প্রায় এক দশক আগের কথা। এক ঘামে ভেজা গ্রীষ্মের দুপুরে মিনু তিওয়ারি গিয়েছেন পশ্চিম ভারতের সুরাটের একটি সুতো কারখানায়। একজন আর্বান প্ল্যানার হিসেবে তিনি প্রায়শই এরকম পরিদর্শনে গিয়ে থাকেন, বিভিন্ন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি কীভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে তা খতিয়ে দেখার জন্য। কিন্তু ঐদিন তিনি এমন কিছু আবিষ্কার করলেন, যা তাকে পুরোপুরি হতবুদ্ধি করে দিল।
সে দিনটি ছিল ওয়ার্কিং ডে। বিশেষ কোনো ছুটিছাটাও সেদিন ছিল না। কিন্তু তবু তিনি কোনো কর্মরত শ্রমিককে দেখতে পেলেন না। চারিদিকে শুধু মেশিন আর মেশিন। খাঁ খাঁ করছে গোটা কারখানার পরিবেশ। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তিনি দেখতে পেলেন, নিকটস্থ একটি শামিয়ানার নিচে ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছে সব শ্রমিক।
ভরদুপুরে কাজ ফেলে রেখে এমন বিশ্রামের কারণ কী?
কারণ খুবই সহজ। সূর্যের প্রচণ্ড খরতাপ আর দাবদাহের ফলে শ্রমিকরা কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই এটা-সেটা ভুল করে ফেলে। আবার অনেকে মেশিনে কাজ করতে গিয়ে অজ্ঞানও হয়ে যায়। এসব সমস্যার সমাধান হিসেবেই কোম্পানির পক্ষ থেকে দুপুরের এই নির্দিষ্ট সময়টায় তাদেরকে বিশ্রাম নিতে বলা হয়েছে। অবশ্য এই বাড়তি সুবিধাটুকু পাওয়ার জন্য তাদেরকে সকালে আগেভাগেই কারখানায় চলে আসতে হয়, আবার কারখানা ত্যাগ করতেও হয় নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে।
এ পর্যায়ে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, মানবদেহ এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে, ওয়েট-বাল্ব টেম্পারেচার তথা উষ্ণতা ও আর্দ্রতা সম্মিলিতভাবে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে, তারা আর সেই চরম উষ্ণতা সামলে কাজ চালিয়ে যেতে পারে না।
এ ব্যাপারটি নানাবিধ প্রমাণ সাপেক্ষে আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, তাপমাত্রা যখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং মানবদেহের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে থাকে, তখন মানুষের বিভিন্ন কাজের পারফরম্যান্স ও সামগ্রিকভাবে তাদের কোপিং মেকানিজম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিশেষজ্ঞরা আবার চরম উষ্ণতার সঙ্গে মানুষের আচরণগত আগ্রাসন বৃদ্ধি, অবধারণগত ক্ষমতা হ্রাস এবং উৎপাদন ক্ষমতা খোয়ানোর সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন।
একদিকে যখন বৈশ্বিক তাপমাত্রা ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী, অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তকে সেদ্ধ করে দিচ্ছে রেকর্ড-ভাঙা হিটওয়েভ, তখন চরম উষ্ণতা মানব আচরণের উপর অদূর ভবিষ্যতে খুব খারাপ ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলেও সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষত স্বল্প-আয়ের জনগোষ্ঠী ও দেশসমূহ, যাদের কাছে পর্যাপ্ত সংস্থান নেই প্রচণ্ড দাবদাহের মাঝেও নিজেদেরকে শীতল রাখার, তারা হয়তো এক্ষেত্রে সামনের সারির ভুক্তভোগীতে পরিণত হবে।
অর্থাৎ, চরম উষ্ণতার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবসমূহ বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হলেও, যে প্যাটার্নে এরা মানুষকে আক্রান্ত করে, সে প্রক্রিয়াটি যারপরনাই বৈষম্যমূলক ও অসম।
উষ্ণতা ও আগ্রাসন
বিজ্ঞানীরা বিগত এক শতকেরও বেশি সময় ধরে নথিভুক্ত করে যাচ্ছেন যে চরম উষ্ণতায় মানবজাতিকে কোন কোন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অবশ্য, সেসব কাজের অধিকাংশই সংঘটিত হয়েছে উচ্চমাত্রায় নিয়ন্ত্রিত ল্যাব সেটিংসে, যার ফলে সেগুলোর সঙ্গে প্রকৃত বাস্তবতার অনেক ফারাক থাকাই স্বাভাবিক।
যেমন ধরুন, কয়েক দশক আগে, সামাজিক মনস্তত্ত্ববিদ ক্রেইগ অ্যান্ডারসন এবং তার সহকর্মীরা তাদের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদেরকে দেখিয়েছিলেন এক দম্পতির মধ্যকার কথোপকথনের চারটি ভিডিও ক্লিপ। একটি ক্লিপের টোন বেশ নিরপেক্ষই ছিল। কিন্তু বাকি তিনটি ক্লিপে দেখানো হয়েছিল কীভাবে ওই দম্পতির মধ্যে উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে।
ওই ভিডিও ক্লিপগুলো দেখছিল যে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীরা, তারা প্রত্যেকেই বসে ছিল একটি করে রুমে, যেখানকার থার্মোস্ট্যাটে পাঁচটি ভিন্ন ধরনের তাপমাত্রার যেকোনো একটি সেট করা ছিল। সেই বিভিন্নতা শুরু হয়েছিল সর্বনিম্ন ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস ঠান্ডা থেকে, এবং শেষ হয়েছিল ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা পর্যন্ত।
গবেষকরা এরপর ওই শিক্ষার্থীদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন দম্পতিটির পারস্পরিক বৈরীভাবের মাত্রাকে স্কোরিং করতে। সেই স্কোরিং থেকে অ্যান্ডারসন দেখতে পান, যে শিক্ষার্থীরা উষ্ণ রুমে অস্বস্তিকর অবস্থায় বসে ছিল, তারা এমনকি নিরপেক্ষ টোনের ভিডিওটিকেও তুলনামূলক বেশি বৈরীভাবসম্পন্ন ক্লিপ হিসেবে রায় দিয়েছে। অথচ যেসব শিক্ষার্থীরা শীতল রুমে আরামে বসে ছিল, তারা স্কোরিংয়ের ক্ষেত্রে সঠিক বিচারই করেছে।
এই গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে অ্যান্ডারসন এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে উষ্ণতা মানুষের মেজাজকে অপেক্ষাকৃত বেশি খিটখিটে করে তোলে। তাই তারা তাদের ইন্দ্রিয় দ্বারা যেসব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়, সেগুলোকেও অপেক্ষাকৃত বেশি কদর্য বলে মনে করে। অ্যান্ডারসনের এই সিদ্ধান্ত ও ফলাফল প্রকাশিত হয় ২০০০ সালের অ্যাডভান্সেস ইন এক্সপেরিমেন্টাল সোশ্যাল সাইকোলজিতে।
এই সিদ্ধান্ত থেকে অনুমান করা যেতে পারে, মানুষের প্রকৃত সহিংস আচরণের পেছনে আদতেই চরম উষ্ণতার ভূমিকা থাকতে পারে। কিন্তু সমস্যার ব্যাপার হলো, এই ‘হিট-অ্যাগ্রেশন হাইপোথিসিস’ সংঘটিত হয়েছে ল্যাব সেটিংসে। বাস্তবিকও এরকম কিছু ঘটতে পারে কি না, তা নিরীক্ষা করে দেখা খুবই কঠিন ব্যাপার। তারপরও সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন গবেষণা অন্য নানাভাবে এ ধারণাকে নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে।
এ বছরের জুলাইয়ে প্রকাশিত ন্যাশনাল ব্যুরো অভ ইকোনমিক রিসার্চের একটি গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, ল্যাবের মতো নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতির পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করা হয়েছিল মিসিসিপির জেলখানাগুলোতে, যেখানে পর্যাপ্ত এয়ার কন্ডিশনিংয়ের অভাব রয়েছে।
