মানুষের বৈচিত্রময় মস্তিষ্ককে জানতে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছেন মনোবৈজ্ঞানিক এবং স্নায়ুবিশারদগণ। বিভিন্ন পরীক্ষা থেকে পাওয়া গেছে অনেক বিস্ময়কর ফলাফলও। কিন্তু এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার পদ্ধতি যদি হয় অমানবিক বা অনৈতিক? নিশ্চয়ই তা কারো কাম্য নয়। মনোবৈজ্ঞানিক এমন কিছু ভুল পরীক্ষণের ইতিহাস রয়েছে, যেগুলো ছিল শতভাগ অনৈতিক এবং পরীক্ষণের ফলাফলও ছিল সর্বনাশা। চলুন জেনে নেওয়া যাক তেমনি কিছু অনৈতিক পরীক্ষণ সম্পর্কে।
১) ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগীকে নিয়ে পরীক্ষণ
টনি লা-মাদ্রিদ নামক ২৩ বছর বয়সী এক যুবকের ডিপ্রেশন এবং স্কিৎজোফ্রেনিয়া ছিল। এই টনি ইউ.সি.এল.এ. মেডিকেল সেন্টারে সাইকিয়াট্রিক বিভাগে একইরকম চিকিৎসা পেয়ে যাচ্ছিলেন ১৮৮৫ সাল থেকে ১৮৮৯ সাল পর্যন্ত। তিনি শুধু রোগীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন ঐ বিভাগের মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষণের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি পরীক্ষা চালানো হয় স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগীদের উপর। পরীক্ষাটি এমন ছিল যে- স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগীদের যদি ওষুধ না দেওয়া হয় তাহলে রোগের মাত্রা বাড়ে না কমে বা অন্য কোনো পরিবর্তন দেখা যায় কিনা এবং কেন দেখা যায় তা জানা। মনোবিজ্ঞানী কেইথ নুয়েক্টারলিন এবং মনোচিকিৎসক মাইকেল গিটলিনের তত্ত্বাবধানে এ পরীক্ষা চালানো হয়। সুস্থ ব্যক্তিদের একটি গ্রুপ এবং ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া স্কিৎজোফ্রেনিক রোগীদের একটি গ্রুপ তৈরি করা হয়। তারপর মস্তিষ্ক পর্যবেক্ষণ করা হয় উভয় গ্রুপের।
ফলাফল? স্কিৎজোফ্রেনিক রোগীদের গ্রুপের প্রত্যেকেই অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাদের হ্যালুসিনেশনের মাত্রা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়। তবে কেন বেড়ে গেল, সেটি পরীক্ষায় বের করা যায়নি। আর কী হলো সেই টনির? এই পরীক্ষণের ছয় বছর পরে একটি বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি।
২) প্রজেক্ট QKHILLTOP- চাইনিজ মগজ-ধোলাই পদ্ধতির পরীক্ষা
চাইনিজ মগজ-ধোলাই সম্পর্কে কী কখনো শুনেছেন? এটি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে অত্যাচার করে, ভয় দেখিয়ে, বিদ্রুপ করে বা অন্য কোনো নেতিবাচক উপায়ে কথা আদায় করা হয়। প্রজেক্ট QKHILLTOP এর উদ্দেশ্য ছিল এই মগজ-ধোলাই পদ্ধতি ব্যবহার করে একটি কার্যকরী প্রশ্নমালা তৈরি করা। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলের ডাক্তার হ্যারল্ড ওলফের অধীনেই বেশিরভাগ পরীক্ষণ চালানো হয়েছিল। প্রথমে অত্যাচার, নিপীড়ন, নিগ্রহ, মানহানি ইত্যাদি সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তারপর সেগুলোকে সাজিয়ে, গুছিয়ে, বিশ্লেষণ করে নতুন কোনো পদ্ধতি আবিষ্কারের চেষ্টা চালানো হয়। এরপর সত্যিকারের মানুষের উপর এই তথ্যগুলো প্রয়োগ করে দেখা হয়েছিল তা আসলেই কার্যকর কিনা। পরীক্ষণে অংশগ্রহণকারীদের উপর চাইনিজ মস্তিষ্ক-ধোলাই ব্যবহার করা ছাড়াও গোপন ওষুধ এবং মস্তিষ্ক বিকৃতকরণ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছিল!
