প্রথমে চিন্তা করা যাক, আমাদের ভার দালানে কি করে সঞ্চালিত হয় এবং তা কোন কৌশলে দালানের নিচে থাকা ভিত্তি (Foundation)-এ গিয়ে পৌঁছে। দালানে থাকা মানুষ, আসবাবপত্র, আনুষঙ্গিক অন্যান্য সরঞ্জামাদি সহ যাবতীয় সবকিছুর ভার প্রথমে যায় পায়ের নিচে থাকা দালানের প্রথম অংশটিতে, যার নাম মেঝে (Floor)। পুরকৌশলের পরিভাষায় এর আরেকটি নাম হলো ‘স্ল্যাব’ (Slab)। ভার প্রথমে গিয়ে পড়ে এই স্ল্যাবে। স্ল্যাব এই ভারকে সঞ্চালন করে তার নিচে থাকা অনুভূমিকভাবে বসানো ‘বিম’ (Beam) এ, অতঃপর বিম এই ভারকে সঞ্চালন করে ‘কলাম’ (Column) এ। স্ল্যাব, বিম ও কলাম – দালানের এই তিনটি অংশকে আমরা খালি চোখে নিজেদের বসতবাড়িতে সবসময় দেখে এসেছি, তাই এদেরকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই।
কলাম এরপর যার ঘাড়ে ভার সঞ্চালন করে তা বাইরে থেকে দেখতে পাওয়া যায় না, এটাই হলো দালানের ‘ভিত্তি’ (Foundation)। আর ভিত্তি থেকে এই ভার সরাসরি চলে যায় এর নিচে থাকা মাটিতে। সব মিলিয়ে বলা যায়, দালানের পুরো ভার আসলে বহন করে তার নিচে থাকা মাটি। দালান নির্মাণের শুরুতেই তাই পরীক্ষা করে নেয়া হয় যে স্থান বা জায়গায় দালানটি নির্মিত হবে সেখানকার মাটির ধরন কেমন এবং তা আসলেই ভবিষ্যতে নির্মাণ করতে যাওয়া দালানের ভার বহন করতে পরিপূর্ণরূপে সক্ষম কিনা। এভাবে মাটি পরীক্ষা করাকে বলা হয় ‘ভূকারিগরি তথ্যানুসন্ধান’ (Geotechnical Investigation)।
কলাম ও তার আকৃতির ঐতিহাসিক বিবর্তন
সময়ের সাথে সাথে কলামের বাহ্যিক গঠনে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। বর্তমান সময়ের কলামগুলোকে প্রস্থচ্ছেদ থেকে দেখলে তা বেশিরভাগই আয়তাকার বা বৃত্তাকার হয়। নকশার দিক থেকে চিন্তা করলে একটি আয়ত বা বৃত্ত বেশ সরল নকশা। বর্তমান সময়ের মানুষ গণিত জানে। কী করে একটি কলাম নির্মাণ করা হলে তা সবচেয়ে কম খরচে সবচেয়ে বেশি টেকসইভাবে তৈরি করা যাবে তা গাণিতিকভাবে বের করা যায়। এখন তো কম্পিউটার চলে আসার কারণে দালান সংক্রান্ত অনেক লম্বা লম্বা গাণিতিক হিসাব সফটওয়্যারের সাহায্যে মুহূর্তেই করা যায়। অনুরূপ হিসাব হাতে করতে গেলে হয়তো অনেক সময় লাগতো*।
(নোটঃ যদিও বিষয়টি সরাসরি দালান নিয়ে নয়, মানুষ ১৯১২ সালে ব্রিটিশদের নির্মিত হার্ডিঞ্জ সেতুকে কেন এতো শ্রদ্ধার চোখে দেখে? এরকম একটি সেতুর নকশা আজকালকার দিনে করা খুবই সহজ একটি কাজ। তবে ১৯১২ সালের প্রেক্ষাপটে যখন কম্পিউটার এরকম উন্নতমানের ছিল না, হাতে হাতে গাণিতিক হিসাব করে কিংবা খুবই সরল কিছু গাণিতিক যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে হার্ডিঞ্জ সেতুর মতো একটি সেতু দাঁড় করিয়ে ফেলা, যে সেতু প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে টিকবে, মোটেই সহজসাধ্য কোনো কাজ ছিল না।)
