১
সমস্যাটা প্রথম ধরা পড়ে সেই ১৯৩৭ সালে। সুইস-আমেরিকান জ্যোতিঃপদার্থ বিজ্ঞানী ফ্রিৎজ জুইকি আমাদেরকে ‘হারানো ভরের সমস্যা‘র সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ভদ্রলোক একটি বিশাল ক্লাস্টারের (একসাথে অনেকগুলো গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ মিলে তৈরি) মধ্যকার ছায়াপথগুলোর গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। মিল্কিওয়ে থেকে অনেক দূরের এই ক্লাস্টারটিকে ‘কোমা বার্নেসিস’ তারকামন্ডল অনুসরণ করে খুঁজে বের করা যায়। তাই এর নাম দেয়া হয়েছে কোমা ক্লাস্টার।
হাজার হাজার ছায়াপথ এই ক্লাস্টারের কেন্দ্রকে ঘিরে এমনভাবে ঘুরে চলেছে যে, দেখে মনে হবে বুঝি অনেকগুলো মৌমাছি একসাথে একটি মৌচাকের দিকে ছুটে যাচ্ছে। মোটামুটি কয়েক ডজন ছায়াপথের গতি ব্যবহার করে, কী পরিমাণ মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র পুরো ক্লাস্টারটিকে বেঁধে রেখেছে তা হিসাব করতে গিয়ে জুইকি আবিষ্কার করলেন, ছায়াপথগুলোর গড় গতিশক্তি অদ্ভুত রকমের বেশি!
যেহেতু প্রচন্ড মহাকর্ষীয় শক্তির আকর্ষণের ফলে কোনো বস্তুর গতিবেগ অনেক বেড়ে যেতে পারে, এই প্রচন্ড মহাকর্ষের পেছনের কারণ হিসেবে কোমা ক্লাস্টারের ভরকে ধরে নিয়ে এর পরিমাণ হিসেবে জুইকি বিশাল এক সংখ্যা অনুমান করে নিলেন। এর বাস্তবতা পরীক্ষা করার জন্য ক্লাস্টারের দৃশ্যমান সকল ছায়াপথের ভর যোগ করে হিসেব করে জুইকি দেখলেন, সব কিছুর ভর মিলেও এই প্রবল গতির জন্য প্রয়োজনীয় মহাকর্ষ সৃষ্টির মতো যথেষ্ট ভর হচ্ছে না।
মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে জুইকির পরীক্ষা থেকে জানা গেল, এই ক্লাস্টারের সবগুলো গ্যালাক্সি তাদের মুক্তিবেগের চেয়েও বেশি বেগে ছুটছে। সহজ কথায়, মুক্তিবেগ মানে মহাকর্ষের বাঁধন ছিন্ন করে সরল রেখা ধরে কক্ষপথ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বেগ। হিসাব অনুযায়ী, পুরো ক্লাস্টারটিরই অন্য কোনো দিকে ছুটে চলে যাওয়া উচিত ছিল। কয়েকশত মিলিয়ন বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর, এর যে আদৌ কোনো কালে কোনো অস্তিত্ব ছিল এমন কোনো চিহ্নও অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। অথচ ক্লাস্টারটির বয়স প্রায় দশ বিলিয়ন বছরের মতো এবং সেটি এখনো দিব্যি টিকে আছে! এভাবেই জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে পুরনো অমীমাংসিত রহস্যটির জন্ম হলো।
২
এই সমস্যার সমাধান তখন বের করা সম্ভব হয়নি। এদিকে জুইকির কাজের পর অন্যান্য যেসব ক্লাস্টার আবিষ্কৃত হয়েছে, দেখা গেলো এদের মাঝেও একই জিনিসই ঘটছে। কাজেই কোমা ক্লাস্টারকে যে অদ্ভুত কিছু বলে দায়ী করে ঘটনার ইতি টানা যাবে, সে উপায়ও নেই। ঝামেলাটা তাহলে কোথায়? মহাকর্ষ তত্ত্ব কি আমাদেরকে ভুল হিসেব দিচ্ছে? কিন্তু আমাদের সৌরজগতের ভেতরে তো এই তত্ত্ব ঠিকভাবেই কাজ করছে! নিউটনের মহাকর্ষেরই পরিমার্জিত রূপ হলো আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব। বিশাল ভরের বস্তুদের জন্য এই তত্ত্ব ব্যবহার করে মহাকর্ষের কাজকর্ম ব্যাখ্যা করা যায়। সমস্যা হলো, ক্লাস্টারগুলোর প্রবল মহাকর্ষ এখনও এত বিশাল পরিমাণে গিয়ে পৌঁছায়নি, যে পরিমাণ মহাকর্ষ বলের জন্য আইনস্টাইনের তত্ত্বকে ঠিকভাবে প্রয়োগ করে পরীক্ষা করে দেখা যায়।
শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা একটি সম্ভাবনার কথা ভেবে নিলেন। হয়তো কোমা ক্লাস্টারের গ্যালাক্সিগুলোকে বেঁধে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ‘অধরা ভর’- এর আসলেই অস্তিত্ব আছে। এরা এমনভাবে আছে, যা শনাক্ত করার মতো প্রযুক্তি আমাদের কাছে নেই। হয়ত এজন্যই এরা এখনও আমাদের কাছে অদৃশ্য। এদের নাম দেয়া হল ‘ডার্ক ম্যাটার’। এই কথাটি দিয়ে বোঝানো হয়, ক্লাস্টারগুলোতে আসলে ভরের কোনো ঘাটতি নেই, বরং এমন কোনো এক পদার্থের অস্তিত্ত্ব অবশ্যই আছে, যাদেরকে আমরা এখনো আবিষ্কার করতে পারিনি।
৩
ততদিনে বিজ্ঞানীরা ক্লাস্টারের ভেতরে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ত্বের কথা মোটামুটি মেনে নিয়েছেন। কারণ, হিসেব নিকেশ বলছে- জিনিসটি যা-ই হোক, কিছু একটা অবশ্যই আছে এখানে। ঠিক এরকম সময় নতুন করে সমস্যাটা আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।
১৯৭৬ সালে বিজ্ঞানী ভেরা রুবিন ছায়াপথগুলোর ভেতরেও একইরকম ভরের গড়মিল আবিষ্কার করলেন।
ছায়াপথের মধ্যে নক্ষত্ররা যে বেগে ছায়াপথের কেন্দ্রকে ঘিরে নিজের কক্ষপথ ধরে ছুটে চলে, সেই হিসেবে যে নক্ষত্র কেন্দ্র থেকে যতদূরে, তার বেগও তত বেশি হওয়ার কথা। কারণ, যে নক্ষত্র কেন্দ্র থেকে যত দূরে, তাদের মাঝখানে মহাকর্ষীয় বলের টানকে বাধা দেয়ার মতো পদার্থ (অন্যান্য নক্ষত্র এবং গ্যাসমেঘ) তত বেশি থাকে, ফলে তারা দ্রুত বেগে ছুটতে পারে।
গ্যালাক্সির উজ্জ্বল ডিস্কের বাইরেও অল্প কিছু বিচ্ছিন্ন গ্যাসমেঘ এবং উজ্জ্বল নক্ষত্র খুঁজে পাওয়া যায়। এদেরকে ট্রেসার হিসেবে ব্যবহার করে গ্যালাক্সির উজ্জ্বল অংশের বাইরের বেশিরভাগ এলাকার মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র পরিমাপ করে ফেলা যায়, যেসব এলাকায় গ্যালাক্সির মোট ভরের সাথে যোগ করার মতো আর কোনো দৃশ্যমান ভরের বস্তুকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তো, এই দূরের নক্ষত্ররা যেহেতু দিন দিন তাদের গতিশক্তি ব্যবহার করে কেন্দ্র থেকে আরো দূরে সরে যাচ্ছে, এতদিনে তাদের ‘কেন্দ্রমুখী বেগ’ কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু রুবিন দেখলেন, এদের কেন্দ্রমুখী বেগ এখনও আগের মতোই প্রবল।
