২০১৫ সালের গ্রীষ্মকাল, গ্রীনল্যান্ড অঞ্চল। বেঞ্জামিন মিয়েল ও তার গবেষকদল মাঠ পর্যায়ের গবেষণার কাজে বিশাল একটি বরফ খণ্ড ড্রিল করা শুরু করলেন। মোটামুটিভাবে একটি মোটরবাইকের ইঞ্জিনের সমান আকারের আয়তন তারা ড্রিল করে ফেললেন। ভাবতে পারেন পাঠক, এই ইঞ্জিন আকৃতির বরফ খণ্ড থেকেই বিজ্ঞানীদের বহু জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর মিলেছে? গবেষকরা নিরন্তর খুঁজে গিয়েছেন একটি উত্তর- “অত্যন্ত ভয়ংকর গ্রীন হাউজ গ্যাস মিথেনের কত শতাংশ তেল ও গ্যাস শিল্প থেকে নিঃসরিত হয়?” বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী গ্যাসসমূহের অন্যতম এই মিথেন গ্যাস।
পূর্বের ধারণা অনুযায়ী, প্রতি বছর বৈশ্বিক মোট নিঃসরিত মিথেনের ১০ শতাংশের উৎস হিসেবে কাজ করত আগ্নেয়গিরির লাভা, উষ্ণ কর্দমাক্ত মাটি। তবে সম্প্রতি বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র বলছে ভিন্ন কথা। মূলত মিথেনকে ঘিরে বিজ্ঞানীদের ধারণাটা ছিল বেশ ভ্রান্ত। মিথেনের ক্ষতিকর প্রভাব বা উৎস বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বরাবরই ভূতাত্ত্বিক ঘটনাবলী সম্পর্কিত ছিল। কিন্তু নেচারের গবেষণানুযায়ী, মিথেন নিঃসরণের প্রধানতম উৎস হলো জীবাশ্ম জ্বালানীর উৎপাদন ও নিষ্কাশনের সাথে জড়িত পুরো শিল্প। এই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ভুল উৎসের প্রতি মনোযোগ থাকায় মিথেনের ক্ষতিকর প্রভাবসমূহকে প্রায় ৪০% কম গুরুত্ব সহকারে বিচার করা হয়ে এসেছে এতদিন।
বেঞ্জামিনের মতে, এই গবেষণার ভালো ও খারাপ দুটো দিকই আছে। খারাপ এই অর্থে যে, প্রাক শিল্পায়ন যুগের তুলনায় বর্তমানে অনেক বেশি মিথেন নিঃসরিত হচ্ছে, অথচ এই মিথেন নিঃসরণের মূল উৎস সম্পর্কে আমরা দীর্ঘকাল যাবত ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে আসছিলাম। আবার ঠিক এই কারণটি আবিষ্কৃত হওয়ার একটি অত্যন্ত ইতিবাচক দিকও রয়েছে। খুব সহজ একটি বিষয় হচ্ছে আগ্নেয়গিরির লাভা কিংবা উষ্ণ কাদামাটি; কোনোটিই আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। অর্থাৎ ভূতাত্ত্বিক উৎসসমূহকে নিজেদের আওতাধীন করা প্রায় অসম্ভব। বাকি রইল মানবসৃষ্ট উৎসসমূহের কঠোর নিয়ন্ত্রণ। আমাদের কার্যকলাপের ফলে উৎপন্ন মিথেনের উপর যত বেশি দৃষ্টিপাত করা হবে, নীতিনির্ধাকরা তত বেশি বাধ্য হবেন এর উপর আইন জোরদার করতে।
গ্রীন হাউজ গ্যাস কার্বন ডাইঅক্সাইড নিয়ে আমাদের মোটামুটি সবারই জানাশোনা আছে। অথচ তার চেয়েও শক্তিশালী মিথেন নিয়ে সম্ভবত তেমন কোনো ধারণাই আমাদের নেই। মিথেন অণুর কেন্দ্রীয় পরমাণু কার্বন এবং এর চার বাহুতে চারটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সমন্বয়ে এর বিশেষ ত্রিমাত্রিক আকৃতি বা কনফিগারেশন একে এক ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে। ২০ বছর সময়ে মিথেন গ্যাস কার্বন ডাইঅক্সাইডের চেয়ে ৯০ গুণ বেশি শক্তিশালী গ্রীন হাউজ গ্যাস হিসেবে কাজ করতে সক্ষম। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে, কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসের চেয়ে মিথেন গ্যাস তাপ ধরে রাখার কাজে অনেক বেশি পারদর্শী। শিল্প বিপ্লবের সূচনালগ্ন থেকে বর্তমানে বাতাসে প্রায় ১৫০ গুণ বেশি মিথেন উপস্থিত। কার্বন ডাইঅক্সাইডের তুলনায় মিথেন অতিরিক্ত মাত্রায় তাপ ধরে রাখতে সক্ষম হওয়ায় বাতাসে এর পরিমাণ যত বাড়বে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন তত বৃদ্ধি পাবে। আর অন্যদিকে ইতিমধ্যে ঘটে যাওয়া দূষণের ক্ষতিপূরণ তো বাকিই রইল।
এই পর্যায়ে আলোচনার একটু গভীরে যাওয়া যাক। এতটুকু পর্যন্ত যা আমরা জানলাম তাতে মনে হতেই পারে যে, মূল অপরাধী তবে মিথেনই, আমরাই বরং বিনা কারণে কার্বন ডাইঅক্সাইডকে এতকাল দোষারোপ করে এসেছি। প্রশ্ন হচ্ছে, কয়লাভিত্তিক শক্তি উৎপাদন থেকে কেন পৃথিবী সরে আসছে? ২০১০ থেকে আজ অবধি যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫০০ কয়লাভিত্তিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল উপাদান হলো মিথেন, যা জ্বালানী হিসেবে কয়লার চেয়ে অনেক দক্ষভাবে পোড়ে। কার্বন ডাইঅক্সাইডের চেয়ে মিথেনের বাতাসে উপস্থিত থাকার ব্যপ্তি অনেক কম। মিথেন যেখানে বাতাসে মাত্র নয় বছর থাকে, সেখানে কার্বন ডাইঅক্সাইড প্রায় শতাব্দী জুড়েও থাকতে পারে। এসব কারণেই মূলত বিশ্বজুড়ে কয়লা থেকে প্রাকৃতিক গ্যাসের দিকে স্থানান্তরের হিড়িক।