কাজেই মানুষ এখন ঠিক সেই নকশাটিই বাছাই করে যা দালানটিকে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী ন্যূনতম স্থায়িত্ব প্রদান করবে। তবে প্রাচীনকালে দালান নির্মাণের দর্শনে গণিতের চেয়ে স্থাপত্য সৌন্দর্যই অধিক প্রাধান্য পেত। তারই সূত্র ধরে বিভিন্ন সময়ে কলামের নকশায় কিছু যুগনির্ধারণী পরিবর্তন এসেছে।
প্রারম্ভিক কলামসমূহ
কলামের প্রথম ব্যবহার ছিল তুলনামূলকভাবে ছোট ভবনের ছাদের জন্য একধরনের সাপোর্ট হিসেবে কিন্তু ব্রোঞ্জ যুগ (খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০-১০০০ অব্দ) থেকে মিশরীয়, অ্যাসিরিয়ান এবং মিনোয়ান সভ্যতায় শুধুমাত্র দালানকে বাইরে থেকে সাপোর্ট দিয়ে রাখার জন্যই নয় বরং অন্যান্য ফাংশন সহ আরও পরিশীলিত কলাম আবির্ভূত হয়েছিল। অর্থাৎ এ সভ্যতাসমূহে কলামকে ‘শুধুমাত্র’ দালান নির্মাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ভাবলে ভুল হবে। এটি দালানের সৌন্দর্য বর্ধন, আভিজাত্য প্রদর্শন ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টিরও কাজ করতো।
যদিও পূর্বের সভ্যতাগুলো তাদের কলামের জন্য পাথর ব্যবহার করত, মিনোয়ানরা পুরো গাছের গুঁড়ি ব্যবহার করত। সাধারণত গাছগুলোর পুনরায় বৃদ্ধি রোধ করার জন্য গাছগুলোকে উল্টো করে স্টাইলোবেটে (ফ্লোর বেস) একটি বেস সেটে বসানো হতো এবং কলামের মাথায় একটি খুব সাধারণ গোল ক্যাপিটাল* বসিয়ে দেয়া হতো। (নোটঃ ক্যাপিটাল হলো কলামের একেবারে মাথায় বসানো সুদৃশ্য স্থাপত্যকর্ম যা ছাদ ও কলামের মধ্য যুগলবন্দি স্থাপন করে।) কলামগুলোর উপরে তখন নসোসের সবচেয়ে বিখ্যাত মিনোয়ান প্রাসাদের মতো করে রং করা হতো। মিনোয়ানরা তখন কলাম ব্যবহার করেছিল তাদের জন্য দালানের ভিতরেই বিশাল সব উন্মুক্ত স্থান তৈরির জন্য, একইসাথে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানও এইসব স্থানে পালন করার ব্যবস্থা ছিল।
এই ঐতিহ্যগুলো পরবর্তী মাইসেনিয়ান সভ্যতার দ্বারা অব্যাহত ছিল, বিশেষ করে তাদের প্রাসাদের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মেগারন বা হলঘরে। স্তম্ভগুলোর গুরুত্ব এবং প্রাসাদগুলোর জন্য তাদের উল্লেখ যে একটা বিশেষ কিছু তা প্রমাণিত হয় হেরাল্ডিক মোটিফগুলোতে, যেমন মাইসিনির বিখ্যাত সিংহ-দ্বার যেখানে দুটি সিংহ একটি কলামের প্রতিটি পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। কাঠের তৈরি হওয়ার কারণে এই প্রারম্ভিক কলামগুলো টেকেনি, তবে তাদের পাথরের ভিত্তি রয়েছে এবং এর মাধ্যমে আমরা এই প্রাসাদ ভবনগুলোতে তাদের ব্যবহার এবং কীভাবে তাদেরকে সাজানো হয়েছিল সে সম্পর্কে অবগত হতে পারি।
প্রথম পাথর নির্মিত কলামসমূহ
প্রাচীন গ্রিসে বড় বড় দালান নির্মাণের জন্য কাঠের বদলে পাথরের ব্যবহার শুরু করা হয়। তবে কাঠ থেকে পাথরে এই যে নির্মাণকাজের রূপান্তর ঘটলো এটাকে কোনভাবেই পরিষ্কার করে বলা যাবে না যে এই সাল থেকেই পরিবর্তনটা শুরু হয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৮ম থেকে ৭ম শতাব্দীর মধ্যবর্তী ইসমিয়া, এফাসাস এবং করিন্থের মন্দিরগুলোতে পাথরের অন্যান্য কাঠামোগত উপাদানগুলোর পাশাপাশি পাথরের ভিত্তি সহ কাঠের স্তম্ভ ব্যবহার করা হতো বলে বিশ্বাস করা হয়। যদিও ধীরে ধীরে, এবং ছাদের বিম বাদ দিয়ে দেখা গেল পাথর পুরো কাঠামোতে বেশ শক্তিশালী ভিত্তি ও স্থায়িত্ব প্রদান করতে পারে।
আগেকার এই পাথরের কলামগুলোকে পুরো একটা পিস আকারে বানানো হতো। কিন্তু যতই দালানের আকৃতি লম্বা হতে লাগলো এবং লম্বা লম্বা সব কলামের দরকার হলো, তখন আর এভাবে এক পিস হিসেবে কলাম বানানো সম্ভব ছিল না। তখন কলাম নির্মাণের আগে প্রথমে একটি শক্ত ভিত্তি নিচে দেয়া হতো যাকে বলে ‘কলাম ড্রাম’। এই কলাম ড্রামের একেবারে কেন্দ্রে তখন মূল কলামকে কাঠের ডাউয়েল বা ধাতব পেগ দিয়ে ফিট করা হতো। ভূমিকম্পের সময় এভাবে বানানো কলামগুলো বেশ ভালো কাজে দিতো।
ড্রামগুলো নিচ থেকে বেশ ভালোরকমের স্থিথিস্থাপকতা প্রদান করতো এবং এ কারণে যদি খুব জোরে বাতাস না আসে কিংবা কেউ যদি দালান থেকে কোনো পাথরের অংশ খুলে সরিয়ে না রাখে অন্য কোথাও ব্যবহার করার জন্যে, শুধুমাত্র ভূমিকম্পের মাধ্যমে এই কলামগুলোকে মাটিতে ফেলে দেয়া বেশ কঠিন ছিল। এরকম ভালো সুবিধা থাকা সত্ত্বেও রোমানরা এক পিস হিসেবে নির্মিত কলামগুলোকেই পছন্দ করতো বেশি যাকে ‘মনোলিথিক কলাম’ বলে।
(নোটঃ মনোলিথিক কথাটার মানেই হচ্ছে একসাথে বা এক করে বানানো। আমাদের এখনকার দালানগুলোতে যখন ঢালাই দেয়া হয় তখন দেখা যায় বিম ও কলামগুলোতে কনক্রিট ঢালাই একবারে দেয়া হচ্ছে। এটা কিন্তু এমন হয় না কখনোই যে প্রথমে কলামগুলোতে কনক্রিট ঢাললাম তারপরে তা শক্ত হলে তখন বিমে কনক্রিট ঢাললাম। এটা কখনোই হয় না। এভাবে কলাম ও বিমের কনক্রিট একসাথে দিয়ে যেই দালান বানানো হয় সেটাকে ‘মনোলিথিক স্ট্রাকচার’ বলে)।
খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে রোমানরা প্রথম গাণিতিকভাবে হিসাব করে কলাম বানানো শুরু করে। তারা কলামের শ্যাফটের দৈর্ঘ্য রাখতো কলামের মোট দৈর্ঘ্যের (মানে ক্যাপিটাল, বেইজ আর শ্যাফটসহ মোট যে দৈর্ঘ্য) ৫/৬ অংশ। এর মানে হলো, যদি কলামের ক্যাপিটাল, শ্যাফট ও বেইজের মোট দৈর্ঘ্য হয় ১৫ ফিট, তাহলে শুধু শ্যাফটের দৈর্ঘ্যই হতে হবে ১২.৫ ফিট। এই ধরনের কলামের জনপ্রিয় উদাহরণগুল রোমের প্যান্থিয়ানে পাওয়া যায়।
কলামের স্থাপত্য ক্রম
