বাংলায় একটি সুন্দর প্রবাদ রয়েছে, ‘মশা মারতে কামান দাগানো’। আপনি মশা মারতে কামানের ব্যবস্থা করুন আর না-ই করুন, মশারা কিন্তু কামড়ানো ছাড়বে না। প্রাণীর ত্বকে কামড়ানোটাই তাদের জৈবিক চাহিদা, বংশবৃদ্ধির মূলমন্ত্র। মানুষসহ কোনো প্রাণীই চায় না তার প্রজাতি সামনের দিকে না এগিয়ে বিলীন হয়ে যাক। এই বিলীন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতেই প্রতিটি প্রাণীর জীবনচক্রে রয়েছে নিজস্ব ধরন কিংবা পদ্ধতি, যার মাধ্যমে নতুন উত্তরাধিকারের সূচনা করে থাকে প্রাণিরা।
মশার ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য, তাদের বংশবৃদ্ধির জন্যও রয়েছে ভিন্ন এক ব্যবস্থা। আর সেই ব্যবস্থাকে পূর্ণতা দিতে মশাদের প্রয়োজন হয় প্রাণীদেহের তাজা রক্তের। স্ত্রী মশা কিংবা মশকীর দেহে ডিম তৈরি হয়। এই ডিমের পুষ্টি ও পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্যই রক্ত চুষে খেতে হয় মশকীকে।
এখন কথা হলো, ডিম তো থাকে মশকীর দেহে, তাহলে রক্ত প্রয়োজন হওয়া উচিত মশকীর। কিন্তু কেন আমরা বলি ‘মশার কামড়’! পুরুষ মশারা আসলে কামড়ায় না, রক্তের পরিবর্তে বিভিন্ন ফলের রস খেয়ে জীবন ধারণ করে থাকে, স্ত্রী মশা অর্থাং মশকীরাই কেবল মানুষ ও নির্বাক প্রাণীদের কামড়ে থাকে রক্তের আশায়।
যদিও আমরা মশার এই রক্ত খাওয়াকে কামড়ানো বলি, কিন্তু রক্ত শুষে নেবার পুরো প্রক্রিয়াকে ইঞ্জেকশন দিয়ে রক্ত সংগ্রহের সাথে তুলনা করা যায়। মশার শোষক ছয়টি সূঁচের তৈরি একটি সিরিঞ্জের মতো অংশ। এর মাধ্যমেই ত্বকের নিচে থাকা রক্তনালী থেকে রক্ত শুষে নেয় মশারা।
ইঞ্জেকশন যদি দিয়ে থাকেন, তাহলে আপনারা ‘হেক্সিসল’ এর সাথে বেশ পরিচিত। অক্ষত ত্বকে জীবাণু ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে এই হেক্সিসলের। ইঞ্জেকশন দেবার পূর্বে তুলায় করে নীল রঙের একটি তরল পদার্থ দিয়ে ত্বককে মুছে নেয়া হয়। ত্বকে থাকা অসংখ্য জীবাণু ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ত্বকে যে ছিদ্র হয় তা দিয়ে দেহের ভেতর প্রবেশ করতে পারে। তাই আগেই হেক্সিসল দিয়ে ইঞ্জেকশনের স্থানটি পরিষ্কার করে নেয়া হয়।
মশারা হেক্সিসল পাবে কোথায়! তারা যে আমাদের দেহের ত্বকে ছিদ্র করে নিজেদের উদরপূর্তি করছে, ক্ষতি তো ষোলো আনা আমাদেরই। আমাদের রক্ত নিচ্ছে, উপহার হিসেবে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু রেখে যাচ্ছে, সেই সাথে আমাদের ত্বকীয় জীবাণুগুলোকে সুযোগ করে দিচ্ছে জনসমুদ্র নিয়ে রক্তে প্রবেশ করবার।
কিন্তু তৃতীয় ঘটনাটি আসলে ঘটে না। এটি বাঁধা দিতে মশারাই উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মশারা অত্যন্ত দায়িত্বের সঙ্গে হেক্সিসলের মতো জীবাণুনাশক দিয়ে ত্বককে পরিষ্কার করে নেয় কামড়ানোর পূর্বে। ত্বকের যেখানে বসে, সেখানে তাদের একপ্রকার থুতুর মাধ্যমে জীবাণুনাশের কাজটি সম্পন্ন করে। সেই সাথে, আমরা যাতে বুঝতে না পারি যে কামড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে একটি মশা, সে ত্বকের সংবেদী স্নায়ুকে অবশ করে নেয় এই থুতুর মাধ্যমে। লক্ষ্য করে দেখবেন, মশা কামড়ানোর পরই আমরা টের পাই, কেননা ততক্ষণে ধারালো সূঁচ রক্তনালীতে ঢুকে গেছে।
