Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সিঙ্কহোল: দানব গর্তের আদ্যোপান্ত

অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর আমাদের এই পৃথিবী। প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে আমরা কখনো হয়ে উঠি কবি, কখনো বা শিল্পী। নিজেদের কল্পনার রঙ আর প্রকৃতির রূপ মিশিয়ে আঁকি তার স্নিগ্ধ অবয়ব। পরক্ষণেই প্রকৃতি তার রূপ বদলায়, হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর; আমাদের চিন্তা-ভাবনাকে ছাপিয়ে হয়ে ওঠে হিংস্রতম। গ্রাস করে সৌন্দর্য, বিলীন করে সভ্যতা। যার প্রমাণ বিভিন্ন প্রকৃতিক দুর্যোগ। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস, ভূমিকম্প, বন্যা, খরা, ভূমিধস, অগ্নুৎপাত ইত্যাদি বিভিন্ন রূপে প্রকৃতি বিপন্ন করে জনজীবন। প্রকৃতির এসব বৈরি ভাব কখনো আগে থেকে আন্দাজ করা যায়, আবার কখনো নীরবে আঘাত হানে। হঠাৎ করেই বিলীন করে দেয় সব।

ধরুন, রাতে আপনি ঘুমিয়ে আছেন। এমন সময় হঠাৎ করে আপনার বাড়িসহ আশপাশের কিছু এলাকা কয়েকশো ফুট মাটির নিচে ডেবে গেল! কিংবা বহু কষ্টে কাজ করে শখের গাড়িটি কিনলেন, গাড়িটি পার্কিংয়ে রেখে নিজের কাজে গেলেন। এসে দেখলেন, আপনার গাড়ি নিজে নিজেই মাটির নিচে তলিয়ে গেছে। এসব কল্পনা করলেও ভয়ে গা শিউরে ওঠা স্বাভাবিক।

কোনোরকম পূর্বাভাস বা সংকেত ছাড়া মাটি ডেবে যাওয়া, বিশাল গর্তের সৃষ্টি হওয়া, পার্কিংয়ে রাখা গাড়ি মাটির নিচে চলে যাওয়া, মুহূর্তেই বিশাল স্থাপনা ধ্বংস হওয়া, একটি শহরের বড় অংশ বিলীন হওয়া, ফসলি জমিতে দানবাকৃতির গর্ত সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি ঘটনাকে এক শব্দে প্রকাশ করা যায় ‘সিঙ্কহোল’ বলে। নামটি অনেকের কাছে অপরিচিত হলেও পৃথিবীর উপরিভাগের পৃষ্ঠে গভীর গর্ত সৃষ্টি হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। তবে সম্প্রতি এই বিষয়গুলো খুব বেশি ঘটছে।

২০১০ সালের জানুয়ারিতে ফ্লোরিডার ডোভারে সিঙ্কহোলটি সৃষ্টি হয়; Image Source: Ann Tihansky, USGS

সিঙ্কহোল কী?

সংক্ষেপে সিঙ্কহোল হলো প্রকৃতিতে হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া বিশালাকার গর্ত। সাধারণত বৃষ্টির পানি মাটির নিচে একটি স্তরে গিয়ে জমা হয়। বিভিন্ন কারণে যখন সেই পানি উত্তোলন করা হয়, তখন মাটির নিচে ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়। যখন মাটির উপরিভাগের ওজন বেশি হয়, তখনই ফাঁকা জায়গায় ভূমিধস হয়ে বিশালাকার গর্ত তৈরি হয়।

এছাড়াও মাটির নিচে যেখানে চুনাপাথর, কার্বনেট শিলা, লবণের স্তর, পাথর, বালি ইত্যাদি বেশি পরিমাণে রয়েছে সেখানে সিঙ্কহোল বা বিশাল আয়তের গর্ত সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, ভূগর্ভস্থ পানির মাধ্যমে খনিজ পদার্থ দ্রবীভূত হয়। শিলা দ্রবীভূত হলে মাটির নিচে ফাঁকা জায়গা বৃদ্ধি পায়। ক্রমে ক্রমে ফাঁকা স্থানের বৃদ্ধির ফলে মাটির উপরিভাগের ভার অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। একসময় উপরিভাগের ভূমিধস ঘটে সিঙ্কহোল সৃষ্টি হয়।

একেকটি সিঙ্কহোল আয়তনে কয়েক ফুট থেকে কয়েকশো ফুট পর্যন্ত হতে পারে, যা তৈরি হতে সময় লাগে কযেক দশক থেকে শতাব্দী। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট সিঙ্কহোলগুলো মাটির গঠন ও এর অভ্যন্তরে থাকা বিভিন্ন ধরনের খনিজ ও শিলার উপর ভিত্তি করে কয়েক ধরনের হতে পারে; যেমন- ডিসসল্যুশন সিঙ্কহোল, কভার-সাবসিডেন্স সিঙ্কহোল এবং কভার কোলাপ্স সিঙ্কহোল।

ডিসসল্যুশন সিঙ্কহোল যেভাবে গঠিত হয়; Image Source: USGS

ডিসসল্যুশন সিঙ্কহোল

মাটির অভ্যন্তরে যেখানে চুনাপাথর বা ডলোমাইট জাতীয় পদার্থ থাকে, সেখানে এ ধরনের সিঙ্কহোল দেখা যায়। বৃষ্টির পানি প্রথমে মাটির নিচে শিলাপৃষ্ঠের সংস্পর্শে আসে এবং সেখান থেকে চুনাপাথরকে দ্রবীভূত করে কার্বনেট বেডরকের জোড়া বা ভাঙা অংশ দিয়ে চুয়ে চুয়ে নিচে যেতে থাকে। এভাবে ধীরে ধীরে পানির ধারা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবে নিচের অংশের মাটি ক্ষয় হয়ে ডেবে যেতে থাকে এবং জলাশয় সৃষ্টি হয়।

কভার-সাবসিডেন্স সিঙ্কহোল গঠন প্রক্রিয়া, এ ধরনের সিঙ্কহোল খুব কম দেখা যায়; Image Source: USGS

কভার-সাবসিডেন্স সিঙ্কহোল

কভার-সাবসিডেন্স সিঙ্কহোলগুলো সাধারণত আবরণযুক্ত পলল ও বালি অঞ্চলে ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে। যেখানে আবরণ উপাদানগুলো তুলনামূলক ঘন বা পলিতে কাদামাটি বেশি থাকে। অধিক ভরের কারণে মাটির উপরের স্তরের বালি কার্বনেট বেডরক ভেদ করে মাটির নিচের ফাঁকা জায়গায় গিয়ে জমা হয়। মাটির উপরিস্তরের মাটি এভাবে ক্ষয় হয়ে ফাঁকা গর্ত তৈরি করে। এ ধরনের সিঙ্কহোলগুলো ছোট হয় এবং দীর্ঘ সময় নিয়ে গঠিত হয় আর খুব কম দেখা যায়।

 হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া কভার কলাপ্স সিঙ্কহোল খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাপক ক্ষতিসাধন করতে পারে; Image Source: USGS

কভার কলাপ্স সিঙ্কহোল

এই ধরনের সিঙ্কহোল হঠাৎ মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বিশাল আকার ধারণ করতে পারে এবং এগুলো বড় ধরনের বিপর্যয় বয়ে আনে। যে স্থানে আবরণ পললে বেশি কাদামাটি থাকে, সেসব স্থানে এমন সিঙ্কহোল দেখা যায়। সময়ের সাথে সাথে কাদামাটি কার্বনেট বেডরক ভেদ করে সেখানে থাকা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে জমা হয় এবং কার্বনেট বেডরকের উপরিভাগে ফাঁকা স্থান সৃষ্টি করে। যখন মাটির উপরিভাগের ওজন সহনসীমা অতিক্রম করে, তখন ভূমিধস হয়ে নাটকীয়ভাবে বিশাল আকৃতির গর্ত তৈরি হয়।

অবাক করা বিষয় হলো, সিঙ্কহোল শুধু স্থলেই নয়, জলভাগেও দেখা যায়। জলাশয়, নদী কিংবা সমুদ্রের তলদেশে মাটির বেডরক ভেদ করে পানি আরো গভীরে প্রবেশ করে। পানির সাথে বেডরকের বিভিন্ন পদার্থ দ্রবীভূত হয় এবং সেখানে বিশাল আকৃতির ফাঁকা স্থান তৈরি হয়। একপর্যায়ে উপরের পানির ওজন সহনসীমা পার হলেই তলদেশে ডেবে গিয়ে সিঙ্কহোলের জন্ম দেয়।

দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থিত ‘ড্রাগন হোল’ খ্যাত সর্বোচ্চ গভীর সিঙ্কহোল। এটি প্রায় ৩০০ মিটার গভীর ও এর উপরিভাগে বিভিন্ন সামুদ্রিক জীবের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে; Image Source: Our Planet

পৃথিবীর গভীরতম ‘আন্ডার ওয়াটার সিঙ্কহোল’ রয়েছে দক্ষিণ চীন সাগরে। এটি স্থানীয়ভাবে ‘ড্রাগন হোল’ নামে পরিচিত। এটি প্রায় ৯৮৭ ফুট (৩০০ মিটার) গভীর। এই সিঙ্কহোল সম্পর্কে চমকপ্রদ একটি তথ্য হলো, সিঙ্কহোলের উপরিভাগে প্রায় বিশের অধিক প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের সন্ধান পাওয়া গেছে, যা ‘ব্লু হোল’ নামেও পরিচিত। ঠিক তার নিচের অংশে, অর্থাৎ ১০০ মিটারের পর থেকে সেখানে অক্সিজেনের কোনো অস্তিত্ব নেই। ফলে সেখানে কোনো জীবের অস্তিত্ব থাকা প্রায় অসম্ভব।

 জাপানের  ফুকুওকা শহরে ২০১৬ সালের নভেম্বরে প্রায় ৪৯ ফুট গভীর এ সিঙ্কহোল ‍সৃষ্টি হয়;
Image Source: Wordlesstech

প্রকৃতির বাইরে মানবসৃষ্ট কারণেও তৈরি হতে পারে সিঙ্কহোল। জনবসতিপূর্ণ এলাকায় তৈরি হওয়া সিঙ্কহোলগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানবসৃষ্ট। মাটির নিচে বিভিন্ন ধরনের নির্মাণকাজ ও পানির লাইন প্রধানত এর জন্য দায়ী। আমাদের জীবন বাঁচানো এই পানির লাইনগুলোই একসময় আমাদের জন্য হুমকির কারণ হয়। বছরের পর বছর ধরে মাটির নিচে থাকা পানির লাইনে যখন কোনো লিকেজ বা ফুটো হয়, তখন সেখান থেকে পানি চুয়ে চুয়ে মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মাটির নিচে জলধারা সৃষ্টি করে।

এভাবে বছরের পর বছর চলতে থাকে এবং জলধারা ক্রমশ বাড়তে থাকে। এছাড়াও মাটির উপরের বৃষ্টির পানি মাটি চুয়ে পড়ে সেখানে গিয়ে যোগ হয় এবং একসময় মাটির নিচের জলধারা বিশাল আকার ধারণ করে। মাটির উপরের স্তরে যখন বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করা হয়, তখন এই ভার অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেলে সেখানকার স্থাপনা মাটির নিচে বিশাল গর্তে নিমজ্জিত হয়ে বিশাল ক্ষয়ক্ষতি করে।

মাটির নিচের পানি প্রবাহ। লাইমস্টোনের ফাঁকা জায়গায় পানি প্রবাহ সৃষ্টি হয়, যার ফলে ফাঁকা স্থানের আয়তন ক্রমেই বাড়তে থাকে; Image Source: Bulldog Adjusters

