মানুষের পাঁচটি ইন্দ্রিয় অন্যান্য প্রাণীকূল থেকে তাকে করেছে অনন্য। আর এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মধ্যে ঘ্রাণশক্তির এক বিশেষ ভূমিকা রয়েছে মানুষের বেশ কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে। মানুষের খাদ্য বাছাইকরণ, পুষ্টি উপাদান নির্ধারণ, এমনকি সঙ্গী হিসেবে কাকে বেছে নেবে সেই বিষয়টিকেও প্রভাবিত করে এই ঘ্রাণশক্তি। আসুন জেনে নেয়া যাক কী রয়েছে মানুষের মানুষের এই শক্তিশালী ইন্দ্রিয়টির কার্যকারিতার নেপথ্যে।
মানুষের যেকোনো বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য দায়ী রাসায়নিক বস্তুটি হলো জিন। এটি মানুষের বংশগতির ধারক ও বাহক। এর রাসায়নিকভাবে আরও বিশ্লেষিত রুপ হলো অ্যামাইনো এসিডের সিকোয়েন্স। মানুষের শরীরে প্রয়োজনীয় ৫১ ধরনের অ্যামিনো এসিড রয়েছে। এই এসিডগুলো বিভিন্নভাবে পুনর্বিন্যস্ত হয়ে তিনটি অ্যামিনো এসিডবিশিষ্ট একেকটি কোডন তৈরি করে, আর এই কোডনগুলোই একেকটি প্রোটিনকে এনকোড করে। এই প্রোটিনই মানবদেহের একেকটি অংশ গঠনে সাহায্য করে। মানুষের ঘ্রাণ কেন্দ্র, যা অলফ্যাক্টরি লোব নামে পরিচিত, এখানের অসংখ্য নিউরন ঘ্রাণশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। ঘ্রাণকেন্দ্রগুলোও প্রোটিন দ্বারা গঠিত। ব্যক্তিবিশেষে এই ঘ্রাণ সংবেদনশীল ইন্দ্রিয়ের সক্রিয়তায় দেখা যায় ভিন্নতা।
কখনো ভেবে দেখেছেন কি- কারও কাছে কোনো ফুলের ঘ্রাণ খুবই প্রিয়, কারও কারও তাতেই অ্যালার্জির ভাব দেখা দেয়। যানবাহনে চলাচলের সময় পেট্রোল, ডিজেল বা অন্যান্য জ্বালানীর গন্ধে সহনশীলতা ব্যক্তিবিশেষে একেক রকম হয়। আবার খাদ্য বাছাইকরণেও আমরা এর ব্যতিক্রম দেখতে পাই না। অনেকেই মাছ-মাংস খেতে ভীষণ ভালবাসে, কেউ কেউ কোনো বিশেষ প্রজাতির মাছ-মাংসের গন্ধ একেবারেই পছন্দ করেন না। শিশুদের খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টি প্রযোজ্য। আসলে একই রাসায়নিক বস্তু ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে, যার পেছনের মূল কারণ হলো প্রত্যেকের আলাদা আলাদা জিনগত বৈশিষ্ট্য, যা মানুষের ঘ্রাণশক্তি কেন্দ্রের জিনগুলোর জন্যও প্রযোজ্য।
মানুষের নাসারন্ধ্রের ভেতরে কিছু সংগ্রাহক প্রোটিন রয়েছে। এরা ঘ্রাণ সংবেদনশীল সংগ্রাহক অণু হিসেবেও পরিচিত। এখন পর্যন্ত মানবদেহে প্রায় ৪০০ ভিন্ন ধরনের এমন সংগ্রাহক প্রোটিনের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য একদল বিজ্ঞানী ১৯৯১ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
এসব সংগ্রাহক প্রোটিনের প্রধান কাজ হলো বাতাসে ভেসে বেড়ানো বিভিন্ন পদার্থের সাথে যুক্ত হওয়া। তবে এ সংগ্রাহক অণুগুলো খুবই সুনির্দিষ্ট হয়। অর্থাৎ অনেকটা তালা-চাবির মতন, প্রত্যেকটা তালার জন্য যেমন একটা নির্দিষ্ট চাবি থাকে, তেমনি প্রত্যেক রাসায়নিক পদার্থের জন্য একটি স্বতন্ত্র সংগ্রাহক প্রোটিন অণু রয়েছে। নির্দিষ্ট চাবি ছাড়া যেমন তালা খুলবে না, তেমন নির্দিষ্ট সংগ্রাহক প্রোটিন ছাড়া ভাসমান রাসায়নিক পদার্থগুলো যুক্ত হবে না। এসব প্রোটিন অণুর একপ্রান্ত নাসিকা গহবরে উন্মুক্ত, আর অন্যপ্রান্ত অলফ্যাক্টরি নার্ভের সাথে যুক্ত থাকে। ঘ্রাণ সৃষ্টিকারী পদার্থগুলো যখন সংগ্রাহক প্রোটিনের সাথে যুক্ত হয়, তখন অলফ্যাক্টরি লোবে তাড়নার সৃষ্টি হয় এবং তড়িৎ রাসায়নিক ক্রিয়ার মাধ্যমে স্নায়ু থেকে স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কের ঘ্রাণকেন্দ্রে পৌঁছায় এবং উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, অর্থাৎ আমাদের কাছে তা পছন্দের না অপছন্দের সেই অনুভূতির সৃষ্টি করে। পাশাপাশি এ তাড়না লিম্বিক সিস্টেমে পৌঁছে দেয় এই ঘ্রাণকে স্মৃতি প্রোকোষ্ঠে জমা রাখার জন্য, যাতে পরবর্তীতে এই ঘ্রাণ পাওয়া মাত্রই চিনে নিতে পারি আমরা।