এই তো গেলো কামড়ানোর পর্যায়, এবার আসা যাক রক্ত শোষণকার্যে। শোষক প্রবেশ করিয়ে মশা রক্তনালী খুঁজতে থাকে। প্রয়োজনবোধে স্থান পরিবর্তন করতে হতে পারে। রক্তনালী খুঁজে পেলেই মশার মস্তিষ্কে তথ্য চলে যায় যে, রক্তের সন্ধান পাওয়া গেছে। রক্ত খাওয়ার পূর্বে মশাকে আরো একটি প্রস্তুতিমূলক কাজ করতে হয়।
আমাদের শরীরের কোথাও কেঁটে গেলে ২-৬ মিনিটের ভেতর কিন্তু সেই অংশের রক্ত জমাট বেঁধে রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায়। রক্তের মাঝে হেপারিন নামক একটি পদার্থের উপস্থিতির দরুন রক্ত তরল অবস্থায় শরীরে সঞ্চালিত হয়, জমাট বাঁধে না শরীরের ভেতর। যখন কেঁটে যাওয়া ত্বকের নিচে উপস্থিত হেপারিন বাতাসের সংস্পর্শে এসে ভেঙে যায়, অণুচক্রিকা নামক কিছু ক্ষুদ্র রক্তকণিকা এসে সেখানের রক্তকে জমাট বাঁধিয়ে ফেলে। ফলে রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায়। হেপারিন জাতীয় পদার্থগুলোকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট, যা রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না। রক্তনালী খুঁজে পেলে মশারাও এমন অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট প্রয়োগ করে রক্তের মাঝে। ফলে শান্তি মতো মশা তখন রক্ত শোষণ করে নিতে পারে। রক্ত খেতে পেটকে তিনগুণ ফুলিয়ে নিতে পারবে একটি মশা।
মশার রক্তশোষণের কারণ জানা হলো, এবার জানা যাক মশাদের জীবনে এরপর কী কী ঘটে সেই সম্পর্কে।
প্রায় সকল পোকামাকড়ের মতো পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠতে একটি মশাকে চারটি ধাপ সম্পন্ন করতে হয়।
১) নিষিক্ত ডিম
একটি মশকী তার পুরো জীবদ্দশায় প্রায় ৫০০টির মতো ডিম পাড়তে পারে। প্রতিবারে ৫০-১০০টি করে করে ৫০০টির মতো ডিম পাড়ে নির্দিষ্ট সময় পরপর। তারপর ধীরে ধীরে স্ত্রী মশারাও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ডিম ফেটে পানির ভেতরেই অবমুক্ত হয় লার্ভাগুলো। ডিম ভেঙে বেরিয়ে আসার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। এটি নির্ভর করে পানির তাপমাত্রা এবং পানিতে উপস্থিত পুষ্টি উপাদানের উপর। এছাড়াও প্রজাতিভেদে এই সময়টুকু বিভিন্ন হয়ে থাকে।
২) লার্ভা
লার্ভা পানিতে ঘুরে বেড়ায় এবং বারবার পানির উপর পৃষ্ঠে আসে শ্বসনের জন্য। একটি লার্ভা এই ধাপে মোট চারবার ত্বক পরিবর্তন করে, প্রতিবারই অল্প অল্প করে বেড়ে ওঠে। ত্বক পরিবর্তনের এই ঘটনাকে বলা হয় মোল্টিং। পানিতে থাকা ক্ষুদ্র অণুজীব ভক্ষণের মাধ্যমে পুষ্টি আহরণ করে থাকে লার্ভা। চতুর্থবার মোল্টিং এর মধ্য দিয়েই একটি লার্ভা হয়ে ওঠে পিউপা।
৩) পিউপা
এই লার্ভাগুলো উপযুক্ত পুষ্টি পেয়ে একসময় পিউপা ধাপ শুরু করে। অতঃপর পরবর্তী ২-৭ দিনের মাঝে ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে উঠে পূর্ণাঙ্গ মশাতে, যার বাঁচার জন্য পানির প্রয়োজন নেই। সে এখন উড়তে সক্ষম।
৪) পূর্ণ মশা
পিউপা ধাপ পেরিয়ে পূর্ণাঙ্গ মশায় পরিণত হয়ে সঙ্গে সঙ্গেই পানি ছেড়ে উড়াল দেয় না, কিছুটা সময় পানির পৃষ্ঠে অবস্থান করে। এই সময়ের মাঝে নিজের দেহকে বাতাসে শুকিয়ে নেয়, অপেক্ষা করে পাখা আর পা কিছুটা দৃঢ় হয়ে ওঠার জন্য। পাখাগুলো ভালোমতো শুকালে একটি মশা উড়তে শুরু করে। প্রজনন ও রক্ত শোষণের জন্য আরো কয়দিন অপেক্ষা করে।
একটি পূর্ণাঙ্গ মশাতে দুটি পুঞ্জাক্ষীসমৃদ্ধ একটি মাথা থাকে, বুক, পেট, একজোড়া পাখা আর ছয় জোড়া পা থাকে। মশাদের একটি অ্যান্টেনা ও শুঁড়ও থাকে।
পূর্ণাঙ্গ মশায় পরিণত হবার পর তাদের মাথায় দুটো নির্দেশই ঘুরতে থাকে- বংশবৃদ্ধি আর পুষ্টি আহরণ।
মশার জীবনচক্রের প্রথম তিনটি ধাপের জন্য পানির উপস্থিতি প্রয়োজন। অর্থাৎ একদম শুরুতে ডিম ভেঙে লার্ভা বেরিয়ে আসতে হলে মা মশাকে পানিতে ডিম পাড়তে হবে। মশকীরা সাধারণত স্থির জমে থাকা পানি কিংবা পানির নিকটবর্তী কোনো স্থানে ডিম পেড়ে থাকে। শুকনো স্থানে কয়েক মাস পর্যন্ত ডিমগুলো অক্ষত থাকতে পারে। এ কারণেই বলা হয়, বাসস্থানের আশেপাশে যদি কোনো স্থির পানির উৎস থাকে, তবে তা সরিয়ে ফেলতে।
সাধারণত ডিম পাড়া থেকে শুরু করে দুই সপ্তাহের মাঝেই একটি মশা উড়তে ও বংশবৃদ্ধিতে সক্ষম হয়ে উঠতে পারে। সবকিছুই নির্ভর করে পরিবেশের অনুকূলতা আর পুষ্টির উপস্থিতির উপর।
পুরুষ মশারা পানি থেকে উঠে এসে একদিনের মতো অপেক্ষা করে। এই সময়েই তাদের জননাঙ্গ কর্মক্ষম হয়ে উঠে। তারপর স্ত্রী মশাদের পাখার শব্দ শুনে খুঁজে বের করে তাদের। মশকীদের সাথে যৌন জননে মিলিত হয়। ডিমকে নিষিক্ত করতে শুক্রাণু স্থানান্তর করে দেয় স্ত্রী দেহে। প্রজননের শেষে পুরুষ মশাগুলো বড়জোড় ৩-৫ দিনের মতো বেঁচে থাকে। কেননা বাকি সব কাজ স্ত্রী মশারাই করে নিতে পারে, স্ত্রী মশারা প্রায় একমাসের মতো বেঁচে থেকে।
প্রজনন শেষে, এবার নিষিক্ত ডিমের পূর্ণতা ও পুষ্টির জন্য প্রয়োজন রক্ত, উত্তপ্ত রক্ত। উত্তপ্ত রক্তের সন্ধানে স্ত্রী মশারা সূর্যাস্তের পরপরই ধেয়ে আসতে শুরু করে জীবন্ত প্রাণীদের দিকে। প্রায় ১০০ ফুট দূরত্ব থেকে মশারা টের পায়, ঠিক কোথায় উত্তপ্ত রক্তের সন্ধান পাওয়া যাবে। নিঃশ্বাসের সাথে যে আমরা কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করি, এই কার্বন ডাইঅক্সাইড ও ত্বকের ঘর্মগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত ল্যাকটিক এসিডের কারণেই মশারা বুঝতে পারে প্রাণীদের অবস্থান।
লেখার দ্বারপ্রান্তে একটি মজার জিনিস সম্পর্কে জানানো যাক আপনাদের। রক্ত শোষণের সাথে সাথে মশারা আপনার গায়ের উপর বর্জ্য নিষ্কাশন অর্থাৎ প্রস্রাব করে দিয়ে যায়। এর কারণ হলো, শরীরে আরো বেশি পরিমাণ রক্ত রাখার জন্য জায়গা খালি করে মশারা। আপনি যতক্ষণ পর্যন্ত না তাড়িয়ে দেবেন, মশা কিন্তু রক্ত খেতেই থাকবে, পেট ভরে রক্ত খেয়ে ঢোল হয়ে পড়ে থাকলেও তাদের সেটি নিয়ে মাথাব্যথা নেই। রক্ত খাওয়া সীমাহীন হারে চলবে, যতক্ষণ না নড়ন চড়নে অক্ষম হয়ে পড়বে। এত রক্ত খেতে গিয়েই প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীরের অপ্রয়োজনীয় পানি বের করে দেয় মশারা।
কামান দাগান কিংবা না দাগান, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে মশার কামড় থেকে নিজেকে বাঁচান। রক্ত শোষণ করে নেয়া তেমন কোনো ক্ষতি নয়। তবে সেই সাথে বিভিন্ন জীবাণুকে দেহে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে যাওয়াটা খুব খারাপ। এতে জীবনহানি পর্যন্ত হতে পারে। তাই মশার কামড় থেকে বাঁচুন। আমাদের জন্য সুখবর হলো, মশাগুলো খুব বেশি দিন বাঁচে না, নাহয় আরো অত্যাচার করে যেত মরতে মরতে!
ফিচার ইমেজ: James Gathany