১২
ওরচেস্টার, ম্যাসাচুসেটস। ১৮৮২।
ফ্যানি লুইস হয়ট এবং নাহুম ড্যানফোর্ড গডার্ডের ঘর আলোকিত করে পৃথিবীতে এল রবার্ট হাচিন্স গডার্ড। প্রথম সন্তান হিসেবে ছেলেকে এমনিতেই প্রচুর আদর-যত্ন করত বাবা-মা। পরবর্তীতে এই দম্পতির আরেকটি সন্তান হয়, এবং মারা যায়। ফলে একমাত্র ছেলেকে আরো বেশি করে আগলে রাখার চেষ্টা করতে থাকে এই দম্পতি।
ছোটবেলায় বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকে পড়ে রবার্ট। বাবা-মা ছেলেকে আরো উৎসাহ দিলেন। সেজন্য জন্মদিনে মাইক্রোস্কোপ ও টেলিস্কোপ উপহার দিয়েছিলেন তারা। সেই সঙ্গে সায়েন্টিফিক আমেরিকানের সাবস্ক্রিপশনও নিয়ে দিয়েছিলেন।
বিজ্ঞানের সাথে ভালোই সখ্যতা হয়ে গেল। এভাবে পেরিয়ে গেল জীবনের পনের বছর। ষোলতে এসে গডার্ড এইচ জি ওয়েলসের দ্য ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস পড়লেন। মহাকাশ অভিযান নিয়ে তার মধ্যে তৈরি হলো প্রবল আগ্রহ।
শারীরিকভাবে রবার্ট কিছুটা রোগা ছিলেন। সেজন্য দেখা যেত, প্রায়ই স্কুলে যেতে পারছেন না। বাবা-মাও সেজন্য ছেলেকে একদমই চাপ দেননি। বাসায় বিশ্রামের সাথে সাথে স্থানীয় লাইব্রেরির বইগুলো নিয়মিতভাবে পড়তে লাগলেন গডার্ড। ওভাবেই সময় কাটতে লাগল।
সাস্থ্য কিছুটা ভালো হলে আবার পড়াশোনায় মন দিলেন গডার্ড। ১৯০৪ সালে সাউথ হাই কমিউনিটি স্কুল থেকে হাই-স্কুলের পড়াশোনা শেষ করলেন। তারপর ভর্তি হয়ে গেলেন ওরচেস্টার পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে। বিষয়, পদার্থবিজ্ঞান।
এখানে একটা মজার ঘটনা আছে। ১৯০৭ সালের কথা। পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের বেজমেন্টে রকেট নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন গডার্ড। রকেট থেকে তীব্রভাবে বেরিয়ে আসা গুঁড়ো জ্বালানীর ফলে তৈরি ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছিল প্রায় পুরো বেজমেন্ট। কর্তৃপক্ষ সেটা টের পেয়েছিল। স্থানীয় লোকজনের মুখে মুখে ছড়িয়ে গিয়েছিল গডার্ডের কথা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব জেনেও কর্তৃপক্ষ তাকে বের করে দেয়নি। বরং উৎসাহ দিয়েছিল রকেট নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে।
যাই হোক, ১৯০৮ সালে ব্যাচেলর অব সায়েন্স ডিগ্রি নিয়ে অনার্স শেষ করেন গডার্ড। তারপর, কিছুদিন পদার্থবিজ্ঞান পড়ালেন ওখানেই।
