চাঁদ উঠেনি বা উঠলেও খুব সরু হয়ে উঠেছে এমন রাতে উঠানে মাদুর পেতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকালে, স্বপ্নীল একটি দৃশ্যের দেখা পাওয়া যাবে। আকাশে হাজার হাজার তারা মিটমিট করে আলো দিচ্ছে। এই আলো দেখলে মনে হয়, এরা নিভু নিভু করছে এমন কোনো মোমবাতি। পৃথিবী থেকে এদেরকে শীতল আলোর ক্ষুদ্র উৎস বলে মনে হবে। কিন্তু এদের প্রকৃত আকৃতি আর প্রকৃত উত্তাপের পরিমাণ শুনলে তা উঠানের মাদুরে শুয়ে থাকা মস্তিষ্কের কল্পনাকেও হার মানাবে। আপাতদৃষ্টিতে ক্ষুদ্র কিন্তু বুকে ধারণ করা অপার রহস্যময় তারার ব্যবচ্ছেদ করা হবে এখানে।
সূর্য
পৃথিবীর সাপেক্ষে তারা বা নক্ষত্রের সবচেয়ে সহজলভ্য উদাহরণটি হচ্ছে সূর্য। সূর্যও একটি তারা। দূর আকাশে মিটমিট করে জ্বলা তারার সাথে সূর্যের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। অন্যসব তারা বা নক্ষত্রের তুলনায় আমরা সূর্যের অনেক কাছে অবস্থান করি বলে সূর্যকে অন্যদের তুলনায় এত বড় দেখায়। একই কারণে অন্যসব নক্ষত্রের চেয়ে অনেক বেশি তাপও পাওয়া যায় সূর্য থেকে। কাছে অবস্থানের কারণে বিকিরণের মাত্রা বেশি হয় এবং তীব্র বিকিরণে ত্বকের ক্ষতিও হয়। সূর্যের দিকে সোজা তাকিয়ে থাকলে চোখেরও ক্ষতি হয়।
সূর্য শুধু কাছেই না, বলা যায় অনেক অনেক কাছে। সূর্য আমাদের থেকে কোটি কোটি কিলোমিটার দূরে থাকা সত্ত্বেও, আমরা বলছি অন্যান্য নক্ষত্রের তুলনায় এটি আমাদের অনেক অনেক কাছে অবস্থিত। সেই তুলনায় মিটমিট করে জ্বলা নক্ষত্রগুলো যে কী পরিমাণ দূরে, তা উপলব্ধি করাও কঠিন। মহাবিশ্বের বিস্তৃত স্থান কত বিশাল তা কল্পনারও অতীত। সত্যি কথা বলতে কী, তা কল্পনা বা উপলব্ধি করা প্রায় অসম্ভব। একটি আপেক্ষিক স্কেল মডেলের মাধ্যমে সূর্য বা অন্যান্য নক্ষত্রের দূরত্ব উপলব্ধি করার সুন্দর একটি পদ্ধতি আছে। জন ক্যাসিডির লেখা আর্থসার্চ (Earthsearch) নামক একটি বইতে পদ্ধতিটি চমৎকারভাবে বর্ণিত আছে। পদ্ধতিটি অনেকটা এরকম-
১. একটি ফুটবল নিয়ে বিস্তৃত একটি খেলার মাঠে যাই। মাঠের এক স্থানে ফুটবলটি রেখে দেই এবং একে সূর্য বলে বিবেচনা করি।
২. তারপর হেঁটে হেঁটে ২৫ মিটার পরিমাণ দূরে যাই এবং একটি ক্ষুদ্র দানা বা বিচি সদৃশ বস্তুকে স্থাপন করি। ক্ষুদ্র দানাটি হবে আমাদের পৃথিবী এবং ২৫ মিটার হবে সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব।
৩. ক্ষুদ্র দানাটির পাশেই আরেকটি কণা সদৃশ বস্তু রাখি যা বলতে গেলে সুঁইয়ের অগ্রভাগে স্থান করে নিতে পারে। সুচাগ্র পরিমাণ ক্ষুদ্র বস্তুটি হবে চাঁদের আকৃতি।
৪. সৌরজগৎ থেকে সবচেয়ে কাছের যে নক্ষত্রটির নাম প্রক্সিমা সেন্টারি, সেটির দূরত্ব হবে ৬ হাজার ৫০০ কিলোমিটার। অর্থাৎ সূর্যকে যদি ফুটবল বলে ধরে নেই এবং পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বকে ২৫ মিটার বলে ধরে নেই, তাহলে সবচেয়ে কাছে যে নক্ষত্রটি অবস্থান করছে তার দূরত্বই হবে সাড়ে ৬ হাজার কিলোমিটার। সূর্য হিসেবে ধরে নেয়া ফুটবলটিকে যদি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডের কোনো মাঠে স্থাপন করা হয় তাহলে প্রক্সিমা সেন্টারির অবস্থান হবে ভারতের দিল্লিতে!
