ফার্মি প্যারাডক্স – ওরা কোথায়?
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপর
একটি শিশির বিন্দু – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
শরতের কোনো এক মেঘমুক্ত রাতে আপনি কি কখনো চোখ ভরে দেখেছেন মাথার উপরের ঐ বিশাল আকাশ? ঘর থেকে বেরিয়ে দু’পা ফেলে একটু খোলা জায়গায় দাঁড়ালেই দেখা মেলে কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলোকের দল, ঝলমল করছে ঐ বিশাল অন্তরীক্ষে। একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই আলোকের দল মিলেমিশে আছে আকাশের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত, একটি সাদা শাড়ির আঁচলের মতো, দুগ্ধ সরের মতো। এই আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথ, এখানেই আমাদের বসবাস। ভারতীয়রা আকাশের এই সাদা পথ দেখে এর মাঝে খুঁজে পেয়েছিল তাদের সুখ-দুখের নদী গঙ্গাকে। নাম দিয়েছিল আকাশগঙ্গা। গ্রীকদের মনে হয়েছিল আকাশে বুঝি ছড়িয়ে আছে তাদের দেবী অ্যান্ড্রোমিডার দুগ্ধসর। আর তাই খুঁজেছিল তাদের দেবতা জিউস-হারকিউলিসের রূপকথাকে। নাম দিয়েছে মিল্কিওয়ে। নক্ষত্রখচিত এই আকাশে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে দেখবেন আপনারও অদ্ভুত একটা মোহ আসবে। ভালো লাগায় ভরে যাবে মন। মাঝে মাঝে আকাশের এই বিশালতায় নিজেকে অনেক তুচ্ছ মনে হবে। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগবে আচ্ছা কী আছে ঐ তারার জগতে? আপনার মতো পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মিরও একটা অনুভূতি হয়েছিল। তার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, ওরা কোথায়?
এ হচ্ছে আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথ। খালি চোখে পরিষ্কার আকাশে আমরা একেই দেখতে পাই। তো খালিচোখে কতগুলো তারা দেখি আমরা? খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে পুরো দিগন্ত সমেত এই আকাশেও কিন্তু আমরা ২৫০০ এর বেশি তারা দেখতে পাই না। যা কিনা এই আকাশগঙ্গা ছায়াপথের ১০০ মিলিয়ন ভাগের একভাগ মাত্র। আর ব্যাপ্তির হিসেবে আমাদের দৌড় মাত্র ১০০ আলোকবর্ষ পর্যন্ত, যা ছায়াপথের মোট ব্যাসের ১% মাত্র। তার মানে বড় স্কেলে আমরা যা দেখি তা আসলে অনেকটা এরকম-
অথচ এই এক ছায়াপথেই আছে ১০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র। বিজ্ঞানীদের ধারণা আমাদের মহাবিশ্বে ঠিক একই পরিমাণ ছায়াপথ আছে। তো এত এত তারার দেশে নিশ্চয়ই এদের নিজেদের চারপাশেও আছে এক একটা জগৎ। যেখানে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে গ্রহদের দল। তার মাঝে শুধু কি সূর্য নামক এই একটি তারার জগতেই ঘটেছে প্রাণের বিস্তারণ, উন্মেষ ঘটেছে আমাদের মতো উন্নত প্রাণের? আমাদের মতো কেউ কি নেই ওখানে?
আমাদের রবীঠাকুর লিখেছিলেন – “কোনো মেঘ-বিনির্মুক্তা তারকাসমুজ্জ্বলা রজনীতে গৃহের বাহির হইয়া গগণমন্ডলের প্রতি একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলে, চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রেরই মনে কতকগুলি চিন্তার উদয় হইবেই হইবে। যে-সকল অগণ্য জ্যোতিষ্কমন্ডল দ্বারা নভস্তল বিভূষিত হইয়া রহিয়াছে, তাহারা কি শূন্য না আমাদের ন্যায় জ্ঞান-ধর্ম-প্রেম-বিশিষ্ট উন্নত জীবদ্বারা পূর্ণ? প্রাণস্বরূপ পরমেশ্বরের বিচিত্র অনন্ত রাজ্যের মধ্যে এমন কি কোনো স্থান থাকিতে পারে যেখানে প্রাণের চিহ্ন নাই?”
চলুন তবে দেখা যাক গাণিতিক সম্ভাব্যতার বিচারে কী আসে ফলাফল?
