গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আবহাওয়ার রূক্ষ আচরণে স্বাভাবিক জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে। কোথাও শৈত্য প্রবাহ আর কোথাও অত্যাধিক বৃষ্টিপাতের ফলে আকস্মিক বন্যা দেখা দিচ্ছে। এতে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি মানুষের মৃত্যুও ঘটছে। শৈত্য প্রবাহ ও অত্যাধিক ভারী বৃষ্টিপাতের মতোই আরেকটি বড় সমস্যা তীব্র তাপদাহ। জাপান থেকে যুক্তরাজ্য, আলজেরিয়া থেকে ক্যালিফোর্নিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় গ্রীষ্মকালে অসহ্য তীব্র তাপদাহ থেকে নিষ্কৃতি পেতে অনেকেই বিভিন্ন রকম পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এসব পরামর্শের অনেকগুলো নিয়ে বির্তক আছে। কোন পরামর্শের পেছনের বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখা কী তা নিয়েও রয়েছে বির্তক।
গরম না ঠান্ডা পানীয় পান করবেন?
হিটওয়েভ বা দাবদাহ চলাকালীন সময়ে যথেষ্ট পরিমাণ পানীয় গ্রহণ অপরিহার্য। কারণ পানি বা অন্য পানীয় কিডনিকে পানিশূন্যতার হাত থেকে রক্ষা করে। তবে এ সময় গরম না ঠান্ডা- কোন ধরনের পানীয় বেশি উপকারে আসে তা নিয়ে বিতর্ক আছে ।
গরম পানীয় পান করা হলে শরীরের ভেতরকার উষ্ণতা বাড়ে। এতে শরীর থেকে বেশি ঘাম বের হয়, যা শরীরের তাপমাত্রা কমিয়ে শীতলতার অনুভূতি সৃষ্টি করে। মানবদেহ থেকে প্রতি ঘন্টায় প্রায় দুই লিটার ঘাম বের হয়ে যেতে পারে, যা শরীরের তাপ কমাতে সাহায্য করে থাকে। তবে ক্যাফেইনের উপস্থিতির কারণে গরমের সময় বেশি চা বা কফি পান করলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে।
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, অত্যধিক গরমের সময় শীতল পানীয় শরীরের তাপ কমাতে গরম পানীয়র চেয়ে বেশি কার্যকর। আবার, ক্লান্তিকর শরীরচর্চার পর দেহে বর্ধিত তাপ কমানোর ক্ষেত্রে শীতল পানীয় বেশি কার্যকর। কিন্তু এর থেকে শীতল পানীয় বেশি কার্যকর এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে কিছু সমস্যা আছে। পরীক্ষাতে সাহসী ভলান্টিয়াররা রেক্টাম থার্মোমিটার ব্যবহার করেছে। ঠান্ডা পানীয় সরাসরি পাকস্থলীতে চলে যায় (যা রেক্টাম অঞ্চলের কাছাকাছি) আর তাপ কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু শরীরের অন্য কিছু অঞ্চলে আটটি থার্মোমিটার স্থাপন করে অন্য একটি পরীক্ষায় দেখা যায়, ঠান্ডা পানীয়ের চেয়ে গরম পানীয় বেশি কার্যকর।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, ঘামের প্রক্রিয়া হিসেবে ধরলে গরম পানীয় পান করাই গরমের সময় বেশি উপকারী। তবে বাতাসের আর্দ্রতা বেশি হলে অথবা শরীরে পোশাকের আধিক্য থাকলে তা বায়ু চলাচলকে ব্যাহত করবে। এক্ষেত্রে গরম পানীয় শরীরকে আরাম দিতে তেমন একটা কার্যকর হবে না।
ফ্যানের বাতাস কেমন উপকারী?
গরমে ফ্যানের বাতাস বেশ উপকারী। ফ্যান বাতাস ঠান্ডা করে না, এটা শুধু বাতাসের চলাচল বাড়ায়। ফলে ঘর্মাক্ত শরীরের তাপ কমতে থাকে এবং স্বাভাবিক ক্রিয়া বজায় থাকে। এমনও দেখা গেছে, গুরুতর গরমে অসুস্থ তিন ব্যক্তিকে হেলিকপ্টারের চলন্ত পাখার নিচে নিরাপদ দূরত্বে রাখা হলে তারা সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
তবে গরমের তারতম্য ভেদে বিচার করা হলে সব সময় ফ্যানের বাতাসের কার্যকারিতা সমান নয়। ঘরের বাইরের তাপমাত্রা বেশি হলে এর কার্যকারিতা কমে যায়। সাধারণভাবে, ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা পর্যন্ত ফ্যান কার্যকর থাকে। ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৯৮.৬ ফারেনহাইট উত্তাপে ফ্যান ব্যবহার করলে উষ্ণ বাতাসের প্রভাবে শরীরের তাপ বেড়ে গিয়ে পানিশূন্যতা কমার বদলে উল্টো বাড়তে পারে। আবার বাতাসের আর্দ্রতা বেশি থাকলে ফ্যানের কার্যকরিতা কমে যায়। কারণ এর ফলে বাতাস চলাচল বাড়লেও ঘাম শুকায় না। ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওহায়ো রাজ্যের সিনসিনাটি শহরে অত্যধিক গরমে মৃত ১০ জন ব্যক্তির কক্ষে চলন্ত ফ্যান দেখা গিয়েছিল। তবে মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে ফ্যান চালানো হয়েছিলো, নাকি অত্যধিক গরমের ভেতর ফ্যানও তাপ কমানোর কাজ করেনি– এটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হয়নি।
বয়স্কদের শারীরিক ঝুঁকি কি বেশি?
