আজকের পৃথিবীতে মানুষের ভয়াবহতম রোগের মধ্যে একটি এইডস। এইচআইভি নামের একটি ভাইরাসের আক্রমণে মানুষের শরীরে এই রোগ বাসা বাঁধে। এই ভাইরাস মানুষের কোষে কোষে এমন সব পরিবর্তন ঘটায় যা পরবর্তীতে সন্তানের মাঝেও ছড়িয়ে যায়। এতে আক্রান্ত কোনো দম্পতির সন্তান জন্মগ্রহণের সময় এইচআইভি আক্রান্ত হয়েই জন্ম নেয়।
তাই এইচআইভি আক্রান্ত কোনো দম্পতি সাধারণত সন্তান গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। নিজেদের স্বাস্থ্যগত সীমাবদ্ধতার কারণে সৃষ্ট বিষাদ, সন্তান না থাকার বেদনা ইত্যাদি সব মিলিয়ে তাদের বেঁচে থাকাটা হয়ে ওঠে আরো কষ্টকর। আর সেই কষ্টের দিনগুলোর সমাপ্তি ঘটাতে আশার আলো দেখিয়েছেন চীনের বিজ্ঞানী জনকুই হি। বংশ পরম্পরায় যেসব রোগ মানুষ বহন করে থাকে, ভ্রূণের জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে তা ঠেকানোর ধারণা বাস্তবায়ন করেছেন তিনি।
বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে মানুষের শরীরে প্রবেশের জন্যে এইডসের জীবাণু মানুষের ডিএনএ-তে থাকা সিসিআর-ফাইভ নামক জিনকে ব্যবহার করে। এখন যদি কোনোভাবে শিশুর জন্ম মুহূর্তে ডিম্বাণু-শুক্রাণুর নিষেকের সময়ই সিসিআর-ফাইভ জিনটিকে পরিবর্তিত করে ফেলা যায় তাহলে এইচআইভি আর তাকে আক্রমণ করতে পারবে না। কিন্তু এই জিনকে পরিবর্তন করা যায় কীভাবে? উত্তর হচ্ছে CRISPR। এর সাহায্যে জিনকে কাটাছেড়া করা যায়।
এর বিশেষ একটি এনজাইম আরএনএ-র সাহায্য নিয়ে ডিএনএ-র একটি নির্দিষ্ট অংশ কেটে ফেলতে সক্ষম। ডিএনএ-র কোনো অংশ কেটে ফেলা হলে সেই অংশটির বৈশিষ্ট্য শরীরে প্রকাশিত হয় না। শুধু তা-ই নয়, কাটা অংশকে বিশেষভাবে জোড়া লাগানোর কথাও ভাবছেন বিজ্ঞানীরা। তবে এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এমন সময়ে জনকুইয়ের এরকম একটি পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে তার সাহসিকতার পরিচয় দেয়। নিজের কাজ সম্বন্ধে তিনি এক ভিডিওতে বলেছেন-
সপ্তাহ কয়েক আগে আর দশটা সুস্থ নবজাতক শিশুর মতো এই সুন্দর পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে লুলু আর নানা। বাবা মার্ক এবং মা গ্রেসের সাথে তারা এই মুহুর্তে সুস্থ শরীরে নিজেদের বাড়িতে রয়েছে। গ্রেসের গর্ভে তাদের জন্ম হয়েছে ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন পদ্ধতির মাধ্যমে। তবে এই পদ্ধতিতে সামান্য ভিন্নতা আছে।
এক্ষেত্রে গ্রেসের স্বামীর শুক্রাণু দিয়ে তার ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করার মুহূর্তে কিছুটা নির্দেশক প্রোটিনও প্রবেশ করানো হয়। এটি এইডসের আশ্রয়ের জন্য দরকারি বিশেষ জিনকে পরিবর্তন করে দিতে পারে। নিষিক্ত হবার পর ভ্রূণ বিকাশের প্রাথমিক ধাপেই এই জিনের পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়। এইচআইভি ভাইরাস যে নির্দিষ্ট জিনকে আক্রমণ করে দেহে প্রবেশ করতো সেই জিনটিকেই নষ্ট করে ফেলা হয়।
গ্রেসের গর্ভে লুলু এবং নানার ভ্রূণকে প্রতিস্থাপন করার আগে তাদের সমগ্র জিনের সিকোয়েন্স করা হয়। এরপরে আমরা তার রক্ত পরীক্ষা ও আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হই যে তার গর্ভে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। গর্ভধারণের পর আরেকবার লুলু এবং নানার জিন সিকোয়েন্স করা হয় এবং দেখা যায় তাতেও কোনো অস্বাভাবিকতা নেই।
মেয়ে দুটি সুস্থ, স্বাভাবিক শরীরে এই পৃথিবীতে জন্মলাভ করে। যখন মার্ক তার বাচ্চাদেরকে প্রথম দেখে সে বিস্ময়ে অভিভূত হয়। সে যে বাবা হতে পারবে এটা কখনো কল্পনা করতে পারেনি। আজ সে বাঁচতে চায়। নিজের সন্তানদেরকে নিয়ে অনেকটা পথ যেতে চায়। মার্কের এই অসাধারণ অনুভূতি আমাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়েছে। শুধুমাত্র এইচআইভি নয়, যেকোনো বংশপরম্পরায় বাহিত রোগকে আমরা প্রতিরোধ করতে পারি জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে।