এ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় অসংখ্য সিঙ্কহোল তৈরি হয়েছে। সেগুলোর প্রভাবে বিলীন হয়েছে নানা জীববৈচিত্র্য ও সভ্যতা। সবচেয়ে বেশি সিঙ্কহোল দেখা যায় আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। আমেরিকার মধ্যে ফ্লোরিডা, পেনসিলভানিয়া, কেন্টাকি, টেক্সাস ইত্যাদি অঙ্গরাজ্যগুলোতে। তুরস্কের কোনিয়া রাজ্যেও ব্যাপক হারে সিঙ্কহোল বাড়ছে, গত এক বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে সিঙ্কহোলের সংখ্যা। এছাড়া ক্রোয়েশিয়া, ইতালি, মেক্সিকো, ইসরায়েল, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে অসংখ্য সিঙ্কহোল। পৃথিবীর বৃহত্তম সিঙ্কহোল রয়েছে চীনে। ‘জিয়াওজাই তিয়ানকেংগ’ নামের এই সিঙ্কহোলের অবস্থান চুনকিংয়ের ফেনজি কাউন্টে, যার গভীরতা প্রায় ৬৬২ মিটার ও প্রস্থ ৫১১ মিটার।

 পৃথিবীর গভীরতম সিঙ্কহোল; Image Soutce: Wonder Mondo

জুনের শুরুতে জেরুজালেমে একটি হাসপাতালের পার্কিংস্থলে হঠাৎ করেই একটি সিঙ্কহোল তৈরি হয়। সেসময় পার্কিংয়ে কোনো লোক না থাকায় হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তবে সেখানে থাকা গাড়িগুলোর ক্ষতি হয়।

জেরুজালেমের একটি হাসপাতালের পার্কিংয়ে হঠাৎ করে এ সিঙ্কহোল তৈরি হয়। সেখানে কোনো হতাহতের খবর পওয়া যায়নি; Image Source: The Times of israel

বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এমন অবস্থা চলতে থাকলে খুব বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে পৃথিবীর বুকে। সিঙ্কহোল বাড়ার পেছনে প্রাথমিক কারণ হিসেবে ভূগর্ভস্থ পানির অধিক উত্তোলনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভূগর্ভের পানি মাত্রাতিরিক্ত উত্তোলনের ফলে ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে ফাঁপা জায়গার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে ধসে পড়ছে মাটি। এছাড়াও খনিজ অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কারণে সিঙ্কহোল সৃষ্টি হতে পারে। আরো একটি উদ্বেগজনক কারণ হলো বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি। এর ফলে প্রকৃতির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয় এবং খরা, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার মতো বৈরিতার সৃষ্টি হয়।

প্রতিনিয়ত মানুষের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বাড়ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা; Image Source: NASA Earth observatory

গত কয়েক দশকে সিঙ্কহোল সমানুপাতিক হারে বেড়ে চলছে। এর প্রভাবে আবাদী জমি থেকে শুরু করে বাসস্থান- প্রায় সব জায়গা ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিপন্ন হচ্ছে জনজীবন। এমন করে যদি সিঙ্কহোলের পরিমাণ বাড়তে থাকে, তবে পৃথিবী দিন দিন আরো বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে।

যদিও সিঙ্কহোল সৃষ্টি হওয়া পুরোপুরি বন্ধ করা আমাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। তবে এটা সত্য যে, প্রকৃতির প্রতি আমাদের স্বেচ্ছাচারিতা আর অবহেলার প্রভাবেই দিন দিন সিঙ্কহোলের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির মাত্রাতিরিক্ত উত্তোলন, অধিক হারে বৃক্ষ নিধন, অপরিকল্পিত নগরায়ন- এগুলোই মূলত সিঙ্কহোল বৃদ্ধির জন্য সবথেকে বেশি দায়ী। অথচ আমরা চাইলেই বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, দরকার শুধু ব্যক্তিগত থেকে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সচেতনতা এবং সুষ্ঠু পরিচালনা।

Related Articles