মহাবিশ্বে মোট ছায়াপথের সংখ্যা প্রায় ১০০ – ৪০০ বিলিয়ন। আর এর প্রত্যেকটিতে আছে ১০০ – ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র। তাহলে আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বেই মোট তারার সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে প্রায় ১০^২২ – ১০^২৪। অর্থাৎ আমাদের পৃথিবীতে যত বালুকণা আছে তার প্রত্যেকটি বালুকণার বিপরীতে আছে ১০,০০০ টি তারা। বিজ্ঞানীরা হিসেব কষে দেখেছেন এতগুলো তারার মাঝে মাত্র ৫ – ২০% তারা আকৃতি, তাপমাত্রা আর উজ্জ্বলতার বিচারে আমাদের সূর্যের মতো। তো বেশি বেশি না ধরে মনে করি মাত্র ৫% তারা সূর্যের মতো। এদিকে তারার সংখ্যাও কম ধরেই হিসেব করা যাক অর্থাৎ ১০^২২ টি। সে হিসেবে আমাদের মহাবিশ্বে সূর্যের মতো নক্ষত্র আছে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন বিলিয়ন।
বুঝলাম এতগুলো সূর্য আছে মহাবিশ্বে। কিন্তু সবগুলোর চারপাশে নিশ্চয়ই পৃথিবীর মতো এরকম একটা গ্রহ নেই, যেটা কিনা সূর্য থেকে এমন একটা আবাসযোগ্য অঞ্চলে থাকবে। কারো কারো মতে প্রতিটি সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর মতো গ্রহ থাকার সম্ভাব্যতা অর্ধেকেরও বেশি। এদিকে সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে কম করে হলেও এ সম্ভাব্যতা ২২%। আমরাও কম ধরেই আগাই। অর্থাৎ ৫০০ বিলিয়ন বিলিয়ন সূর্যের মধ্যে ২২% সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর মতো একটি করে গ্রহ আছে। সংখ্যার বিচারে, এ মহাবিশ্বে প্রায় ১০০ বিলিয়ন বিলিয়ন পৃথিবীর মতো গ্রহ আছে, যা কিনা মহাবিশ্বের মোট তারার ১ শতাংশ। তার মানে পৃথিবীর প্রতিটি বালুকণার বিপরীতে আছে ১০০ টি করে পৃথিবী। এখন থেকে সমুদ্র সৈকতে গেলে ব্যাপারটা মাথায় রাখবেন। আপনার পায়ের তলার একমুঠো বালির বিপরীতে কতগুলো পৃথিবী আছে ঐ বিশাল মহাবিশ্বে, ভাবা যায়!
আরো আগানো যাক। এতক্ষণ পর্যন্ত যা যা হিসেব করে আসলাম সেখানে খুব বেশি গোজামিল নেই। যতই এদিক সেদিক করা হোক না কেন এই মহাবিশ্বে মোটামুটি এতগুলোই পৃথিবীর মতো গ্রহ আছে। এখন সামনের দিকে যেতে হলে আমাদের কিছুটা আন্দাজের মাধ্যমে যেতে হবে। পৃথিবীতে যেমন ১ বিলিয়ন বছর পর প্রাণের উন্মেষ ঘটেছে, আমরাও ধরে নেই এই গ্রহগুলোর অন্তত ১% গ্রহে উদ্ভব ঘটেছে প্রাণের। অর্থাৎ আপনার পায়ের তলার একটি বালুকণার বিপরীতে আছে একটি করে প্রাণচঞ্চল পৃথিবীর মতো গ্রহ। এবারো ধরে নেই প্রাণধারী এসব গ্রহের মধ্যে মাত্র ১% গ্রহে বিকাশ ঘটেছে আমাদের মতো বুদ্ধিমান প্রাণের। এর মানে হলো শুধু পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বেই মানুষের মতো ১০ মিলিয়ন বিলিয়ন উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব আছে।
দূরে থাক মহাবিশ্ব, আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কথাই ধরা যাক। একই হিসেবে করে আমরা দেখি এই ছায়াপথেই আছে ১ বিলিয়ন পৃথিবী সদৃশ গ্রহ আর ১ লক্ষ মানুষের মতো উন্নত সভ্যতা। পৃথিবীর সে সংস্থাটি এরকম উন্নত সভ্যতা খুঁজে বেড়াচ্ছে নিরন্তর, তার নাম SETI (Search for Extraterrestial Intelligence). এই সংস্থাটি সবসময় আকাশের দিকে এন্টেনা তাক করে বসে আছে। যদি আমাদের ছায়াপথেই এক লক্ষ উন্নত সভ্যতা থাকে এবং তাদের কিয়দাংশও যদি পরষ্পরের সাথে যোগাযোগ করে তবে সেই বেতার তরঙ্গের একটা অংশ হলেও তো SETI এর রাডারে ধরা পড়ার কথা! না, এখনো কেউ আমাদের হ্যালো বলে নি, কেউ কাউকে হ্যালো বলতে শুনি নি। তবে ওরা কোথায়?