Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মশার অস্তিত্ব পুরোপুরি বিলীন করে দেওয়া কি আদৌ সম্ভব?

বাংলায় একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে, “মশা মারতে কামান দাগা”। যার আভিধানিক অর্থ সামান্য কাজের জন্য অত্যধিক পরিশ্রম করা।

আসলে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে মশা মারার জন্য সত্যি সত্যিই কামান দাগতে হবে। বিগত কয়েক মাস যাবত আমাদের দেশে ডেঙ্গু মহামারী আকার ধারণ করেছিল। হাসপাতালে প্রতিদিন রোগীদের ভীড় যেন কোনোভাবেই কমছিল না। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল মশা নিধনের জন্য। কিন্তু কোনো পদক্ষেপই যেন কাজে আসছিল না। এখন পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল হলেও পুনরায় এই রোগ ফিরে আসবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

সম্প্রতি ডেঙ্গুজ্বর মহামারী আকার ধারণ করেছে বাংলাদেশে; Image Source: thedailystar.net

মশা নামক এই পতঙ্গটি আক্ষরিক অর্থেই আমাদের কোনো উপকারে আসে না। উল্টো প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে নানা মশাবাহিত রোগের কারণে। মশার কারণে সৃষ্ট রোগ ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া তো আছেই। এর সাথে চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাসের মতো নতুন নতুন মহামারী রোগ যুক্ত হচ্ছে। একটি সামান্য মশার কামড়ের কারণে প্রতি বছর অসংখ্য সুস্থ মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। অবস্থা এতটাই আশংকাজনক যে, মশার কারণে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা মানুষের কারণে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যার চেয়েও বেশি।  

একটি মশার কামড় থেকেই অনেক বড় রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে; Image Source: adventuremumma.com

গেটস ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর মশাবাহিত রোগের কারণে মারা যায় প্রায় ৭,২৫,০০০ জন। যেখানে কেবল ম্যালেরিয়ার কারণেই মৃত্যুবরণ করে প্রায় ৬,০০,০০০ জন। আর জিকা ভাইরাসের আগমন এই বড় সংখ্যার সাথে আরো ভয়াবহতা যোগ করেছে। এই ভাইরাসের কারণে গর্ভবতী মায়ের নবজাতক বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নেয়। আর এই বিরাট সংখ্যক মৃত্যুর জন্য দায়ী কেবল মশার কামড়।

চলুন, আগে জেনে নেওয়া যাক মশার কামড়ের পেছনে আসল উদ্দেশ্য কী। রক্ত মশার খাদ্যের চাহিদা মেটায় না। অন্য প্রাণীর রক্ত শুষে নেওয়ার পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো বংশবিস্তার। একটি মশাকে ডিম উৎপন্ন করার জন্য পুষ্টির প্রয়োজন হয়। রক্ত থেকে তারা সেই পুষ্টি সংগ্রহ করে। আর ঠিক এ কারণেই কেবল স্ত্রী মশাগুলো কামড় দিয়ে থাকে, পুরুষ মশা নয়। তবে সকল প্রজাতির মশাই মানুষের রক্ত শোষণ করে না। পৃথিবীতে মোট ৩,৫০০ প্রজাতির মশা রয়েছে। আর এদের মধ্যে কেবল ২০০ প্রজাতির মশাই মানুষকে কামড় দিয়ে বিরক্ত করে থাকে। এদের মধ্যে ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু বহন করে অ্যানোফেলিস গণের মশা, ডেঙ্গু ও জিকা ভাইরাসের জন্য দায়ী এডিস এজেপ্টাই এবং চিকুনগুনিয়ার জন্য দায়ী এডিস অ্যালবোপিক্টাস ও এডিস এজেপ্টাই দুটোই।

জিকা ভাইরাসের কারণে শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নিচ্ছে; Image Source: businessinsider.com

এখন প্রশ্ন হলো, যে প্রাণী মানুষের কোনো উপকারেই আসে না, বরং অকাল মৃত্যু বয়ে আনতে মানুষকেও হারিয়ে দিয়েছে, আমাদের নিজেদের বেঁচে থাকার স্বার্থে এদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা ঠিক কতটা যুক্তিযুক্ত? লিভারপুল স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের জীববিজ্ঞানী প্রফেসর হিলারি র‍্যানসন বলেন,

আমার মনে হয় না আমজনতার মশাকে পুরোপুরি বিলীন করে দেওয়ার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ রয়েছে। আমি বেশিরভাগ সময় এদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করি কেবল গবেষণা করার জন্য। কিন্তু তা কেবলই এদের মেরে ফেলার উপায় বের করার জন্য।

পৃথিবী থেকে মশার অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার ব্যাপারটা অতটা সহজ নয়। ৩,৫০০ প্রজাতির মধ্যে কেবল ২০০ প্রজাতিই মানুষকে বিরক্ত করে। আর এর পেছনের মানবিক ব্যাখার সাথে সাথে দার্শনিক ব্যাখাও মাথায় রাখতে হবে। মানুষের কি সত্যিই উচিত নিজের সুবিধার জন্য প্রকৃতি থেকে ১০০ মিলিয়ন বছরেরও পুরনো এক প্রাণীকে একেবারে বিলীন করে দেওয়া? প্রকৃতির উপর এমন সেচ্ছাচারী মনোভাব প্রদর্শন আপাতদৃষ্টিতে আমাদেরকে প্রকৃতির শত্রু বানিয়ে দেয়। তাছাড়া এজন্য প্রকৃতিকেও অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হতে পারে।

মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধের জন্য চলছে বিস্তর গবেষণা; Image Source: time.com

আমাদের কাছে মশা নানা বিরক্তির কারণ হলেও, অন্যান্য নানা প্রাণীর নিকট এটি খাদ্যের উৎস। বিভিন্ন মাছ মশার লার্ভা খেয়ে বেঁচে থাকে। ছোট ছোট পাখি, ব্যাং ও কিছু বড় বড় পতঙ্গের খাবার মশা। এরা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেলে তা প্রাকৃতিক খাদ্য শৃঙ্খলের উপর প্রভাব ফেলবে। আরেকটি বড় কথা হলো, ফুলের পরাগায়ণেও মশা অংশগ্রহণ করে। কিছু কিছু মশা ফুলের নেকটার খেয়ে জীবনধারণ করে। এছাড়া গাছের জন্য কিছু ক্ষতিকর প্রোটোজোয়া মশার খাদ্য। মশা না থাকলে যেমন উদ্ভিদের পরাগায়ণ ব্যাহত হবে, তেমনি কিছু গাছের যথাযথ বৃদ্ধি হবে না। কাজেই আমাদের প্রয়োজন না হলেও প্রকৃতির মশার প্রয়োজন রয়েছে।

মশার লার্ভা নানা প্রাণীর প্রাথমিক খাদ্য; Image Source: thoughtco.com

প্রকৃতির উপর আমরা যে সবসময় সদয় থাকি তা কিন্তু নয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা, বন ধ্বংস, নগরায়ন ইত্যাদির জন্য অনেক প্রাণীই বিলুপ্ত হয়েছে কিংবা বিলুপ্তির পথে। আমাজনে আগুন লাগার পেছনে মূল কারণ সবাই জানে। নিজেদের সুবিধার জন্য আমরা প্রকিতির উপর অনেক আগে থেকেই স্বেচ্ছাচার করে আসছি। তাই অনেকের মনে হতে পারে মশাই তো, এদের সরিয়ে ফেললে কী এমন ক্ষতিই বা হবে। তবে কিছু প্রকৃতিবিজ্ঞানী এই বিষয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোকপাত করেছেন। মানুষের বন-জঙ্গলে রাত না কাটানোর পেছনে এক গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো রোগ বহনকারী মশা। মশা না থাকলে মানুষের এই ভয়ও থাকবে না। আর বন-জঙ্গলে মানুষের অবাধ চলাফেরার একটা সহজ রাস্তা তৈরি হয়ে যাবে। এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল বনগুলোর জন্য ভালো না-ও হতে পারে।

প্রকৃতির সাথে বিরুদ্ধাচরণ ও মানবিক আবেগ- এই দুটি জিনিসের মাঝে মানুষ পড়তে চায় না। আবেগের মূল্যই আমাদের কাছে বেশি। ডেঙ্গু কিংবা ম্যালেরিয়ার কারণে মারা যাওয়া সন্তানের বাবা-মায়ের কথা চিন্তা করুন। কিংবা জিকা ভাইরাসের কারণে মানসিক বা শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে যাওয়া বাচ্চাটার কথাই চিন্তা করুন। এসব রোগের সাথে লড়াই করা মানুষদের সাথে এ বিষয়ে তর্কে যাওয়াটা বোকামি। তাছাড়া গবেষকরাও মশার বিলুপ্তিকরণের পক্ষে রয়েছেন। আর এ বিষয়ে তারা যথাযথ পদক্ষেপও নিচ্ছেন।

গবেষণাগারে তৈরি রূপান্তরিত পুরুষ মশা ; Image Source: sciencemag.org

মশা মারার জন্য আমরা সাধারণ জনগণ কয়েল, অ্যারোসল, ধোঁয়া, তেল ইত্যাদি ব্যবহার করি। কিন্তু এদের পুরোপুরি উচ্ছেদ করে দেওয়ার জন্য আরো বড় অস্ত্রের প্রয়োজন। আমাদের মূল শত্রু হলো এডিস মশা। এই মশাগুলো মানুষের বসবাসের জায়গার সাথে খুব ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারে। আমাদের নিজেদের উদাসীনতার কারণে এদের খাদ্য ও বাসস্থানের ব্যবস্থা আমরাই করে দিয়েছি। তাই এদের বিনাশ করতে কোনো ছোটখাট পদক্ষেপে কাজ হবে না। পুরোপুরি সকল প্রজাতির মশা বিলুপ্ত না হলেও অন্তত এডিস, অ্যানোফেলিস ও কিউলক্স জাতের মশাগুলো বিলুপ্তিকরণের জন্য কাজ করা হচ্ছে। আর এদের উচ্ছেদ করার মূল অস্ত্র হলো প্রযুক্তি।

বিভিন্ন এলাকায় মশার উপদ্রব কমানোর জন্য ফগার মেশিন ব্যবহার করা হয়; Image Source: maagicpest.com

একটি এলাকায় মশার উপদ্রব চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার এক উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হলো জেনেটিক মোডিফিকেশন। এর মাধ্যমে পুরুষ মশাগুলোর জিনে বিশেষ পরিবর্তন আনা হয়। যার কারণে স্ত্রী মশার সাথে মিলনের পর এরা যে মশাগুলোর জন্ম দেয় তারা বংশবিস্তারে অক্ষম বা স্টেরাইল হিসেবে জন্ম নেয়। এতে করে নতুন মশা আর বংশবিস্তার করতে পারে না। মশা না মেরে মশার বংশবিস্তার আটকে দেওয়ার এ পদ্ধতি অনেক চমৎকার একটা উপায়। তবে বৃহৎ পরিসরে এই কাজটা করা অনেক চ্যালেঞ্জিং। কারণ তা বাস্তবায়নের জন্য মিলিয়ন সংখ্যক পুরুষ মশার প্রয়োজন।

২০০৯-২০১০ সময়কালে ইংল্যান্ডের কেম্যান আইল্যান্ডস নামক দ্বীপ শহরে পরীক্ষামূলকভাবে প্রায় ৩০ লক্ষ পুরুষ মশা ছাড়া হয়। এতে পার্শ্ববর্তী এলাকার তুলনায় ঐ শহরে মশার সংখ্যা ৯৬ শতাংশ হ্রাস পায়। ২০১৬ সালের দিকে ব্রাজিলের এক শহরে একই পরীক্ষা চালিয়ে মশার উপদ্রব ৯২ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। তবে ঐ শরগুলোতে মশার উপর জীবন ধারণ করা প্রাণীগুলোও এর ভুক্তভোগী গয়েছিল। গবেষকরা দাবী করেছেন, এই পরীক্ষা চালানোর পর কিছু পাখির বাচ্চা জন্মদানের সংখ্যা তিন থেকে দুইয়ে নেমে আসে।

মশার অস্তিত্ব পুরোপুরি বিনষ্ট করা সম্ভব নয়। কিন্তু ক্ষতিকর মশাগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এতে করে প্রকৃতি সাময়িক সময়ের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এমনটিই দাবী করেছেন গবেষকরা। যেসব প্রাণী খাদ্যের জন্য মশার উপর নির্ভরশীল তারা প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী ঠিকই বিকল্প খুঁজে নিবে। অনেকগুলো জীবন রক্ষার জন্য প্রকৃতিকে সামান্যই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তাছাড়া সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তির উন্নতি ঘটছে। প্রযুক্তিবিদরা এমন যন্ত্র তৈরি করছেন, যা দিয়ে মশার পাখার কম্পাঙ্ক হিসাব করে ক্ষতিকর মশা শনাক্ত করা সম্ভব।

একেবারে মশাহীন পৃথিবী কল্পনা করা যায় না। তবে মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে না আনলে নানা নতুন রোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা থেকে যায়। মশা থেকে পুরোপুরি নিস্তার পেলে হয়ত মশার কয়েল, অ্যারোসল ও রিপেলেন্ট ক্রিম বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির মুখ দেখবে। তবে প্রতি বছর এক বিরাট সংখ্যক নিরীহ প্রাণকে অকালমৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে জানতে পড়ুন এই বইটি-

১) ডেঙ্গু প্রতিরোধ প্রতিকার টিপস

This article is about the possibility of wiping out the entire species of mosquitos and also the after effect of nature. Necessary links have been hyperlinked within the article. 

Feature Image Source: kamalandkamal.com

Related Articles