ইউনিভার্সিটি অভ উইসকনসিন-ম্যাডিসনের অর্থনীতিবিদ অনীতা মুখার্জী এবং কর্নেল ইউনিভার্সিটির নিকোলাস স্যান্ডার্স ২০০৪-১০ সাল পর্যন্ত ৩৬টি কারেকশনাল ফ্যাসিলিটির সহিংসতার হার যাচাই করে দেখেন। সব মিলিয়ে, প্রতিটি ফ্যাসিলিটিতে বছরে গড়ে ৬৫টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। তবে এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই যে, যেসব দিনে বাইরের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠেছিল, যা বছরের ৬০ দিনের মতো হয়ে থাকে, সেসব দিনে কয়েদিদের মধ্যে সহিংসতার সম্ভাব্যতা বেড়ে গিয়েছিল ১৮ শতাংশ পর্যন্ত।
ওইসব দিনের মধ্যে অধিকাংশ সময়ই তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। কিন্তু গবেষকদের প্রাপ্ত রিডিংয়ে মিসিসিপির উচ্চ আর্দ্রতার উল্লেখ ছিল না। তাই এক্ষেত্রে গবেষণায় কিছুটা অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের অনেক পুরনো কারেকশনাল ফ্যাসিলিটিতেই পর্যাপ্ত এয়ার কন্ডিশনিংয়ের অভাব রয়েছে, এবং নেই যথাযথ ভেন্টিলেশন ব্যবস্থাও। তাই ওইসব ফ্যাসিলিটির ভেতরের তাপমাত্রা অনেক ক্ষেত্রে বাইরের তাপমাত্রাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।
রাজনীতিবিদরা প্রায়ই দাবি করে থাকেন, জেলখানায় কয়েদিদের জন্য এয়ার কন্ডিশনিংয়ের ব্যবস্থা করা নাকি তাদের জন্য অভিজাত আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করার সামিল। কিন্তু যখন জেলখানার ভেতর, যেখানে কয়েদিরা বাস করে, সেখানকার তাপমাত্রা ১২০ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়, তখন বিষয়টি নৈতিক মূল্যবোধের প্রশ্ন হয়ে ওঠে।
যা-ই হোক, মিসিসিপি থেকে সংগৃহীত উপাত্তের সাহায্যে মুখার্জী ও স্যান্ডার্স এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, বর্ধিষ্ণু উষ্ণতার কারণে প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের কারেকশনাল ফ্যাসিলিটিগুলোতে চার হাজারের অধিক অতিরিক্ত সহিংস ঘটনার সূত্রপাত হয়ে থাকে।
এছাড়া কিছু গবেষণা থেকে জানা যায়, উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জেলের বাইরের পৃথিবীতেও সহিংসতার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১০-১৭ পর্যন্ত মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসে লস অ্যাঞ্জেলেসে সেইসব দিনে সহিংস অপরাধের হার ৫.৫ শতাংশ বেশি ছিল, যেসব দিনে তাপমাত্রা ২৪ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (৭৫ থেকে ৮৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট) মধ্যে ছিল। এ বছরের মে মাসে জার্নাল অভ পাবলিক ইকোনমিকসে এ ব্যাপারে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। আর যেসব দিনে তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও অধিক ছিল, সেসব দিনে সহিংস অপরাধের হার বৃদ্ধি পেয়েছিল আরো ১০ শতাংশ।
উষ্ণতা ও পারফরম্যান্স
উষ্ণতা ও মানব আচরণের সম্পর্ক কেবল সহিংসতাতেই সীমাবদ্ধ নয়। এক্ষেত্রে বিবেচনা করতে পারেন সেইসব শিক্ষার্থীদের কথাও, যারা অনেক গরম স্কুল দালানে পরীক্ষা দিয়ে থাকে।
