একদেশে ছিল এক রাজা। রাজার ছিলো তিন মেয়ে। তো, একদিন হঠাৎ রাজার মনে এক আজব প্রশ্ন এলো। রাজা যাচাই করতে চান তার মেয়েরা তাকে কী পরিমাণ ভালবাসে। রাজা বলে কথা! বিচিত্র চিন্তাভাবনা তো কেবল রাজাদেরই মানায়। তাই তিন রাজকন্যাকে রাজার সামনে হাজির করা হলো।
রাজা মেয়েদের জিজ্ঞেস করলেন তারা তাঁকে কেমন ভালবাসে। বড় মেয়ে বললেন, “মহারাজ, আমি আপনাকে চিনির মতো ভালবাসি।” তারপর মেজ মেয়ের পালা। তিনি রাজাকে মধুর মতো ভালবাসেন বলে জানালেন। কিন্তু গোল বাঁধালো রাজার সবচেয়ে প্রিয় ছোট মেয়ে। ছোট মেয়ে যখন বললেন, “মহারাজ, আমি আপনাকে লবণের মতো ভালবাসি”, তখন রাজা তো রেগে আগুন।
তখন ছোট রাজকন্যা রাজাকে বললেন, মধু বা চিনি ছাড়াও অনেক খাবার খাওয়া যায়, কিন্তু লবণ ছাড়া কোনো খাবারের স্বাদই খাওয়া যায় না।
শেষমেষ রাজা নিজের ভুল বুঝতে পারলেন এবং এটাও বুঝলেন যে, তার মেয়েদের মধ্যে ছোট মেয়েই সবচেয়ে বুদ্ধিমান। আর ঠিক তখন থেকেই প্রচলিত হলো “লবণের মতো ভালোবাসা” কথাটির।
ধারণা করা হয়, আজ থেকে প্রায় ৬,০০০ বছর পূর্বের পৃথিবীতেও লবণের প্রচলন ছিল। ২,৭০০ খ্রিস্টপূর্বে চীনে চিকিৎসাবিজ্ঞানে লবণের ব্যবহার বিষয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়, যাতে প্রায় চল্লিশ রকমের লবণ সম্পর্কে এবং দুই ধরনের লবণ উৎপাদন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। The Archeology of Chaina অনুসারে প্রায় ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে শ্যাং বংশের রাজত্বকালে চীনে বাণিজ্যিকভাবে লবণ উৎপাদন শুরু হয়। তখনকার দিনে লবণে উচ্চমূল্য যাতে লাগামহীন না হয় সেজন্য সরকারের হাতেই মূলত লবণ উৎপাদন ও বন্টনের দায়িত্ব ছিল। আর সে কারণেই চীনের নাগরিকদের টাকার পাশাপাশি তাদের কাছে বছর শেষে বেঁচে যাওয়া অতিরিক্ত পরিমাণ লবণ সরকারকে কর হিসেবে দিতে হতো।
ইউরোপে রোমানরাই সর্বপ্রথম লবণের চাষ শুরু করে প্রায় ৬০ খ্রিস্টপূর্বে। তারা মূলত ভূমধ্যসাগরীয় উপত্যকাগুলোতে মাটির নিচ থেকে খনিজ লবণ উৎপাদন করতো। সে সময় অনেক দেশই লবণ উৎপাদনপ্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতো না। এছাড়াও ভূমিতে আবদ্ধ দেশগুলোও লবণ আমদানি করত রোমানদের কাছ থেকে। এই উৎপাদিত লবণের ব্যবসা করে রোমান সাম্রাজ্য বেশ বিত্তবান হয়ে ওঠে। তখন লবণ প্রধানত বিভিন্ন রকম ফল ও সবজি সংরক্ষণ করতে ব্যবহার করা হতো। এছাড়াও পরাক্রমশালী রোমান সৈন্যবাহিনীর সৈন্যদের মাসিক বেতনের একটি অংশও এই লবণ দিয়ে পরিশোধিত হতো। লবণের উচ্চমূল্যের কারণে এই ব্যবসায় জড়িত সকলেই সমাজে উচ্চ মর্যাদাশীল ছিলেন।
প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশেরও আছে এই লবণের লবণাক্ত ইতিহাস। ষোল শতকের আগেও এই উপমহাদেশে লবণ উৎপাদিত হতো। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক শোষণে স্থানীয় লবণ শিল্পে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। তখনকার দিনে গুজরাটের পশ্চিম তীরে, উরিষ্যার পূর্ব তীরে, এবং কক্সবাজারে লবণ উৎপাদিত হতো।
১৮০৪ সালের ১লা নভেম্বর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আদেশবলে লবণ চাষকে সরকারীকরণ করা হয় অর্থাৎ সরকারী লোকজন ব্যতিত কেউ লবণ উৎপাদন ও বাজারজাত করতে পারবে না। তখন ইংরেজ সরকার স্থানীয় জমিদারদের সাহায্যে লবণ চাষীদের উৎপাদন থেকে বিরত রাখে। অনেক চাষীদের এককালীন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। তবে তা ছিল যৎসামান্য। অল্প কিছুদিনের মধ্যে ক্ষতিপূরণের টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় এবং লবণ উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা থাকায় লবণ চাষীরা অন্য কাজে যোগ দিতে শুরু করে। অপরদিকে ইংরেজদের কারসাজিতে বাজারে লবণের দাম ছিল আকাশচুম্বী। ১৯৩০ এর ১২ মার্চ মহাত্মা গান্ধী গুজরাটের লবণ শিল্প পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে রওনা দেন। তার সাথে ছিল তার ৭৮ অনুসারী। প্রায় ২৫ দিন ধরে ২৪০ মাইল দূরে হেঁটে পাড়ি দেয়ার পর মহাত্মা গান্ধী ডান্ডি পৌঁছান। এ সময় তাঁর অনুসারী ৭৮ থেকে বেড়ে প্রায় ৬০,০০০ এর কাছাকাছি হয়। সেখানে গিয়ে তিনি নিজ হাতে লবণ তৈরি করেন। এই যাত্রাকে লবণ সত্যাগ্রহ বলা হয়ে থাকে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে বিসিক-এর সহযোগিতায় লবণ শিল্প পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলে প্রায় ৬৭ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে। আয়োডিনের অভাবজনিত অসুখ প্রতিরোধের লক্ষে সরকার ১৯৯৪ সালে দেশে আয়োডিনবিহীন লবণ বাজারজাত বন্ধ করে এবং খাদ্য লবণে আয়োডিনের মাত্রা নির্ধারিত হয় ১৫ পিপিএম (parts per million)।
খাদ্য লবণ বা সোডিয়াম ক্লোরাইড মূলত আমাদের শরীরের একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন সুস্থ মানুষের প্রতিদিন ২,০০০ মিলিগ্রাম লবণ গ্রহণ করা উচিত। লবণের সোডিয়াম আয়ন দেহে স্নায়ুতন্ত্র ও পেশীতন্ত্র সচল রাখতে এবং দেহে জলীয় অংশের ভারসাম্য রাখতে সাহায্য করে। অক্সিজেন ও খাদ্য উপাদান এই জলীয় অংশের মাধ্যমেই সঞ্চালিত হয়। আবার এই সোডিয়াম বেশি মাত্রায় গ্রহণ করলে উচ্চ রক্তচাপসহ আরো নানা রকম অসুখ হতে পারে। অন্যদিকে ক্লোরাইড আয়ন দেহে রক্তের pH এবং পাকস্থলির বিভিন্ন পাঁচক রস তৈরিতে সাহায্য করে।
তাহলে, মানুষের পক্ষে কি সম্ভব লবণ না খেয়ে বেঁচে থাকা?
উত্তর হচ্ছে, না। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অতি সামান্য যে পরিমাণ লবণ প্রয়োজন তার অধিকাংশই আসে মাংস, ডিম ও সামুদ্রিক মাছ থেকে। আর আমরা অতিরিক্ত লবণ যোগ করি স্বাদ বৃদ্ধির জন্য।
বিজ্ঞানের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/