সময়টা ২০০৫ সাল, আজ থেকে ১৫ বছর আগের কথা। দেশটির নাম ইতালি। জনগণ এক অবিস্মরণীয় ‘মাস হিস্টেরিয়া’ বা ‘গণ উন্মাদনা’ প্রত্যক্ষ করলেন। ইতিহাসে এই কুখ্যাত ঘটনার নাম লেখা হলো ‘ফিফটি থ্রি ফিভার’ নামে। ঘটনার সূত্রপাত লটারি কেনা থেকে। বারি, নেপলস, ভেনিস ইত্যাদি বিভিন্ন শহরের নামানুসারে মোট ১১টি হুইল ছিল এবং অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেককে প্রথমে একটি হুইল নির্বাচন করতে হত। তারপর নির্বাচিত হুইলের বিপরীতে ১ থেকে ৯০ এর মধ্যবর্তী যে কোনো একটি সংখ্যার ওপর বাজি ধরতে হত।
বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নির্ভর করত একজন ব্যক্তি সূচনালগ্নে কত বাজি ধরেছেন, মোট কতটি সংখ্যা তিনি বেছে নিয়েছেন এবং পছন্দ করা সংখ্যাগুলোর কতগুলো সঠিক প্রমাণিত হয়েছে এসবের উপর।
২০০৩ সালের কোনো এক সময়ে আচমকা ভেনিস নামাঙ্কিত হুইলে ৫৩ সংখ্যাটির প্রদর্শন বন্ধ হয়ে গেল। ৫৩ সংখ্যাটির ক্রমাগত অনুপিস্থিতিতে বাজিকরদের মাথা ঘুরে গেল। তারা সকলেই কমবেশি ভাবতে শুরু করলেন যে ভাগ্যদেবী বুঝি এবার প্রসন্ন হবেন। একটি নির্দিষ্ট হুইলে একটি সুনির্দিষ্ট সংখ্যার বিরামহীন অনুপস্থিতি থেকে তারা ধারণা করে নিলেন যে ৫৩ সংখ্যাটি অতি শীঘ্রই দেখা দেবে এবং এই আশাবাদী মনোভাব তাদেরকে আরও অধিক বাজি ধরার প্রতি ধাবিত করে।
২০০৫ সালে এসে ফিফটি থ্রি ফিভারের কারণে সহস্রাধিক মানুষ সর্বস্বহারা হয়ে পড়েন। নিঃস্ব এই মানুষগুলোর অনেকেই শেষ অবধি গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন।
পরিশেষে ৯ ফেব্রুয়ারি লটারির ড্র অনুষ্ঠিত হলে ফলাফল আসে ১৮২ টি নো শো। লটারির সর্বমোট বাজির অংকটা অনুমান করতে পারবেন? ৪ বিলিয়ন ইউরো!
