জ্যোতির্বিজ্ঞান – পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় শাখাগুলোর একটি। এটার প্রতি জনসাধারণের যতটা আগ্রহ আছে, তা নিঃসন্দেহে পদার্থবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার তুলনায় অনেকখানিই বেশি। গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের জয়জয়কার চলছে। নাসার মঙ্গলের বুকে পানির সন্ধান, নিউ হরাইজন্সে প্লুটোর প্রথম স্পষ্ট ছবি ধারণ, ভয়েজারের সৌরজগৎ পেরোনো, লাইগোর (LIGO) প্রথমবার মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্ব আবিষ্কার, প্রথম ব্ল্যাক হোলের (কৃষ্ণবিবরের) ছবি ধারণ করতে সক্ষম হওয়া, গোল্ডিলক জোনে আরো অনেক গ্রহের (Exoplanets-বাহ্যগ্রহ) আবিষ্কার ইত্যাদি নানা বড় বড় বিষয়ের জন্য জ্যোতির্বিদরা খবরের শিরোনাম হয়েছেন প্রতিনিয়তই।
২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত নোবেল পুরষ্কারেও জোতির্বিদদের, কিংবা মোটাদাগে তাত্ত্বিক পদার্থবিদদেরই জয়জয়কার। গেল পাঁচ বছরের তিনবারই নোবেল গেছে জ্যোতির্বিজ্ঞানের নানা শাখায়। আপনি পদার্থবিজ্ঞানে আগ্রহী হয়ে থাকলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই জেনে থাকবেন যে এবারের ২০২০ সালে নোবেল পেয়েছেন ডক্টর রজার পেনরোজ, ডক্টর রেইনহার্ড গেঞ্জেল ও ডক্টর আন্দ্রেয়া ঘেজ।
পুরষ্কারের অর্ধেকটা পাচ্ছেন ডক্টর পেনরোজ, আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব (General Theory of Relativity) যে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বকে সমর্থন করে, এই আবিষ্কারের জন্য। এবং বাকি অর্ধেক পুরষ্কার বাকি দু’জন পাচ্ছেন আমাদের ছায়াপথ বা গ্যালাক্সির কেন্দ্রে যে একটা দৃঢ় বস্তু (Compact object- Supermassive Blackhole) আছে, সেটার আবিষ্কারে অবদান রাখার জন্য। সাধারণভাবে বললে বলা যায় যে, এই তিনজনই মূলত ব্ল্যাকহোল নিয়ে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞান বা এই সম্পর্কিত ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা বলতে গেলেই অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের নামটা চলে আসেই। বিজ্ঞান পরিমণ্ডলে আইনস্টাইনের প্রভাব ও অবদান সুগভীর। একটু আগেই বললাম, গত পাঁচটা নোবেলের তিনটাই জ্যোতির্বিজ্ঞানে গেছে; আর এতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আইনস্টাইনের নামটা জড়িত। তবে এবারের নোবেল পুরষ্কারের ক্ষেত্রে টুইস্টটা এখানেই যে, ব্যক্তি আইনস্টাইন নিজে কিন্তু ব্ল্যাকহোল অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না! অবশ্য বিজ্ঞান কখনোই কারো ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ধার ধারে না, বা ধারেওনি।
ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণবিবর নিয়ে কথা বলার আগে এর পূর্ব ইতিহাস ও আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাকে (General Relativity) একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক।
ব্ল্যাকহোল নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়েছিল সেই অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে। তখন অবশ্য ব্ল্যাকহোল প্রত্যয়টির গোড়াপত্তনই হয়নি। ১৭৮৩ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী জন মিশেল সুর্যের সমান ঘনত্বের কিন্তু প্রায় পাঁচশ গুন বড় এমন একটি নক্ষত্রের থাকার গাণিতিক সম্ভাবনা প্রস্তাব করেন, যেটার মহাকর্ষীয় প্রাবল্য এত বেশি হবে যে আলোকেও তার পৃষ্ঠ থেকে নির্গত হতে দেবে না। এই ধরনের দানবাকার নক্ষত্রের তিনি নাম দিয়েছিলেন ডার্ক স্টার (কৃষ্ণনক্ষত্র)। ফরাসি বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ল্যাপলাসও প্রায় একই রকম নক্ষত্রের অস্তিত্বের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছিলেন (১৭৯৯)। দুইজনেরই এই ডার্ক স্টার সম্পর্কিত কাজের কাঠামোর ভিত্তি ছিল নিউটনিয়ান বলবিদ্যা (Newtonian Mechanics)।
