![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/03/maxresdefault-19.jpg?w=1200)
আপনি হয়তো রাস্তা দিয়ে আপনমনে হাঁটছেন। চারপাশের বাড়িঘর, মানুষজন সবই আপনার অচেনা। হঠাৎ করে কোনো বাড়ি, মানুষ বা অন্য কিছু দেখে আপনার মনে হলো আপনি এটি আগে দেখেছেন। খুব চেনা চেনা লাগছে মানুষ বা জিনিসটি। অথচ, আপনি সত্যিই তা আগে কখনো দেখেন নি। বিজ্ঞানের ভাষায়, আমাদের হঠাৎ এই প্রতিক্রিয়ার নাম হলো ‘দেজা ভ্যু'(Deja Vu)। আমাদের সবার সাথেই কম-বেশি এই বিষয়টি ঘটে থাকে। আজ আমরা জানবো এই বিষয়টির আদ্যোপান্ত।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/03/yd8f954y-1357710688-680x531.jpg)
নতুন কিছুকে আগে থেকে পরিচিত মনে হওয়াই দেজা ভ্যু; source: theconversation
দেজা ভ্যু কী?
দেজা ভ্যু কথাটি মূলত ফরাসি ভাষা থেকে এসেছে (Déjà vu), যার বাংলা ‘ইতোমধ্যে দেখা’। এর অন্য নামটি হচ্ছে পারামনেসিয়া, যা মূলত গ্রিক শব্দ ‘প্রোমনেসিয়’ থেকে এসেছে। প্রোমনেসিয় শব্দটির বুৎপত্তি παρα এবং μνήμη নামের দুটি গ্রিক শব্দ থেকে। παρα শব্দটির অর্থ নিকটে, বিপক্ষে অথবা পরিপন্থী এবং μνήμη শব্দটির অর্থ স্মৃতি। সুতরাং পারামনেসিয়া অর্থ হচ্ছে এমন একটি নিশ্চিত অনুভবের অভিজ্ঞতা যা একজন ইতোপূর্বে এমন পরিস্থিতি সম্মুখীন হয়েছে অথবা স্বচক্ষে দেখেছে।
এক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে একটি পরিস্থিতি বা দৃশ্য দেখে হঠাৎ করে তা আগে থেকে পরিচিত মনে হওয়ার অনুভূতিই হচ্ছে দেজা ভ্যু। এক্ষেত্রে ঘটনা/দৃশ্য/অনুভূতিটি পরিচিত মনে হলেও ব্যক্তির মধ্যে তা নিয়ে একটি অনিশ্চয়তা কাজ করে।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/03/main-680x340.jpg)
দেজা ভ্যুর ক্ষেত্রে কাজ করে একটি অনিশ্চয়তা; source: frontiersin
কিভাবে আসলো এই নাম
দেজা ভ্যু নামটি প্রচলিত হবার বেশ আগে থেকেই বিভিন্ন সাহিত্যিক এবং মনস্তাত্ত্বিকের লেখনীতে এই ধরনের পরিস্থিতির বর্ণনা পাওয়া যায়। কিন্তু তখন পুরো বিষয়টি এককথায় প্রকাশের জন্য কোনো নাম ছিল না। ফরাসি মানসিক বিশ্লেষক এমিল বোইরেক সর্বপ্রথম এই নামটি ব্যবহার করেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন তিনি মানসিক বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ (L’Avenir des sciences psychiques) নামের একটি বই লিখেন। বইটির একটি প্রবন্ধে তিনি দেজা ভ্যু শব্দ দুটি ব্যবহার করেন।
প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ
সুইচ গবেষক আর্থার ফাঙ্কহাউজার দেজা ভ্যু প্রক্রিয়াটিকে (déjà experiences) বোঝার সুবিধার জন্য অভিজ্ঞতার পার্থক্যের ভিত্তিতে দুটি বিশেষ ভাগে ভাগ করেন।
- ইতোপূর্বে দেখা বা পরিদর্শন করা হয়েছে এমন অভিজ্ঞতা (déjà visite)
- ইতোপূর্বে অনুভব করা হয়েছে এমন অভিজ্ঞতা (déjà vecu)
পৃথিবীতে এমন লোক কমই আছেন যাদের এই অভিজ্ঞতা হয়নি। সাউদার্ন মেথোডিস্ট ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী অ্যালান এস. ব্রাউন ২০০৩ সালে তার এক অনুসন্ধানের ভিত্তিতে বলেন-
“পৃথিবীর ৭০ ভাগের বেশি মানুষ তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময় এই পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছেন।”
দেজা ভ্যু কি কোনো মানসিক সমস্যা?