এই যে উন্মাদনায় ইতালিয়ানরা ভুগছিলেন এর কারণ কী? প্রকৃতপক্ষে কেবল ইতালিয়ানরা নন বরং অধিকাংশ মানুষই এই উন্মাদনার শিকার হয়ে থাকেন বিশেষ পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে। মানুষের চিন্তন দক্ষতার এই সীমাবদ্ধতাকে বলা হয় ‘গ্যাম্বলার্স ফ্যালাসি’।
মূলত বর্তমানে ঘটমান প্যাটার্ন বা সিকোয়েন্সকে বাছবিচার করে আসন্ন ঘটনাবলী অনুমান করতে চাওয়ার এই চর্চাকেই গ্যাম্বলার্স ফ্যালাসি নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। ব্যাংক অফিসার, বেসবল আম্পায়ার, বিচারক, জুয়াড়ি, শেয়ার বিনিয়োগকারী এমনকি গোলকিপাররাও এই ফ্যালাসির শিকার হয়ে ভবিষ্যতের একটি ভ্রান্ত পূর্বাভাস দিয়ে থাকেন।
গ্যাম্বলারস ফ্যালাসিকে ‘মন্টে কার্লো ফ্যালাসি’, ‘নেগেটিভ রিসেন্সি ইফেক্ট’ বা ‘ফ্যালাসি অভ দ্যা ম্যাচিউরিটি অভ চান্সেস’ নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। চলুন এক নজরে দেখে নেওয়া যাক এই ফ্যালাসি সম্পর্কিত কিছু মৌলিক ধারণা:
- একটি ঘটনা যতবার ঘটবে ঘটবে এর পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা তত কমবে এবং একটি ঘটনা যত কম ঘটবে ভবিষ্যতে এর ঘটবার সম্ভাবনা তত বাড়বে। আপাতদৃষ্টিতে যথেষ্ট বলিষ্ঠ ও দৃঢ় অথচ প্রকৃতপক্ষে একেবারে অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন এই বিশ্বাসই গ্যাম্বলারস ফ্যালাসি।
- বস্তুত একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিসমূহ প্রত্যেকেই একটি স্বতন্ত্র ও মৌলিক ঘটনা। একটি ঘটনার পূর্বে সংঘটিত হওয়া বা না হওয়া ভবিষ্যতে এর পৌনঃপুনিকতাকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে না।
- বাস্তব জীবনে সম্ভাব্যতা বা পরিসংখ্যান কখনোই আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয় না।
ধরুন, আপনাকে একটি নিটোল অর্থাৎ খুঁতহীন মুদ্রা নিক্ষেপ করতে বলা হল। আপনি পরপর দশবার মুদ্রাটি শুন্যে ছুড়ে দিলেন। দশবার যথাক্রমে আপনি পেলেন হেড, টেল, হেড, টেল, টেল, হেড, হেড, হেড, হেড, হেড। এগারোবার নিক্ষেপ করলে মুদ্রার কোন পিঠটি উঠবে? যেহেতু শেষ পাঁচবারের টানা পাঁচবারই হেড এসেছে, বেশিরভাগ মানুষ আশা ব্যক্ত করবেন যে পরবর্তীতে টেল ওঠার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে কেন না পরপর কয়েকবার হেড ওঠায় এর ঠিক পরবর্তী নিক্ষেপে টেল আসার মাধ্যমে বিষয়টিতে একটি সমতা বিধান হবে। পরিসংখ্যান ও সম্ভাব্যতার বিচারে একটি নিটোল অর্থাৎ একেবারে নিখুঁত মুদ্রা নিক্ষেপ করলে তার হেড বা টেল দু’টো আসার সম্ভাবনাই সমান কারণ দু’টো ঘটনাই স্বাধীন। আপনি একটি মুদ্রাকে শুন্যে ছুড়ে দিলে হেড বা টেল যে কোনোটি আসার সম্ভাবনাই সমান। এর অর্থ এই যে আপনি টানা ৫০০০ বার একটি খুঁতহীন মুদ্রা নিক্ষেপ করে যদি প্রতিবারই টেল পান তবুও ৫০০১ তম বার নিক্ষেপে হেড আসার এতটুকু বেশি সম্ভাবনা থাকে না; সেবারও হেড ও টেল যে কোনো একটি পাওয়ার সম্ভাবনা একই থাকে। ঠিক এই কারণে গাণিতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে ‘হেড, হেড, হেড, হেড’ এবং ‘হেড, টেল, টেল, হেড’ দু’টো ঘটনা মূলত একই।