মহাশূন্যের এই বিশাল খালি অংশটুকুতে- প্রতিটি গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে অনেক দূরের সীমানাবর্তী এই অঞ্চলগুলোতে বলতে গেলে তেমন কোনো দৃশ্যমান ভরের বস্তুই নেই, যার জন্য এই ট্রেসার নক্ষত্রদের কক্ষীয় বেগ এত বেশি হতে পারে। কাজেই, যৌক্তিকভাবেই রুবিন সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন, গ্যালাক্সির দৃশ্যমান অঞ্চল যেখানে শেষ, তারপর থেকে শুরু হওয়া সীমানাবর্তী অঞ্চলগুলোতে নিশ্চয়ই কোনো ধরনের ডার্ক ম্যাটার আছে। রুবিনের কাজের বদৌলতে আমরা এখন প্রতিটি গ্যালাক্সির এই অঞ্চলগুলোকে বলি ‘ডার্ক ম্যাটার হ্যালোস’।
বাতির নিচে অন্ধকারের মতো এই হ্যালো বা চক্র সমস্যা আমাদের নাকের একেবারে নিচে, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেও দেখা যায়। ছায়াপথ বলি, কিংবা ক্লাস্টার— দৃশ্যমান বস্তু থেকে হিসেব করে পাওয়া ভর আর বিদ্যমান মহাকর্ষ বলের জন্যে প্রয়োজনীয় ভরের পরিমাণের পার্থক্য কয়েকগুণ থেকে শুরু করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শত শতগুণও হয়। স্থানকাল ভেদে এই পরিমাণ একেক ক্ষেত্রে একেকরকম হয়, তবে পুরো মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে বিবেচনা করলে গড় হিসেবে এই পার্থক্য হয় ৬ গুণের মতো।
অর্থাৎ, মহাকাশে লুকিয়ে থাকা ডার্ক ম্যাটারের জন্য সৃষ্ট মহাকর্ষ বলের পরিমাণ আমাদের কাছে দৃশ্যমান বস্তুর জন্য সৃষ্ট মহাকর্ষ থেকে ছয় গুণ বেশি।
৪
মহাবিশ্ব জন্মের অর্ধ মিলিয়ন বা পাঁচ লাখ বছর পরের সময়টার কথা একটুখানি ভেবে দেখা যাক। ১৪ বিলিয়ন বছরের হিসেবে বলতে গেলে, একবার চোখের পলক ফেলতে যে সময় লাগে, মহাবিশ্ব কেবল সেটুকু সময় পেরিয়ে এসেছে। সে সময়ের মহাবিশ্বে যে পদার্থরা ছিল, তারা কেবল বুদবুদের মতো জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। সময়ের হাত ধরে এই বুদবুদগুলো একসময় ছায়াপথ, ক্লাস্টার এবং সুপারক্লাস্টারে পরিণত হবে। কিন্তু পরবর্তী অর্ধ মিলিয়ন বছরের মধ্যে মহাবিশ্বের আকার বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাবে, এবং প্রতি মুহুর্তে সেটি বাড়তেই থাকবে। এর মানে, সে সময়ের মহাবিশ্বে দুটি শক্তির মাঝে এক বিচিত্র যুদ্ধ চলছে: একদিকে মহাকর্ষ সবকিছুকে টেনে জমাট বাঁধিয়ে ফেলতে চাচ্ছে, অন্যদিকে বিস্ফোরণ পরবর্তী শক্তির টানে প্রতিমুহুর্তে বেড়ে চলা মহাবিশ্ব চাইছে সবকিছু আরো দূরে সরে যাক, আরো দূরে।
একটুখানি গাণিতিক হিসেব নিকেশ কষলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন, সাধারণ পদার্থের ভর থেকে সৃষ্ট মহাকর্ষ একা এই যুদ্ধ কোনোভাবেই জিততে পারতো না। জেতার জন্য সাহায্য চাই, ডার্ক ম্যাটারের সাহায্য। এবং সে সময় ডার্ক ম্যাটারের সাহায্য না পেলে আমরা এমন এক মহাবিশ্ব পেতাম, যে মহাবিশ্বে কোনো অবকাঠামো বা স্ট্রাকচারের অস্তিত্ব থাকতো না। আসলে ‘আমরা পেতাম’ না, আমাদেরই তো কোনো অস্তিত্ব থাকত না! কাজেই, সে মহাবিশ্বে থাকত না কোনো ক্লাস্টার কিংবা গ্যালাক্সি, গ্রহ-নক্ষত্র কিংবা মানুষ- কিচ্ছু থাকতো না।
সাধারণ পদার্থ থেকে সৃষ্ট মহাকর্ষের তাহলে ডার্ক ম্যাটারের কাছ থেকে কতটুকু মহাকর্ষ সাহায্য হিসেবে দরকার পড়েছিল? সাধারণ পদার্থ থেকে সৃষ্ট মহাকর্ষের ছ’গুণ!
মনে আছে, আমরা আগেই হিসেব করে দেখেছিলাম, বর্তমান মহাবিশ্বে ডার্ক ম্যাটার থেকে ঠিক এই পরিমাণ মহাকর্ষই পাওয়া যায়? এটা মোটেও কাকতালীয় ঘটনা নয়। হ্যাঁ, এই বিশ্লেষণ থেকে ডার্ক ম্যাটার আসলে কী, সেটা জানা যায় না। কিন্তু ডার্ক ম্যাটারের প্রভাব যে একশত ভাগ বাস্তব, সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়। কারণ, যতভাবেই চেষ্টা করেন না কেন, সে সময়ের ঐ যুদ্ধে জেতার কৃতিত্ব আপনি সাধারণ পদার্থকে দিতে পারবেন না।
৫
‘ডার্ক ম্যাটার’ কথাটার বাংলা হলো ‘গুপ্তবস্তু’। এ থেকে ব্যাপারটি আরো ভালোভাবে অনুভব করা যায়। আমরা জানি না, জিনিসটা কী, সেটা কেমন কিংবা কীভাবে কাজ করে, কিন্তু লুকিয়ে থাকা একটা কিছু অবশ্যই আছে। ভবিষ্যতে সেটার ধরন বা বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার হতে পারে, হয়তো জানা যেতে পারে জিনিসটি আদৌ পদার্থ বা ম্যাটার না (যদিও, এই গুপ্তবস্তু মহাকর্ষ সৃষ্টি করে। এবং বিজ্ঞানের যেকোনো শিক্ষার্থীই জানে, মহাকর্ষ সৃষ্টি হয় ভরের জন্য)। কিন্তু, সেটা যা-ই হোক, এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত যে, একটা কিছু অবশ্যই আছে। যেহেতু জিনিসটি লুকিয়ে আছে, এখনো ধরা দেয়নি, কাজেই তার নাম দেয়া হয়েছে গুপ্তবস্তু বা ডার্ক ম্যাটার।
৬
গত একশত বছরের চারভাগের প্রায় তিনভাগ সময় ধরে ডার্ক ম্যাটারকে শনাক্ত করার যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়েছে, এবং এখনো হচ্ছে। এখন, কণা পদার্থবিজ্ঞানীরা একটা ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত: ডার্ক ম্যাটারের মধ্যে এখনো অনাবিষ্কৃত এমন ধরনের কণারা আছে, যারা সাধারণ পদার্থের সাথে মহাকর্ষের মাধ্যমে মিথষ্ক্রিয়া করে। এছাড়া আর কোনোভাবে এরা পদার্থ কিংবা আলোর সাথে হয় একেবারেই মিথষ্ক্রিয়া করে না, আর নাহয় করলেও খুবই দুর্বলভাবে করে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পার্টিকেল এক্সেলারেটর বা কণা ত্বরক যন্ত্রগুলো নানা ধরনের কণার মাঝে সংঘর্ষ ঘটিয়ে ডার্ক ম্যাটারের কণা উৎপন্ন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এদিকে, বিশেষভাবে ডিজাইন করা মাটির নিচের গবেষণাগারগুলোতে পরোক্ষভাবে ডার্ক ম্যাটারের কণা শনাক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যদি অন্যান্য কণার মতো গুপ্তবস্তুর কণা মহাকাশ থেকে কোনোভাবে পৃথিবীতে ছুটে চলে আসে, তাহলে যেন তাদেরকে শনাক্ত করা যায়। এই গবেষণাগারগুলো মাটির নিচে স্থাপন করার কারণ, আমাদের জানা কোনো মহাজাগতিক কণা যেন গুপ্তবস্তুর ছদ্মবেশে ডার্ক ম্যাটার কণা শনাক্তকারী যন্ত্রকে ধোঁকা দিতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করা। পৃথিবীপৃষ্ঠ প্রাকৃতিকভাবেই এই সুরক্ষা দেয় গবেষণাগারগুলোকে।
হ্যাঁ, হতে পারে এর সবই অহেতুক ঝামেলা, দিনশেষে হয়তো এর কোনোটিই কোনো কাজে আসবে না। কিন্তু, ছলনাময়ী গুপ্তবস্তুর কণার কথা ভেবেচিন্তে সেটা শনাক্ত করার একটা কিছু ব্যবস্থা করে রাখাটা আসলে প্রয়োজন। এর সবচেয়ে ভাল উদাহরণ নিউট্রিনো।
