বিশ্বের কোথাও না কোথাও প্রতিনিয়তই চলছে বিজ্ঞানীদের গবেষণা। প্রত্যেকটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পেছনেই থাকে বিজ্ঞানীদের নিরলস পরিশ্রম আর ত্যাগের গল্প। আজ বিজ্ঞানীদের যে উদ্ভাবনকে ছোট করে দেখা হচ্ছে, হয়তো আগামীকালই তা হয়ে উঠতে পারে মহা দরকারি। তাই এত সব গবেষণার মধ্যে বিজ্ঞানীদের গুটিকয়েক গবেষণাকে নির্বাচন করা বেশ কষ্টসাধ্য!
জীববিজ্ঞানের মতো বিজ্ঞানের একটি বৃহৎ শাখার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। জীববিজ্ঞানে ২০২২ সালের অসংখ্য গবেষণা থেকে অন্যতম সেরা কয়েকটি আবিষ্কারকে নিয়ে একটি তালিকা প্রকাশ করেছে ‘কোয়ান্টা ম্যাগাজিন’। ২০২২ সালে ‘বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন’ ক্যাটেগরিতে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছে ম্যাগাজিনটি। কোয়ান্টা ম্যাগাজিনের তালিকা থেকে সেরা পাঁচটি আবিষ্কারকে নিয়েই আজকের এ আলোচনা।
স্মৃতিগঠন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ
মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের গাঠনিক ও কার্যকর একক হচ্ছে নিউরন। দুটি নিউরনের সংযোগস্থলকে বলা হয় সিন্যাপস। এভাবে সিন্যাপস গঠনের মাধ্যমে তৈরি একাধিক নিউরনের সার্কিটই আমাদের স্মৃতিগঠন ও সংরক্ষণের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা দীর্ঘ দিনের গবেষণা থেকে মস্তিষ্কের স্মৃতি গঠনের বিষয়ে আমাদের একটি সম্যক ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছেন। আমরা যখন কোনো কিছু উপলব্ধি করি, অনুভব করি, কিংবা চিন্তা করি, তখন তা সংশ্লিষ্ট নিউরনসমূহের সিন্যাপটিক সংযোগকে আরো দৃঢ় করে। নিউরনের সার্কিটের এই পরিবর্তনই স্মৃতি হিসেবে মস্তিষ্কে সংরক্ষিত থাকে। পরবর্তীতে প্রয়োজনের সময় আমাদের উপলব্ধির এই ইলেকট্রিক্যাল প্যাটার্ন আবার পুনরায় স্মরণ করতেও পারি। তবে স্মৃতিগঠনের এ সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া যে যথেষ্ট জটিল ও রহস্যময় তা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ বছরের শুরুর দিকে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকরা মস্তিষ্কের এ ইলেকট্রিক্যাল পরিবর্তনকে পর্যবেক্ষণ করার একটি উপায় বর্ণনা করেছেন। অসহনীয় তাপ প্রয়োগে জীবন্ত জেব্রা মাছের স্মৃতি গঠনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া তারা অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তারা আরো পর্যবেক্ষণ করেন- এ প্রক্রিয়ায় কিছু সিন্যাপসের সংযোগ শুধু দৃঢ়ই হচ্ছে না, বরং কিছু সিন্যাপসের ক্ষেত্রে এ দৃঢ়তা মুহূর্তেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
মস্তিষ্কের স্মৃতিভাণ্ডার যেসব তথ্য জমা রাখে, তা আমরা পরবর্তীতে স্মরণ করতে পারি। এক্ষেত্রে মস্তিষ্ক কিছু স্মৃতিকে ভালো স্মৃতি হিসেবে ও কিছু স্মৃতিকে খারাপ স্মৃতি হিসেবে চিহ্নিত করে রাখে। এ বছরই অপর একটি গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন- মস্তিষ্কের নিউরন থেকে নিঃসৃত ‘নিউরোটেনসিন’ এই ভালো ও খারাপ স্মৃতির নির্ণায়ক হিসেবে কাজ করে।
আণবিক বাস্তুসংস্থান থেকেই পৃথিবীতে প্রাণের শুরু?