বছরখানেক পরে ওরচেস্টারের ক্লার্ক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গেলেন। উদ্দেশ্য, পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স করা। ১৯১০ সালে সেটাও হলো। বছরখানেক পরে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করলেন পিএইচডি। তারপর, ক্লার্ক ইউনিভার্সিটিতেই পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন। এতদিনে মহাকাশযাত্রা নিয়ে তার চিন্তা-ভাবনা আরো বিস্তৃত হয়েছে। এখন সেই সুযোগও এসে গেল। তাই, ক্লার্ক-এ থাকা অবস্থাতেই রকেট নিয়ে আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন গডার্ড।
এ সময় প্রিন্সটন থেকে রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে গেলেন। চলে গেলেন সেখানে। কিন্তু আবারো রোগে ধরল। টিউবার্কিউলোসিস। রিসার্চ ফেলোশিপ ছেড়ে ওরচেস্টারে ফিরে এলেন গডার্ড।
শরীর যখন ভেঙ্গে পড়ছে, মাথা তখন ছুটছে প্রচণ্ড গতিতে। অসুখ থেকে সারার আগেই, ১৯১৩ সালে রকেট নিয়ে তার প্রথম কাজ সম্পন্ন করলেন গডার্ড। ক্যালকুলাস ব্যবহার করে এমন এক গাণিতিক সমীকরণ আবিষ্কার করলেন, যেটা দিয়ে লম্ব ভাবে উড়ে যাওয়া রকেটের অবস্থান ও বেগ নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা যাবে। সেজন্য সমীকরণে রকেটের ওজন, জ্বালানীর ওজন এবং বেরিয়ে আসা গ্যাসের বেগ (রকেটের সাপেক্ষে) বসিয়ে হিসাব করতে হবে।
মজার ব্যাপার হলো, এসব করতে গিয়ে স্বাধীনভাবে ‘জাল্কোভস্কি রকেট ইকুয়েশন’ আবারো আবিষ্কার করেন তিনি। একযুগ আগেই যে এই সমীকরণ আবিষ্কৃত হয়ে গেছে, সেটা গডার্ড জানতেন না। সমীকরণে তিনি অবশ্য নতুন দুটো জিনিস যুক্ত করেছিলেন। এক, লম্বভাবে চলমান বস্তুর জন্য মহাকর্ষের প্রভাব ও দুই, বাতাসের বাধা ও ঘর্ষণের প্রভাব।
কঠিন জ্বালানীর সাথে সাথে, তরল জ্বালানী নিয়েও কাজ করলেন গডার্ড। ১৯১৪ সালে তার দুটো পেটেন্ট গৃহীত হয়। একটিতে তিনি কঠিন জ্বালানী দিয়ে চলা বহুস্তরবিশিষ্ট রকেটের কথা বলেন। আরেকটিতে বলেন তরল জ্বালানী ব্যবহারের কথা।
বলাই বাহুল্য, এ ধরনের যেকোনো এক্সপেরিমেন্টের জন্য প্রচুর টাকা প্রয়োজন। গডার্ডের সেই টাকা ছিল না। তারপরও গাঁটের পয়সা খরচ করে বিভিন্ন ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করতে থাকেন তিনি। ‘গাঁটের পয়সা’ কথাটা বলার কারণ আছে। রকেটের মতো কিছু থেকে মূল সুবিধা পেতে পারত সরকার বা বড় কোনো প্রাইভেট কোম্পানি। গডার্ডের মতো একা মানুষ ঠিকঠাক রকেট বানাতে পারলেও কী করতেন? কিন্তু সরকার বা বড় কোম্পানিগুলো তাকে সে সময় পাত্তা দেয়নি। ভেবেছে, পৃথিবীর সীমানা পেরিয়ে যাওয়ার চিন্তা পাগলামি ছাড়া আর কিছু না।
