
আনন্দ মানে কী? সুখী থাকতে হলে জীবনে কী সবচেয়ে প্রয়োজন? সুখ বলতে সত্যিকার অর্থে কী বোঝানো হয়? এসব প্রশ্নের উত্তর ও এগুলোর ব্যাখ্যা প্রত্যেকের ক্ষেত্রে ভিন্ন, অনন্য। সাধারণ অর্থে সুখ কী জিনিস তা আমরা সবাই কম-বেশি বুঝি। তাই এর সংজ্ঞা কেমন হওয়া উচিত সেই তর্কে যাওয়ার আগে সুখ কয় ধরনের হতে পারে তা নিয়ে একটু বলি। ধরনের ক্ষেত্রেও মতভেদ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়
মনোবিজ্ঞানের ভাষায় সুখ দুই প্রকার। হেডোনিক সুখ এবং ইউডাইমোনিক সুখ। সহজ ভাষায় বললে, স্বল্পমেয়াদী (হেডোনিক) ও দীর্ঘমেয়াদী (ইউডাইমোনিক) সুখ। সংজ্ঞা হিসেবে বলতে গেলে- হেডোনিক সুখ হচ্ছে এমন সুখ, যা আমোদ-প্রমোদ বা আনন্দদায়ক ঘটনা থেকে পাওয়া যায়। এই ধরনের সুখ আমরা সবসময় চাই। হেডোনিক সুখ স্বল্প সময়ের জন্য হলেও তা আমাদের জীবনটাকে সুন্দর করে তোলে, উন্নত করে। ভালো লাগার মুহূর্তগুলো উপভোগ করার সুযোগ দেয়।
আর ইউডাইমোনিক সুখ হলো কোনো অর্থবহ ঘটনা, অভিজ্ঞতা কিংবা নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য থেকে প্রাপ্ত। অনেকটা সাধনা ও প্রচেষ্টার ফলে অর্জিত সুখই হলো ইউডাইমোনিক সুখ। তাছাড়া এমন কিছু কাজ আছে যা আমরা এমনিতেই করে থাকি। কারণ, এগুলো আমাদের আনন্দ দেয়। অর্থাৎ শুধু লক্ষ্যটিই নয়, বরং লক্ষ্যটি পূরণের পথটাও বেশ আনন্দের। উপভোগ করার মতো না হলেও তাতে আত্মতুষ্টি ও আত্মতৃপ্তি রয়েছে। ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করে তুলতেও প্রয়োজন ইউডাইমোনিক সুখের। জীবনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী, দু’ধরনের সুখেরই দরকার আছে। তবে মানুষ ভেদে এই সুখ ভিন্ন ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। এই লেখায় এই দু’রকমের সুখ নিয়েই আলোচনা করা হবে।

এবার সুখ কাকে বলে- এই প্রশ্নে আসা যাক। সুখ হলো ইতিবাচক মানসিক অবস্থা। অর্থাৎ এটি ব্যক্তি বিশেষের এমন একটি অবস্থা যখন তার কাছে মনে হয় পরিস্থিতি তার অনুকূলে। জীবনে পরিতৃপ্ত ও সন্তুষ্ট থাকলেই সুখী হওয়া যায়। সুখী হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। আর এক্ষেত্রে সংস্কৃতি, শিক্ষা, মূল্যবোধ এবং ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে থাকে। মনোবিদদের মতে, সুখ মানে এমন কিছু যা কল্যাণকর বা মঙ্গলজনক।

