সাইক্লিং শেখাতে গিয়ে গল্পের ছলে আজকাল বেশ মজার মজার অবস্থার মুখোমুখি হই। যারা আমার স্কুলে সাইক্লিং শিখতে আসে, তাদের কাছে শুরুতেই আমি জানতে চাই তারা কেন সাইক্লিং শিখতে চাইছে। আর এখান থেকেই মজার ব্যাপারগুলো উঠে আসে। তো একবার এমন হলো, পাঁচ বোন একসাথে সাইক্লিং শিখতে এসেছে, কারণ তাদের আরো এক বোন এর আগে আমারই স্কুল থেকে সাইক্লিং শিখে যাবার পর দারুণভাবে ওজন কমিয়ে মোটামুটি স্লিম হয়ে গেছে। যতই তারা জানতে চায় সেই বোনের কাছে কী এই রহস্য, রোজ কত ঘণ্টা সে সাইক্লিং করে, বোন আর কিছুতেই বলে না। অগত্যা তারা আমারই কাছে এলো সাইক্লিং করে শুকিয়ে যাবার রহস্য উদ্ধার করতে।
বিজ্ঞানের জ্ঞান
নিজের শরীরটাকে ভালোবাসায় কোনো ক্ষতি নেই। যত মোটাই আমরা হই না কেন, মনে মনে একটা ইচ্ছে সবসময় থাকে, “আহা একটু যদি ওজনটাকে কমাতে পারতাম!” যেসব মেয়ে ওজন কমিয়ে সুন্দর অবয়ব পেতে চায়, তাদের আমি সাধুবাদ জানাই। কিন্তু আমরা আসলে ঠিক কতটুকু ওজন কমাতে চাই? ঠিক কতখানি শুকনো স্বাস্থ্যের অধিকারী হলে আমরা নিজেদের নিয়ে খুশি থাকি?
সায়েন্টিফিক আমেরিকান এর আগস্ট, ১৯৯৬ সালের ইস্যুতে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে মেয়েদের শরীরে শতকরা Fat Mass এর পরিমাণ ছেলেদের তুলনায় সবসময় বেশি। জন্ম থেকে ৮ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলে-মেয়ে প্রত্যেকের শরীরে এই ফ্যাট সেলের সংখ্যা প্রায় সমান থাকলেও ৮ বছর বয়সের পর থেকে মেয়েদের শরীরের ফ্যাট সেলের আকৃতি পরিবর্তিত হতে থাকে। ১৯৯৬ সালের মে মাসে প্রকাশিত Nagy TR-এর এক গবেষণায় জানা যায়, ফ্যাট সেলের এই তুলনামূলক বড় আকার-আকৃতির কারণে মেয়েদের শরীরে স্বাভাবিক সময়ে ফ্যাট থেকে শক্তি তৈরি করার হার কম থাকে যাকে আমরা বলি Basal Fat Oxidation Rate। কিন্তু একই সাথে এই জমে থাকা আন্তঃশক্তি মেয়েদের প্রয়োজন হয় সন্তান জন্ম দিতে, মা হয়ে ওঠার সময়।
১৯৮৮ সালে আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশানের এক মিটিং এ Dr. Rudolph L. Leibel জানান, অন্তঃসত্ত্বা হয়ে সন্তান ধারণের জন্য একজন মাকে প্রায় ৮০,০০০ ক্যালোরির ফ্যাট সেল বহন করতে হয়। এই ক্যালোরি সন্তান বহন আর মায়ের শরীরে থাকা অবস্থায় তাকে খাবার জোগানোর জন্য দরকার পড়ে, যেটা সন্তান ধারণের আগ পর্যন্ত মেয়েদের শরীরের নিম্নাংশে জমা থাকে।
এতকিছুর সারমর্ম হলো, প্রাকৃতিকভাবেই মেয়েরা তাদের শরীরে ছেলেদের চেয়ে বেশি ফ্যাট সেল বহন করে, কারণ পৃথিবীতে পরম্পরা বজায় রাখার জন্য তাদেরকে সন্তান জন্মদানের মতো একটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এটাকে যদি মেয়েদের জন্য প্রকৃতি প্রদত্ত সুবিধা হিসেবে ধরি, তাহলে এর আপাত অসুবিধার কথাও এবারে বলতে হয়!
দেখতে আমি মোটা কেন?
অমুকের চেয়ে আমি কেন এতো মোটা- এই অভিজ্ঞতা কিংবা অনুভূতি মনে হয় বেশিরভাগ মেয়ের ক্ষেত্রে সত্যি। কেন আমার তলপেট, উরু, নিতম্ব সুন্দর আকৃতির না? কেন চর্বি-জমা ভাঁজ খাওয়া কোঁচকানো আমার নিম্নাংশ?
বড় হয়ে যাবার পর নতুন করে কোনো ফ্যাট সেল কিন্তু জন্ম নেয় না। জন্মের সময় যে ফ্যাট সেল তৈরি হয়, সেগুলো প্যাকেটের মতো জমতে থাকে বিশেষ বিশেষ অংশে। এর সাথে খাবার থেকে আসা বাড়তি ক্যালরি যোগ হয়। এই বড় বড় ফ্যাট প্যাকেটগুলো ফুলে ফেঁপে চামড়ার নিচ থেকে আলাদাভাবে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়। যেহেতু বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের চামড়ার পুরুত্ব এবং স্থিতিস্থাপকতা কমতে থাকে, তাই পনিরের মতো রঙের এই ফ্যাট প্যাকেটগুলো সহজেই বাইরে থেকে বোঝা যায় ভাঁজ খাওয়া, অসমান এবড়ো-থেবড়ো চেহারায়, যাকে আমরা বলি সেলুলাইট।
দ্য মাইন্ড গেইম
এই লেখার ম্যাজিকাল সূচনা যে কারণে সেখানে চলে আসি। আমরা মেয়েরা আমাদের ওজন নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তায় দিন পার করি এটা যেমন সত্যি, ছেলেরাও করে না- তা ভাবা ভুল। লেখার শুরুটা মেয়েদের নিজেদের শারীরিক ওজন নিয়ে স্বীয় দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে শুরু হলেও মূলত আমি সেসব ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ভাবছিলাম, যারা নিজেদের ওজন নিয়ে সবসময় লজ্জা, গ্লানি আর হীনমন্যতায় ভোগে। এটা ঠিক যে মোটা মেয়েদের ক্ষেত্রে এই অনুভূতিগুলো আরো বেশি কাজ করে। কারণ আমাদের সাধারণ সামাজিক প্রেক্ষাপটে মেয়েদেরকে সুন্দর দেখানোর, সুন্দর অবয়বের অধিকারী হয়ে ওঠার জন্য মানসিকভাবে ক্রমাগত আক্রমণ করা হয়। এ কারণেই যে মেয়েটা স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের অধিকারী সে স্বপ্ন দেখে জিরো ফিগার পাবার। আমাদের নাটক, চলচ্চিত্র, মিডিয়া মেয়েদেরকে ছোটবেলা থেকেই ভাবতে বাধ্য করে ৩৬-২৮-৩৬ হলো আদর্শ ফিগার। বার্বি কার্টুন দেখতে দেখতে আর বার্বি হাউজ নিয়ে খেলতে খেলতে যে বাচ্চা মেয়েটা বেড়ে ওঠে, সে নিজের অজান্তেই মাথার ভেতর ধারণ করে বার্বির চেহারা, অবয়ব, পোশাক আর সাজসজ্জা।
মিডিয়া কিংবা পারিপার্শ্বিকতা যে কারণেই হোক না কেন, শরীরে জমে থাকা অতিরিক্ত চর্বি পোড়াতে আমরা কী না করি! ক্রাশ ডায়েটের নামে না খেয়ে থাকা, মাত্রাতিরিক্ত ব্যায়াম, চর্বি কমানোর ক্রিম, ওষুধ, ভেষজ কোনকিছুই বাদ যায় না। কিন্তু খুব সাধারণ মাইন্ড গেইম কি খেলি? জার্নাল অব নিউরো-ফিজিওলজিতে প্রকাশিত Brian C. Clark এর গবেষণায় জানা যায়, শুধুমাত্র ব্যায়ামের চিন্তা করলে আমাদের শরীরে যে প্রাণপ্রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া হয়, তা জিমে গিয়ে চর্বি পোড়ানোর ও মাংসপেশীর কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য ব্যায়াম করার সমতুল্য। অন্যভাবে বলা যায়, শুধু ব্যায়াম করার চিন্তা আমাদের শরীরের মাংশপেশীকে দৃঢ় করে, ক্যালোরি অপচয় ও কোষের মৃত্যুহার কমায়।
আমাদের মস্তিষ্কের কর্টেক্স অংশ যেহেতু আমাদের মাংসপেশীর নড়াচড়া এবং পারস্পারিক সমন্বয়ের জন্য কাজ করে, তাই এই মাইন্ড গেইম অথবা চিন্তা-ভাবনার খেলা বাস্তবিক অর্থে আমাদের শারীরিক কর্মক্ষমতা বাড়াতেও পারে- এই চিন্তা থেকে ক্লার্কের গবেষণার শুরু। ক্লার্কের নির্দেশনায় ওহাইয়ো ইউনিভার্সিটির আরো জনাকয়েক গবেষক দুটো দলে ভাগ করে কিছু মানুষ নিয়ে এই পরীক্ষা চালান। একটি দলের কাজ ছিলো গবেষকদের দেয়া ব্যান্ড হাতে জড়িয়ে ১১ মিনিট ধরে টানা বসে থেকে ব্যায়ামের চিন্তা করা। প্রতি সপ্তাহে ৫ দিন করে টানা ৪ সপ্তাহ তাদেরকে এই কাজ করানো হয়। অন্য দলটিকে এর কিছুই করতে বলা হয় নি। ৪ সপ্তাহ পরের ফলাফলে দেখা যায়, প্রথম দলের শরীরের মাংশপেশী অন্য দলের প্রত্যেকের তুলনায় সবল এবং দৃঢ়। পাশাপাশি তাদের মস্তিষ্কও অনেক বেশি কর্মক্ষম।
এসো ব্যায়ামের স্বপ্ন দেখি!
জিমে যাবো, খাবার মেপে খাবো, সাইক্লিং করবো, সাঁতার কাটবো- এই সবকিছু অবশ্যই ফেলে দেয়ার মতো নয়। ওজন নিয়ন্ত্রণে আমাদের সব চেষ্টাকে একেবারে বাতিলের খাতায় ফেলে দিতে বলছি না। তবে সবকিছুর আগে দরকার একটি ইতিবাচক মানসিকতা। কে কীভাবে ওজন কমিয়ে কমিয়ে শুকিয়ে গেলো, আমি কেন তার মতো হতে পারছি না- এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা বাদ দিয়ে সেই সময়টুকু ব্যায়ামের চিন্তায় কাজে লাগালেও কিন্তু বিরাট লাভ। ক্লার্কের গবেষণার ফলাফল অন্তত সে কথাই বলে!