প্রতিনিয়তই বিজ্ঞানীরা এটা-ওটা আবিষ্কার করে চলছেন। গুণোত্তর ধারায় এগিয়ে চলছে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা। তারপরও এমন অনেক কিছু আছে, যা বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পারেননি এখনো কিংবা উপযুক্ত ব্যাখ্যা দিতে পারেননি যেগুলোর। যে যে ব্যাপারগুলোর ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে পারছে না, সেগুলোতে এই সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নিয়েই সেগুলোকে ব্যাখ্যার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কোনো ঘটনা সম্পর্কে উপযুক্ত ব্যাখ্যা না জানলে, ব্যাখ্যার জন্য অপেক্ষা করবে কিন্তু কখনোই মনগড়া ব্যাখ্যা প্রদান করে বসবে না। এটিই বিজ্ঞানের সৌন্দর্য, এটিই বিজ্ঞানকে দান করেছে অনন্যতা।
কিন্তু এক শ্রেণীর ব্লগার ও ফেসবুক ব্যবহারকারী আছে, যারা বিজ্ঞানের এই সুন্দর বৈশিষ্ট্যকে পুঁজি করে নিজেদের মনগড়া মতামত প্রদান করে থাকে এবং দাবি করে বসে যে, বিজ্ঞান নাকি একটি অগ্রহণযোগ্য মাধ্যম। বাংলা ব্লগ ও ফেসবুক জগতে ভাইরাল হওয়া একটি উদাহরণ তুলে ধরছি।
-আমি কোথায়?
– বাংলাদেশে।
– বাংলাদেশ কোথায়?
– এশিয়া মহাদেশে।
– এশিয়া কোথায়?
– ৭,৯২৬ মাইল ব্যাসের পৃথিবীতে।
– পৃথিবী কোথায়?
– ৩০০ কোটি মাইল ব্যাপী বিস্তৃত সৌরজগতে।
– সৌরজগৎ কোথায়?
– এক হাজার কোটি সৌরজগৎ নিয়ে গঠিত ৫.৭ ট্রিলিয়ন মাইল ব্যাপী মিল্কিওয়ে নামক গ্যালাক্সিতে।
– এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি কোথায়?
– এরকম কয়েকশো থেকে কয়েক হাজার গ্যালাক্সির সমন্বয়ে গঠিত ৪ বিলিয়ন ট্রিলিয়ন মাইল ব্যাপী গ্যালাক্সি ক্লাস্টারে!
– গ্যালাক্সি ক্লাস্টারটা আবার কোথায়?
– এরকম অনেকগুলো ক্লাস্টার নিয়ে গঠিত সুপারক্লাস্টারে।
– এই সুপার ক্লাস্টার আবার কোথায়?
– অনেকগুলো সুপার ক্লাস্টার নিয়ে গঠিত সুপার সুপারক্লাস্টারে।
– সেটা আবার কোথায়?
– অনেকগুলো সুপার সুপার ক্লাস্টার নিয়ে গঠিত ট্রিপল সুপারক্লাস্টারে। এভাবে চলতেই থাকবে… চলতেই থাকবে…।
– এটাই কি মহাবিশ্বের পরিসীমা?
– মোটেই না! মাত্র ৪% বলা হয়েছে, বাকি ৯৬% বিজ্ঞানীরা চিন্তাও করতে পারছে না!
আপাতত এখানেই থামছি। উল্লিখিত বর্ণনাটির পরে ফেসবুকের পোস্টদাতা দাবি করেন, বিজ্ঞান আসলে কিছুই জানে না। যদি জানতো, তাহলে কি আর ৯৬% বাকি থাকতো? এরপর নিজের পছন্দমতো মতামত বসিয়ে দেন। এমন সব দাবি বসিয়ে দেন, যেগুলো বিজ্ঞানসম্মতভাবে গ্রহণযোগ্য নয় কিংবা বিজ্ঞানের মাধ্যমে সেগুলো সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। তারপর কোনো একটি অলৌকিক ব্যাপারকে তুলে এনে বলেন, বিজ্ঞান ‘অমুক জিনিস’কে ভুল বলছে, কিন্তু আমরা নিজের চোখেই দেখছি যে, বিজ্ঞান জগতের তেমন কিছুই জানে না। যেহেতু বিজ্ঞান কিছুই জানে না, সেহেতু ‘অমুক জিনিস’ সম্পর্কে বিজ্ঞান যা দাবি করছে, তা ভুল। যেহেতু বিজ্ঞান তেমন কিছুই জানে না, সেহেতু ‘অমুক জিনিস’ এর সত্যতা প্রমাণিত!
