পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তির সময় থেকেই উপকারী জীব, অণুজীবের যেমন উদ্ভব ঘটেছে, তেমনি পাশাপাশি ক্ষতিকর জীব-অণুজীবেরও উদ্ভব ঘটেছে। এমনই একটি ক্ষতিকর অনুজীবের নাম ভাইরাস। প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে মুঠোফোন, ল্যাপটপ, নোট প্রভৃতি সবার হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ায় ভাইরাস শব্দটি এখন সবার নিকট সুপরিচিত একটি শব্দ। এই লেখায় অণুজীব ভাইরাস নিয়ে থাকছে চমকপ্রদ কিছু তথ্য, যা ২০১৮ সাল জুড়ে বিজ্ঞানের দুনিয়া মাতিয়ে রেখেছে।
প্রথমেই জানা যাক, ভাইরাস কী? ভাইরাস একটি অতিক্ষুদ্র ও অকোষীয় অনুজীব যাদের খালি চোখে দেখা যায় না। এরা জীবদেহে (উদ্ভিদ, প্রাণী, ব্যাকটেরিয়া) বাস করে এবং এখানেই তাদের বংশবিস্তার ও সকল প্রকার কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। এরা মূলত জীবদেহে বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই সৃষ্টির জন্য দায়ী।
ল্যাটিন ভাষা থেকে আগত ভাইরাস শব্দটির অর্থ বিষ। ১৮৯২ সালে রাশিয়ান বিজ্ঞানী দিমিত্রি আইভানভস্কির গবেষণায় ভাইরাস সর্বপ্রথম নজরে আসে। এরপর ১৮৯৮ সালে ডাচ বিজ্ঞানী মার্টিনাস ডব্লিও বেইজেরিংক প্রথম ভাইরাস সম্পর্কে ধারণা দেন। তিনি বলেন, এটি একটি নতুন ধরনের সংক্রামক উপাদান যা অবশ্যই জীবিত। পরবর্তীতে জানা যায়, ভাইরাস মূলত প্রোটিনে আবৃত ডিএনএ কিংবা আরএনএ’র গঠন। এরা নিজেদের জেনেটিক কোডকে প্রাণীদেহের জেনেটিক কোডের সাথে সংযুক্ত রাখার ক্ষমতা রাখে। ফলে এরা অনায়াসে যেকোনো প্রাণীর মাঝে লুকিয়ে থাকতে সক্ষম হয়।
১৮৯২ সালে ভাইরাস সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হলেও আজও এই ক্ষতিকর অণুজীব নিয়ে রয়েছে কৌতূহল এবং সেসব উন্মোচনে চলছে বিস্তর গবেষণা। আর গবেষকদের এই নিরন্তর গবেষণার ফলে ভাইরাস সম্পর্কে বেরিয়ে আসছে একের পর এক নতুন তথ্য। সম্প্রতি বিজ্ঞানীগণ এই ক্ষতিকর অণুজীব সম্পর্কে বেশ কিছু নতুন তথ্য উন্মোচন করেছেন। ভাইরাস সম্পর্কিত ভাইরাল হতে যাওয়া এই ৬টি নতুন তথ্যই থাকছে এই লেখায়।
মানুষের মস্তিষ্কে প্রাচীন ভাইরাস রয়েছে
ভাইরাস সম্পর্কিত নতুন তথ্যগুলোর একটি হলো, প্রতিটি প্রাণীর মস্তিষ্কেই এক ধরনের প্রাচীন ভাইরাসের অস্তিত্ব রয়েছে। জানুয়ারিতে প্রকাশিত জার্নাল সেলে দুই পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়। গবেষকগণ তাদের এই প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করেছেন, মানুষসহ অন্যান্য জীবজন্তুর মস্তিষ্কের নিউরনে এরকম প্রাচীন সংক্রামক ভাইরাসের অস্তিত্ব রয়েছে।
গবেষকগণ চতুষ্পদীর প্রাণীর মস্তিষ্কে আর্ক নামক একটি ভাইরাসের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন, যা প্রাচীন ভাইরাসের জেনেটিক কোডের অবশিষ্টাংশ। এই জিন জেনেটিক তথ্য প্যাকেজিংয়ের কাজ করে থাকে এবং এগুলো নার্ভকোষ থেকে তাদের প্রতিবেশী কোষগুলোতে তথ্য প্রেরণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে গবেষকগণ জানান, এই ক্ষুদ্র ক্যাপসুলাকৃতির প্যাকেজগুলো কীভাবে নার্ভের সাথে যোগাযোগ পুনর্বিন্যাস করে থাকে তা এখনো জানা যায়নি। তাদের মতে, এ সম্পর্কে জানতে আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
ভাইরাস মাটিতে পতিত হয়
দীর্ঘদিন যাবত ভাইরাসের আকৃতিগত মিল নিয়ে বেশ কৌতূহল ছিল বিজ্ঞানীদের মাঝে। আর সেটি হলো- পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাওয়া যাক না কেন, সব ভাইরাসের গঠন এক। বিজ্ঞানীদের মনে প্রশ্ন জাগে- এটা কী করে সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর মিলে যায় ২০১৮ সালে। গবেষণা থেকে উদ্ভুত অবাক করা তথ্য হলো, ভাইরাস শুধু মাটি ও পানিতে চলাচল করতেই সক্ষম নয়; এরা বাতাসে ভেসেও বেড়াতে পারে। মাল্টিডিসিপ্লিনারি জার্নাল অব মাইক্রোবায়োলজিতে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বিজ্ঞানীরা জানান, ভাইরাস বায়ুমন্ডলীয় স্তর ট্রপোস্ফিয়ারের মধ্যে ভেসে ভেসে চলাচল করতে পারে। আর এভাবে ভাসতে ভাসতেই তারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে পতিত হয়।