এবার আসা যাক কেন এই ফ্যালাসিকে মন্টে কার্লো নামেও আখ্যা দেওয়া হয়? ১৯১৩ সালে মোনাকোর রুলে টেবিলে টানা ২৬ বার কালো উঠে আসে। যারা ২৭ তম বারে লালের উপর বাজি ধরেছিল তারা জিতে গেলেও অনেকেই আশা করেছিল যে টানা এতবার কালো আসার পর টানা বেশ কয়েকবার লাল এসে পুরো বিষয়টার ভারসাম্য রক্ষা হবে। ঠিক এই ধারণা পোষণ করার কারণেই জিতে নেওয়া টাকার বিশাল অঙ্ক অনেকে সেখানেই খুইয়ে দিয়ে আসে। এই পক্ষপাতিত্বমূলক চিন্তাভাবনা দ্বারা এখনও জুয়াড়িরা ক্যাসিনোতে হরহামেশাই সর্বহারা হচ্ছেন। ক্যাসিনোতে স্থাপন করা গোপন নিরাপত্তা ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও থেকে গবেষকরা এমন তথ্যই পেয়েছেন।
শিক্ষা কিংবা আইকিউ’র সাথে গ্যাম্বলার্স ফ্যালাসির এক অদ্ভুত সম্পর্ক রয়েছে। যারা অধিক শিক্ষিত বা উচ্চ আইকিউ স্কোরের অধিকারী তারা এই ফ্যালাসির শিকার হন বেশি। কারণ তারা নিজেদের মেধা, চিন্তন দক্ষতা ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা নিয়ে একেবারেই সন্দিহান থাকেন না। নিজেদের ব্যপারে তারা এতটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে থাকেন যে তারা প্যাটার্ন বা সিকোয়েন্সের অনিবার্যতা সম্পর্কে নিজেদের শতভাগ নির্ভুল ভাবেন। কিন্তু বিষয়টি তো কখনোই ষষ্ঠেন্দ্রিয় নির্ভর কোনো কিছু নয়। তাই নিজেদের সামর্থ্য সম্পর্কে তাদের অতি আত্মবিশ্বাস তাদেরকে অনায়াসেই ভুল সিদ্ধান্তের দিকে প্ররোচিত করে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা যখন ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তখন তারাও এই ফ্যালাসিতে ভুগে থাকেন। একজন কর্মকর্তার কাছে কোন ক্রমে ঋণ বিষয়ক দরখাস্তগুলো আসছে সেটি একটি গুরুত্ববহ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। পরপর দুই থেকে তিনজন আবেদনকারীকে ঋণ মঞ্জুর করার পর তারা পরবর্তী আবেদনটি নামঞ্জুর করবেন তার সম্ভাবনা ৮%। আবার এর বিপরীতটিও সম্ভব। অর্থাৎ ক্রমান্বয়ে দুই তিনটি আবেদন নাকচ করে দেওয়ার পর তারা কিছুটা নিজেকেই অবচেতনে প্রবোধ দেওয়া শুরু করেন পরবর্তী ব্যক্তিকে ঋণ দেওয়ার জন্য।
শেষ করব অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয় দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বিচারকরা শরনার্থীদেরকে আশ্রয় সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রেও ফ্যালাসির শিকার হয়ে থাকেন। আমরা সকলেই স্বীকার করব যে, কোনো দেশে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় পাওয়ার ক্ষেত্রে আবেদনের ক্রম গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিৎ না কোনোভাবেই। পরপর দু’জন শরনার্থীর আবেদন গৃহীত হলে তৃতীয়জনের আবেদন মঞ্জুর হওয়ার সম্ভাবনা ৫.৫% কমে যায়। অথচ এই ফ্যালাসির বিষয়টিকে বাদ দিয়ে হিসেব করলে আশ্রয় সুবিধাদানের গড় হার দাঁড়ায় ২৯%। পার্থক্যটা একেবারেই সুস্পষ্ট! সচেতন বা অবচেতন যেভাবেই হোক বিচারকদের এক অদ্ভুত পক্ষপাতদুষ্ট বিশ্বাস যে পরপর তিনটি আবেদনে ইতিবাচক সাড়া প্রদানে কোনোভাবেই সমতা চিত্রায়িত হয় না।
বাস্তব জীবনে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো আমাদের আমলে নিতে হবে। তাহলে ঘটনার ফলাফলের ইতিবাচকতা সামান্য হলেও বেশি পাব।