আপেক্ষিক হিসেব থেকেই দেখা যায় নক্ষত্ররা কত দূরে অবস্থিত। তাহলে সত্যিকার দূরত্ব হিসেব করলে সেটা কত বেশি হবে? আর এ হিসেবটি তো সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রের জন্য, অন্যান্য দূরবর্তী নক্ষত্রগুলোর দূরত্ব কেমন তা ভাবা যায়? মহাবিশ্বের অনেক অনেক নক্ষত্রেই আবর্তনকারী অনেক অনেক গ্রহ আছে। গ্রহ-উপগ্রহ নিয়ে আমাদের সূর্য-পরিবারের মতোই তাদের পরিবার।
নক্ষত্রের প্রক্রিয়া
একটি নক্ষত্র ও একটি গ্রহের মধ্যে অন্যতম পার্থক্য হচ্ছে, নক্ষত্ররা উজ্জ্বল ও উত্তপ্ত হয় আর এই উত্তাপ এবং উজ্জ্বলতা তারা নিজেরাই তৈরি করে। অন্যদিকে গ্রহরা উজ্জ্বল বা উত্তপ্ত কোনোটিই নয়। অল্প বিস্তর যা-ই উজ্জ্বলতা দেখা যায় তা-ও তাদের নিজস্ব আলোতে নয়। গ্রহরা যে নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে, সেই নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা দিয়েই গ্রহরা কিছুটা উজ্জ্বল হয়। গ্রহ ও নক্ষত্রের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হচ্ছে তাদের ভর। নক্ষত্রদের ভর বেশি হবার কারণেই তারা আলোক বিকিরণ করে এবং তাপ নিঃসরণ করে। ভর কীভাবে এসব কাজের চালিকা হতে পারে? সেটাই দেখবো এখন।
কোনো বস্তু যত বড় বা ভারী হবে সে বস্তুর মহাকর্ষীয় টান তত বেশি হবে। ভারী বস্তু সবকিছুকে তার কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে বা টেনে নেয়। মূলত মহাবিশ্বের সকল বস্তুই একে অপরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। একজন লোক যদি অন্য আরেকজন লোকের সামনে বসে থাকে, তাহলে তারাও একে অপরকে মহাকর্ষীয় বলে আকর্ষণ করবে। তবে বস্তুর ভর যদি কম হয়, তাহলে সেই আকর্ষণ তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। আকর্ষণের মান এতই ক্ষুদ্র হবে যে তাকে অগ্রাহ্যই করা যায়। বস্তুর ভর যত বেশি হবে, তার আকর্ষণ বলও তত বেশি হবে।
পৃথিবী আকারে অনেক বড় ও ভারী। যার কারণে এর মহাকর্ষ বল অনেক শক্তিশালী। এই বলের উপস্থিতির কারণেই আমরা ভূমিতে লেগে আছি, আকর্ষণ না থাকলে বায়ুতে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতাম। এই বলের উপস্থিতির কারণেই গাছ থেকে ফল বিচ্ছিন্ন হলে তা নিচে গিয়ে পড়ে, আকর্ষণ ডিঙিয়ে উপরের দিকে উঠে না।
পৃথিবীর তুলনায় একটি নক্ষত্র অনেক অনেক বড় ও ভারী। অধিক পরিমাণ ভারী হবার কারণে তাদের মাঝে ক্রিয়াশীল মহাকর্ষ বলও খুব শক্তিশালী। নক্ষত্রের মহাকর্ষ বল এতটাই বেশি যে, তার কেন্দ্রের পদার্থগুলো আকর্ষণজনিত কারণে অত্যধিক চাপের সম্মুখীন হয়। চাপ যত দৃঢ় হবে এর তাপমাত্রাও তত বেশি হবে। তাপমাত্রা যখন খুব বেশি হয়ে যাবে, যা