তাহলে মিথেন কী এমন দোষে দুষ্ট? তেল ও গ্যাস শিল্পে প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন ও ব্যবহারের সময় যেটুকু মিথেন অব্যবহৃত থাকে বা সিস্টেম লস হিসেবে বিবেচিত হয়, সেটুকুই এত বিশাল ক্ষতির জন্য দায়ী। খুব প্রচলিত শব্দযুগল: ‘লিকেজ রেট’। অর্থাৎ উৎপাদন ও ব্যবহারকালে ঠিক কী পরিমাণ মিথেন পরিবেশে বিমুক্ত হয়ে যায়। পুরো বিষয়টিকে সুসংহত রাখতে লিকেজ রেট ১% এর নীচে থাকা আবশ্যক। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে নিঃসরণের হার ২% এরও অধিক হতে পারে, যা কি না সন্দেহাতীতভাবে আশঙ্কাজনক।
বেঞ্জামিনের কাজে ফিরে যাই। গ্রীনল্যান্ডের বরফ আচ্ছাদিত অঞ্চলে তারা অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করলেন। প্রায় ২,০০০ পাউন্ড বরফ তারা খনন করে ফেললেন। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই বরফের অস্তিত্ব প্রাক-শিল্পযুগ থেকেই। অর্থাৎ শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার আগে থেকেই এই অঞ্চল বরফে ঢাকা। প্রায় ১০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত খনন করে তারা দেখতে পেলেন, অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্পবিপ্লব হওয়ার আগের আমলের মিথেন, বরফের স্ফটিকের মাঝে বিদ্যমান সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বায়ু থলিতে (এয়ার বাবল) উপস্থিত রয়েছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভূতাত্ত্বিক মিথেন ও বরফের মাঝে জমে থাকা মিথেনের রাসায়নিক সজ্জায় পার্থক্য রয়েছে।
মিথেনের তাপ ধরে রাখার অসাধারণ নৈপুণ্যের দরুন এটি কার্বন ডাইঅক্সাইডের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর। মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ২৫% এর জন্যই দায়ী পরিবেশে নিঃসরিত মিথেন গ্যাস। মিথেন গ্যাস কর্তৃক সম্ভাব্য ক্ষতিসমূহ একনজরে দেখে নেওয়া যাক:
- শ্বাসকষ্ট
- চেতনা হারানো
- মাথা ব্যথা ও মাথা ঘোরানো
- শারীরিক ভারসাম্য হারানো
- বমি বমিভাব
- দুর্বলতা
- অস্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস
মিথেনের এত ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের সমাধানের কিছু উপায় হতে পারে:
- প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন ও নিষ্কাশনের স্থানসমূহের সুনির্দিষ্ট তালিকা থাকা চাই। কোথায়, কোন প্রতিষ্ঠান এই কাজের সাথে জড়িত এবং তাদের প্রত্যেকের প্রাত্যহিক উৎপাদিত ও নিঃসরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের বিস্তারিত তথ্য থাকলে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ নজরদারি করতে পারবে এবং সকলেই স্বীয় অবস্থান থেকে তৎপর হবে। নিঃসরণের পরিমাণ খুব বেশি হলে প্রতিষ্ঠানকে অবকাঠামোগত উন্নয়ন জোরদার করার নির্দেশ প্রদান সহজতর হবে।
- বর্তমানে গুগল স্ট্রিট ভিউ কারের সাহায্যে নিঃসরণের স্থান ও আকার সম্পর্কে তথ্য পাওয়া সম্ভব। তবে এই বিষয়টির উন্নয়ন যথেষ্টই দরকার। মোবাইল মনিটরিং সিস্টেমের মাধ্যমে নিঃসরণ সম্পর্কিত প্রতি মুহূর্তের তথ্য থাকলে প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনের বিষয়টি কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাঝে থাকবে।
- লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হতে পারে একটি অসাধারণ উদ্যোগ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে তিন বছর মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য। এই তিন বছরব্যাপী তাদের উৎপাদিত ও নিঃসরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের ধারাবাহিক পরিমাণ জনসমক্ষে প্রকাশিত হলে প্রত্যেকের ভেতরেই জবাবদিহিমূলক মনোভাব বেড়ে উঠবে এবং পেশাদারিত্বও বাড়বে।
- সহযোগিতামূলক মনোভাব বৃদ্ধি করতে হবে। সরকার কিংবা কোনো রেগুলেটরি কমিশনের একার পক্ষে পুরো একটি রাষ্ট্রের সবকিছু সামলানোর চেয়ে সকলের অংশগ্রহণ অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণের মূল কাঠামো থাকবে, তবে পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে কোনো নিঃসরণের ঘটনা ঘটলে স্থানীয় প্রশাসন বা জনগণকেও তাদের দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে।
একুশে বইমেলা ‘২০ উপলক্ষে রোর বাংলা থেকে প্রকাশিত বইগুলো কিনতে এখনই ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে-
১) ইহুদী জাতির ইতিহাস
২) সাচিকো – নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশুর সত্য ঘটনা
৩) অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে