এই জগতে বিদ্যমান বিভিন্ন ঘটনা ব্যাখ্যা করতে আমরা ইন্দ্রিয়ের সাহায্য নেই। চোখে দেখলে বা কানে শুনলে বা ত্বকে অনুভূত হলে আমরা সিদ্ধান্ত নেই সেখানে আসলেই কিছু না কিছু একটা আছে কিংবা কিছু না কিছু একটা অবশ্যই ঘটছে। তবে জগতের সবকিছুই যে আমাদের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বিচার-বিশ্লেষণ করা যাবে এমন নয়। ভৌত জগতের অনেক কিছুই আছে যা স্বাভাবিকভাবে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করা যায় না। তবে সরাসরি অনুভব করা না গেলেও ভিন্ন একটি উপায়ে বিজ্ঞানীরা বিশেষ ঐ ঘটনার ব্যাপারে সিদ্ধান্তে উপনীত হন।
বাস্তব জগতের কোনো ঘটনা কেমন হবে তা যদি সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা না যায়, তাহলে বিজ্ঞানীরা তা ব্যাখ্যা করার জন্য ‘মডেল‘ প্রদান করেন। প্রদত্ত মডেল তার দাবীর সত্যতার পক্ষে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করবে। যদি ভবিষ্যদ্বাণী সত্য বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে ঐ মডেল সঠিক বলে বিবেচিত হবে। আর ভবিষ্যদ্বাণী যদি মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তাহলে সেই মডেল বাতিল বলে গণ্য হবে কিংবা মডেলকে সংশোধন করে আবার নতুনভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
মহাবিশ্বের উৎপত্তি কখন ও কীভাবে হয়েছিল সে সম্বন্ধে আমাদের ইন্দ্রিয় কিছু বলতে পারবে না। কারণ এই ঘটনা ঘটে গেছে অনেক অনেক আগে। তাই মহাবিশ্বের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করতে হলে অবশ্যই কোনো না কোনো মডেলের দ্বারস্থ হতে হবে। বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্বন্ধে দুটি মডেল প্রচলিত ছিল। মডেল দুটি ছিল একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং বক্তব্যের দিক থেকেও ছিল পরস্পর বিপরীতমুখী। এদের একটি হচ্ছে ‘স্টিডি স্টেট’ বা ‘স্থির মহাবিশ্ব’ মডেল আর অপরটি হচ্ছে ‘বিগ ব্যাং’ বা ‘বৃহৎ বিস্ফোরণ’ মডেল। তখনকার সময়ের প্রেক্ষিতে স্থির মহাবিশ্ব মডেলই ছিল সবচেয়ে অভিজাত ও যুক্তিপূর্ণ মডেল। কিন্তু অভিজাত হলেও পরবর্তীতে তা ভুল বলে গণ্য হয়, কারণ এই মডেল মহাবিশ্ব সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল তা ভুল প্রমাণিত হয়।
স্থির মহাবিশ্ব মডেল অনুসারে মহাবিশ্বের কোনো সূচনা বা শুরু ছিল না। মহাবিশ্ব সবসময়ই অস্তিত্বমান ছিল। এটি এখন যেমন আছে, আগেও তেমন ছিল, ভবিষ্যতেও তেমনই থাকবে। অন্যদিকে বিগ ব্যাং মডেল অনুসারে মহাবিশ্ব একটি নির্দিষ্ট সময় আগে অদ্ভুত রকমের এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে উৎপত্তি লাভ করেছিল। বিস্ফোরণের পর থেকে মহাবিশ্ব প্রসারিত হয়েই চলছে। স্থির মহাবিশ্ব মডেলের সাথে যখন এর দ্বন্দ্ব, তখন এটিকে বেশি যুক্তিপূর্ণ বলে মনে হয়নি। কিন্তু তারপরেও এই মডেলকে সকল বিজ্ঞানীই গ্রহণ করে নিয়েছিল। কারণ এই মডেলের দেয়া ভবিষ্যদ্বাণী মহাবিশ্বের পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্যের সাথে মিলে যায়।
বিগ ব্যাং মডেলের আধুনিক ভার্সন অনুসারে আজ থেকে ১৩ বা ১৪ বিলিয়ন বছর আগে পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের সকল বস্তু একটি মাত্র ক্ষুদ্র বিন্দুতে আবদ্ধ ছিল। বিশাল এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে ক্ষুদ্র বিন্দু চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং পদার্থবিজ্ঞানের কিছু নিয়ম মেনে আজকের গ্রহ নক্ষত্র তৈরি করে। এখানে ‘পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব’ কথাটি কেন বললাম? পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব বলতে বোঝায় দৃশ্যমান আলোয় আমাদের চোখে দেখা, টেলিস্কোপের মাধ্যমে এক্স-রে বা অবলোহিত আলোর মাধ্যমে দেখা মহাবিশ্ব।