এই অভিজ্ঞতা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও মনোবিজ্ঞানের সাথে এর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। হ্যালুসিনেশন জাতীয় অন্যান্য উপসর্গের সাথে কেউ যদি বারবার দীর্ঘ সময়ের জন্য এই ধরনের পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেন তবে সেক্ষেত্রে তা ব্যক্তির ক্ষেত্রে ‘মানসিক বা স্নায়বিক অসুস্থতার লক্ষণ’ হিসেবে বিবেচিত হয়।
দেজা ভ্যুর কারণ হিসেবে সচরাচর যে বিষয়টি উল্লেখ করা হয় তা হচ্ছে মস্তিষ্কে স্নায়ুতন্ত্রের সাময়িক স্থবিরতা। স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যতিক্রম ঘটলে এক শক্তিশালী সংবেদনশীলতার সৃষ্টি হয়, যার ফলে বর্তমানের কোনো ঘটনা বা অভিজ্ঞতাকে অতীতের সাথে মেলানোর একটি প্রবণতা অর্থাৎ দেজা ভ্যু পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
প্রথমদিকে গবেষকেরা দেজা ভ্যুর সাথে দুশ্চিন্তা, মানসিক ভীতি, স্কিৎজোফ্রেনিয়ার মতো বিভিন্ন ধরনের মানসিক জটিলতা সাথে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাদের এই পরস্পর নির্ভরশীলতা বা পারস্পরিক সম্পর্কের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০০৮ সালের এক সমীক্ষায় দেজা ভ্যু বিষয়টির সাথে মনোবিজ্ঞানের এক সম্পর্ক পাওয়া যায়। তখন দেজা ভ্যু বিষয়টি একটি ‘আবেগপূর্ণ পৃথক অভিজ্ঞতা’ (pathological dissociative experiences) হিসেবে গবেষণায় উঠে আসে।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/03/U5dqw6mD2QuTSbq7dBkPMLtEt3YtGbZ_1680x8400-680x511.jpg)
দেজা ভ্যু কোনো মানসিক সমস্যা নয়; source: amazonaws
দেজা ভ্যু সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাখ্যা
দেজা ভ্যু বিষয়টি নিয়ে অনেক গবেষকই কাজ করেছেন। অতীতে থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত অনেকেই তাদের গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে নানা রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ব্যাখ্যাগুলো বিশ্লেষণ সাপেক্ষে দেজা ভ্যু হওয়ার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় ‘প্রভাবক’ হিসেবে উঠে আসে। এগুলো হলো-
- স্বপ্নের প্রভাব
- অতীত স্মৃতির প্রভাব এবং
- মস্তিষ্কের প্রভাব।
এক্ষেত্রে সবথেকে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাটি হচ্ছে-
“দেজা ভ্যু প্রক্রিয়াটি স্মৃতির সাথে সম্পর্কিত। একটি ধ্বনি যেমন হঠাৎ করে আমাদের জিহ্বার ডগায় চলে আসে, ঠিক তেমনি কোনো স্মৃতি হঠাৎ করেই আমাদের মানসপটে চলে আসতে পারে। কিন্তু এখানে সমস্যা হচ্ছে- জাগ্রত এই স্মৃতি পুরোপুরি একটি অবচেতন প্রক্রিয়া, অনেকটা স্বপ্নের মতো।”
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/03/Deja-vu-1024x768-680x510.jpg)
দেজা ভ্যুর ক্ষেত্রে প্রচলিত আছে নানা ব্যাখ্যা; source: espritsciencemetaphysiques
অ্যানি ক্লেরির গবেষণা
কলোরাডো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ববিদ অ্যানি ক্লেরি অনেকদিন ধরেই দেজা ভ্যু নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার মতে,
প্রক্রিয়াটি মূলত আগের কোনো শঙ্কা থেকেই সৃষ্টি হয়। এটা আমাদের অনুভূতির সাথে জড়িত। কোনো ব্যক্তির স্বাভাবিক অনুমান থেকে দেজা ভ্যু অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি অপেক্ষাকৃত সঠিকভাবে ভবিষ্যতের বিষয়ে ধারণা করতে পারেন।
অন্যান্য অনেক বিজ্ঞানীই বিভিন্ন সময়ে দেজা ভ্যুর সাথে মনের নিবিড় সম্পর্কের কথা বলেছেন। কিন্তু ক্লেরির মতানুসারে, এক্ষেত্রে পূর্ব ধারণাই নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে।
তিনি বলেন,
“আমরা সচেতনভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সমসময় মনে করতে পারি না। কিন্তু আমাদের মস্তিস্ক এক্ষেত্রে একটি সাদৃশ্য খুঁজে বেড়ায়। এ কারণেই আমাদের মধ্যে এমন একটি অনিশ্চিত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় যে, আমাদের মনে হয় এটা আমরা আগে করেছি বা আমাদের সাথে এমন ঘটনা আগে ঘটেছে। কিন্তু ‘কেন বা কোথায়’- এর কোনো উত্তর থাকে না আমাদের কাছে।”
১৯৫৯ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়,
দেজা ভ্যুর কারণ হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্কের বহিঃস্তরের সাময়িক উদ্দীপনা।
এই পর্যবেক্ষণের উপরে ভিত্তি করে ক্লেরি ২৯৮ জন ব্যক্তির উপরে এক পরীক্ষা চালান। তাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে একই কম্পিউটার গেম খেলতে দেওয়া হয়। এই পরীক্ষার ফল দেজা ভ্যু সম্পর্কে আগের প্রতিষ্ঠিত ধারণাগুলোকে অস্বীকার করে। ক্লেরি নতুন করে বলেন,
“দেজা ভ্যুর অভিজ্ঞতা কখনোই ভবিষ্যতের ব্যাপারে ধারণা প্রদান করে না।”
![]()
অ্যানি ক্লেরির পরীক্ষা; source: colostate.edu
রহস্যের সমাধান
যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আকিরা ও’কনর এবং তার দলের সম্প্রতি পরিচালিত এক গবেষণায় চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য পাওয়া গিয়েছে। তাদের পরিচালিত গবেষণায় দেজা ভ্যু অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে ‘মিথ্যা অতীত স্মৃতির’ বিষয়টি পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দেজা ভ্যু অভিজ্ঞতা অনেকদিন ধরেই জনসমক্ষে এক অভেদ্য রহস্য হিসেবে ছিল। তারা দাবি করেন, ল্যাবে বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা এই দেজা ভ্যু রহস্যের সমাধান করতে সক্ষম হয়েছেন।
আকিরা মূলত হোসি উরকুহার্টের পদ্ধতি অবলম্বন করে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে একটি পরীক্ষা চালান। ‘অতীত স্মৃতির’ উপর গবেষণা করে দেজা ভ্যু অভিজ্ঞতার জন্য তাদের পুরনো কিছু স্মৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। আকিরা তার ব্লগে লিখেন,
“মস্তিষ্কের সাথে আমাদের পুরনো স্মৃতির সম্পর্কটা আসলে এক ধরনের যুদ্ধের মতো, এখানে মিথ্যার কোনো জায়গা নেই। ব্যক্তিবিশেষের কতটুকু মনে থাকছে তার উপর নির্ভর করেই ‘দেজা ভ্যুর’ ব্যাপারটি ঘটে থাকে।”
আকিরার পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের কয়েকটি শব্দ পড়তে দেয়া হয়। শব্দগুলো এমন- বিছানা, বালিশ, রাত, স্বপ্ন ইত্যাদি। এই শব্দগুলো ঘুমের সাথে সম্পর্কিত হলেও ঘুম শব্দটি তাদের পড়তে দেওয়া হয় নি। কিন্তু যখন পরবর্তীতে শব্দগুলো বলতে বলা হলো, তখন তাদের মধ্যে একটি ‘তাড়না বা উত্তেজনা’ সৃষ্টি করা হয় যাতে তারা ‘ঘুম’ শব্দটি শুনেছেন বলে মনে করেন। কৌশলটি ছিল একটি ‘মিথ্যা স্মৃতি তৈরির প্রয়াস’, যা মূলত তাদের সাথে ঘটেনি। S আদ্যাক্ষরের Sleep শব্দটির প্রতি একটি ইংগিত দেয়ার পরে তারা শুনেছেন কিনা জিজ্ঞাসা করলে তাদের তরফ থেকে ‘না’ সূচক উত্তর আসে।
এই পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে আকিরা ও’কনর বলেন,
“দেজা ভ্যু অভিজ্ঞতার সাথে পুরনো কোনো স্মৃতির সংযোগ স্থাপন মূলত নিরর্থক।”
ফিচার ইমেজ- youtube.com