তবে কল্যাণকর বলতে কী বোঝানো হয়, সেটাও একটা ভাবার বিষয়। এসব কিছুই আসলে একেকজনের কাছে একেকরকম। তবে মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে কল্যাণের সাথে ছয়টি বিষয় জড়িত। যেমন- ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তিগত উন্নতি, লক্ষ্য, আত্ম গ্রহণযোগ্যতা, কর্তৃত্ব এবং সকলের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক। এগুলো জীবনে কল্যাণ তথা সুখ বয়ে আনতে পারে।
হেডোনিক সুখ
‘হেডোনিক’ (Hedonic) একটি গ্রিক শব্দ যার অর্থ সুমধুর বা আনন্দ। হেডোনিক সুখের ব্যাপারটা গ্রিক দার্শনিক অ্যারিসটিপ্পাসের মতামতের আলোকে বলা যায়। তার মতে, জীবনের লক্ষ্য হলো আনন্দ বাড়ানো। শুধু আরিসটিপ্পাটিসই নন, হোবস ও বেনথামও একই মত পোষণ করে গেছেন। বিষয়টি তাৎক্ষণিক পরিতৃপ্তির সাথে সম্পর্কিত। যেমন- ভালো একটি গান শুনলে, সিনেমা দেখলে বা একবেলা অন্যরকম ও ভালো কিছু খেতে পারলে আমরা পরিতৃপ্ত হই।

এই তৃপ্তি কয়েক ঘণ্টার বা কয়েক দিনের। অর্থাৎ কম সময়ের জন্য এবং এর রেশও দ্রুত চলে যায়। এরকম অনুভূতিই হলো হেডোনিক সুখ। জীবনে উন্নতি করার জন্য প্রতিদিন পড়াশোনা করা, আয় করার উদ্দেশ্যে চাকরি করা কিংবা সঙ্গীতশিল্পী হওয়ার জন্য প্রতিদিন চর্চা করা কষ্টকর, কিন্তু এর ফলে ভবিষ্যতে প্রাপ্ত আনন্দটাও বড় এবং দীর্ঘমেয়াদী। এসব সুখ হেডোনিকের মধ্যে পড়ে না। এগুলো ইউডাইমোনিক সুখের আলোচ্য বিষয়। হেডোনিক সুখের আলোচনা খুব ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্তগুলো নিয়ে। এই যে আমরা প্রতিনিয়ত ছোট ছোট আনন্দ ও সুখ পাই, এগুলো বেঁচে থাকার বা জীবন চলার পথকে সহজ করে তোলে। এই ঘটনাগুলো শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকেও সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। হেডোনিক সুখের মূল উদ্দেশ্যই হলো আনন্দকে বাড়ানো, আর কষ্টকে কমানো।

ইউডাইমোনিক সুখ
গ্রিক ‘ইউ’ (eu) এবং ডাইমোন (daimon) থেকে উৎপত্তি ‘ইউডাইমোনিক’ (eudaimonic) শব্দটির। ‘ইউ’ (eu)-এর অর্থ ভালো, ঠিক, ন্যায্য। আর ‘ডাইমোন’ (daimon)-এর অর্থ সহায়ক, তত্ত্বাবধায়ক, পালক। ‘ইউডাইমোনিক’-এর মূল অর্থ হলো ‘সুখ অর্জনে সহায়ক’। হেডোনিক সুখ থেকে এটি অনেকটাই আলাদা। এই সুখ জীবনের ভবিষ্যতের একটি বিশেষ লক্ষ্য। ইউডাইমোনিক সুখের বিষয়টি এরিস্টটল সর্বপ্রথম তার বই ‘নিকোম্যাকিয়ান এথিকস’-এ উল্লেখ করেন। এরিস্টটলের মতে, সুখ অর্জনের জন্য একজন ব্যক্তিকে তার জীবন নৈতিকতার সাথে কাটানো উচিত। তিনি দাবি করেন, মানুষ সবসময় তার সংকল্প পূরণ করার চেষ্টা করে বা এর পেছনে ছোটে। আর এটাই তাদের জীবনের বৃহত্তর উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়ক। এই সুখ অর্জনের পথটাই বেশ আনন্দদায়ক, সুখকর। মনে করুন, আপনার জীবনের লক্ষ্য হলো আপনি চিত্রশিল্পী হবেন। যদি আপনি হাতে শুধু রঙ আর তুলি নিয়ে বসে যান তাহলে আপনার সেই লক্ষ্য কখনো পূরণ হবে না। দিনের পর দিন চর্চা করতে হবে, একবার ভুল হলে দশবার নতুন করে করতে হবে।