পরীক্ষণের ফলাফল কী হয়েছিল? অংশগ্রহণকারীদের উপর মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচার, ধর্ষণ, নিপীড়ন, মানসিক অবমাননার প্রয়োগের ফলে বেশিরভাগই স্থায়ীভাবে বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল, এতই বিধংসী ছিল এই প্রজেক্টটি।
৩) ফ্রয়েডের ভয়ংকর সার্জারি
সিগমুন্ড ফ্রয়েড ছিলেন একজন ডাক্তার এবং সাইকো-অ্যানালাইসিসের প্রবক্তা। ২৭ বছর বয়সী ইমা একস্টেইন একবার পাকস্থলীর পীড়া এবং মৃদু ডিপ্রেশনের কারণে ফ্রয়েডের কাছে যান। ফ্রয়েড পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলেন, ইমা হিস্টিরিয়া বা মৃগী রোগে আক্রান্ত এবং ফ্রয়েড ভাবলেন মেয়েটি মাত্রাধিক হস্তমৈথুনও করতো। সেই সময়ে হস্তমৈথুন বিষয়টিকে একটি মারাত্মক মানসিক অসুস্থতা হিসেবে ধরা হতো। আর তাই ফ্রয়েড তাকে টানা তিন বছর সাইকো-অ্যানালাইসিসের আওতায় রাখেন। মনোবিজ্ঞানের জনক ফ্রয়েডের অনেক সূত্রই ইমার উপরে পরীক্ষণের মাধ্যমে দেওয়া, যেমন- সাইকোপ্যাথলোজি।
কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় ফ্রয়েডের বদ্ধমূল এক ধারণা। ফ্রয়েডের ধারণা ছিল, ইমা হস্তমৈথুন করে দেখে তার প্রচণ্ড পা ব্যথা হয় এবং আরো কিছু সমস্যা দেখা দেয়। তার বিশ্বাস ছিল, নাক এবং জননাঙ্গের টিস্যুগুলো পরস্পর সংযুক্ত। তাই অপারেশনের মাধ্যমে যদি সংযোগটি নষ্ট করে দেওয়া যায়, তাহলেই ইমা এ সমস্যা দেখে মুক্তি পাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। আরেকজন ডাক্তার উইলহেম ফ্লাইসের সহায়তায় পরীক্ষামূলক অপারেশন শুরু করে দেন ফ্রয়েড। অপারেশনের সময় মৃদু অবশকারক এবং কোকেইন ব্যবহার করে প্রথম ভুলটি করে ফেলেন। অপারেশনের ফলাফল ছিল ভয়াবহ। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ শুরু হয় এবং কোনোভাবেই তা বন্ধ করা যাচ্ছিল না। রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে অর্ধ মিটার লম্বা একটি গজ ইমার নাসা গহ্বরে ঢুকিয়ে দেন ফ্রয়েড। পরে এই গজ বের করার সময় ইমার স্থায়ী মুখ বিকৃতি ঘটে।
ফ্রয়েড অবশ্য এর একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিলেন। তিনি বলেন ইমা অসুস্থ থাকতে ভালোবাসে অনেকদিন থেকেই, আর তাই অপারেশনের পর এই রক্তক্ষরণ হলো ‘উইশ-ব্লিডিং’ বা হিস্টিরিয়া-গ্রস্থ ইচ্ছাকৃত রক্তক্ষরণ। এই অপারেশনের পর থেকে ফ্রয়েড আর কোনো সার্জারি করেননি। আর ইমাকে অবশ্য অনেক কষ্টে সুস্থ করতে পেরেছিলেন এবং তারপর ইমাও তার সাইকো-অ্যানালাইসিসের সঙ্গী হয়েছিল।
৪) বাচ্চাদের উপর ইলেক্ট্রো-শক থেরাপি