গবেষকগণের মতে, মাটি অথবা পানি দিয়ে বিদ্যমান ভাইরাসের তুলনায় বায়ুমন্ডলে ভাসতে ভাসতে চলা এই ভাইরাসগুলো অধিক গতিসম্পন্ন। কেননা এই ভাইরাসগুলো যখন মুক্ত ট্রপোস্ফিয়ার অঞ্চল দিয়ে চলাচল করে, তখন এরা ভূপৃষ্ঠ থেকে ৮,২০০ থেকে ৯,৮০০ ফুট উঁচুতে থাকার ফলে বায়ুমন্ডলে অতিদ্রুত চলাচলের ক্ষমতা অর্জন করে। ভ্যানকুভার ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী লেখক কার্টিস স্টল এই নতুন তথ্য সম্পর্কে বলেন, এই মুক্ত ট্রপোস্ফিয়ার অঞ্চল থেকে প্রতিদিন ৮০০ মিলিয়ন ভাইরাস ভূপৃষ্ঠের প্রতিমিটার এলাকায় পতিত হয়। তার এই মন্তব্য সদ্য আবিষ্কৃত তথ্যকে যেন আরো সমর্থনযোগ্য করে তোলে।
ভাইরাস আলঝেইমার রোগের জন্য দায়ী
আগে থেকেই সন্দেহ ছিল যে, আলঝেইমার রোগের নেপথ্যে হয়তো হার্পিস ভাইরাস রয়েছে। তবে জুনে প্রকাশিত জার্নাল ‘নিউরন’ এর প্রতিবেদন এই ধারণাটিকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। গবেষকগণ বিভিন্ন মস্তিষ্ক ব্যাংক থেকে প্রায় ১,০০০ পোস্টমর্টেমকৃত মস্তিষ্ক সংগ্রহ করেন, যার মধ্যে আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত মানব মস্তিষ্ক এবং সুস্থ মানুষের মস্তিষ্কও ছিল।
গবেষণার জন্য তারা সুস্থ ও আক্রান্ত ঐ মস্তিষ্কের কোষগুলো থেকে জেনেটিক সিকোয়েন্স সংগ্রহ করেন। এই গবেষণায় তারা লক্ষ্য করেন, সুস্থ মানুষের তুলনায় আক্রান্ত মানুষের মস্তিষ্কের হার্পিস ভাইরাসের দুটি সাধারণ স্ট্রেইন দ্বিগুণ পরিমাণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত থাকে। এই পরীক্ষা থেকে ধারণা করা হয়, আলঝেইমার রোগ মূলত হার্পিস ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে হয়ে থাকে।
তবে আলঝেইমার রোগের জন্য গবেষকরা পুরোপুরিভাবে হার্পিসকে এখনও দায়ী করছেন না। কেননা আলঝেইমার রোগের বিস্তারে হার্পিস মূলত কী ধরনের ভূমিকা পালন করে সে বিষয়ে তারা এখনো উপযুক্ত তথ্যাদি পাননি। আর তাই তারা বলতে চান, হার্পিস এই রোগের পুরোপুরি কারণ হতে পারে, কিংবা শুধুমাত্র এই রোগের গতিবৃদ্ধির প্রভাবক হিসেবেও কাজ করতে পারে। আবার এমনও হতে পারে যে, হার্পিস ভাইরাস এই রোগের জন্য দায়ীই না, হয়তো অন্য কোনো কারণে আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির মস্তিষ্কে হার্পিস ভাইরাস বাসা বেঁধেছিল।
জায়ান্ট ভাইরাস (Giant Viruses) তাদের নিজস্ব জিন উৎপাদন করে থাকে
ভাইরাস সম্পর্কিত আরেকটি নতুন তথ্য হলো- জায়ান্ট ভাইরাস তাদের নিজেদের জিন নিজেরাই তৈরি করতে সক্ষম। এর নাম জায়ান্ট ভাইরাস হওয়ার কারণ হলো এই ভাইরাসগুলো সাধাণ ভাইরাসের তুলনায় আকৃতিতে দ্বিগুণ এবং জটিল জিনোম সম্পন্ন। মাত্র কয়েক বছর আগে এটি আবিষ্কৃত হয়। আবিষ্কৃত হওয়ার সময়ই এর আকৃতিগত চেহারা বিজ্ঞানীদের অবাক করে দিয়েছিল। স্ট্রাকচারাল এন্ড জিনোমিক ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সময় গবেষকগণ ভাইরাসের এই অদ্ভুত পরিবার এবং তাদের দৈত্যাকার জিনোম আবিষ্কার করেন।
গত জুনে গবেষকদের প্রতিবেদনে দেখা যায়, জায়ান্ট ভাইরাস অর্থাৎ প্যান্ডোরা ভাইরাসে কিছু জিন দেখা যায়। একে গবেষকেরা অনাথ জিন (Orphan Genes) নামকরণ করেছেন এবং এই জিনগুলো এই ভাইরাসের তৈরি। পাশাপাশি তারা লক্ষ্য করেন, এই ভাইরাসগুলো নতুন জিন তৈরিতে বেশ উর্বর। প্যান্ডোরা ভাইরাসের জিন তৈরির কারণ জানা সম্ভব না হলেও পরবর্তীতে হয়তো গবেষকগণ অনুসন্ধান করে বের করে আনবেন এর জটিল রহস্য। তবে ভাইরাসও যে সৃষ্টিশীল, এটাই বা কম আশ্চর্যজনক কী!