ধৈর্য সহকারে কাজ করে যেতে হবে। শুধুমাত্র তখনই একজন ভালো চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব। ঠিক একইভাবে মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করলে উন্নতির শিখরে ওঠা সম্ভব। কথায় আছে, লেখাপড়া করে যে গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে। অর্থাৎ জীবনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সাধনা করাটা দরকার, কিন্তু তা অবশ্যই কষ্টের। সবসময় একটা দ্বন্দ্বে থাকতে হয়। একটু আরাম-আয়েশ করে জীবন কাটাবো নাকি ভবিষ্যতকে সুন্দর করার লক্ষ্যে এখন থেকে কাজ করবো। দুটোতেই সুখ আছে, আনন্দ আছে। তবে তাদের ধরন আলাদা। আরাম-আয়েশের সুখ কয়েক মুহূর্তের। বিশ্রাম করা জরুরি হলেও তা অতিরিক্ত করার খেসারত দিতে হতে পারে ভবিষ্যতে। আর মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করলে ছাড়তে হবে ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্তগুলো। এভাবে অনেক সাধনা করে যেসব সংকল্প পূরণ করতে হয় সেগুলো সবই ইউডাইমোনিক সুখের অন্তর্ভুক্ত। এসব অর্জন করা বেশ ঝামেলার হলেও এর ফল অনেক বড়, টেকসই এবং ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করার জন্য অন্যতম উপকরণ।

জীবনে হেডোনিক নাকি ইউডাইমোনিক সুখের প্রয়োজন তা বোঝার আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো একজন ব্যক্তি কী চায়? তার সন্তুষ্টি ও পরিতৃপ্তি কোথায়? সে তার জীবনকে কীভাবে দেখতে চায়? কীভাবে উপভোগ করতে চায়? সুখ বা আনন্দের বিষয়কে আসলে বাঁধাধরা কয়েকটি বাক্যে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। পৃথিবীতে সাড়ে সাতশো কোটি মানুষের কাছে সুখের সংজ্ঞা সাড়ে সাতশো রকমের। সকলের সংজ্ঞাই অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ। তবে সবগুলো তো আর জানা সম্ভব নয়। তাই সুখের ধরনের সাপেক্ষে এই বিষয়গুলোকে নির্দিষ্ট ছাঁচে আনার জন্যই দার্শনিক ও মনোবিদরা কাজ করে গেছেন। প্রথমেই বলেছিলাম যে, হেডোনিক ও ইউডাইমোনিক দু’ধরনের সুখেরই প্রয়োজন রয়েছে। তবে কোন সুখ বা আনন্দ বেশি প্রয়োজন তা বলা সম্ভব নয়। গুরুত্ব কোনটার বেশি তা নিয়ে তো দার্শনিক ও মনোবিদদের মধ্যেই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত। তবে মনোবিজ্ঞান নিয়ে যারা গবেষণা করে তাদের মতামত অনুসারে দু’ধরনের সুখেরই মূল উদ্দেশ্য হলো জীবনে কল্যাণ বয়ে আনা।
হ্যান্ডারসন ও তার দলের মত অনুযায়ী, হেডোনিক সুখ মনে ইতিবাচক অনুভূতির সৃষ্টি করে, জীবনে পরিতৃপ্ত থাকতে শেখায়, নিজের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। তাছাড়া নেতিবাচক অনুভূতি কমানো, চিন্তা ও হতাশা দূর করতেও দরকার এরকম সুখের। অন্যদিকে, ইউডাইমোনিক সুখ নিয়ে যায় জীবনের আসল তাৎপর্যের দিকে এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের চূড়ায় পৌঁছে দেয়। অথবা এটা হলো এমন সুখ, যা একজন ব্যক্তির নৈতিক গুণাবলি অর্জনের সময় অনুভব করার সুযোগ পায়। অর্থাৎ হ্যান্ডারসনের গবেষণাতেও প্রকাশ পেয়েছে যে, হেডোনিক ও ইউডাইমোনিক সুখ উভয়ই জীবনে কল্যাণ বয়ে আনতে সক্ষম, কিন্তু তা ভিন্ন ভিন্ন পন্থায়। তবে দুটোই আমাদের জীবনে সুন্দর ও আনন্দের মুহূর্তগুলো বাড়িয়ে দেয়।