নিউ ইয়র্কের বেলেভ্যু হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগ একবার অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চাদের উপর ব্যাপক গবেষণা শুরু করে। লরিটা বেন্ডার, গবেষণার মূল কারিগর, বিশ্বাস করতেন অটিজম স্কিজোফ্রেনিয়ারই একটি অংশ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা স্কিৎজোফ্রেনিয়ার প্রথম লক্ষণ।
তার পরীক্ষামূলক গবেষণার কয়েকটি ধাপ ছিল। প্রথম ধাপে অটিস্টিক বাচ্চাকে অনেকের সামনে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয় এবং বোঝার চেষ্টা করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে বাচ্চাটিক মাথা ধরে হালকা চাপ দেওয়া হয়। যদি এই চাপে বাচ্চাটি মাথা নাড়ানোর চেষ্টা করে, তাহলে বুঝে নিতে হবে, সে স্কিৎজোফ্রেনিয়ার প্রথম ধাপে রয়েছে। পরবর্তীতে বাচ্চাকে ইনসুলিন-শক থেরাপি দেওয়া হয়, যেখানে প্রচুর পরিমাণে ইনসুলিন প্রবেশ করানো হয় বাচ্চার দেহে; যেটি কিছু সময়ের জন্য তাকে কোমায় নিয়ে যায়। এছাড়াও কিছু অ্যান্টি-সাইকোটিক ওষুধও প্রয়োগ করা হয় বাচ্চাদের উপর। কিছু বাচ্চার উপর তিনি নয় মাস ধরে LSD প্রয়োগ করেছিলেন।
কিন্তু হঠাৎ বেন্ডারের মনে হলো, এতে করে বাচ্চাদের উদ্বিগ্নতার মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তাই তিনি এসবের পরিবর্তে ইলেক্টো-কনভালসিভ থেরাপি দেওয়া শুরু করেন। এই পদ্ধতিতে তিনি ৩ থেকে ৫ বছর বয়সী প্রায় ১০০ বাচ্চাকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া শুরু করেন!
থেরাপিটি যেমন ‘শকিং’, এর ফলাফলও তেমনই। প্রতিটি বাচ্চার অবস্থা আগের থেকে বহুগুণ খারাপ হয়ে পড়ে। একটি ছয় বছরের বাচ্চা যে ছিল চুপচাপ, একাকীত্ব পছন্দ করতো, এই থেরাপির পর সে প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। বেন্ডারের এক রোগী, যাকে তিনি প্রায় ২০টি শক দিয়েছিলেন, বড় হয়ে সে সিরিয়াল কিলার হয়েছিল। এছাড়াও বড় হয়ে অনেকেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে।
৫) দ্য মনস্টার স্টাডি
১৯৩৯ সালে ওয়েন্ডেল জনসন তার শিষ্য মেরি টিউডরের সাথে একটি গবেষণা চালান। তাদের গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল, সুস্থ বাচ্চাদের তোতলামো শেখালে তা তাদের কথা বলার ধরনে পরিবর্তন আনে কিনা তা জানা। তারা ২২টি এতিম বাচ্চাকে নেন গবেষণার জন্য। বাচ্চাদেরকে বোঝানো হয়, তাদেরকে কথা বলা শিখানো হবে। ২২টি বাচ্চাকে তারা দুইটি দলে বিভক্ত করেন। প্রথম দলকে স্বাভাবিক স্পিচ থেরাপি দেওয়া হয়। আর দ্বিতীয় দলটিকে স্পিচ থেরাপির পরিবর্তে তোতলামো শেখানো হয়।
ফলাফল? যেসব বাচ্চাদের তোতলামো শেখানো হয়েছিল তারা পরবর্তীতে অনেক মানসিক সমস্যায় ভুগেছিল। বেশিরভাগ বাচ্চারই কথা বলার ধরন আর পরিবর্তন হয়নি, আজীবন তোতলামো রয়েই গিয়েছিল।