এভাবেই বিজ্ঞানের একটি বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে অত্যন্ত সুচতুরভাবে মনগড়া মতামত প্রতিষ্ঠা করে ফেলছে কিছু শ্রেণীর ফেসবুক সেলিব্রেটি কিংবা ব্লগাররা। উল্লেখ্য, উক্ত বর্ণনার মাঝেই বেশ কতগুলো ভুল আছে।
১) ট্রিপল সুপারক্লাস্টার বলতে আলাদা করে কোনো টার্ম আছে কি? এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি। খোঁজাখুঁজি করেও তেমন কিছু পাওয়া যায়নি।
২) মহাবিশ্বের পরিসীমা মাত্র ৪% জানা হয়েছে, আর বাকি ৯৬% বাকি আছে- এটা কেমন কথা হলো? ভুল করে ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জির মাঝে প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলছে না তো? উল্লেখ্য, মহাবিশ্বের গাঠনিক উপাদানের ৪% জুড়ে আছে সকল গ্রহ, নক্ষত্র ও মহাজাগতিক ধুলোবালি।
যদি সেটাই হয়ে থাকে, তাহলে “বিজ্ঞানীরা চিন্তাও করতে পারছে না“- এমন দাবি আসলে ভুল। বিজ্ঞানীরা ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জির পরিমাণ আলাদা করেছেন এবং সেগুলো নিয়ে অনেক গবেষণাও চলছে। হয়তো এই দিক সম্বন্ধে তেমন বেশি অগ্রগতি আসেনি, কিন্তু তারা ‘কিছুই জানেন না’, এমনও নয়। আজকে হয়তো কোনো একটি ব্যাপার সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট করে কোনোকিছু বলতে পারছেন না, কিন্তু তার মানে এই না যে, কখনোই ব্যাখ্যা দিতে পারবেন না। তার মানে এই না যে, একজন চাইলে ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যা প্রদান করে ফেলবেন।
মধ্যযুগের মানুষদের নিয়ে একটু কল্পনা করলেই হবে। মধ্যযুগের সবচেয়ে শিক্ষিত ও বুদ্ধিদীপ্ত মানুষও যদি আজকের যুগের উন্নত প্রযুক্তির পণ্যগুলো দেখে, তাহলে এগুলো নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? উড়োজাহাজ, বসে বসে পাখির মতো উড়ে যাওয়া যায়। ল্যাপটপ, জীবন্ত মানুষের আনাগোনা দেখা যায় এর ভেতরে। টাইপরাইটারের অক্ষরগুলো কত মিহি আর নিখুঁত! লিখতে কোনো কলম লাগে না। মোবাইল ফোন আর ওয়াইফাই রাউটার- কী এক তেলেসমাতি উপায়ে বাতাসে ভর করে করে ছবি, গলার আওয়াজ, ভিডিও ক্লিপ সব চলে আসছে। মোবাইলে কোনো কোনো কোম্পানির সিমে মাত্র তিন টাকা দিয়ে একশটা চিঠি (মেসেজ) কেনা যায়। আবার সেকেন্ডের মাঝেই সেগুলোকে শত শত মাইল দূরে পাঠিয়েও দেয়া যায়। হঠাৎ করে এরকম অসম্ভব বিপ্লব দেখলে ৫০০/৬০০ বছরের আগের মানুষ হতবুদ্ধি হয়ে যেত নিশ্চিত।
ঐ সময়ের মানুষ যত বুদ্ধিমানই হোক, আজকের যুগের প্রযুক্তি সম্বন্ধে তার বিন্দুমাত্র ধারণাও ছিল না। বর্তমানের স্বাভাবিক ঘটনাগুলো চোখের সামনে দেখতে পেলে নির্ঘাত সে এগুলোকে অলৌকিক বলে মেনে নিতো। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রযুক্তি উন্নত হয় এবং প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে অসম্ভব অলৌকিকতাগুলো বাস্তবতায় পরিণত হয়।
