আমেরিকার ‘নাসা’, রাশিয়ার ‘রসকসমস’, বা ভারতের ‘ইসরো’ – সবাই কেন চাঁদে বা অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহে একের পর এক মিশন পরিচালনা করছে? এগুলোর মিশন কি শুধুই নতুন নতুন উদ্ভাবনী আর মানবমনের কৌতুহল মেটানো? একটু ভাবুন তো, শুধু আবিষ্কারের নেশায়ই কি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার তারা খরচ করে যাচ্ছে দেদারসে?
এর উত্তর হচ্ছে, ‘না’। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো বিনা লাভে একের পর এক মিশন পরিচালনা করছে না। এসব অভিযানের পেছনে যেমন আছে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার অভিপ্রায়, ঠিক তেমনই রয়েছে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য। হয়তো নগদ অর্থ উপার্জন হচ্ছে না এখনই, কিন্তু তারা যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে, তাতে একটা সময় হয়তো বা তাদের বিনিয়োগের কয়েক গুণ বেশি অর্থ উপার্জন করতে তারা সমর্থ হবে। শুধুমাত্র চাঁদের পিছনে বিনিয়োগের বাণিজ্যিক অনেকগুলো কারণের মধ্যে সব থেকে আলোচিত কারণ হচ্ছে হিলিয়াম-৩ নামক একটি পদার্থের উপস্থিতি। এই উপাদানটিকে ধরা হচ্ছে ভবিষ্যতের পৃথিবীর জ্বালানীর যোগানদাতা হিসেবে। জ্বালানীর গুরুত্ব বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে কতটা, তা বোধ করি প্রত্যেক সচেতন মানুষই জানেন। তাই চাঁদ ও হিলিয়াম-৩ নিয়ে বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা সংস্থার আগ্রহ এখন তুঙ্গে। তো চাঁদ কীভাবে ভবিষ্যতের জ্বালানীর অন্যতম যোগানদাতা হতে পারে, তা নিয়েই আজকের আলোচনা।
প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে আমাদের চাহিদাও বাড়ছে। আর দৈনন্দিন বিভিন্ন চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে কমছে খনিজ জ্বালানির মজুদ। আমরা এত বেশি জীবাশ্ম জ্বালানি খরচ করে ফেলেছি যে, ২০১৫ সালের এক গবেষণায় উঠে এসেছে খনিজ তেলের মজুদ ৫০ বছর, প্রাকৃতিক গ্যাসের ৫৩ বছর, আর কয়লার মজুদ ১১৪ বছর পর পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে। উন্নত দেশগুলো স্বাভাবিকভাবেই তখন পারমাণবিক শক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত জ্বালানির দিকে ঝুঁকে যাবে। আর নিউক্লিয়ার ফিউশন হচ্ছে পারমাণবিক শক্তি তৈরির অন্যতম পদ্ধতি। ধারণা করা হচ্ছে, চাঁদের মাটির নিচে বিদ্যমান হিলিয়াম-৩ নামক উপাদান নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমে শক্তি তৈরিতে বিপ্লব ঘটাতে পারে।
এটি মূলত হিলিয়ামের একটি আইসোটোপ। এই উপাদান তেজস্ক্রিয় না হওয়ায় এবং ক্ষতিকর বর্জ্য উৎপাদন না করায় এটি নিরাপদ কিন্তু কার্যকরী পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনে সক্ষম।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই হিলিয়াম-৩ আইসোটোপ কীভাবে চাঁদে এলো?
আমরা জানি যে, সূর্যে প্রতিনিয়ত সৌরঝড় হয়। এই সৌরঝড়ের কারণে সৃষ্ট তপ্ত বাতাস সৌরজগতে আছড়ে পড়ে। কিন্তু পৃথিবীর শক্তিশালী বায়ুমণ্ডল আর চৌম্বকক্ষেত্রের কারণে এই ‘Solar Wind’ বা ‘সৌর বাতাস’ পৃথিবীপৃষ্ঠে পৌছায় না। কিন্তু চাঁদে এরকম বায়ুমণ্ডল আর চৌম্বকক্ষেত্র না থাকায় এই ‘Solar Wind’ সরাসরি চাঁদের মাটিতে এসে পড়ে। আর এই ‘Solar Wind’-এ থাকে হিলিয়াম-৩ উপাদানটি। এভাবেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলমান এই প্রক্রিয়ার কারণে চাঁদের মাটিতে হিলিয়াম-৩ এর বিশাল মজুদ তৈরি হয়েছে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ২৫ টন হিলিয়াম-৩ ব্যবহার করে ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের এক বছরের জ্বালানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব! ধারণা করা হচ্ছে, চাঁদের মাটিতে এই হিলিয়াম-৩ এর রিজার্ভ আছে ২৪ লাখ ৬৯ হাজার টন! কাজেই এই বিশাল পরিমাণের হিলিয়াম-৩ কে কাজে লাগানো গেলে পৃথিবীর জ্বালানির চাহিদা অনেকাংশেই পূরণ করা সম্ভব।
কিন্তু বিলিয়ন ডলার খরচা করে এই বস্তু পৃথিবীতে নিয়ে এসে শক্তি উৎপাদন করা কি লাভজনক হবে?
উত্তর হচ্ছে, অবশ্যই হবে। কেননা, নাসার গবেষণা বলছে, হিলিয়াম-৩ ফিউশন রিএক্টরে ব্যবহার করে ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে যে শক্তি উৎপাদিত হবে, তা চাঁদের মাটি থেকে হিলিয়াম-৩ উত্তোলন এবং তা পৃথিবীতে প্রেরণের জন্য যে সম্মিলিত শক্তি প্রয়োজন, তার থেকেও ২৫০ গুণ বেশি! অর্থাৎ যতটুকু শক্তি খরচ হবে তার থেকেও ২০০-২৫০ গুণ বেশি লাভ! ভাবা যায়!
কিন্তু আমাদের কাছে কি এই প্রযুক্তি আছে, যার মাধ্যমে আমরা এই বিশাল সম্পদকে পৃথিবীতে নিয়ে এসে মানুষের কাজে লাগাতে পারি?
উত্তর হচ্ছে, নেই। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বসেও নেই। ইতোমধ্যে গবেষণা শুরু হয়ে গিয়েছে এই বিষয়ে। তবে আরো দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা প্রয়োজন। আর সেটা হয়তো করতে হবে চাঁদে বসেই!
ইতোমধ্যে আমেরিকার নাসা চাঁদকে ঘিরে তাদের উচ্চাভিলাষী প্রকল্প ‘Mission Artemis’-এর ঘোষণা দিয়েছে – যার উদ্দেশ্য হচ্ছে চাঁদে আবারও মানুষ পাঠানো, সেখানে হিউম্যান বেস স্থাপন করে চাঁদে বড় পরিসরে খনন শুরু করা, এবং খনন করার পর প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো পৃথিবীতে নিয়ে আসা। এই উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যে চারটি কোম্পনির সাথে তারা চুক্তিও সেরে ফেলেছে। আর হিলিয়াম-৩ সহ চাঁদে প্রাপ্ত বিভিন্ন উপাদান নিয়ে গবেষণা এবং এগুলোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে লাভবান করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র একজন সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা টিম ক্রিসম্যান এই ব্যাপারটি স্বীকার করে ইসরায়েলি জেরুজালেম পোস্ট পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন!
আর চীন তো এই বিষয়ে অনেকখানিই এগিয়ে গেছে। চাঁদ থেকে আনা মাটি ও পাথরের স্যাম্পল তারা ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ভাগ করে দিয়েছে বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে গবেষণার জন্য। আর তাদের এই গবেষণার একটা বড় উদ্দেশ্যই হচ্ছে চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে হিলিয়াম-৩ এর উত্তোলনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা। এটা তারা ঘোষণাও দিয়েছে। ভারতের চন্দ্রযান-২ মিশনেরও একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল হিলিয়াম-৩ এর খোঁজ করা এবং এই নিয়ে গবেষণা করা।
চাঁদে অভিযানে অংশ নেয়া স্পেস সংস্থাগুলোর এই তালিকা ধীরে ধীরে বাড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে হাতে থাকা প্রযুক্তির উপর ভর করে এই নিশ্চয়তা তারাও দিতে পারছে না যে তারা সফল হবেই। তবুও চেষ্টা চলছে এবং চলবে বলেই আশা করা যায়। তারা কতখানি লাভবান হবে, কিংবা পৃথিবীর মানুষ কতটুকু উপকৃত হবে, তা ভবিষ্যতই বলে দেবে।