যেহেতু এ ধরনের পরিবর্তন আমরা ভ্রূণাবস্থার একদম প্রাথমিক দশায় করতে পারি তাই পুরো জীবনে ওই নির্দিষ্ট রোগটিতে আর তারা আক্রান্ত হতে পারবে না। শুধু তা-ই নয়, তাদের বংশপরম্পরায়ও এই পরিবর্তনটি থেকে যাবে।
আজকের পৃথিবীতে অসংখ্য দম্পতি আছে যারা শুধু এইচআইভি নয়, অন্যান্য অনেক বংশগত রোগের জন্য সন্তান নিতে পারছে না। তাদের জন্য হলেও জিন সম্পাদনার মাধ্যমে এ ধরনের পরিবর্তনকে আমাদের স্বাগত জানানো উচিত বলে আমি মনে করি।
জনকুই জানিয়েছেন, এই পরীক্ষা তিনি প্রথমে সাতজন দম্পতির উপর চালালেও একটি ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। এরকম দম্পতির কথা চিন্তা করে তিনি ভবিষ্যতেও জিনগত অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুর জন্ম দিতে চান। তিনি এই জিনগত পরিবর্তনকে কোনো ফ্যাশন বা ডিজাইনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেননি। ব্যবহার করেছেন সুখী, সুন্দর পরিবার সৃষ্টির লক্ষ্যে। আর তাই এজন্য তিনি যেকোনো সমালোচনা মাথা পেতে নিতে রাজি আছেন।
এখানে সমালোচনা কেন? সমালোচনার প্রসঙ্গ এ কারণে এসেছে যে, ধরনের পরীক্ষা এখনো পর্যন্ত বিজ্ঞান জগতে অনৈতিক। মানুষের উপর সরাসরি এ ধরনের পরীক্ষা চালানোর ক্ষেত্রে বিজ্ঞানমহলে বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞা আছে। তাই লন্ডনের কিংস কলেজের স্টেম সেল বিশেষজ্ঞ ড. ডুস্কো ইলিচ বিরোধিতা করে বলেছেন,
এ ধরনের কাজকে যদি নৈতিক বলে আখ্যা দেওয়া হয়, তাহলে তা হবে সারা দুনিয়ার প্রচলিত নৈতিক ধারণা থেকে একেবারেই ভিন্ন।
ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ে হয়ে যাওয়া হিউম্যান জিনোম এডিটিং সামিটে আলোচনার সময় জনকুই জানিয়েছেন তার পরীক্ষার অধীনে জিনগত অস্ত্রোপচার করা ভ্রূণে আরেকজন গর্ভবতী মা রয়েছেন। যদি তিনি সুস্থ ও সফলভাবে সন্তান জন্মদানে সক্ষম হন তবে এটি হবে জিনগত সম্পাদনা করা দ্বিতীয় মানবশিশু।
তবে এখনো বিস্তারিত বর্ণনাসহ কোনো গবেষণাপত্র তিনি প্রকাশ করেননি। আর এই কাজটি খুব গোপনে করা হয়েছে। অধ্যাপক জনকুই-এর বিশ্ববিদ্যালয় সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি থেকে জানানো হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও এ ধরনের কোনো প্রকল্প সম্পর্কে কিছু জানতো না। তাই কেউ কেউ এই দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ তুলছেন। তবে এই কাজ বাস্তবায়ন বেশ কঠিন হলেও একেবারে যে অসম্ভব নয় সে কথাও বিজ্ঞানীমহল একবাক্যে স্বীকার করেন।
অন্যদিকে এ কথাও মনে রাখা দরকার, জিন পরিবর্তনের কিছু নেতিবাচক প্রভাবও আছে। তাই অধ্যাপক জনকুই জানিয়েছেন বাচ্চাগুলোকে ১৮ বছর পর্যন্ত তিনি নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখবেন। প্রতিটি মুদ্রার যেমন দুই পিঠ থাকে, তেমনই এরকম গবেষণারও দুই পিঠ থাকে- ইতিবাচক এবং নেতিবাচক। তবে মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখা এই গবেষক শেষ পর্যন্ত আস্থা আর বিশ্বাস রাখছেন মানুষের ভালবাসার উপরেই। তিনি বলেন,
এটি একটি বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রক্রিয়াকে পৃথিবীর সর্বত্র বৈধতা দেওয়া হবে কি না, সেটা আমাদের সমাজই ঠিক করে দেবে।
বিজ্ঞান সময়ে সময়ে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। এটিও সেরকমই একটি অসম্ভব। এই প্রযুক্তির সফলতা আসলে মানবস্বাস্থ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে নিঃসন্দেহে। সকল নেতিবাচক দিক কাটিয়ে উঠে এটি যেন মানবকল্যাণে ব্যবহৃত হয় সেরকমই আমাদের কামনা।