আমাদের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাবে, তখন এর অভ্যন্তরে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া শুরু হবে। নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় কল্পনাতীত পরিমাণ শক্তি অবমুক্ত হয়। অবমুক্ত হওয়া এই শক্তি তাপ ও আলোক আকারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই আলোক রশ্মিগুলোই যখন ভ্রমণ করতে করতে আমাদের চোখে এসে লাগে তখন আমরা তাদের দেখতে পাই। রাতের আকাশে দেখা শত শত নক্ষত্রের সবগুলোরই আলোর উৎস হচ্ছে তার পেটের ভেতর ঘটে যাওয়া নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার শক্তি।
ক্রমবর্ধমান তাপশক্তি নক্ষত্রকে বাইরের দিকে চাপ দেয়, অনেকটা বেলুন ফুলানোর মতো। বেলুনে ফুঁ দিলে যেমন এটি সবদিক থেকে স্ফীত হয় অনেকটা তেমন। আবার একই দিকে অভিকর্ষ বল তার আকর্ষণ শক্তির মাধ্যমে ঠিক উল্টোভাবে সংকুচিত করছে। একদিকে প্রসারণ আরেকদিকে সংকোচন, দুইয়ে মিলে একটা মাঝামাঝি অবস্থানে ভারসাম্য তৈরি করে। অনেক দিন ধরে বাইরের দিকের বল ও ভেতরের দিকের বলের ভারসাম্য বজায় রেখে নক্ষত্র জ্বলতে থাকে।
নক্ষত্রকে বলা যায় একটি বৃহৎ থার্মোস্ট্যাট। থার্মোস্ট্যাট হলো একপ্রকার ইলেকট্রনিক যন্ত্র। ফ্রিজ, ইস্ত্রি ইত্যাদি যন্ত্রে তাপের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়। নক্ষত্র যত উত্তপ্ত হয় ততই এটি বাইরের দিকে বল প্রয়োগ করে। নক্ষত্রের উপাদান বাইরের দিকে চলে গেলে, কেন্দ্রভাগের শক্তিশালী চাপের পরিমাণ কমে যায়। চাপের পরিমাণ কমে গেলে তাপের উৎপাদন কমে যায় এবং বাইরের দিকে চাপের পরিমাণ কমে যায়। ফলে এটি আবারো সংকুচিত হয় এবং পরে আবারো চাপ বাড়ে। এরপর আবারো আগের প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি হয়। এভাবে পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে থার্মোস্ট্যাট প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। ফলে নক্ষত্র ক্ষয়ক্ষতি ব্যতিরেকে অনেক দিন ধরে তাপ ও আলোক শক্তি বিকরণ করতে পারে।
শুরুতে বলেছিলাম, সূর্য আসলে অন্যসব নক্ষত্রের মতো। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, এই মহাবিশ্বে বিভিন্ন ধরনের নক্ষত্র আছে। কোনো কোনোটি আকারে বড় বা ছোট, কোনো কোনোটি ভরে বেশি বা কম, কোনো কোনোটি বড় কিন্তু হালকা আবার কোনো কোনোটি ক্ষুদ্র কিন্তু ভারী। আর এসব বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে নক্ষত্রের আচার আচরণ ও ভবিষ্যৎ নিয়তি। নক্ষত্র কীভাবে মারা যাবে বা ধ্বংস হবে তা নির্ভর করে তার ভরের উপর।