ইউসিএলএ-র অর্থনীতিবিদ আর জিসাং পার্ক এবং তার সহকর্মীরা জানার চেষ্টা করেছিলেন যে উচ্চ তাপমাত্রা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্সে কী ধরনের প্রভাব ফেলে থাকে। এক্ষেত্রে তারা নির্ভর করেছেন পিএসএটি-র উপর, যে স্ট্যান্ডার্ডাইজড পরীক্ষাটি নেয়া হয়ে থাকে হাই-স্কুলারদের বৃত্তি প্রদানের জন্য। গবেষক দলটি ১৯৯৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ২১ মিলিয়ন স্কোর মূল্যায়ন করেন ১০ মিলিয়ন সেসব শিক্ষার্থীদেরকে, যারা অন্তত দুবার ওই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল। এরপর যে শিক্ষার্থী যে পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষায় বসেছিল, পরীক্ষার দিনে সেখানকার তাপমাত্রা কত ছিল তা বের করে, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রাপ্ত স্কোর ও তাপমাত্রার মধ্যে কোরিলেশন বের করার চেষ্টা করেন তারা। কোন পরীক্ষাকেন্দ্রে এয়ার কন্ডিশনিংয়ের অবস্থা কেমন ছিল, সে তথ্যও তারা বিবেচনায় আনেন।
এই গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, প্রায় সকল শিক্ষার্থীই প্রথমবারের তুলনায় দ্বিতীয়বারের পরীক্ষায় তুলনামূলক বেশি স্কোর করে থাকে। তবে এই ব্যাপারটিকে বাদ দিয়েও গবেষকরা দেখতে পান, যেসব পরীক্ষাকেন্দ্রে এয়ার কন্ডিশনিংয়ের ব্যবস্থা ছিল না, সেসব পরীক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষার্থীরা এয়ার কন্ডিশনিং সহযোগে পরীক্ষা দেয়া শিক্ষার্থীদের চেয়ে খারাপ ফল করেছে।
২০২০ সালে আমেরিকান ইকোনমিক জার্নাল: ইকোনমিক পলিসিতে এই গবেষণার উপর প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, কৃষ্ণাঙ্গ ও হিস্পানিক শিক্ষার্থীরাই মূলত বেশি স্কুলে গেছে ও পরীক্ষা দিয়েছে তুলনামূলক উষ্ণ দালানে। এ থেকে গবেষকরা অনুমান করেন যে, তাপমাত্রার ব্যবধানগুলো যদি না থাকত, সেক্ষেত্রে পিএসএটি-র ফলাফলে যে বর্ণবাদী ফারাক রয়েছে, তা অন্তত ৩-৭ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হতো।
চরম উষ্ণতা কর্মক্ষেত্রেও মানুষের পারফরম্যান্সের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সেই যে তিওয়ারি সুরাটের সুতো কারখানায় গিয়েছিলেন, এরপর থেকে তিনি প্রায় এক দশক ধরে ভারতের বিভিন্ন সুতো কারখানা ও গার্মেন্টসে ওয়ার্কার ইনপুট সংগ্রহ করতে শুরু করেন, বিশেষত যেসব জায়গায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল এয়ার কন্ডিশনিং খুবই বিরল।
তিনি দেখতে পান, যেসব দিনে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপর উঠে যায়, সেসব দিনে সুতোর কারখানায় প্রাত্যহিক উৎপাদন ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম তাপমাত্রার দিনগুলোর চেয়ে প্রায় ২ শতাংশ কমে যায়। অপরদিকে গার্মেন্টসে সেলাইয়ের হার কমে যায় ৮ শতাংশ পর্যন্ত। তিওয়ারি ও তার সহকর্মীদের এই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে জুন মাসের জার্নাল অভ পলিটিক্যাল ইকোনমিতে।
গবেষকরা এরপর জাতীয় জরিপের উপাত্তের সাহায্যে ভারতের অন্যান্য শিল্পের দিকেও লক্ষ্য রাখেন। তারা দেখতে পান, তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপর উঠলেই প্রাত্যহিক উৎপাদনের হার নিম্নগামী হতে শুরু করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গবেষক দলটি হিসাব করে বের করেছেন, গড়ে প্রাত্যহিক তাপমাত্রা যদি বর্তমান পরিস্থিতির চেয়ে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসও বেড়ে যায়, তাহলে বছর শেষে উৎপাদন কমে যাবে ২.১ শতাংশ। এতে এক বছরেই দেশটির স্থূল অভ্যন্তরীন উৎপাদন বা জিডিপি কমে যাবে ৩ শতাংশ।