মোদ্দা কথা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেভাবেই হোক মহাবিশ্বের যে পরিমাণ এলাকা মানুষের পক্ষে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব তা-ই পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব। বিশাল বিস্তৃত মহাবিশ্বের এমন অংশও তো থাকতে পারে যা কোনোপ্রকার যন্ত্রপাতি দিয়েই মানুষ পর্যবেক্ষণ করতে পারে না। এমনও তো হতে পারে মহাবিশ্বের বাইরে অন্য একটি মহাবিশ্ব আছে যেটি সম্বন্ধে আমরা কোনোভাবেই জানতে পারবো না।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে নিজেদের মহাবিশ্বের বিস্তৃতি সম্পর্কেই আমরা ভালো করে জানি না। এ তো গেল নিজেদের মহাবিশ্বের কথা, কোনো কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন এই মহাবিশ্বের বাইরে আরো অনেক অনেক মহাবিশ্ব আছে। আমাদের মহাবিশ্ব সহ অন্যান্য সকল মহাবিশ্বকে একত্রে ‘মাল্টিভার্স’ বা ‘অগণন মহাবিশ্ব’ বলা হয়। মাল্টিভার্সের মধ্যে থাকা মহাবিশ্বগুলো ফেনার মধ্যে থাকা বুদবুদের মতো। একেকটা বুদুবুদ একেকটা মহাবিশ্বকে প্রতিনিধিত্ব করে। অসংখ্য বুদবুদের মাঝে আমাদের সমগ্র মহাবিশ্বটিও একটি বুদবুদ। কিন্তু এসব মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা পর্যবেক্ষণলব্ধ কোনো তথ্য পাই না। তাই এগুলো পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের অন্তর্ভুক্ত নয়। এ কারণেই ‘পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব’ কথাটি উল্লেখ করা হয়েছিল। বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে ১৪ বিলিয়ন বছর আগে আমাদের এই পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের যাত্রা শুরু হয়েছিল।
বিভিন্ন বিজ্ঞানীকে বলতে শোনা যায় সময়েরও একটি শুরু আছে বা সময়েরও জন্ম আছে। বিগ ব্যাংয়ের পর থেকে মহাবিশ্বে সময়ের শুরু হয়েছিল। তাই বিগ ব্যাংয়ের আগে কী ছিল এমন প্রশ্ন করলে প্রশ্নটা হয়ে যায় সময়ের শুরুর আগে কী ছিল? ঋণাত্মক সময় বলতে কিছু নেই। তাই সময়ের শুরুর আগে কী ছিল বলে প্রশ্ন করলে সেটি প্রশ্ন বলেই গণ্য হবে না। কেউ যদি উত্তর মেরুর উত্তরে কী আছে প্রশ্ন করে তাহলে যেমন কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না, তেমনই মহাবিশ্ব শুরুর আগে বা সময়ের শুরুর আগে কী ছিল বললেও কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না।
বুঝতে কষ্ট হচ্ছে? আসলে প্রথমদিকে এই ব্যাপারটা অনুধাবন করতে একটু সমস্যা হয়ই। পরে ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে আমাদের আশেপাশের স্থান যেমন একধরনের মাত্রা, তেমনই সময়ও একধরনের মাত্রা। বিগ ব্যাংয়ের পরে যেমন স্থানের মাত্রার জন্ম হয়েছিল, তেমনই সময়ের মাত্রারও জন্ম হয়েছিল। তাই বিগ ব্যাংয়ের আগে কী ছিল এমন প্রশ্নও আসলে কোনো প্রশ্ন নয়। শুধু এটা অনুধাবন করা জরুরী যে, একটি নির্দিষ্ট সময় আগে একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল।
কীভাবে সবকিছুর শুরু হয়েছিল তা ব্যাখ্যা করতে গেলে প্রথমেই জানতে হবে গ্যালাক্সি সম্বন্ধে। কারণ গ্যালাক্সির প্রসারণের ঘটনা থেকেই বিগ ব্যাং মডেলের পক্ষে বড় ধরনের প্রমাণ এসেছিল। গ্যালাক্সির ভেতরে থাকা নক্ষত্রগুলোর মাঝে অবিশ্বাস্য পরিমাণ ফাঁকা স্থান বিদ্যমান। গ্যালাক্সির বিশালতার তুলনায় নক্ষত্র বলতে গেলে কিছুই না। লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র নিয়ে এক একটি গ্যালাক্সি গঠিত হয়। এক গ্যালাক্সি থেকে আরেক গ্যালাক্সির দূরত্ব কল্পনাতীত পরিমাণ বেশি। এখানে চারটি গ্যালাক্সির একটি ছবি দেয়া হলো। ছবির গ্যালাক্সিগুলোতে সর্পিলাকার প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যায়। রেখার মতো দেখতে এসব সর্পিল প্যাটার্নগুলো আসলে কোটি কোটি নক্ষত্রের সমন্বয়ে গঠিত। নক্ষত্রের পাশাপাশি আছে ধূলি ও গ্যাসের বিস্তৃত মেঘ।
এরকমই একটি গ্যালাক্সি হচ্ছে মিল্কিওয়ে এবং আমাদের সূর্য মিল্কিওয়ের মাঝে বিদ্যমান অনেকগুলো নক্ষত্রের মাঝে একটি। এই গ্যালাক্সিকে মিল্কিওয়ে কেন বলা হয় তার পেছনে কারণ আছে। রাতের পরিষ্কার আকাশে এই গ্যালাক্সিটির একটি অংশবিশেষ দেখতে পাওয়া যায়। অংশটি দেখতে একটি প্রণালি বা পথ (ওয়ে) এর মতো। এজন্য একে বাংলায় ছায়াপথ বা ইংরেজিতে মিল্কিওয়ে বলা হয়।
এটিকে পথ বা প্রণালির মতো দেখা যায় কারণ আমরা এর সামান্য একটি অংশ মাত্র দেখতে পাই। সামগ্রিকভাবে এটি দেখতে মোটেও পথের মতো নয়। যদি কোনো একভাবে অন্য কোনো গ্যালাক্সিতে অবস্থান করে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির দিকে তাকাতে পারতাম তাহলে এটিকে সর্পিলাকার হিসেবে দেখতে পেতাম। নিচের ছবিতে সর্পিলাকার গ্যালাক্সির মাঝে একটি অংশে গোল চিহ্নিত করা আছে, এখানেই আমাদের সূর্যের অবস্থান। এই ক্ষুদ্র একটি বিন্দুই সমগ্র সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্র তথা সমগ্র সৌরজগতকে প্রতিনিধিত্ব করছে। গ্রহগুলো এত বিশাল হওয়া সত্ত্বেও এবং সূর্যের সাথে এদের দূরত্ব এত বেশি হওয়া সত্ত্বেও গ্যালাক্সির আকারের তুলনায় এই ‘বিশাল’ দূরত্ব কিছুই নয়। তাই ছবিতেও এদেরকে আলাদা করে দেখানো সম্ভব হয়নি।
নিচে আরো একটি ছবি তুলে দেয়া হলো। এটি কোনো শিল্পীর কল্পনায় আঁকা নয়, টেলিস্কোপের মাধ্যমে তোলা বাস্তব ছবি। ছবিতে ফুটে ওঠা প্রত্যেকটি ফুটকীই একেকটি গ্যালাক্সির প্রতিনিধিত্ব করছে। ছোট হোক বড় হোক যতগুলো বিন্দু আছে সবগুলোই একেকটি গ্যালাক্সি, আর প্রতিটি গ্যালাক্সিতে আছে বিলিয়ন বিলিয়ন পরিমাণ নক্ষত্রের সমাবেশ। চমৎকার এই ছবিটিতে যতবারই তাকাই ততবারই অভিভূত হয়ে যেতে হয়। ছবিটি দেখে মনে হয় এই মহাবিশ্বের বিশালত্ব কল্পনাতেও ধারণ করা অসম্ভব। ব্যাখ্যা করতে না পেরে এতটুকুই বলা যায়, আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব অনেক অনেক অনেক বিশাল।
বিংশ শতকের শুরুর দিকে এডউইন হাবল নামে একজন বিজ্ঞানী পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেখান গ্যালাক্সিগুলো একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সরে যাওয়াটা এলোমেলোভাবে যাচ্ছেতাই দিকে নয়, একটি নির্দিষ্ট হারে সরছে। যে গ্যালাক্সির দূরত্ব যত বেশি তার সরে যাওয়ার হার তত বেশি। যেহেতু একটি আনুপাতিক হারে গ্যালাক্সিগুলো দূরে সরে যাচ্ছে তার মানে উল্টো করে পেছনের দিকে গেলে দেখা যাবে একসময় সকল গ্যালাক্সি একত্রে পুঞ্জীভূত অবস্থায় ছিল। এই পুঞ্জীভূত সকল পদার্থ একটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে সমগ্র মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে প্রসারিত হতে থাকে। ঐ বিস্ফোরণটিকেই আমরা বিগ ব্যাং বলে অভিহিত করে থাকি। বৈজ্ঞানিকভাবে বিগ ব্যাং মডেলই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মডেল। এই মডেল অনুসারে বিগ ব্যাংয়ের পর থেকেই মহাবিশ্বের সূচনা ঘটেছিল।