‘Earworm’ ; বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘কানের পোকা’। কিন্তু গানের সাথে তো মনের আত্মিক সম্পর্ক, পোকার সাথে নয়। না, আজকে জ্যান্ত কিলবিলে কোনো পোকা নিয়ে কথা বলবো না। তবে ইয়ারওয়ার্ম কোনো জ্যান্ত পোকা না হলেও তা বাস করে আমাদের মনের গহীনে অদৃশ্যভাবে এবং প্রতিনিয়ত ৯০% মানুষকে সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও জ্বালাতন করে। কিন্তু কী এই ইয়ারওয়ার্ম?
অলসভাবে কারো জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় বসে আছেন, আর ঠিক সেসময় মাথার মধ্যে একটানা বেজে চলেছে আগে কোনো একসময় শোনা একটা গান। অথচ আপনার আশেপাশে কোথাও বাজানো হচ্ছে না সেই গান। পুরোটা নয়, কেবলমাত্র গানটির একটি অংশ। মিনিটের পর মিনিট, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কখনো বা দিনের পর দিন আটকে থাকে মনে।
কিংবা পড়ার টেবিলে মন বসছে না, অথচ দিব্যি মনের মধ্যে বেজে চলেছে একটু আগে শোনা গানটির ১৫-২০ সেকেন্ডের কিছু অংশ। একটি লুপের মতো তা মাথার মধ্যে বেজেই চলেছে। কিন্তু আপনি চাচ্ছেন না তা পুনরায় এভাবে বাজতে থাকুক। যে-ই না ভুলে থাকার চেষ্টা করছেন, অমনি তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে আরো বেশি করে।
কখনো কি আপনিও এমন কোনো ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন? সম্ভাবনা আছে আপনার একের অধিকবার এই ধরনের ঘটনার সাক্ষী হবার। কারণ পৃথিবীজুড়ে ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষ এই ধরনের সমস্যায় পড়েছে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার। কেউ কেউ আবার এর থেকেও বেশি।
মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ইয়ারওয়ার্ম ইফেক্ট। মন আটকে থাকে গানের লাইনে। আর লুপের মতো তা মাথার ভেতর চলতেই থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটে সেসব কাজ করার সময় যেগুলোতে অপেক্ষাকৃত কম মনোযোগ দরকার হয়। যেমন, অলসভাবে বসে থাকার সময়, কখনো যানবাহনে যাত্রা করার সময়, জ্যামে আটকে বা ট্রাফিক সিগনালের অপেক্ষায় থাকার সময় বা এমনই কোনো কাজের ক্ষেত্রে। এমনকি ঘুম থেকে ওঠার পরপরই ইয়ারওয়ার্ম হতে পারে। ঘুম থেকে ওঠার পর আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে খেয়াল হতে পারে মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে পরিচিত কোনো গান।
বিষয়টি অনেকটা মেন্টাল ইমেজারির মতো। যেমন- আপনি চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন কোনো এক দৃশ্য বা কোনো বস্তুর কথা। আপনার মনের মধ্যে তার চিত্র ভেসে উঠবে। আপনার কল্পনা কেবল দৃশ্যই নয়, শব্দও হতে পারে। যেমন- নদীর ধারে বসে থেকে নদীর স্রোতের শব্দ, কোনো বিশেষ পাখির ডাক কিংবা বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ। ইয়ারওয়ার্মের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনই এক শব্দ কল্পনার মতো ঘটনা ঘটে, যা আপনার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল না। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয়ে থাকে অডিটরি ইমেজারি। আপনার আশেপাশে সেই শব্দের উৎস না থাকলেও কানে বাজতে থাকে সেটি। গানের ক্ষেত্রে পুরো গানটি নয়, বরং গানের কিছু অংশ, কয়েক লাইন বা কয়েক সেকেন্ডের অংশ একইভাবে বাজতে থাকে মনের ভেতর।
কিন্তু কেন মনের ভেতর আটকে থাকে গানের অংশ? সব গানের ক্ষেত্রেই কি এমনটা হয়? নাকি বিশেষ কোনো গানের জন্য? আর বিজ্ঞান কী বলে ইয়ারওয়ার্মের ব্যাপারে? এর থেকে কি চাইলেই পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব?