তিওয়ারির ভাষ্যমতে, এই গবেষণা থেকে আমরা যা শিখতে পারলাম তা হলো: অতিরিক্ত উষ্ণতা অনেক দেশের অর্থনীতিকে একটু একটু করে ধসিয়ে দেয়।
উষ্ণতা প্রশমনের উপায়
উষ্ণতা বৃদ্ধির বোঝা অধিকাংশ সময়ই বইতে হয় একটি দেশের দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীকে। যেমন- গত ১৪ জুলাইয়ের ক্লাইমেট সেন্ট্রালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আবাসান নীতিমালার ফলস্বরূপ, সবচেয়ে দরিদ্র মানুষগুলোকেই বাস করতে হয় একটি শহরের উষ্ণতম অঞ্চলে। একটি শহরের ওই উষ্ণতম অঞ্চলগুলোকে বলা হয়ে থাকে ‘আর্বান হিট আইল্যান্ডস’, যেখানে প্রত্যহ দুপুরের মাঝামাঝি তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে অন্যান্য এলাকার চেয়ে ৮ থেকে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসতি যেখানে, সেখানে এর ফলাফল দাঁড়ায় সবচেয়ে খারাপ, কেননা সেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব হয়ে থাকে অনেক বেশি, সবুজের পরিমাণ থাকে নিতান্তই কম, এবং ওসব জায়গার পৃষ্ঠতল প্রতিফলনের বদলে তুলনামূলক বেশি সূর্যরশ্মি শুষে নেয়।
লস অ্যাঞ্জেলেসের ইউনিভার্সিটি অভ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার পরিবেশ অর্থনীতিবিদ ম্যাথিউ কান বলেন, সমাজে বিদ্যমান অসমতার কথা মাথায় রেখে, সবচেয়ে সহজ সমাধান হলো সবার জন্য এয়ার কন্ডিশনিংয়ের ব্যবস্থা করা।
কিন্তু এয়ার কন্ডিশনিংয়ের মাধ্যমে একটি শহরের সকল দালানকে শীতল করা সহজ কথা না। ২০২০ সালের জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী কুলিং ইকুইপমেন্টের পেছনেই চাহিদা ছিল মোট জোগানকৃত বিদ্যুতের ১৭ শতাংশ। আরো সাংঘাতিক ভবিষ্যদ্বাণী হলো, উদীয়মান অর্থনীতিগুলোতে এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবহারের ফলেই ২১০০ সাল নাগাদ মোট শক্তি খরচ হবে বর্তমানের চেয়ে ৩৩ গুণ বেশি! এই মুহূর্তে এসব শক্তি আসে তেল, কয়লা ও গ্যাস থেকে। ফলে, যদি ২১০০ সালে ওই শক্তির চাহিদা মেটাতে চাওয়া হয়, সেক্ষেত্রে তা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে আরো বেশি ভূমিকা রাখবে।
তিওয়ারিও মনে করেন, সবার জন্য এয়ার কন্ডিশনিং নিশ্চিত করা সহজ কাজ হবে না। কারণ একটি গোটা কারখানাকে এয়ার কন্ডিশনিংয়ের আওতায় আনতে যে পরিমাণ অর্থ ও শক্তি খরচ হবে, তার চাইতে শ্রমিকদেরকে দুপুরে কয়েক ঘণ্টা বিশ্রামের সুযোগ দেয়া এবং তাদের জন্য হাতেগোনা কয়েকটি রুমে এয়ার কন্ডিশনিংয়ের ব্যবস্থা করা ঢের সহজ ও কম খরচসাপেক্ষ। তাছাড়া সবচেয়ে ভালো পরিবেশ শীতলীকরণের পদ্ধতি হতে পারে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে শহরাঞ্চলে সবুজের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলা, এবং দালানকোঠা নির্মাণে আরো ভালো মানের ‘শীতল কাঁচামাল’ ব্যবহার করা, যেন সেগুলো সূর্যরশ্মিকে প্রতিফলিত করে।
কিন্তু হ্যাঁ, দিনশেষে এটি ভুলে গেলে চলবে না যে, ধনীদের যদি কৃত্রিম এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবহারের সুযোগ থাকে, তবে একটি আদর্শ পৃথিবীতে সেই সুযোগ দিতে হবে হতদরিদ্রদেরও। কোনো ধরনের অজুহাত দেখিয়েই তাদের সেই অধিকারহীনতার বিষয় লুকিয়ে রাখলে চলবে না।
(সায়েন্স নিউজ সেপ্টেম্বর ১১, ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত সুজাতা গুপ্তের প্রবন্ধ অবলম্বনে)