ধরিত্রী; ইংরেজিতে Earth শব্দটিকে সোজা বাংলায় ধরিত্রীই বলা হয়। আমরা সচরাচর এই ধরিত্রীকে পৃথিবী নামে ডাকি। এই পৃথিবীর বুকেই আমাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা। জীবনের নানা বাঁক পেরিয়ে আবার এই পৃথিবীতেই মৃত্যু হয় আমাদের। বছরজুড়ে আমরা বিভিন্ন ইস্যুতে নানা দিবস পালন করে থাকি এই পৃথিবীতে। পৃথিবীর জন্যও ঠিক তেমনি আছে একটি দিন- ২২ এপ্রিল; বিশ্ব ধরিত্রী দিবস। দিবসটি এখন ‘ইন্টারন্যাশনাল মাদার আর্থ ডে’ নামে পালিত হয়।
কীভাবে এলো এই দিবসের ভাবনা?
Those who contemplate the beauty of the earth, find reserves of strength that will endure as long as life lasts.
আমেরিকান সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী ও লেখিক র্যাচেল কার্সনের পরিবেশ বিষয়ক লেখা বই ‘Silent Spring‘ থেকে নেয়া উক্তি এটি।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের পরিবর্তন আসা শুরু করে। সে সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো ঘটনা নাড়া দেয় আমেরিকার জনগণকে। দেশটির বিভিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন। সাথে অন্যান্য সামাজিক বিষয়েও সচেতনতা তৈরি হচ্ছিল মানুষের মধ্যে। ফলশ্রুতিতে রাজনীতিতে জনমতের গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ে। তবে পরিবেশ বিষয়ে তখনও খুব একটা আলোচনা ছিলো না।
আমেরিকানরা পরিবেশের উপর দূষণ সম্পর্কিত প্রভাব নিয়ে সচেতন হতে শুরু করে ষাটের দশকের শুরুতে। সে সময়, নির্দিষ্ট করে বললে ১৯৬২ সালে, এই প্রেক্ষাপটকে আরো জোরালো করে তোলেন র্যাচেল কার্সন। সামুদ্রিক এই জীববিজ্ঞানী তার ‘Silent Spring’ নামের বইয়ে পরিবেশের উপর কীটনাশকের বিপজ্জনক প্রভাব বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। তুমুল আলোড়ন তোলে বইটি। জন্ম নেয় আধুনিক পরিবেশ আন্দোলনের।
আমেরিকার উত্তর-পূর্ব ওহাইও রাজ্যের ক্লিভল্যান্ডের কুয়াহোগা নদীতে ১৯৬৯ সালের রাসায়নিক বর্জ্য নিষ্কাশন থেকে সৃষ্ট আগুন পরিবেশ নিয়ে নতুন ভাবনা সৃষ্টিতে প্রভাবিত করে সেদেশের জনগণকে। এর আগপর্যন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার কখনোই রাজনৈতিক ইস্যু হয়নি এবং শিল্প দূষণের মতো বৃহত্তর ইস্যুতে আন্দোলন করার মতো মানুষও ছিল না তেমন। এই সুযোগে শিল্প কারখানাগুলো দূষিত ধোঁয়া এবং বর্জ্য বায়ু, হ্রদ এবং নদীতে ছেড়ে দিত। নামমাত্র কিছু আইন পরিবেশের এই ভয়াবহ দূষণ ঠেকাতে কাজে আসছিল না। আমেরিকান জনসংখ্যার কেবলমাত্র একটি ছোট অংশই পুনর্ব্যবহার (রিসাইক্লিং) শব্দটার ঠিকঠাক ব্যবহার করতে জানত।
এমন এক সময় ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে তেল উপচে পড়ে বিশাল দুর্যোগ সৃষ্টি হয়। এই ঘটনাটি দেখে উইসকন্সিনের সিনেটর গেলরড নেলসন অত্যন্ত বিচলিত হন। তিনি ভাবতে শুরু করেন, কী করা যায়!