অত্যধিক গরমের কারণে হাসপাতালে ভর্তি করা রোগীদের মধ্যে বয়স্কদের সংখ্যাই বেশি দেখা যায়। ৩৬-৩৭.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা মানবদেহের কার্যক্রমের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। চামড়ার তাপ-উদ্দীপক কোষগুলো তাপমাত্রার এক ডিগ্রি বৃদ্ধিও অনুভব করে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে শরীরের তাপের সাথে সামঞ্জস্য রেখে শরীর থেকে ঘাম বেরোতে শুরু করে, যার ফলে শরীর ঠান্ডা হতে শুরু করে। শরীর শীতল করার আরেক পদ্ধতি হলো মাথা ও পায়ে রক্ত চলাচল বাড়ানো, যার জন্য প্রয়োজন হৃৎপিণ্ডের গতিবৃদ্ধি করা। মূলত এ কারণেই অত্যধিক গরমের সময় বেশি বয়সীদের প্রায়ই হার্ট অ্যাট্যাক বা স্ট্রোক করার মতো ঘটনা ঘটে।
আবার কম বয়সী সকলেই যে গরমের সময় এমন স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে মুক্ত তা বলা যাবে না। শিশু, দুর্বল স্বাস্থ্যের কিশোর-কিশোরী ও যুবকরাও অত্যধিক গরমে স্বাস্থঝুঁকির মুখোমুখি হতে পারে। এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০৩ সালে ইউরোপ জুড়ে অত্যধিক গরমের ফলে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ মারা যায়, যার মধ্যে বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হলেও কম বয়সীদের সংখ্যাও একেবারে কম ছিল না।
সব জানালা খুলে দেওয়াটা কি উপকারী?
অত্যধিক গরমের সময় ঘরের সব জানালা খুলে দেওয়া বেশ কার্যকরী এক উপায়। তবে দিনের বেলায় এই প্রক্রিয়া কার্যকরী না হয়ে তার বিপরীতও হতে পারে। গরমের সময় দিনের বেলা ঘরের বাইরের তাপমাত্রা বেশি হলেও যথাযথ আচ্ছাদনের কারণে ঘর অনেক সময় বাইরের তুলনায় বেশ ঠান্ডা থাকে। এমন ক্ষেত্রে জানালা খুলে দিলে বরং ঘরের তাপমাত্রা না কমে উল্টো বেড়ে যেতে পারে। আবার রাতের বেলা যখন ঘরের তাপমাত্রা বেশি থাকে, তখন জানালা খুলে দিলে বাড়তি তাপ বেরিয়ে গিয়ে ঘরের তাপমাত্রা কমিয়ে ফেলে।
বিয়ার পান করলে কি শরীরের তাপমাত্রা কমে?
১৯৫৮ সালে নির্মিত ছায়াছবি ‘আইস কোল্ড ইন অ্যালেক্স’ ছবিতে অভিনেতা জন মিলসকে দেখা যায় মরুভূমির গরম থেকে ছুটে এসে ঠান্ডা বিয়ারে চুমুক দিয়ে তৃপ্তি পেতে। সিনেমার দৃশ্য হিসেবে এর আবেদন থাকলেও সত্যিই কি বিয়ার পান করলে তা গরমে শরীরের উত্তাপ কমাতে সাহায্য করে? সম্ভবত না।
পরিমাণে কম হলে বিয়ার গরমে তেমন ক্ষতি করে না। এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, আর্দ্রতাপূর্ণ পরিবেশে ভারী ও পরিশ্রমসাধ্য শরীরচর্চা করার পর বিয়ার পান করলে পানিশূন্যতা না কমে বরং বেড়ে যায়। তবে অ্যালকোহলশূন্য বা কম অ্যালকোহল যুক্ত বিয়ারে এমনটা দেখা যায়নি। সাম্প্রতিক আরেকটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, পানি বা গড়পরতা স্পোর্ট ড্রিঙ্কসের চেয়ে পানিশূন্যতা পূরণে বিয়ার কিছুটা এগিয়ে আছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, বিয়ার পানে ইউরিনেশনের হার বেশি কেন হয়? এর কারণ হয় তো এই যে, শরীরকে বিয়ার থেকে পানিশূন্যতা পূরণে বেশি শক্তি ব্যয় করতে হয়, এজন্য। তবে বিয়ারের এসব পরীক্ষার একটা দুর্বল দিক হচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে শরীরের তাপমাত্রার ওঠা-নামা বিবেচনায় আনা হয়নি। কেবল শরীরে পানির উপস্থিতি ও ক্রিয়াকলাপই দেখা হয়েছে। এ থেকে স্বল্প পরিসরে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, অল্প বা পরিমিত পরিমাণে বিয়ার পান অন্য উপকার করতে না পারলেও শরীরের পানিশূন্যতা কিছু পরিমাণে পূরণ করতে পারে। তবে বিয়ারের বিষয়টি পাশ্চাত্যের জন্য প্রযোজ্য হলেও বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য পানীয় হিসেবে এটি এখনও প্রযোজ্য নয়।