত করার কারণে গ্রেপ্তার করা হলেও পরে মুক্ত করা হয়। ২০ বছর বয়সে পার্কস তার চাকরি হারানোর পর ইনসোমনিয়াতে ভুগতে শুরু করে এবং জুয়াতে আসক্ত হয়। যদিও তার স্ত্রী ও শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে তার সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো ছিলো এবং তার স্ত্রী তার পক্ষেই ছিলো।
৫) মধ্যবয়সী এক অস্ট্রেলীয়ান নারীও (গোপনীয়তার কারণে তার নাম অদ্যাবধি প্রকাশ করা হয় নি) এই সমস্যায় ভুগতো। যদিও তার কোনো খুনের ইতিহাস নেই। তবে তার ঘটনা অন্যরকম। সে প্রতি রাতেই ঘুমের ভেতর ঘর থেকে বের হয়ে যেত এবং একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তির সাথে যৌনতায় লিপ্ত হতো। কিন্তু সে নিজে, তার স্বামী বা সেই আগন্তুক কেউই বিষয়টা আন্দাজ করতে পারে নি। পরবর্তীতে একদিন তার স্বামীর ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর তার স্ত্রীকে খুঁজতে গিয়ে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে।
৬) এছাড়া লেসলি কুস্যাক (Lesley Cusack) নামক এক মহিলার ঘুমের ভেতর রান্না করা এবং খাওয়ার (Sleep eating) ঘটনাও পাওয়া যায়। ভদ্রমহিলা নিজের ফিটনেস ধরে রাখতে ডায়েট করতেন। কিন্তু রাতে ঘুমের ভেতরই তিনি প্রায় ২,৫০০ ক্যালোরির মতো খাবার খেয়ে ফেলার ইতিহাস তৈরী করেন। তবে যেটা ভয়ের সেটা ছিলো ঘুমের ভেতর তার রান্না করা। কারণ সারা রাত গ্যাসের চুলা জ্বালানো থাকতো।
৭) ১৯৯৪ সালে রিক্সজার (Ricksger) এবং ১৯৯৯ সালে ফালাটার (Falater) নামক ব্যক্তিদের ঘুমের ভেতর তার স্ত্রীকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয় এবং যাবজ্জীবন কারাবাস দেয়া হয়। এক্ষেত্রে তাদের কাউকেই মুক্তি দেয়া হয় নি।
৮) ১৯৯৮ সালে জেমস কারেন (James Currens) নামক এক ব্যক্তি ঘুমের ভেতরই হাতে তার লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু যখন তার ঘুম ভাঙে, তখন সে নিজেকে কোনো এক পুকুরে বুকজলে আবিষ্কার করে, যেখানে সে কাদায় আটকে পড়েছিলো। তবে ভয়ংকর ব্যাপার তখনই হলো যখন সে আবিষ্কার করলো যে, সে কয়েকটি কুমির দ্বারা বেষ্টিত। যদিও পুলিশের আগমনে সেই যাত্রায় বেঁচে যায় কারেন।
৯) ২০০৩ সালে জ্যান লুডেক (Jan Luedecke) নামক এক ব্যক্তিকে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। জ্যান কোনো একটি পার্টিতে উপস্থিত ছিলো এবং অতিরিক্ত মদ্যপানের একপর্যায়ে সে ঘুমিয়ে পড়ে। কয়েক ঘন্টা পর যখন সে ওঠে তখন পার্টিতে উপস্থিত এক মহিলাকে সে ধর্ষণ করে। যদিও সে বলে যে সে এই ব্যাপারে কিছুই জানে না কারণ সে তখনও ঘুমের ভেতর ছিলো।
১০) ২০০৮ সালে ব্রায়ান থমাস (Brian Thomas)-কে তার স্ত্রীকে হত্যার দায়ে আটক করা হয়। তার ভাষ্যমতে সে স্বপ্নে দেখছিলো যে কেউ একজন তার ঘরে অনধিকার প্রবেশ করছে এবং সে তাকে হত্যা করেছে। আদালত তাকে মুক্তি দেয়।
১১) সর্বশেষ টিমোথি বার্গম্যান (Timothy Brueggeman) নামক ব্যক্তি ঘুমের ভেতরই তার পিক-আপ ভ্যানটি চালিয়েছিলো এবং অবশেষে একটি গাছের সাথে ধাক্কা লাগিয়ে দিয়েছিলো। এই সময় সে Ambien নামক ঘুমের ওষুধ সেবন করেছিলো। যদিও টিমোথি সে যাত্রায় বেঁচে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে ২০০৯ এর জানুয়ারীতে কোনো এক রাতে সে শুধুমাত্র আন্ডারওয়্যার পরেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পরদিন তাকে বরফের ভেতর মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
স্লিপওয়াকিং-এর জন্য অদ্যাবধি কোনো সম্পূর্ণ ফলপ্রসূ চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার হয় নি। কারণ ব্যক্তি নিজেও কখনো টের পান না যে আসলে তার ঘুমের ভেতর কি হচ্ছে। তবে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ছেড়ে বা ঘুমের প্রতি নিয়মানুবর্তী হলেই অনেকাংশে এই সমস্যা থেকে দূরে থাকা সম্ভব। নতুবা নিজেই না কবে ঘুমিয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে উল্টে যাবেন কিংবা খুনই না করে ফেলবেন কবে কাকে!