প্রাচীনকালে কলামের আকৃতির বিবর্তন কীভাবে হলো তা কিছু স্থাপত্যক্রম দ্বারা শ্রেণিবিন্যস্ত করা হয়ে থাকে। প্রধান তিনটি ক্রম হলো- ডরিক, আয়নিক ও করিন্থিয়ান। যদিও এগুলো বাদ দিলে প্রথমদিকে রাখতে হয় মিশরীয় কলাকে যেগুলো একটি বেইজের (একেবারে নিচের অংশ) উপর দাঁড়াতো এবং যাদের শ্যাফটে (মাঝের লম্বা অংশ) বিভিন্ন কারুকার্যময় গাছ লতা পাতার নকশা থাকতো। অন্যদিকে ফার্সি কলামগুলোতে ক্যাপিটালে (একেবারে উপরের অংশ) বিভিন্ন প্রাণীর ছবি (যেমন- ষাঁড়) আঁকা থাকতো।
গ্রিক দুনিয়ায় প্রথম ক্রম ছিল ডরিক যেখানে কলামগুলো নিচের দিকে চওড়া হতো কিন্তু কোনো বেইজ থাকতো না, সাথে ক্যাপিটাল হতো একদম ছিমছাম, তত একটা কঠিন সাজসজ্জা ছিল না। আয়নিক কলামের কিন্তু একটা বেইজ থাকতো তবে এর মাথা বা ক্যাপিটালটা হতো একেবারে বুনো মহিষের শিংয়ের মতো দুই দিকে মোড়ানো (এটাকে ডবল স্ক্রল বা ভলিউট বলে)। করিন্থিয়ান কলামগুলো ছিল মোটামুটি কিছুটা চিকন ও লম্বা। বেইজ ছিল, সাথে অনেক বেশি কারুকার্যমণ্ডিত ক্যাপিটাল থাকতো যেখানে ফুল ও পাতা আঁকা ছিল।
সবগুলো কলামের গায়েই লম্বালম্বিভাবে ডোরাকাটা দাগ কাটা থাকতো, এগুলোকে বলা হয় ফ্লুট। যেমন আমাদের এখনকার কোনো কলামেই কিন্তু সাধারণত গায়ে কোনো লম্বালম্বি গর্ত বা দাগ থাকে না। রোমানরা প্রথম টাস্কান কলামের প্রচলন ঘটায় যার গায়ে কোনো ফ্লুট ছিল না এবং বেইজ ও ক্যাপিটাল ছিল একদম সাধারণ। রোমান ডরিক কলাম যেগুলো ছিল তা আবার একই ধরনের ছিল কিন্তু তাদের গায়ে ফ্লুট ছিল। পরবর্তীতে কম্পোজিট কলাম চলে আসে যেখানে এই তিন ধরনের কলামেরই মিশ্রণ দেখা যেতো। এমনকি সলোমনিক কলামের শ্যাফট ছিল টুইস্টেড বা প্যাঁচানো।
লম্বা দালানের দৃষ্টিজনিত ভ্রম দূর করতে কিছু জ্যামিতিক সংশোধন করা হতো। যেমন কলাম বানানোর সময় উপর উঠাতে উঠাতে সেটাকে কিছুটা ভেতরের দিকে ঠেলে উঠানো হতো যাতে এটাকে দূর থেকে দেখলে গায়ের একদম সোজাসুজি উঠে যাওয়া ফ্লুটগুলোকে কিছুটা বাঁকা মনে হয়। একেবারে কোণার কলামগুলো কিছুটা মোটা করে বানানো হতো। এর চেয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় উদাহরণ হলো প্রাচীন গ্রিসের এথেনিয়ান অ্যাক্রোপলিসের পার্থেনন মন্দির।
কিছু কিছু সময় কলাম দেখতে এতটাই সুন্দর হয় যে এগুলোকে আলাদা স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে রক্ষা করা হয়। তখন কিন্তু কলামটি আর দালানের কোনো অংশ না, এটা নিজেই একটা আলাদা সৌন্দর্যের বস্তু। এ রকম কলামের উদাহরণ হলো- ১১৩ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত রোমের ট্রাজান’স কলাম যা প্রায় ৩০ মিটার উঁচু এবং পারসেপোলিসের বুল-ম্যান কলাম (খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী)।
বিমের কাজ
প্রাচীনকালে যখন বহুতল ভবন নির্মাণ শুরুও হয়নি, বেশিরভাগ সাধারণ দালান বা রাজসিক ভবন ছিল একতলার। এসব ভবনের সুদৃশ্য অবয়ব ছিল, ছিল চোখ ছানাবড়া করা কারুকাজসম্পন্ন স্থাপত্য নকশা। তবে একটু গভীরে গিয়ে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, স্থাপত্যশৈলী উপস্থাপনা ছাড়া এসব অংশের আর কোনো কাজ ছিল কিনা, বিশেষত দালানের সামগ্রিক গঠন নির্মাণে এসবের কোনো গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে কিনা, দেখা যাবে তা নেই। সহজ ভাষায় বললে, দালানের এমন কিছু অংশ ছিল যারা শুধু তার দর্শকের মনোরঞ্জন করার জন্যই নির্মিত হতো, আদতে ওটি না থাকলে দালানটির কোনো কিছু আসতো যেতো না। বহুতল ভবন নির্মাণ পদ্ধতি আসার আগে দালান নির্মাণ কাজের শুরুর দিকে বিম ছিল অনেকটা এমনই এক জিনিস। একতলা একটি দালানের উপর স্ল্যাব থাকে একটিই। ঐ স্ল্যাবকে ‘ছাদ’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়। কেবল ছাদ থেকে আসা বিভিন্ন ধরনের ভার ছাড়া এতে অন্য কোনো ভার আসে না। কাজেই বলা যায়, স্ল্যাবের নিচে থাকা বিমগুলোর এক্ষেত্রে খুব একটা ভার বহন করতে হয় না। বিমগুলোর একটিই মাত্র কাজ আর তা হলো উপরে থাকা স্ল্যাবটিকে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা।
গ্যালিলিও গ্যালিলির ক্যান্টিলিভার বিম পরীক্ষণ
বিখ্যাত ইতালীয় বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলিকে (১৫৬৪-১৬৪২) আমরা মূলত চিনি তার জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত কাজের জন্য। তিনি তৎকালীন সময়ের সুপারস্টার ছিলেন, অনেকটা বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের মতো। তিনি ‘কোপারনিকান হেলিওসেন্ট্রিজম’ এর একজন বড় সমর্থক ছিলেন যেখানে বলা হয় সূর্য স্থির এবং পৃথিবী প্রতিদিন সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। এ কারণে ক্যাথলিক চার্চ থেকে ভীষণ বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সে যাই হোক, আমরা অনেকেই জানি না মেকানিক্স অব সলিড বা কঠিন বস্তু সংক্রান্ত বলবিদ্যা (এক কথায়, কোনো একটা কঠিন বস্তু ধরা যাক কনক্রিটের বিমকে যদি দুই হাতে চাপ দিয়ে ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করা হয় কিংবা মোচড় দেয়া হয় কাপড়ের মতো তাহলে তা কেমন আচরণ করবে এবং ফলাফল কী হবে) নিয়েও তার কিছু ভালো কাজ আছে, অন্তত ঐ সময়ের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের সাথে তুলনা করলে। এর একটি হলো গ্যালিলিওর ক্যান্টিলিভার বিম।
প্রথমে বোঝা যাক ক্যান্টিলিভার (Cantilever) কথাটা দিয়ে আসলে কী বোঝায়। সহজ ভাষায়, আমরা সবাই গাছের ডাল দেখেছি। ডালগুলোর এক প্রান্ত দেখা যায় গাছের সাথে আটকানো আর অন্য প্রান্ত একেবারে খোলা বা বাতাসে ঝুলে আছে। এই যে শুধুমাত্র এক প্রান্তের উপর ফিক্স করে একটা বস্তুর দাঁড়িয়ে থাকা, এরকম কাঠামোকেই এক কথায় ‘ক্যান্টিলিভার’ বলা হয়।
গ্যালিলিওর আগেও অনেক গণিতবিদ বলবিদ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন, বিশেষত কোনো একটা কঠিন বস্তুতে বল প্রয়োগ করলে কীভাবে তা পুরো বস্তুর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে- এ ব্যাপারটি বেশ জটিল। গ্যালিলিও এসে নতুন করে একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, কোনো কঠিন বস্তুর আকার ও আকৃতি কেমন তার উপর নির্ভর করবে সেটি কতটা ভার নিতে পারবে এবং এর মধ্য দিয়ে কীভাবে সেই ভার ছড়িয়ে যাবে। তিনি দেখেছিলেন বিমের দৈর্ঘ্য যত বাড়ানো হবে এর শক্তি তত কমতে থাকে যদি না এটিকে চওড়ায় ও পুরুত্বের দিক থেকেও একই হারে বাড়ানো হয়। এ কারণে বিমের আকার দ্বিগুণ বা তিনগুণ করে দিলেই যে সেটি দ্বিগুণ বা তিনগুণ ভার নিতে পারবে এমনটা আশা করা কখনোই ঠিক নয়।
গ্যালিলিওর এই অনুধাবনটিকেই আমরা বর্তমান যুগে চিনি ‘স্কেলিং প্রবলেম’ হিসেবে। প্রকৃতিতে এ কারণেই কোনো জিনিস কতটুকু লম্বা হবে তার একটা সীমা থাকে। যদি একটি গাছের ডাল অত্যধিক লম্বা হয় কিংবা মানুষের হাতই অতিরিক্ত লম্বা হতো তাহলে তা নিজের ভারেই ভেঙ্গে যেতো, যেটাকে ‘সেলফ ওয়েইট’ বলা হচ্ছে। গ্যালিলিও যে ক্যান্টিলিভার বিমের পরীক্ষণ করেছিলেন সেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন কোনো বিমের উপর ভাঙ্গার জন্য প্রযুক্ত বল (ব্রেকিং ফোর্স) তার দৈর্ঘ্যের বর্গের সমানুপাতে বাড়তে থাকে।
শুধুমাত্র কনক্রিট দিয়ে যতদিন দালান নির্মাণ করা হতো ততদিন পর্যন্ত ক্যান্টিলিভার বিমের কাঠামো বানানো বেশ কঠিন ছিল। পরবর্তীতে যখন কনক্রিটের সাথে ইস্পাতের (স্টিল) ব্যবহার শুরু হলো (যাকে রিইনফোর্সড কনক্রিট বলা হচ্ছে) কেবলমাত্র তখনই ক্যান্টিলিভার বিম বাস্তবে বানানো সম্ভব হলো। ফ্র্যাংক লয়েড রাইট (১৮৬৭-১৯৫৯) ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থপতি যিনি এই ক্যান্টিলিভার সিস্টেম ব্যবহার করেছিলেন। শিকাগোর রবি হাউজ নির্মাণে তিনি ১৯০৬ সালে তিনি এটি প্রথম ব্যবহার করেন। ইস্পাত ও কনক্রিট একসাথে ব্যবহার করে তিনি ছাদকে সাপোর্ট থেকে প্রায় ২০ ফিট (৬ মিটার) বর্ধিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমনকি রাইট সাহেবের নতুন ধরনের নির্মাণ পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে স্থাপত্যের নতুন একটি স্কুল তৈরি হয় যার নাম ‘প্রেইরি স্কুল’।
ক্যান্টিলিভারের ব্যবহার কিন্তু দালান নির্মাণের আগেও সেতু নির্মাণে অনেক আগে থেকেই হতো। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে প্রথম ক্যান্টিলিভার সেতু নির্মাণ করা হয় জার্মানিতে যার কারিগর ছিলেন হেনরিখ গ্যারবার। তিনি এখানে প্রাচীন চাইনিজ সেতুর নির্মাণশৈলীর ধারণা ব্যবহার করেছিলেন যেখানে অনেক আগে থেকেই ক্যান্টিলিভারের ধারণার প্রচলন ছিল। ক্যান্টিলিভার ব্যবহার করার কারণে সেতুকে একেবারে মাঝ থেকে সাপোর্ট দেয়া দরকার হয় না এবং এ কারণে নদীর গভীর পর্যন্ত সেটিকে ছড়িয়ে দেয়া যায়।