আপনার হাতের আঙুলের দিকে একবার খেয়াল করে দেখুন। প্রতি আঙুলেই যেন অসংখ্য দাগ বা খাঁজ রয়েছে। যারা টিভি শো দেখেন তারা কোনো না কোনো সময় CID বা CSI জাতীয় ক্রাইম শো দেখেছেন। তারা নিশ্চয় জানেন এই খাঁজ দিয়ে আসামী সনাক্ত করা হয়। এই আঙুলের ছাপকে প্রমাণ হিসেবে সাধারণত অকাট্য বলে বিবেচনাও করা হয়। কিন্তু এ প্রক্রিয়া কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য তা নিয়ে অনেকেরই ধারণা নেই। আমাদের আজকের এই আলোচনা এই বিষয়টি নিয়েই।
শুরু করার আগে দেখা যাক আঙুলের ছাপ আসলে কী। আমাদের প্রতিটি আঙুলে, হাত বা পায়ের তালুতে বিভিন্ন রকমের ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। মায়ের গর্ভে থাকাকালীন সময়েই আমাদের জীবনের সূচনালগ্ন যেমন ছিল তার উপর ভিত্তি করে ছাপ তৈরি হয়। বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে একমত যে গর্ভ ধারণের ১০ সপ্তাহে এই আঙুলের ছাপ তৈরি হওয়া শুরু করে। কিন্তু কোন পদ্ধতিতে ছাপ আঙুলে তার অবস্থান করে নেয়, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত কোনো ধারণা দিতে পারেননি।
সবচেয়ে প্রচলিত যে ধারণা রয়েছে তা হলো আমাদের ত্বকের মধ্যস্তর (Basal layer) অপর দুইটি স্তর অপেক্ষা দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যার কারণে বাইরের এপিডার্মিস এবং ভেতরের দিকের ডার্মিস স্তরে চাপের সৃষ্টি হয়। এই চাপের কারণে এপিডার্মিসের কিছু অংশ ডার্মিসে পিষ্ট হয়ে খাঁজের তৈরি করে, যা পরিশেষে আঙুলের ছাপ হিসেবে সাথী হয়ে থাকে। তবে ত্বকের স্তরের চাপের পাশাপাশি আরো কিছু পারিপার্শ্বিক প্রভাব এক্ষেত্রে কাজ করে। এর মধ্যে অন্যতম হল রক্তচাপ, রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ, মায়ের শরীরে পুষ্টির পরিমাণ এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে ভ্রূণের অবস্থান।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে (১৮৯৬ সালের দিকে) আঙুলের ছাপ সর্বপ্রথম অপরাধী সনাক্তকরণে ব্যবহৃত হয়। স্যার এডওয়ার্ড হেনরি ১৯০১ সালে আঙুলের ছাপকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করেন। যা ধীরে ধীরে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ১৯১১ সালে আমেরিকাতে থমাস জেনিংস নামে এক ব্যক্তিকে আঙুলের ছাপের ভিত্তিতে হত্যা মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তবে এ সময়ে মূলত আঙুলের ছাপ মানুষের চোখের আন্দাজের উপরে ভিত্তি করে একই কিনা তা নির্ণয় করতো। এ কাজে কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৯০ এর দশকে।
তবে ব্যাপারটা এমন নয় যে আপনি একটি ডাটাবেজে একটি আঙুলের ছাপ নিয়ে রাখবেন আর তা আপনাকে নিমেষের মধ্যে সে আসামীর সন্ধান করে দেবে। এফবিআই এর ডাটাবেজে প্রায় ৫৩ মিলিয়নের অধিক ফাইল রয়েছে। এফবিআই ল্যাবোরেটরির ল্যাটেন্ট প্রিন্ট সাপোর্ট ইউনিটের প্রধান মাইকেল উইনার্সের মতে, একটি ছাপ ডাটাবেজে মিলিয়ে দেখতে কমপক্ষে ২ ঘণ্টার মতো সময় লাগে।
আঙুলের ছাপের অনন্যতা কি বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত?
ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষের আঙুলের ছাপ অনন্য। এই কথাটি শুরু হয় স্যার ফ্রান্সিস গাল্টনের এক দাবি থেকে। তবে তিনি এই তথ্য সমর্থন করার জন্য এখনও বৈজ্ঞানিক কোন দলিল দেখাতে পারেন নি। আর বর্তমানে সেটাই সত্য বলে বিবেচনা করা হয়। যে সকল পরীক্ষণ করা হয়েছে তার সবই একটি নির্দিষ্ট জনসংখ্যার জন্য। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আপনি এই ফলাফল দেখে হয়ত বলতে পারবেন সেই নির্দিষ্ট জনসংখ্যার মধ্যে কারও আঙুলের ছাপ মিলে না। ধরে নিলাম আপনি একই পরীক্ষাটি পুরা বিশ্বের ৭.৬ বিলিয়ন মানুষের আঙুলের ছাপ নিয়ে পরীক্ষাটি করলেন, তা-ও আপনার দলিল স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে না। এর কারণ আপনি জীবিত মানুষদের ছাপ পরীক্ষা করলেও পৃথিবীতে এতদিনে মৃত্যু হওয়া প্রায় ১০০ বিলিয়ন মানুষের হিসেব আপনি করতে পারছেন না। যার ফলে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক দলিল করাটা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা এটুকু সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হয়েছেন যে, এই ছাপ প্রতি মানুষের বেলায় ভিন্ন হবে। এমনকি বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে এই ছাপ পরিবর্তন হতে পারে। গবেষণায় এটিও নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে যে এই ছাপ অভিন্ন যুগল বা আইডেন্টিকাল টুইনের ক্ষেত্রেও কিছু অংশে ভিন্নতা থাকে।
তাহলে আসামী ধরার ক্ষেত্রে এই ছাপ কি আসলে কাজ করে
আপনারা টিভি শোতে যেমন দেখেন আঙুলের ছাপ এবং অন্যান্য নজির ফরেনসিক ল্যাবের মানুষজন সংগ্রহ করে নেন। কিন্তু ব্যাপারটা এতটা সোজা নয় যতটা আপনি চিন্তা করছেন। একটি অপরাধপটের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা প্রতিটি চিহ্ন সংগ্রহ করে তার মধ্যে কোনগুলি ব্যবহারযোগ্য তা নির্ণয় করতে হয়। আমাদের আলোচনা আপাতত আঙুলের ছাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক। আঙুলের ছাপ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ একটি দল মত প্রকাশ করেছেন, তাদের যে সকল ছাপ নিয়ে কাজ করতে হয় তা তাদের কাছে ডাটাবেজে সুন্দরভাবে থাকে না, অধিকাংশই থাকে একটি ছাপের কিছু অংশ বা ঘষে মুছে যাওয়া ছাপ, যার ফলে আসলে ডাটাবেজে কারও আঙুলের ছাপ থাকলেও তা মেলানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এফবিআই এর মাইকেল উইনার্সের মতে, ল্যাবে যে সকল প্রিন্ট আসে তার শুধুমাত্র ২৬ শতাংশ ব্যবহার উপযোগী থাকে।
তাছাড়া আংশিক ছাপের ক্ষেত্রে কোনরকম বাঁধাধরা নিয়ম নেই বললেই চলে। এরকম ছাপের ক্ষেত্রে কয়েকটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে ছাপ মিলে কিনা তা মিলিয়ে দেখা হয়। একেক দেশ এই ব্যাপারটি একেকভাবে দেখে। যেমন ফ্রান্সে এরকম মিলার জন্য ১৬টি অবস্থানে দুটি ছাপের মিল থাকতে হয়, সেখানে সুইডেনের ক্ষেত্রে এই বিন্দুর সংখ্যা খালি ৭ এবং অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে ১২।
ডিজিটাল ফটোগ্রাফির সহায়তায় এরকম প্রিন্ট মিলানো আগে থেকে তুলনামূলক সোজা হয়ে গেলেও এখনও এই কাজের শেষে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির চোখে এই চিহ্নগুলি দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে আদৌ দুটি ছাপ একই কিনা। এরকম বিবেচনা করতে দিলে দেখা দেয় ত্রুটি যার নামকরণ করা হয়েছে Cognitive bias।
এক গবেষণায় পাঁচজন আঙুলের ছাপ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের একটি আঙুলের ছাপ অন্য একটি ছাপের সাথে মিলে কিনা পরীক্ষা করতে দেন। তাদেরকে যে ছাপগুলি দেয়া সবগুলিই তারা তাদের জীবনের কোনো একসময়ে মিলে গিয়েছিল বলে দাবি করেছিলেন। গবেষকেরা এসময় যে বিষয়টি পাল্টান তা হল তারা একজন অপরাধীর ব্যাপারে তাদের অবহিত করেন। অবাক করা বিষয় হয়ে দাঁড়ায় যখন পাঁচজনের মধ্যে চারজন তাদের মত পরিবর্তন করেন তাদের বিশ্লেষণ নিয়ে।
আরেকটি গবেষণায় একদল অভিজ্ঞদের কিছু আঙুলের ছাপ দিয়ে বলা হয় যে ডিজিটাল ডাটাবেজ থেকে মিলিয়ে তাদের কিছু আঙুলের ছাপ সাজিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের সে ফলের সত্যতা বিবেচনা করতে হবে। এ গবেষণায় দেখা যায়, তালিকার প্রথম দিকে থাকলে তাদের ছাপ মিলানোর সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়, একইভাবে তালিকার নিচের দিকে আসল ছাপ থাকলে সেটি মিলানোর সম্ভাবনা হ্রাস পেয়েছে।
কিন্তু এর মানে এই নয় যে আইন প্রয়োগকারী সংগঠনের আঙুলের ছাপ ব্যবহার করা বন্ধ করে দেয়া উচিত। তারা অবশ্যই ব্যবহার করবেন, কিন্তু তা অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে সতর্কতা অবলম্বন করে। সেক্ষেত্রে দায়িত্বটা খালি আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী সংগঠনের থাকেবনা। গবেষকদের কাছে দায়িত্ব থাকে আরও গবেষণা করে আঙুলের ছাপ উত্তোলন থেকে শুরু করে বিশ্লেষণের প্রক্রিয়াকে আরও পরিমার্জিত করা। তাছাড়া অভিজ্ঞদের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে Cognitive bias পরিত্রাণের বিষয়টিও একটু মাথায় রাখা প্রয়োজন। পরিশেষে বলা যায়, আঙুলের ছাপ বিষয়ে অভিজ্ঞগণ তাদের মতামত উপস্থাপন করেন, কোনো সত্য নয়।
ফিচার ইমেজ: sciencemag.org