তার এক্সপেরিমেন্টের বড় অংশ জুড়ে ছিল জ্বালানী নিয়ে গবেষণা। অনেক দূর এগিয়েওছিলেন। কিন্তু নিজের টাকায় আর কত! শেষ পর্যন্ত ১৯১৬ সালে স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউটের কাছে ফান্ড চেয়ে লিখলেন গডার্ড। যা লিখলেন, রকেট বিজ্ঞানের ইতিহাসে সেটা ক্লাসিক ডকুমেন্ট হিসেবে এখনো বিখ্যাত।
ওরা তাকে ৫ হাজার ডলার ফান্ড দিয়েছিল। সেই ফান্ড ব্যবহার করে কী কী করেছেন, ১৯১৯ সালে তার একটা বিস্তারিত রিপোর্ট দেন গডার্ড। সেই রিপোর্ট ও আগে ফান্ড চেয়ে লেখা মূল ডকুমেন্ট ১৯২০ সালের জানুয়ারিতে এসে একসঙ্গে প্রকাশিত হলো। নাম, আ মেথড অফ রিচিং এক্সট্রিম অলটিচ্যুডস। তার আবিষ্কৃত রকেটের জ্বালানী নিয়ে গাণিতিক তত্ত্বও সেই লেখায় উঠে এসেছিল।
লেখার শেষাংশে গডার্ড একটা সম্ভাবনার কথা বললেন। তার তত্ত্ব ব্যবহার করে কোনো রকেট চাইলে চাঁদে গিয়ে, সেখানে অনেকটুকু ফ্ল্যাশ পাউডার ফেলে আসতে পারে। তাহলে চাঁদের মাটিতে একটা চিহ্ন থেকে যাবে। রকেট যে আসলেই ওখানে পৌঁছেছে, তার চিহ্ন।
(আপনি কি জানেন, নীল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিন চাঁদের মাটিতে একটি রেট্রোরিফ্লেক্টর রেখে এসেছেন? ঠিক গডার্ডের ভাবনাই প্রতিফলিত হয়েছে তাদের কাজে। আজও, পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে সেই রিফ্লেক্টরের দিকে লেজার ছুঁড়ে দিলে, প্রতিফলিত হয়ে সেখান থেকে সিগন্যাল ফিরে আসে। সেই সিগন্যাল রিসিভ করে কম্পিউটারে আপনি নিজেই দেখতে পারবেন, একটা সিগন্যাল ফিরে এসেছে!)
মিডিয়ার লোকজন বৈজ্ঞানিক পেপার পড়ে তেমন কিছুই বুঝল না। শুধু বুঝল, গডার্ড চাঁদে রকেট পাঠানোর সম্ভাবনার কথা বলেছেন। কী অবাস্তব চিন্তা-ভাবনা! এর পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালা হচ্ছে? গডার্ডের গবেষণা ও পেপার নিয়ে বিদ্রুপের ঝড় বয়ে গেল সংবাদমাধ্যমগুলোতে। কেউ কেউ তাকে সরাসরি পাগল বলেও আখ্যা দিল। এই ক্ষোভ তিনি সারাজীবন পুষে রেখেছিলেন। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন অনেকটা। কিন্তু গবেষণায় ঢিল দেননি একটুও।
সংবাদমাধ্যমগুলোর সব বিদ্রুপের জবাব গডার্ড হাতে-হাতে দিয়েছিলেন ১৯২৬ সালে। ম্যাসাচুসেটসের অবার্ন থেকে তরল জ্বালানী ব্যবহার করে সফলভাবে প্রথম রকেট উৎক্ষেপণ করেন তিনি। কিন্তু তাতেও সেরকম লাভ হলো না। কিছুদিন আগেই প্রথম বিমান উড়িয়ে দেখিয়েছেন উইলবার রাইট আর অরভিল রাইট। মার্কিন সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে সরকার পর্যন্ত সবাই সেই মুগ্ধতার ঘোরে আটকে গেছে। পাগল-খ্যাত এক লোকের নিজস্ব গবেষণা নিয়ে মাতামাতি করতে তাদের বয়েই গেছে!