এত বেশি আগের সময়ে যেতে হবে না, শার্লক হোমসের যুগে গেলেই হবে। আন্তর্জাতিক কোনো ক্রিমিনাল চক্র যদি ফোনে নিজেদের সাথে যোগাযোগ রেখে কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করে; আর সেই পুরনো আমলের শার্লক হোমসকে সেই ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে এই সাধারণ ঘটনাই শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা শার্লক হোমসের কাছে মনে হবে ‘টেলিপ্যাথি’। সে আমলের তুখোড় গোয়েন্দাও ধরে নিতে বাধ্য হবে, তারা হয়তো বিশেষ উপায়ে দূরে অবস্থান করেও মস্তিষ্ক থেকে মস্তিষ্কে যোগাযোগ রাখছে! আর জি.পি.এস ট্র্যাকিং করে অপরাধীদের ধরার প্রক্রিয়া সম্বন্ধে অবগত হলে তো সম্ভবত তাদের মুখ দিয়ে কথাই বের হবে না।
আরেকটি ব্যাপার খেয়াল করি। ধরি, শার্লক হোমসের সময়কালের পটভূমিতে লন্ডনে একজন লোক খুন হয়ে গেল। শার্লক হোমস গোয়েন্দাগিরি করে দেখলো, যে ব্যক্তিকে আসামী হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে, সে ব্যক্তি ঐ দিন ছিল বাংলাদেশের ঢাকাতে। তাহলে শার্লক হোমস নির্ঘাত ধরে নেবে, ঐ ব্যক্তি খুন করেনি। কারণ ঐ আমলে একই দিনে ঢাকা ও লন্ডনে অবস্থান করা সম্ভব নয়। একমাত্র অলৌকিক কিছু হলেই তা সম্ভব।
অথচ আজকের উন্নত বিমানের যুগে একই দিনে ঢাকা ও লন্ডন অবস্থান করা মামুলী ব্যাপার হয়ে গেছে। একসময় এটি দৃশ্যত অবাস্তব ও অলৌকিক ছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তা বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এত বেশি জাদুময় হয়ে গেছে যে, বিজ্ঞানের আবিস্কার ও প্রযুক্তির উন্নয়নগুলোকে অলৌকিক বলেই মনে হয়। বিজ্ঞানের আবিস্কার আর অলৌকিক জাদু প্রায় একরকম বলেই মনে হয়। এজন্যই আর্থার সি. ক্লার্ক বলেছিলেন, “Any sufficiently advanced technology is indistinguishable from magic“।
একটি টাইম মেশিনে করে যদি আমরা এক বা কয়েক শতাব্দী সামনে চলে যাই, তাহলে হয়তো এমন কিছু দেখতে পাবো, যেগুলোকে আজকের যুগে আমরা অসম্ভব বলে জানি। সায়েন্স ফিকশনগুলো এই ক্ষেত্রটিকে আরো উর্বরতা দান করেছে। সায়েন্স ফিকশন লেখকেরা নিজেদের কল্পনায় ইচ্ছেমতো এই জিনিস-ঐ জিনিসের কথা বলেন। চাইলেই তারা একটি টাইম মেশিন তৈরি করে ফেলেন। এতে চড়ে অতীতে বা ভবিষ্যতে চলেও যায় গল্পের চরিত্ররা। আবার তারা ইচ্ছে হলেই একটি এন্টি-গ্র্যাভিটি মেশিন তৈরি করে ফেলেন। সেই মেশিনের মাধ্যমে অভিকর্ষকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মহাকাশে ভ্রমণ করতে পারে মানুষ। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানের তত্ত্ব ও তথ্য অনুসারে এই টাইম মেশিন ও অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি মেশিন- দুটোই তৈরি করা অসম্ভব।
অতীতে কল্পবিজ্ঞান লেখকেরা অনেক অসম্ভব কিছু কল্পনা করেছেন। পরবর্তীতে এসব কল্পনার অনেকগুলো বাস্তবে পরিণতও হয়েছে। কল্পবিজ্ঞান লেখক এইচ. জি. ওয়েলস কিংবা জুল ভার্নের কল্পবিজ্ঞানগুলো তার চমৎকার উদাহরণ। তেমনই আজকের যুগে যেগুলো অসম্ভব মনে হয়, ভবিষ্যতে সেগুলো সম্ভব হতে পারে। তবে সবগুলোই যে সম্ভব হবে, এমন নয়। অনেক কিছুই আছে, যেগুলো বাস্তবে সম্ভব হবে না। আগেও অনেক কিছু ছিল, যেগুলো এখনো বাস্তবে সম্ভব হয়নি।
যদি এমন কিছু ঘটে থাকে, যাকে অতিপ্রাকৃত ও অলৌকিক বলে মনে হয় বা যাকে বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, তাহলে সেগুলো ডেভিড হিউমের দুই সম্ভাবনার কোনো না কোনো একটিতে পড়বে। হয় ঘটনাটি ঘটেনি (দাবিকারী ব্যক্তি ভুল দেখতে পারে বা ঘটনা সম্পর্কে মিথ্যা বলতে পারে কিংবা ঘটনাটি কোনো ট্রিক হতে পারে), নাহয় ঘটনাটি সময়ের আগে আমাদের চোখে চলে এসেছে, আমাদের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের অনেক আগেই এটি ঘটে গেছে। ভবিষ্যতে এর রহস্য উন্মোচিত হবে কিংবা এর ব্যাখ্যা জানা যাবে।
যদি এমন কোনো ঘটনা আমাদের সামনে উপস্থিত হয় এবং বিজ্ঞানের সাহায্যে তার ব্যাখ্যা করা না যায়, তাহলেও তার পেছনে লেগে থাকতে হবে। এটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যদি প্রচলিত বিজ্ঞানের বাইরে নতুন কোনো যৌক্তিক বিজ্ঞান তৈরি হয়, তাহলেও কোনো সমস্যা নেই। এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের ধারণার কোনোটির সাথে না মিলুক, সমস্যা নেই; একে ব্যাখ্যার জন্য নতুন ধারার বৈজ্ঞানিক রীতি-নীতির জন্ম হোক, সমস্যা নেই।
কোনো ঘটনাকে ব্যাখ্যার জন্য প্রচলিত বিজ্ঞানের নীতিকে ‘না’ বলে দিয়ে নতুন ধরনের বিজ্ঞানের জন্ম আগেও হয়েছে, এটি স্বাভাবিক ঘটনা। যেমন- আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা ইত্যাদি।
হয়তো এমন ঘটনা ঘটতে পারে, যাকে ব্যাখ্যা করা অনেক চ্যালেঞ্জিং। যত চ্যালেঞ্জিংই হোক না কেন, সেটা গ্রহণ করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত উপযুক্ত ও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই চ্যালেঞ্জে লেগেই থাকতে হবে। কেউ যদি বলে “আপনি তো বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ, অমুক ঘটনাটির ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? এটা অলৌকিক না হয়ে পারেই না।” তখন এর উত্তরে এটি বলে দেওয়া যায়, “এই ঘটনার ব্যাখ্যা সম্পর্কে বিজ্ঞান এখনো কিছু জানে না। তবে বিজ্ঞান এর ব্যাখ্যায় কাজ করে যাচ্ছে। একসময় হয়তো এর ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।” এভাবে নিজেদের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করতে কোনো সমস্যা নেই, লজ্জার কিছু নেই। নিজের বর্তমান সীমাবদ্ধতাকে উল্লেখ করে ভবিষ্যতের প্রতি আশাবাদী হওয়াটাই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পন্থা।