এরা সাধারণ কণার সঙ্গে খুবই সামান্য পরিমাণ মিথষ্ক্রিয়া করে। তারপরও এদের কথা অনুমান করে সেই হিসেবে আইসকিউব অবজারভেটরি নির্মাণের পরে একসময় এদেরকে ঠিকই শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যাবে এখানে।
ডার্ক ম্যাটারের কণাও হয়তো এমন বিরল কোনো মিথষ্ক্রিয়ার ফলে ধরা দিতে পারে। কিংবা হয়তো নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশ করতে পারে শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল, দুর্বল নিউক্লিয়ার বল কিংবা তড়িৎচৌম্বক বল ছাড়া ভিন্ন কিছুর মাধ্যমে। এই তিনটি বল আর মহাকর্ষ- এরাই হচ্ছে মহাবিশ্বের চারটি মৌলিক বল, যাদের মাধ্যমে আমাদের জানা সকল কণা নিজেদের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া করে।
অর্থাৎ, উপায় কেবল দুটো। হয় ডার্ক ম্যাটারের কণাকে শনাক্ত করার জন্যে আমাদেরকে আগে নতুন কোনো একটি বল বা এক শ্রেণীর বলকে আবিষ্কার করতে হবে এবং তাকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায় বুঝে নিতে হবে, যার মাধ্যমে ডার্ক ম্যাটারের কণারা মিথষ্ক্রিয়া করে; অথবা ডার্ক ম্যাটারের কণারা সাধারণ বলগুলোর মাধ্যমেই খুব, খুবই দুর্বলভাবে মিথষ্ক্রিয়া করে এবং সেই হিসেবেই আমাদের একে শনাক্ত করতে হবে।
তবে, ডার্ক ম্যাটারের যে প্রভাব আছে, সেটি নিখাদ বাস্তব। আমরা কেবল জানি না, জিনিসটা আসলে কী।
পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায়, ডার্ক ম্যাটার মহাকর্ষ সৃষ্টি করে এবং এর প্রভাব আমাদের জানা সাধারণ পদার্থদের উপরেও পড়ে। ব্যাস, এটুকুই। এত এত বছর পরেও আমরা একে আর কিচ্ছু করতে দেখিনি, কিংবা তেমন কিছু আবিষ্কার করতে পারিনি।
৭
মহাবিশ্বের ইতিহাস প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছরের ইতিহাস, সেখানে আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের পুরো বিপ্লবটুকু হয়েছে মোটামুটি গত দু’শো বছরে। যারা এই লেখাটি পড়ে ভাবছেন, বিজ্ঞানীরা জানেনটা কী!— তাদের জন্য বলি, পৃথিবীর এক কোনায় ছোট্ট একটি ঘরে বসে আমরা চাইলেই সৌরজগতের গ্রহগুলোর গতি-প্রকৃতি হিসেব করে বের করে ফেলতে পারি। নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, ছায়াপথ কিংবা ক্লাস্টাররা ঠিক কী বেগে একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বলতে পারি, মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল ঠিক ১৪ বিলিয়ন বছর আগে! এমনকি, আমাদের পাঠানো মহাকাশযান পেরিয়ে গেছে সৌরজগতের সীমা, ছুটে চলেছে আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাশূন্যের পথ ধরে।
হ্যাঁ, মহাবিশ্বের ৫/৬ ভাগ ভরের প্রকৃতি কিংবা এদের ব্যাপারে তেমন কিছু আমরা জানি না। কিন্তু ১৪ বিলিয়ন বছরের রহস্য, ইতিহাস বনাম মাত্র দু’শো বছর- এটুকু সময়ের মাঝে মাত্র ৩ পাউন্ডের মস্তিষ্ক ব্যবহার করে আমরা যেটুকু জানি, সেটাই কি আমাদেরকে স্বপ্ন দেখানোর জন্য যথেষ্ট না?