এখন আসা যাক কী করে ব্যক্তিবিশেষে এই প্রতিক্রিয়ায় পার্থক্য দেখা যায়। প্রথমেই বলা হয়েছিলো যে, মানুষের প্রত্যেকটি বৈশিষ্ট্যের নিয়ন্ত্রক একেকটি জিন, যা অ্যামিনো এসিডের শিকল বা সিকোয়েন্স নামে পরিচিত, আর একেকজনের সংগ্রাহক প্রোটিনের অ্যামিনো এসিডের শিকলের গঠন একেক রকম।
২০১৩ সালে কিছু মানুষের এই ভিন্ন ঘ্রাণ সংবেদনশীলতার উপর পরীক্ষা চালানো হয়, যা অ্যাসপারাগাস টেস্ট নামে পরিচিত। প্রত্যেক ব্যক্তিকে অ্যাসপারাগাস খাওয়ানোর পর তাদের ইউরিন নিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়। কিছু কিছু ব্যক্তি ইউরিনে উৎকট গন্ধের সালফার যৌগের গন্ধ পান, কিছু কিছু ব্যক্তি এই গন্ধ শনাক্তকরণে ব্যর্থ হন। আর এই পার্থক্যের মূল কারণ হলো তাদের নাকের সংগ্রাহক প্রোটিন অণুগুলোর গঠনগত ভিন্নতা, অর্থাৎ অ্যামিনো এসিড সিকোয়েন্সে ভিন্নতা। এই একই পরীক্ষা তাদেরকে রুটি খাওয়ানোর পর করানো হয় এবং ব্যক্তিবিশেষে ঘ্রাণ সনাক্তকরণে একই ধরনের ফলাফল পাওয়া যায় ৷ গবেষকদল এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, এখানে শরীরের ভেতরে মেটাবলিজমের কিছুটা সংশ্লিষ্টতা থাকলেও মূলত সংগ্রাহক প্রোটিনগুলোর জিনগত ভিন্নতাই এজন্য দায়ী।
এছাড়াও নিউ ইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা ইদুরের উপর মানুষের ঘ্রাণ সংবেদনশীল জিন প্রতিস্থাপন করেন। তারা এই ইদুরগুলোর নাম দেন সুপার স্নিফার মাইস, যারা মাইনের প্রতি সংবেদনশীল। অর্থাৎ তারা ভূমিমাইন গন্ধের মাধ্যমে শনাক্ত করতে পারে। এই সুপার স্নিফার ইঁদুরগুলো পারকিন্সন ও আলঝেইমার নামক মস্তিষ্কের রোগ সনাক্তকরণে সক্ষমতা দেখায়।
অনেকের ধারণা আছে, যাদের অন্য কোনো ইন্দ্রিয় অক্ষম, বিশেষ করে দর্শনেন্দ্রিয় কার্যকর না, তাদের ঘ্রাণকেন্দ্র বিশেষভাবে গঠিত। কিন্ত এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আসলে তাদের দর্শন বা অন্য ইন্দ্রিয় সচল না থাকায় ঘ্রাণশক্তির উপর তাদের নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়।
তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, মানুষের এই ঘ্রাণকেন্দ্র কতটা গুরুত্ব বহন করে। আপনারা জেনে অবাক হবেন, এমনকি সঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও এই ঘ্রাণকেন্দ্রের গঠনগত ভিন্নতার প্রভাব রয়েছে। আমাদের শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে যে রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়, তা একেকজনের সংগ্রাহক প্রোটিনের সাথে আবদ্ধ হয়ে একেক ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাই সঙ্গী হিসেবে আমরা কাকে বেছে নিচ্ছি আমাদের মনের অজান্তেই বিষয়টি প্রভাবিত হয়। আর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার দ্বারাও বোঝা যায় যেকোনো বিষয়ের পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটাও তার জিনগত বৈশিষ্ট্য দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই আসলে কেন কারও পছন্দ এরকম এ ধরনের প্রশ্ন হয়তো আমাদের মনে আর দ্বন্দ্ব তৈরি করবে না।