সময়টি ছিল ভিয়েতনাম-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের। যুক্তরাষ্ট্রের ছাত্রসমাজ এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলে। নেলসন এই যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের শক্তি পরিবেশ সুরক্ষার আন্দোলনেও নিয়ে আসতে আগ্রহী হন। এই লক্ষ্যে তিনি গণমাধ্যমে পরিবেশ বিষয়ক শিক্ষার জন্য একটি দিন পালনের ঘোষণা দেন। রিপাবলিকান রক্ষণশীল সিনেটর পিট ম্যাকক্লাওয়াস্কিকে তার সাথে সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার জন্য রাজি করান। সেসময় সিয়াটলে এক সম্মেলনে তিনিই প্রথমবারের মতো ধরিত্রী দিবস উদযাপনের প্রস্তাব দেন। তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দেখানো যে পরিবেশ আন্দোলনের প্রতি জনগণের ব্যাপক ও গভীর সমর্থন রয়েছে। তারা ডেনিস হায়েস নামে একজনকে এই কর্মসূচির কো-অর্ডিনেটর হিসেবে নিয়োগ দেন।
একজন ডেনিস হায়েস
এবার ডেনিস হায়েস নামে সেই কো-অর্ডিনেটরের গল্প জানা যাক। উইসকন্সিনে জন্মগ্রহণকারী হায়েস ছয় বছর বয়সে পরিবারের সাথে কলম্বিয়া নদীর তীরে অবস্থিত শহর ক্যামাসে চলে আসেন। তার বাবা হিলিং ক্রাউন জেলারবাচ পেপার মিলে কাজ করতেন।
তরুণ হায়েস বাইকে চড়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে বেড়াতেন। সেই শহরটি ক্রমেই মিল আর কলকারখানার দূষণে নিয়ন্ত্রণহীন বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছিল। এটি ভীষণ ভাবাত হায়েসকে। তিনি বেশ কয়েকটি কলেজে যোগ দেন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তত্ত্ব বিস্তৃতভাবে পড়েন, কিন্তু কোনো কিছুই তাকে এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ দেখায়নি। পরের তিন বছরের সময়কালে তিনি এশিয়া এবং আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্য প্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে ভ্রমণ করেন। এ ক’বছর প্রাণীদের নানা বৈচিত্র্যময় ব্যবহার দেখে তিনি পরিবেশ নিয়ে নতুন করে ভাবতে উদ্বুদ্ধ হন।
নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে হায়েস বলছিলেন,
আমি বাস্তুশাস্ত্রের (Ecology) নীতিগুলোর অগ্রগতিতে আমার জীবন উত্সর্গ করতে চেয়েছিলাম কারণ তারা মানব এবং মানব সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে, মানবিক প্রক্রিয়াগুলোতে ভূমিকা রাখে।
তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং স্নাতক শেষ করার পরে হার্ভার্ডের কেনেডি স্কুল অফ গভর্নমেন্টের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেন। তখনই তার সিনেটর নেলসনের সাথে পরিচয় হয়। তিনি শীঘ্রই হার্ভার্ড থেকে সরে আসেন এবং বেশ কয়েক সহপাঠীকে তার সাথে আসতে রাজি করান।
২২ এপ্রিল ১৯৭০
কর্মসূচীর জন্য এমন একটি দিন বেছে নেয়া প্রয়োজন ছিল, যেদিন সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থীদের একত্র করা যাবে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হয় দিনটা হবে ২২ এপ্রিল, ১৯৭০। বসন্তের ছুটি এবং ফাইনাল পরীক্ষার মাঝামাঝি সময়ে পড়া একটি দিন সেটি। হায়েস ৮৫ জনের একটি দল গঠন করে সারা দেশব্যাপী এই কর্মসূচীর ব্যাপারে জনমত গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন।
ধরিত্রীর জন্য পালিত দিনটি আমেরিকার প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। ফিলাডেলফিয়া, লস অ্যাঞ্জেলস, শিকাগোসহ আমেরিকার অনেক শহরের হাজারো মানুষ ১৫০ বছরের শিল্প বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট দূষণের বিরুদ্ধে তাদের সমর্থন জানিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল।
বিক্ষোভ থেকে নতুন দিনের গল্প
প্রথম ধরিত্রী দিবস পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে কার্যকর ছিল। সরকারেরও টনক নড়ে। একে একে পরিবেশগত আইন সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আইন পাশ হয় যার মধ্যে বিশুদ্ধ বায়ু আইন, পানির গুণগত মান উন্নয়ন আইন, বিপন্ন প্রজাতি আইন, বিষাক্ত পদার্থ নিয়ন্ত্রণ আইন ও সারফেস মাইনিং কন্ট্রোল এবং পুনঃনির্ধারণ আইন উল্লেখযোগ্য। এসব আইন লক্ষ লক্ষ পুরুষ, মহিলা এবং শিশুদের রোগ এবং মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছে এবং শত শত প্রজাতি বিলুপ্ত হতে রক্ষা করেছে। আরেকটি বড় পদক্ষেপ ছিল Environmental Protection Agency প্রতিষ্ঠা করা। এটি মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ-বায়ু, পানি এবং জমি রক্ষার দায়িত্ব পালন করায় ভূমিকা রাখছে।
বৈশ্বিক রূপে ধরিত্রী দিবস
১৯৯০ সালে ডেনিস হায়েস দিবসটি বিশ্বব্যাপী উদযাপনের উদ্যোগ নেন আর্থ ডে নেটওয়ার্ক নামের একটি অলাভজনক প্লাটফর্মের মাধ্যমে। আর্থ ডে নেটওয়ার্ক হলো পরিবেশের আন্দোলনে বিশ্বের বৃহত্তম স্বেচ্ছাসেবী প্লাটফর্ম। আমাদের গ্রহের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ১৯০টিরও বেশি দেশে ৭৫ হাজারেরও বেশি অংশীদারের সাথে কাজ করছে।
সেবার ধরিত্রী দিবসটি বিশ্বের ১৪১টি দেশে পালিত হয় এবং পরিবেশগত সমস্যাগুলো বিশ্ব মঞ্চে উচ্চারিত হয়। এই আয়োজন ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরোতে জাতিসংঘের জাতিসংঘের আর্থ শীর্ষ সম্মেলনের পথ প্রশস্ত করতে সহায়তা করেছে।
পরবর্তীতে গেলরড নেলসন ধরিত্রী দিবসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে সম্মানজনক বেসামরিক খেতাব ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম’ লাভ করেন। আর্থ ডে নেটওয়ার্কের লক্ষ্য বিশ্বব্যাপী পরিবেশ আন্দোলনকে বৈচিত্র্যময় করা, মানুষকে এই বিষয়ে সচেতন এবং সক্রিয় করা।
এই বছরের ধরিত্রী দিবস
বর্তমানে ধরিত্রী দিবস বিশ্বের বৃহত্তম অসাম্প্রদায়িক দিবস পালন হিসেবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত, প্রতিবছর এক বিলিয়নেরও বেশি মানুষ মানুষের আচরণ পরিবর্তন করতে এবং বিশ্বব্যাপী, জাতীয় এবং স্থানীয় নীতিগত পরিবর্তন আনার দিন হিসেবে চিহ্নিত করে।
প্রতিবছর ২২ এপ্রিল বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ধরিত্রী দিবস। এই বছর দিবসটির ৫০ তম বার্ষিকী পালিত হলো। দিনটির এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘Climate Action‘। এ বছর দিবসটি পাঁচটি ক্যাম্পইনের মাধ্যমে পালিত হয়। এগুলো হচ্ছে- Earthrise, Great Global Cleanup, Earth Challenge, Foodprints for the Future এবং
Artists for the Earth।
এ বছর করোনা ভাইরাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লকডাউন চলমান থাকায় দিবসটি ঘরে বসে উদযাপনে জোর দিয়েছেন আয়োজকরা। পরিবেশ বাঁচাতে আওয়াজ তোলার মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগাতে বলেছেন ডিজিটাল মিডিয়াকে।
শুধু ধরিত্রী দিবসে নয়, বছরের প্রতিটি দিনই আসুন আরও একবার সচেতন হই পরিবেশ বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসে। স্বপ্ন দেখি এক সুন্দর নির্মল পৃথিবীর।