ভাইরাস আসক্তিতে ভূমিকা পালন করে
ভাইরাস সম্পর্কিত আরো একটি তথ্য হলো- এরা আসক্তির জন্য দায়ী। যদিও এই তথ্য দিয়েই থেমে গিয়েছেন গবেষকগণ। কেননা এটি কীভাবে আসক্তিতে ভূমিকা রাখে সে বিষয়ে তারা কোনো তথ্য বের করতে পারেননি। এই তত্ত্বের ব্যাখ্যার জন্য প্রয়োজন আরো গবেষণা, যা আসক্তিতে ভাইরাসের ভূমিকা স্পষ্ট করে তুলবে। সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত জার্নাল প্রোসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমির একটি প্রতিবেদনে গবেষকরা দাবী করেন, এইচকেটু (HK2) নামক ভাইরাসের জেনেটিক ট্রেস সাধারণ মানুষের তুলনায় মাদক কিংবা ওষুধ সেবনকারীদের মাঝে বেশি বিদ্যমান।
গবেষকদের মতে, অবাক করা বিষয় হচ্ছে আজ থেকে ২,৫০,০০০ বছর আগের সংক্রমক জিন এখনও তাদের উত্তরসূরীদের মাঝে বিদ্যমান। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এইচকেটু (HK2) সংক্রমিত প্রাণীর সংখ্যা কত সেটা জানতে গিয়ে গবেষকরা মাত্র ৫-১০ শতাংশ প্রাণীর মাঝে এইচকেটুর অবশেষ পান। গ্রিক গবেষকগণ এইচআইভি (HIV) আক্রান্ত ব্যক্তিদের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখেন, এইচআইভি নিরাময়ের ওষুধ সেবনের ফলে তাদের শরীরে এইচকেটুর পরিমাণ ২.৫ গুণ বেড়ে গিয়েছিল। এছাড়া ইংরেজ গবেষকরা দেখেছেন, হেপাটাইটিস সি আক্রান্তদের মাঝে দীর্ঘ সময় ওষুধ সেবনকারীদের মাঝে এইচকেটুর পরিমাণ ৩.৬ গুণ বেশি ছিল।
হঠাৎ জেগে ওঠা হার্পিস ভাইরাস
মূলত আমরা সবাই একাধিক ভাইরাসের সাথে প্রতিবেশী হিসেবে বাস করছি এই পৃথিবীতে। তন্মধ্যে একটি হলো হার্পিস ভাইরাস। মোটামুটি একশো রকম হার্পিস ভাইরাসের মধ্যে নয়টির প্রধান কাজ হলো মানুষকে সংক্রমিত করা। এটি এমন একটি ভাইরাস যা মানুষের শরীরে নীরবে বাস করে। আর এর সবচেয়ে ভয়ানক দিক হলো এটি যখন তখন সক্রিয় হয়ে মানব শরীরের কোষগুলো অকেজো করার ক্ষমতা রাখে।
এই ভাইরাসের স্বভাব সম্পর্কে আলোকপাত করতে গেলে বলতে হয়, আপনি যদি জীবনের শুরুতে কখনো এই ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়ে পড়েন, তবে এরা আপনার শরীরের কিছু কোষের মধ্যে ঘুমন্ত অথবা সুপ্তাবস্থায় রয়ে যায়। এরপর সময় ও কালের পরিক্রমায় একদিন এই ভাইরাসগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং তারা তাদের একাধিক প্রতিলিপি তৈরি করে আপনার এক কোষ থেকে আরেক কোষ অকেজো করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, শতকরা ৮০ জন মানুষের শরীরেই এই ঘুমন্ত ভাইরাসের অস্তিত্ব বিদ্যমান। এটি যখন সুপ্তাবস্থায় থাকে তখন এটি আপনার মাথাব্যাথার বিন্দুমাত্র কারণ হয়ে ওঠে না। কিন্তু বিপদ হয় তখন, যখন এরা জেগে ওঠে অর্থাৎ সক্রিয় হয়ে ওঠে। কেননা তখন এদের প্রতিরোধ করা তো দূরের কথা, শনাক্ত করাই দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে পড়ে।