কিন্তু আগের মতোই স্মিথসোনিয়ান তার পাশে ছিল। ১৯২৭ সালে তাকে আরো ১০ হাজার ডলারের ফান্ডিং দিল তারা। সেই সাথে চার্লস লিন্ডবার্গের উদ্যোগে ড্যানিয়েল এন্ড ফ্লোরেন্স গুগেনহেইম ফাউন্ডেশন থেকেও আর্থিক সমর্থন পেলেন। সবমিলে এ সময় দারুণভাবে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন গডার্ড।
তার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটা ছোট্ট তালিকা দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে-
- অনেকটা উচ্চতায়, এমনকি চাঁদ পর্যন্ত যাওয়ার জন্য রকেটের জ্বালানীর ব্যবহার ও এর বাস্তবতা নিয়ে গবেষণা (১৯১৩)
- প্রমাণ করেন, ভ্যাকুয়ামেও রকেট চলতে পারবে (১৯১৩)
- তরল জ্বালানী দিয়ে প্রথম রকেট উৎক্ষেপণ (মার্চ, ১৯২৬)
- পেলোডসহ (রকেটের ভেতরে বয়ে নেওয়ার জন্য রাখা যেকোনো কিছু) রকেট ছুঁড়ে দেখা (১৯২৯)
- রকেটের জন্য ‘ভেইন’ (ছোট পাখনার মতো, এটা ব্যবহার করে রকেটের পেছন থেকে বেরিয়ে আসা জ্বালানী প্রবাহের দিক নিয়ন্ত্রণ করা যায়) ব্যবহার (১৯২৯)
- রকেটের জন্য জাইরো-কন্ট্রোল (রকেট কত দ্রুত কোণাকুণি ঘুরছে, সেটা হিসেব রাখা ও নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র) বানানো (১৯৩২)
- রকেটের জ্বালানীর জন্য বিশেষ ধরনের ফুয়েল-পাম্প তৈরি (আবিষ্কারের সন সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি, তবে ১৯৩২ এর কাছাকাছিই হবে)
এই তালিকা থেকেই বোঝা যায়, ১৯২৭ এর পরে দারুণভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন গডার্ড। রকেট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পুরো খোল-নলচে বদলে দেন তিনি। ১৯২৬ থেকে ১৯৪১ এর মধ্যে নানা ধরনের ৩৪টি রকেট উৎক্ষেপণ করেন। এদের কোনো কোনোটি ২.৬ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত উঠেছিল। আর, সর্বোচ্চ বেগ ছিল ঘন্টায় ৮৮৫ কিলোমিটার।
মৃত্যুর আগে রবার্ট গডার্ডের নামে পেটেন্ট ছিল ২১৪টি! পরে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানদের বানানো ভি-২ রকেটে গডার্ডের আবিষ্কৃত জাইরো-কন্ট্রোল, ভেইন ও ফুয়েল-পাম্প ব্যবহার করা হয়। অথচ ২১৪টি পেটেন্টও জীবদ্দশায় গডার্ডকে যথার্থ সম্মান ও মূল্য এনে দিতে পারেনি।
১৯৪৫ সালের ১০ আগস্ট তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পরেও দীর্ঘদিন তার কাজ ওভাবেই, হেলায় পড়ে ছিল। ১৯৫৯ সালের দিকে তার স্ত্রী, এস্থার গডার্ড তার কাজ নিয়ে ফের আলোচনা করতে শুরু করেন। তিনি সরকারের কাছে গডার্ডের কাজের স্বীকৃতি চান। সে বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর ৮৬ তম কংগ্রেস প্রফেসর রবার্ট হাচিন্স গডার্ডের সম্মানে, তার স্ত্রীর হাতে স্বর্ণের মেডেল তুলে দেওয়ার কথা বলে। ১৯৬১ সালের ১৬ মার্চ, গডার্ডের প্রথম তরল জ্বালানীবিশিষ্ট রকেট উৎক্ষেপণের ঠিক ৩৫ বছর পূর্তির দিন তার স্ত্রীর হাতে এই মেডেল তুলে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে রবার্ট গডার্ড তার সারা জীবনের কাজের স্বীকৃতি পান।
মার্কিন সরকার যখন গডার্ডের কাজ চরম অবহেলায় ফেলে রেখেছে, ঠিক সে সময় আরেক কৃতী বিজ্ঞানীও রকেট নিয়ে কাজ করছেন। তার খোঁজে এবারে আমাদের যেতে হবে জার্মানিতে। তিনি হারমান ওবার্থ। রকেট প্রযুক্তির তৃতীয় জনক।
সিরিজটির আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব