মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের পাহাড়চূড়ায় রেসট্র্যাক প্লায়া নামে একটি শুষ্ক হ্রদের অবস্থান। এই শুষ্ক হ্রদে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির এমন কিছু রহস্যময় পাথর আছে, যেগুলো কারো সাহায্য ছাড়াই নিজে নিজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করতে পারে! পাথরগুলোর পেছনে হ্রদের শুষ্ক কাদামাটিতে অনেক দূর পর্যন্ত গভীর দাগ দেখা যায়, যা থেকে মনে হতে পারে, কেউ বুঝি পাথরগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে এত দূরে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আশেপাশে কোনো মানুষের পায়ের ছাপ তো দূরের কথা, অন্য কোনো কিছুরই ছাপ দেখা যায় না!
শুষ্ক হ্রদটির স্বাভাবিক দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার এবং প্রস্থ প্রায় ২ কিলোমিটার। এর অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,১৩০ মিটার উঁচুতে। সেখানে যেতে হলে নিকটবর্তী শহর থেকে উঁচু-নিচু পথে জিপে করে পাড়ি দিতে হয় তিন ঘণ্টার পথ। কিন্তু তারপরও কৌতুহলী মানুষ, গবেষক এবং বিজ্ঞানীরা বারবার সেখানে ছুটে গিয়েছেন পাথরগুলো দেখার জন্য। কিন্তু কেউ কোনো সমাধান করতে পারেননি।
পাথরগুলোকে কেউ কখনো নড়তে দেখেনি, কিন্তু সেগুলো নড়ে ঠিকই। কারণ সময়ের সাথে সাথে সেগুলোর অবস্থান পরিবর্তিত হয় এবং পেছনে নতুন নতুন দাগ তৈরি হয়। স্বভাবতই মানুষ নিজেদের মতো করে এই রহস্যজনক ঘটনার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কারো ধারণা, কোনো কোনো সময় এখানে বিশেষ ধরনের চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়, যার প্রভাবে পাথরগুলো স্থান পরিবর্তন করে। কেউ আবার মনে করে, এগুলো এলিয়েনদের কারসাজি। তারাই মহাকাশ থেকে নেমে এসে পাথরগুলো স্থানান্তর করে দিয়ে আবার চলে যায়। আবার অন্যদের ধারণা, এগুলো কিছু দুষ্টু ছেলের দুষ্টামি ছাড়া আর কিছুই না।
বিজ্ঞানীরাও অন্তত অর্ধশত বছর ধরে এই ভূতুড়ে রহস্যটি নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন, কিন্তু কোনো সমাধান দিতে পারেননি। তাদের অনেকেই অবশ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, এটি হয়তো বাতাস, পানির স্রোত এবং বরফ খণ্ডের ধাক্কার সম্মিলিত প্রভাব হতে পারে। কিন্তু তাদের এই দাবির কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছিল না। অবশেষে একদল বিজ্ঞানী ঠিক করেন, তারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমেই এ রহস্যটির সমাধান করার চেষ্টা করবেন।
২০১১ সালে সমুদ্রবিজ্ঞানী রিচার্ড নরিস এবং তার চাচাতো ভাই, প্রকৌশলী জেমস নরিস ডেথ ভ্যালির রেসট্র্যাক প্লায়াদে যান। তারা সেখানে কিছু ক্যামেরা স্থাপন করে আসেন, যেগুলো নিয়মিত বিরতিতে পাথরগুলোর ছবি তুলে রাখবে। এছাড়াও তারা ঐ স্থানের তাপমাত্রা, বায়ুচাপ, আর্দ্রতা, প্রভৃতি নথিভুক্ত করার জন্য একটি ছোট আবহাওয়া কেন্দ্র স্থাপন করেন। পাথরগুলোর নড়াচড়া লিপিবদ্ধ করার জন্য তারা বিভিন্ন আকারের অনেকগুলো পাথরের গায়ে বিশেষভাবে নির্মিত কিছু জিপিএস ট্র্যাকার সংযুক্ত করে দিয়ে আসেন, যেগুলো পাথরগুলো স্থান পরিবর্তন করলেই সাথে সাথে তা রেকর্ড করে রাখবে।
কিন্তু সমস্যা ছিল, তারা জানতেন না ফলাফলের জন্য তাদেরকে ঠিক কত দিন অপেক্ষা করতে হবে। এই পাথরগুলোর রহস্য নিয়ে তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন গ্রহবিজ্ঞানী র্যাল্ফ লরেঞ্জ, যিনি ২০০৭ সাল থেকেই এই শুষ্ক হ্রদ নিয়ে গবেষণা করছিলেন, অন্যান্য গ্রহের শুকিয়ে যাওয়া হ্রদের পরিবেশ এবং আবহাওয়া সম্পর্কে বোঝার জন্য। কিন্তু জিপিএস প্রযুক্তির মাধ্যমে যে পাথরগুলোর রহস্যের সমাধান করা যাবে, এ ব্যাপারে তার আস্থা ছিল না। তার ধারণা ছিল, পাথরগুলো এতো ধীরে ধীরে নড়াচড়া করে যে, এগুলো পরিমাপ করতে যুগের পর যুগ সময় লেগে যেতে পারে। তিনি বলেন, “আমি ভেবেছিলাম, এটি হতে যাচ্ছে বিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে বিরক্তিকর পরীক্ষা।”
কিন্তু লরেঞ্জের অনুমান ভুল ছিল। যন্ত্রপাতি স্থাপনের দুই বছর পর, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে রিচার্ড এবং নরিস আবার ডেথ ভ্যালিতে যান সেগুলো পরিদর্শন করার জন্য এবং সেগুলোর ব্যাটারি পাল্টে দেওয়ার জন্য। সেখানে গিয়ে তারা অদ্ভুত একটি দৃশ্য দেখতে পান- শুষ্ক হ্রদটির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আবৃত হয়ে আছে বরফের পাতলা চাদরে।
হ্রদটি স্বাভাবিক অবস্থায় পানিশূন্যই থাকে। কিন্তু বছরের কিছু কিছু সময় আশেপাশের উঁচু পাহাড় থেকে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে এসে এখানে জমা হয় এবং কৃত্রিম জলাধারের সৃষ্টি করে। রাতের বেলা যখন তাপমাত্রা শূন্যের নিচে নেমে যায়, তখন সেই পানি জমে বরফে পরিণত হয়।
বরফের স্তর দেখেই রিচার্ড বুঝতে পারেন কী ঘটতে যাচ্ছে। তারা অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে তাঁবু টানিয়ে তারা দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে থাকেন। অবশেষে ২০ ডিসেম্বর তাদের চোখের সামনে হঠাৎ করেই বরফের পাতলা আস্তরণ ভাঙতে শুরু করে। কিছু কিছু স্থানের বরফ গলে যখন শূন্যস্থান তৈরি হয়, তখন মৃদু বাতাসের ধাক্কায় আশেপাশের অপেক্ষাকৃত ছোট বরফখণ্ডগুলো চলাচল করার সুযোগ পায়। চলতি পথে সেগুলো পাথরগুলোকে আস্তে আস্তে ধাক্কা দিতে থাকে। এভাবে বিজ্ঞানী দু’জনের চোখের সামনেই পাথরগুলো খুবই ধীরে ধীরে নড়তে শুরু করে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, বরফখণ্ডের ধাক্কায় যদি পাথরগুলোকে নড়তে হয়, তাহলে বিশাল বিশাল বরফখণ্ড এবং ঝড়ো বাতাসের প্রয়োজন হবে। কিন্তু তাদেরকে অবাক করে দিয়ে এই বরফের স্তর ছিল খুবই পাতলা, এক ইঞ্চির চেয়েও কম। ঐ স্থানের ভূ-প্রকৃতির কারণে এবং বিশাল জায়গাজুড়ে অবস্থিত বরফের আস্তরণের সম্মিলিত প্রভাবে হালকা বায়ুই পাথরগুলোকে নড়ানোর জন্য যথেষ্ট ছিল।
অবশ্য পাথরগুলোর গতি এতই ধীর ছিল যে, খালি চোখে দেখে বোঝা সম্ভব ছিল না। কিন্তু বিকেলের দিকে যখন অধিকাংশ বরফ গলে গেল, তখন দেখা গেল প্রায় ৬০টি পাথরের পেছনে নতুন করে দাগ তৈরি হয়েছে! রিচার্ড এবং নরিস শহরে গিয়ে র্যাল্ফ লরেঞ্জকে নিয়ে আবারও ফিরে আসেন। ৯ জানুয়ারি, ২০১৪ তারিখে তারা তিনজন মিলে আবারও পাথরগুলোর স্থানান্তর প্রত্যক্ষ করেন এবং ভিডিওতে ধারণ করেন। সে বছর শীতকাল শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করা পাথরটি ভ্রমণ করে মোট ২২৪ মিটার! সাক্ষী-প্রমাণ সহ সমাধান হয় অর্ধশত বছর ধরে মানুষকে ভাবিয়ে তোলা এক ভূতুড়ে রহস্যের।
তাদের এই গবেষণার মাধ্যমে একই সাথে এটাও পরিস্কার হয়েছে যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেন একাধিক পাথর পরস্পরের সাথে হুবহু সমান্তরাল পথ অতিক্রম করে। তারা জানান, মাঝে মাঝে কিছু বরফখণ্ড আকারে এতো বড় থাকে যে, সেগুলো একই সাথে একাধিক পাথরখণ্ডকে একই দিকে সরিয়ে নিয়ে যায়। বরফখণ্ডের আকারের উপর নির্ভর করে এরকম পাথরখণ্ডের সংখ্যা শতাধিক পর্যন্ত হতে পারে।
এই তিন বিজ্ঞানী গবেষণাটির ফলাফল ‘এ ব্রিফ মোমেন্ট ইন টাইম’ শিরোনামে একটি গবেষণাপত্রে প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন,
“এটি খুবই বিরল একটি ঘটনা। এটি কোনো কাল্পনিক রিপোর্ট না, আমাদের কাছে ঘটনার আগের এবং পরের ছবি, সেসময়ের আবহাওয়ার প্রতিবেদন সহ সব প্রমাণই আছে।”
তাদের মতে, যদিও এটিই হয়তো সবগুলো পাথরের নড়াচড়ার একমাত্র কারণ না-ও হতে পারে, কিন্তু এটি নিশ্চিতভাবেই রহস্যটির একটি প্রধান অংশের বৈজ্ঞানিকভাবে সমাধান করতে সক্ষম হয়েছে।