বিজ্ঞানের আর সব জটিল রহস্যের মধ্যে ইয়ারওয়ার্ম একটি। বিজ্ঞানীরা এখনো শতভাগ এই রহস্যের সমাধানে সফল হননি। তবে গবেষণা আর অনুসন্ধান থেকে যা উঠে এসেছে জেনে নেয়া যাক সে সম্পর্কে।
Earworm শব্দটি এসেছে জার্মান শব্দ Ohrwurm থেকে, যার অর্থ কেন্নো পোকা। আশির দশকে এই শব্দটির প্রচলন ঘটে। ধারণা করা হয়, এর প্রসার ঘটে মার্কিন হরর এবং ফিকশন লেখক স্টিফেন কিং এর মাধ্যমে।
ইয়ারওয়ার্ম হলো অনাহূত অতিথির মতো এবং চাইলেও তাকে তাড়ানো যায় না। সম্পূর্ণ অনৈচ্ছিক একটি প্রক্রিয়া হওয়াই ইয়ারওয়ার্মকে বিজ্ঞানীরা আরেক নাম ব্যবহার করে থাকেন, তা হলো ‘ইনভলান্টারি মিউজিকাল ইমেজারি’।
কেন এই ঘটনা ঘটে থাকে আর কাদের ক্ষেত্রে এর প্রবণতা বেশি দেখা যায় তার উত্তর খুঁজতে গেলে বেশ কিছু মনস্তাত্ত্বিক বিষয় উঠে আসে।
ইন্সট্রুমেন্টাল মিউজিকের তুলনায় লিরিক্যাল গানের ক্ষেত্রে ইয়ারওয়ার্মের আধিক্য দেখা যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে স্টেজ গানের ইয়ারওয়ার্মও বেশি হয়ে থাকে। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, আপনার পছন্দের ব্যান্ড বা গায়ককে সামনাসামনি গাইতে দেখে আপনার মধ্যে বেশ উত্তেজনা কাজ করে।
সাধারণত ইয়ারওয়ার্ম হলে গানের খুব চিত্তাকর্ষক অংশটিই মনের মধ্যে আটকে থাকে। আর সাধারণ গানের চেয়ে জটিল গানের ক্ষেত্রে ইয়ারওয়ার্ম হবার সম্ভাবনা খুব কম। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সাধারণ ধাঁচের, কিন্তু শুনতে একটু অন্যরকম লাগে এমন গান মনের মধ্যে আটকে থাকে খুব সহজে। মস্তিষ্ক জটিল গানের থেকে আকর্ষণীয় গান বা গানের অংশ খুব সহজে মনে রাখে।
ইংল্যান্ডের ডারহাম ইউনিভারসিটির মিউজিক সাইকোলজিস্ট কেলি জ্যাকুবোস্কি, যিনি নিজেও প্রতিনিয়ত ইয়ারওয়ার্মের শিকার, একটি অনলাইন জরিপে ইয়ারওয়ার্মের শিকার হয়েছেন এমন কয়েক হাজার ব্যক্তির থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। তাতে দেখা যায়, তারা যেসব গানের দ্বারা ইয়ারওয়ার্মের শিকার হয়েছেন সেগুলোর প্রায় সবগুলোই আপবিট ধাঁচের এবং তাদের ছন্দবদ্ধ প্যাটার্নে একটা চিত্তাকর্ষক ভাব আছে। গানের নোটের পিচগুলো একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন মেনে ওঠানামা করে, যা গানটিকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তোলে।
খুব সাধারণ উদাহরণের জন্য ‘টুইংকেল টুইংকেল’ ছড়াটির কথা ভাবুন। ছড়াটির শুরু নিম্ন পিচ দিয়ে, ধীরে ধীরে তা উঠে আবার নামতে থাকে, যা একটি অনন্য ছন্দের প্যাটার্ন তৈরি করে। ফলে খুব সহজেই তা ছোটদের ভাল লেগে যায় এবং মনে গেঁথে থাকে। গানের ক্ষেত্রে নোটগুলো হবে দীর্ঘ, কিন্তু পিচগুলো উচ্চ কম্পাঙ্কের, অর্থাৎ কাছাকাছি। যেমন Waterloo এর ABBA গানটি। অনন্য ছন্দ, সরলতা এবং গানের পিচ তাই ইয়ারওয়ার্মের সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে।
২০১০ থেকে ২০১৩ সালে ইংল্যান্ডে চালানো একটি অনলাইন জরিপে তিন হাজার ইয়ারওয়ার্মের শিকার ব্যক্তির শোনা গানগুলো তথ্য নিয়ে একটি তালিকা তৈরি করা হয়। তাতে শীর্ষে জায়গা করে নেয় লেডি গাগার ‘ব্যাড রোম্যান্স’ গানটি। এছাড়াও তার ‘আলেকজান্দ্রো’ এবং ‘পোকার ফেস’ও শীর্ষ দশের মধ্যে ছিল। কেটি পেরির ‘ক্যালিফোর্নিয়া গার্লস’, ম্যারুন ফাইভের ‘মুভস লাইক জ্যাগার’ এবং জার্নির ‘ডোন্ট স্টপ বেলভিন’ গানগুলো শীর্ষ দশে জায়গা করে নেয় ইয়ারওয়ার্ম তৈরি করায় বেশ দক্ষ হওয়াতে। এদের সবগুলোই ছন্দ, সরলতা এবং পিচের দিক থেকে অনন্য।
গবেষণা থেকে দেখা গেছে, সাধারণত সম্প্রতি শোনা কোনো গান বা অপেক্ষাকৃত বেশি বার শোনা গানগুলো ইয়ারওয়ার্ম ইফেক্ট তৈরির জন্য উপযুক্ত। এছাড়াও প্রিয় ব্যান্ড বা গায়কের সম্প্রতি মুক্ত হওয়া গানও ইয়ারওয়ার্ম ইফেক্ট তৈরি করতে পারে।
মনস্তাত্ত্বিক দিক বিবেচনা করলে ইয়ারওয়ার্ম ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে, আবার ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন গানও মনে আটকে থাকতে পারে। এর সাথে জড়িয়ে থাকে কোনো বিশেষ স্থান, ব্যক্তি বা আবেগময় অনুভূতি, যা সেই স্মৃতি সম্পর্কিত নির্দিষ্ট কোনো গানের পুনরাবৃত্তি ঘটায় মনের মধ্যে। এটি নির্ভর করবে অনেকটা আপনার পছন্দ এবং রুচির উপরেও। তাই একই গান সবার ক্ষেত্রে একই রকমের প্রভাবও ফেলবে না।
অনেক ক্ষেত্রে হতাশা বা অতিরিক্ত কাজের চাপের ফলে মনোযোগ বিঘ্নিত হয়। তাতেই জেঁকে বসতে পারে এই ইফেক্ট। গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক জটিল কোনো সমস্যা সমাধানের সময় মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে মনোযোগে বিঘ্ন ঘটায়। আর তা থেকে অলসতার ফলে ইয়ারওয়ার্ম ইফেক্ট তৈরি হয়।
কিন্তু ইয়ারওয়ার্ম কি কেবল বিরক্তিই সৃষ্টি করে, নাকি তা আরো ভালো প্রভাবও ফেলে?