আমাদের সূর্য নক্ষত্র হিসেবে অন্যগুলোর তুলনায় খুব বেশি বড় নয়। প্রক্সিমা সেন্টারি থেকে সামান্য একটু বড় কিন্তু অন্যান্য অনেক নক্ষত্রের চেয়ে ছোট। আমাদের জানা সবচেয়ে বড় নক্ষত্র কোনটি? এটা নির্ভর করবে আমরা কোন দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের পরিমাপ করছি। UY Scuti নামের একটি পর্যবেক্ষণকৃত নক্ষত্রকেই ধরা হচ্ছে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বৃহৎ নক্ষত্র। এর ব্যাস আমাদের সূর্যের ব্যাস থেকে ২ হাজার গুণ বড়! অন্যদিকে সূর্যের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের তুলনায় ১০০ গুণ বেশি বড়।
আরো একটি বৃহৎ নক্ষত্র আছে, ওয়াই সি ক্যানিস মেজরিস নামে। এটি ব্যাসের দিক থেকে প্রায় দেড় হাজার গুণ বড়। এই নক্ষত্র আকারে বড় হলেও আকারের তুলনায় তার ভর একদমই কম। সূর্যের ভরের চেয়ে মাত্র ৩০ গুণ বেশি ভারী। এর আকারের সবটা জুড়েই যদি নাক্ষত্রিক উপাদান সমানভাবে বিস্তৃত থাকতো তাহলে এর ভর দাঁড়াতো সূর্যের ভরের বিলিয়ন গুণ।
নতুন আবিষ্কৃত ইটা ক্যারিনি কিংবা R136a1 নক্ষত্রগুলো সূর্যের ভরের ১০০ গুণের চেয়েও বেশি। অন্যদিকে সূর্যের ভর পৃথিবীর ভরের ৩ লক্ষ গুণ। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, ইটা ক্যারিনির ভর সমগ্র পৃথিবীর ভরের তুলনায় প্রায় ৩০ মিলিয়ন গুণ বেশি।
যদি R136a1 নক্ষত্রের মতো কোনো দানব নক্ষত্রে গ্রহ আবর্তন করে আর তাতে প্রাণের উপযোগী পরিবেশ থাকে এবং তাতে যদি প্রাণ থাকে তাহলেও তারা তাদের সূর্যকে আমাদের সূর্যের সমানই দেখতে পাবে। আমরা যেমন সূর্যকে থালার আকৃতিতে দেখি তারাও তেমনই দেখবে। কারণ নক্ষত্র বেশি বড় বা ভারী হলে গ্রহগুলোকে দূরে দূরে অবস্থান করতে হয়, আর যত দূরে অবস্থান করবে নক্ষত্রকে ততই ছোট দেখাবে। গ্রহ যদি বড় নক্ষত্রের কাছে থাকে তাহলে নক্ষত্রটির গ্রাসে গ্রহটি নষ্ট হয়ে যায়। যদি এরকম না হতো, তাহলে সেখানে হয়তো প্রাণ ধারণই সম্ভব হতো না।
সত্যি কথা বলতে কী, R136a1 নক্ষত্রে প্রাণ থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ খুব বেশি বড় নক্ষত্রদের জীবনকাল খুব ক্ষুদ্র হয়ে থাকে। এই নক্ষত্রটির বয়স এক মিলিয়ন বছরও হবে বলে মনে হয় না। এক মিলিয়ন যদি হয়ও, তাহলেও এর বয়স সূর্যের বয়সের চেয়ে হাজার গুণ কম। এত কম সময়ে ঐ নক্ষত্রে আবর্তনকারী কোনো গ্রহে প্রাণের বিকাশ ও বিবর্তন সম্ভব নয়, অন্তত স্বাভাবিকভাবে সম্ভব নয়। তাই এরকম নক্ষত্রের আশেপাশে প্রাণ না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। সেই তুলনায় আমাদের সূর্য অনেক ছোট, ছোট বিধায় আয়ুও বেশি। নক্ষত্র হিসেবে সূর্যকে বলা যায় মেইনস্ট্রিম বা ‘মূলধারার নক্ষত্র’। এরকম নক্ষত্রেরা কয়েক বিলিয়ন বছর টিকে থাকে (বড় নক্ষত্রের মতো শুধু কয়েক ‘মিলিয়ন’ বছর নয়)।