মনে করা হয়, প্রায় ৪০০ কোটি বছর পূর্বে কোষের আবির্ভাবের মাধ্যমেই পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয়। তবে কোষ আবির্ভাবের পূর্বে নিশ্চয়ই বিভিন্ন রাসায়নিক অণুসমূহ ক্রমাগত বিবর্তনের মাধ্যমে বিচিত্র ও জটিল রূপ ধারণ করে। গত এক দশক ধরে এ বিষয়ে গবেষণা করছেন জাপানের একদল গবেষক। তারা ক্রমাগত অনুলিপিত আরএনএ অণু নিয়ে গবেষণা করেছেন। এখানে একটি আরএনএ অণু থেকে অনুলিপনের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের অনুলিপিত আরএনএ তৈরি হচ্ছে কিনা তা-ও পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা।
এ বছরের মার্চে বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণা সম্পর্কে নতুন এক বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছেন। তারা দেখিয়েছেন- উপযুক্ত পরিবেশে কিছু নির্দিষ্ট রাসায়নিক অণুকে অনুলিপনের ক্ষমতা প্রদান করলে তা অনেকটাই ‘বাহক’ ও ‘পরজীবী’র ন্যায় জটিল নেটওয়ার্ক তৈরি করে এবং তারা ক্রমাগত সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এক ক্ষুদ্র বাস্তুসংস্থানিক পরিবেশ গড়ে তোলে! প্রিবায়োটিক পৃথিবীতে আরএনএ ও অন্যান্য রাসায়নিক অণুর এমন বিবর্তনই কোষ গঠনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করছেন তারা।
এভাবে রাসায়নিক অণুর অনুলিপনের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভবের ধারণার পাশাপাশি আরো নানা তত্ত্ব রয়েছে এ বিষয়ে। প্রাণরসায়নবিদ নিক লেন ও অন্যান্য গবেষকরা মনে করেন- সমুদ্র তলদেশে হাইড্রোথার্মাল ভেন্টে প্রথম প্রাণের উদ্ভব হয়, যেখানে কোষে জেনেটিক তথ্যের আবিভার্বের পূর্বেই মেটাবলিজমের উপকরণসমূহ বিদ্যমান ছিল। এ বছরের শুরুর দিকে নিক লেন গবেষণাগারে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে তার ধারণার স্বপক্ষে প্রমাণ হাজির করেন। বিজ্ঞানীদের এ গবেষণা বার্ধক্য ও ক্যানসারের গবেষণায় দারুণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
কীভাবে দেহের কোষগুলো উপযুক্ত স্থানে পৌঁছায়?
ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলনে তৈরি একটি মাত্র জাইগোট কোষ থেকেই ধীরে ধীরে তৈরি হয় একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ। একটি মাত্র কোষ থেকে শুরু করে কীভাবে একটি পূর্ণ বয়স্ক মানুষে প্রায় দুইশ ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ত্রিশ ট্রিলিয়নের মতো কোষ তৈরি হয়? এ বিষয়ে গত প্রায় এক শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল এমন- দেহের বিভিন্ন স্থানে তৈরি একধরনের রাসায়নিক নতিমাত্রার (chemical gradient) কারণে কোষগুলো বুঝতে পারে দেহের কোথায় তাদেরকে প্রয়োজন। পরবর্তীতে সেখানে পৌঁছে প্রয়োজনমাফিক ত্বক, অস্থি,পেশি প্রভৃতি অংশে ভাগ হয়ে যায় তারা।
তবে পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা রাসায়নিক নতিমাত্রার পাশাপাশি এখানে উক্ত কোষসমূহকে ঘিরে থাকা পারিপার্শ্বিক টিস্যুসমূহের শারীরিক পীড়নের মাত্রাকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেন। এ বছরের মে মাসে বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে একটি নতুন ধারণার অবতারণা করেন। একটি গবেষণায় তারা দেখান, ভ্রূণের মধ্যে একধরনের যান্ত্রিক চাপের ফলেই বিভিন্ন ধরনের বিশেষায়িত কোষ তৈরি হয়। যেমন: কোনো জায়গায় ত্বক তৈরি হবে নাকি ত্বকের জায়গায় পালক তৈরি হবে এটি অনেকটাই ভ্রূণের মধ্যের এ যান্ত্রিক চাপের উপর নির্ভর করে।
অন্যদিকে এ বছরেই ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির একদল গবেষক একধরনের কৃত্রিম জিন নেটওয়ার্কের প্রভাবে স্টেম কোষ থেকে বিভিন্ন ধরনের বিশেষায়িত কোষ তৈরির প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। যদিও তারা কোষের এমন প্রাকৃতিক জেনেটিক নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে সক্ষম হননি, তবে এ প্রক্রিয়া যে খুব একটা জটিল না, বিজ্ঞানীদের এ মডেল তারই ইঙ্গিত দেয়।
খাদ্য সংকটে কি মস্তিষ্ক ভিন্ন আচরণ করে?
মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ক্রিয়া চালু রাখার জন্য দরকার হয় প্রচুর শক্তির। আর শক্তির জোগানদাতা হলো খাদ্য। মস্তিষ্ক যদি যথেষ্ট পরিমাণে শক্তি না পায় তাহলে তো এর কাজকর্মে ব্যাঘাত তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। এ বছরের জানুয়ারিতে ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গের গবেষকরা নিউরন জার্নালে এ বিষয়ে তাদের একটি গবেষণা তুলে ধরেছেন।
খাদ্য সংকটে থাকা ইঁদুরের উপর গবেষণায় তারা দেখিয়েছেন, এ অবস্থায় তাদের মস্তিষ্কে একধরনের ‘লো পাওয়ার মোড’ চালু হয়ে যায়। এ অবস্থায় মস্তিষ্কের দৃষ্টি কেন্দ্রে প্রায় ৩০% কম শক্তি ব্যবহৃত হয়। ফলে এ অবস্থায় প্রাণীর দৃষ্টিশক্তিও কমে যায় অনেকাংশেই।
দৃষ্টিশক্তির পাশাপাশি মস্তিষ্কের ঘ্রাণ উপলব্ধির বিষয়েও বিজ্ঞানীদের গবেষণা চলমান রয়েছে। সম্প্রতি ‘কৃত্রিম নাক’ তৈরিকে সামনে রেখে চলমান একটি গবেষণায় বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেন- সুগন্ধযুক্ত অণুর রাসায়নিক গঠন যেমন এর সুবাস উপলব্ধিতে ভূমিকা রাখে, তেমনি বিভিন্ন মেটাবলিক পদ্ধতির মাধ্যমে ঐ রাসায়নিক অণুর তৈরি হওয়ার উপরও আমাদের ঘ্রাণ উপলব্ধি অনেকাংশেই নির্ভরশীল।
ইঁদুরের মস্তিষ্কের সাথে মানব মস্তিষ্কের সংযোগ
মাথার খুলির উপস্থিতি ও নৈতিক কারণে জীবন্ত মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা অনেকাংশেই একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। এজন্য বিজ্ঞানীদের কম ঝামেলা পোহাতে হয় না! তাই গবেষণার কাজে এর বিকল্প হিসেবে বিজ্ঞানীরা মানুষের মস্তিষ্কের সাথে মিল রেখে ল্যাবরেটরিতে প্রস্তুত মস্তিষ্ক কোষ ব্যবহার করেন, একে বলা হয় ‘অর্গানয়েড’।
এ বছর বিজ্ঞানী সার্জিউ পাসকা ও তার সহকর্মীরা মানুষের এই ‘অর্গানয়েড’ মস্তিষ্ক ল্যাবরেটরিতে প্রস্তুত ইঁদুরের মস্তিষ্কে প্রবেশ করালে কেমন আচরণ করে তা পর্যবেক্ষণ করেন। দেখা যায়, মানুষের মস্তিষ্ক কোষ ইঁদুরের মস্তিষ্কের নিউরনের সার্কিটের সাথে সংযোগ স্থাপন করে এবং তা ইঁদুরের ঘ্রাণ উপলব্ধিতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম। মানবমস্তিষ্ক সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গবেষণায় বিজ্ঞানী পাসকার এ পর্যবেক্ষণ এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে বলে মনে করা হচ্ছে।