এর উত্তরও ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। অনেকেই তাদের ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করে বলেন, তারা গানের এই পুনরাবৃত্তি উপভোগ করেন। তবে সেটা একটা সীমিত সময় পর্যন্ত। অনেকক্ষেত্রে কাজ করার সময় তা একরকম বিনোদনের মতো কাজ করে, যা মন হালকা রাখতে সাহায্য করে। আবার বিজ্ঞানীরা ইয়ারওয়ার্ম ইফেক্ট নিয়ে গবেষণা করে মস্তিষ্কের অজানা কিছু রহস্য উন্মোচন করতে পারবেন, যার উপর পুরোপুরিভাবে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আমাদের মন এবং মস্তিষ্কের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণে তা বিশেষভাবে কাজে আসবে। জরিপে দেখা গিয়েছে, প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ এই প্রভাব নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামান না। কিন্তু বাকিদের ক্ষেত্রে তা বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অনেক সময় এই প্রভাব কয়েক দিন থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়, যা রীতিমতো এক ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। অনেক ক্ষেত্রে তা অমনোযোগিতা, অনিদ্রার মতো সমস্যা সৃষ্টি করে। আবার মনে আটকে থাকা গানটি যে সব সময় পছন্দের গানই হবে তা-ও ঠিক নয়। কারণ আপনার অপছন্দের কোনো গানও চিত্তাকর্ষক হতে পারে আপনার মস্তিষ্কের জন্য, যার ফলাফল আপনার মেজাজ খিটখিটে করে তুলবে।
কিন্তু অদৃশ্য এই পোকার হাত থেকে মুক্তির উপায় তবে কী?
খুব সহজ সমাধান হতে পারে নিজেকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে ফেলা, মনের গানের কথা না ভেবে তা সম্পূর্ণভাবে ভুলে যাবার চেষ্টা করলে এর থেকে মুক্তি মিলতে পারে। এছাড়া প্রচলিত আছে চুইংগাম চিবানোর ফলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি মিলে। কারণ গাম চিবানোটাও একটা পুনরাবৃত্তিক প্রক্রিয়া, যা মস্তিষ্ক আপনার গানের পুনরাবৃত্তির জন্য প্রয়োজনীয় মনোযোগ গাম চিবানোর জন্য সরবরাহ করে। তবে সবার জন্য তা কাজ না-ও করতে পারে।
আরেকটি উত্তম সমাধান হতে পারে গানের লুপ থেকে মুক্তি পেতে আরেকটি গান শুনে ফেলা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, তবে সেই গানটি যেন আবার একই প্রভাব তৈরি না করে বসে।
মুক্তির উপায় নিয়ে কথা বলতে গেলে উঠে আসে জেইগার্নিক ইফেক্টের কথা। এই ইফেক্টের সারাংশ হলো, আমাদের মস্তিষ্ক অসম্পূর্ণ কাজগুলোর ব্যাপারে অধিক সচেতন। তাই যে কাজগুলো অসম্পূর্ণ থেকে যায়, মস্তিষ্ক তা বারবার মনে করিয়ে দেয়। তাই আপনি যখন কোনো গানের কিছুটা অংশ শুনে রেখে দেন, মস্তিষ্ক সেটাকে একটা অসম্পূর্ণ কাজ হিসেবে মনে করিয়ে দিতে থাকে ইয়ারওয়ার্ম প্রভাব তৈরি করে। তাই অসম্পূর্ণ গানটি শুনে শেষ করাও হতে পারে আরেকটি সমাধান।
বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে চলেছেন রহস্যের সমাধান করার। আর এই রহস্য রীতিমতো সাধারণ একটি ঘটনা, যার সমাধান সম্পর্কে এখনও আমরা পুরোপুরিভাবে অবগত নই। তার মধ্যে বহুল প্রচলিত একটি প্রশ্ন হলো, কেন গান? খাবারের স্বাদ বা অন্য কিছু কেন পারে না এই ধরনের প্রভাব তৈরি করতে? এর খুব সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির উত্তর হতে পারে- আমাদের মস্তিষ্ক ছন্দপ্রিয়। গানের একটি নোট শোনার পর আমাদের মধ্যে পরবর্তী নোটটি শোনার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু বিজ্ঞানীদের কাছে এখনও এর স্পষ্ট কোনো জবাব নেই।
আপনিও কী এমন প্রভাবের মুখোমুখি হয়েছেন কখনও? সেটা কি ঘনঘন? আপনি তা কতটুকু উপভোগ করেন? নাকি আপনার মধ্যেও তা জন্ম দেয় একরাশ বিরক্তির?