আমরা জানি যে, নিউটনের করে যাওয়া মহাকর্ষের ধারণাতে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি মূলত মহাকর্ষ বা গ্রাভিটিরই নবতর সংজ্ঞায়ন। ১৯০৫ সালে স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বে আইনস্টাইন দেখিয়েছিলেন যে, সময় আসলে ধ্রুব বা সবার ক্ষেত্রে একই হবে না, সময়টাও আপেক্ষিক। এবং সেখান থেকেই আইনস্টাইন এই ধারণা পেয়েছিলেন যে, ত্রিমাত্রিক স্পেস বা স্থান আসলে সময়ের সাথে সম্পর্কিত এবং সময় ও স্থান মিলেই স্থান-কালের চতুর্মাত্রিক ক্ষেত্র (4 Dimensional Space-time continuum) তৈরি করে। আমাদের মহাজাগতিক বাস্তবতার সবকিছুই আসলেই এই চার-মাত্রার বুনটের অংশ।
প্রায় দশ বছর খাটুনির পরে ১৯১৫ সালে আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে আইনস্টাইন দেখান যে, মহাকর্ষ বা গ্রাভিটি আসলে স্পেস-টাইমের বক্রতাকেই নির্দেশ করে (Distortion in the space time continuum)। যার ভর বেশি, সে স্পেস-টাইমের বক্রতা ঘটাতে পারে বেশি।
আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বকে সহজভাবে বোঝানোর জন্য চাদর ও ভারী বলের উদাহরণ টানা হয় প্রায়শই। গ্রাভিটেশনাল রেডশিফট, লেন্সিং, বুধ গ্রহের কক্ষপথে পরিবর্তন, বা সাম্প্রতিক মহাকর্ষীয় তরঙ্গের শনাক্ত হওয়া ইত্যাদি নানা পরীক্ষায় সফলভাবেই উতরে গেছে আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব।
আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশের দুই মাস পরই কার্ল শোয়ার্জচাইল্ড আইনস্টাইনের যে ফিল্ড ইকুয়েশন আছে, সেটার সমাধান প্রস্তাব করেন; যেটা কোনো ভারী বস্তু এর আশেপাশে কীভাবে এবং কী পরিমান বক্রতার সৃষ্টি করবে, সেটার ধারণা দাঁড় করাতে সক্ষম হয়। একে শোয়ার্জচাইল্ড মেট্রিক বলা হয়ে থাকে। মূলত এটাই ব্ল্যাক হোলের ধারণাকে আরো সুদৃঢ় করে।
১৯৩৯ সালের দিকে বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার ব্যাখ্যা করেন কীভাবে একটা বড় নক্ষত্র নিজের জ্বালানী শেষ করে সুপারনোভা বিষ্ফোরণের পর বিভিন্ন দশায় উপনীত হয়। তিনিই প্রথম দেখতে পান, প্রত্যেকটা নক্ষত্রই নিজেকে শূন্যে বিলীন করে দিতে চায়; পড়ে থাকে কেবল তার মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র। কিন্তু তার এবং সমসাময়িক সকলেরই ধারণা ছিল যে, এই ধরনের ব্যাপার সাধারণ আপেক্ষিকতার আতশকাঁচে রীতিসিদ্ধ হচ্ছে না। কারণ, অসীম বক্রতার (সিঙ্গুলারিটি) ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কেমন হবে, সেটা তখনো ভালোভাবে ব্যাখ্যা করার মতো কোনো তত্ত্ব বা বিশ্লেষণও ছিল না।
তখনও পর্যন্ত কিন্তু এ ধরনের নক্ষত্রকে ডার্ক স্টার হিসেবেই ডাকা হতো। ১৯৬০ সালে পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট ডিক প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখার সময় সর্বপ্রথম ‘ব্ল্যাকহোল’ প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন। এই প্রত্যয়টিকে জনপ্রিয় করে তোলেন আমেরিকান বিজ্ঞানী জন হুইলার। ততদিনে ব্ল্যাকহোলের আশেপাশে ইভেন্ট হরাইজন বা স্পেস-টাইমের উপস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়েছিল।
রজার পেনরোজ যখন কাজ শুরু করেন, তাকে সম্পূর্ন নতুন ধরণের গাণিতিক পদ্ধতির সহায়তা নিতে হয়, এবং এই সময়েই তিনি প্রস্তাব করেন তার বিখ্যাত সিঙ্গুলারিটি থিওরেম। তিনি প্রস্তাব করেন, ঘটনা-দিগন্ত বা ইভেন্ট হরাইজনের মধ্যেই একটা আবদ্ধ তল বা ট্র্যাপড সার্ফেস রয়েছে, যেটা আলোকে ফিরে আসতে দেয় না। কোনো সার্ফেসের মান শোয়ার্জচাইল্ড রেডিয়াসের চেয়ে কম হলেই কেবলমাত্র এরকম ট্র্যাপড সার্ফেসের সৃষ্টি হবে। ব্ল্যাক হোলের ক্ষেত্রের স্পেস-টাইমের বক্রতা কেমন হবে, সেজন্য পেনরোজ একটা ছবির মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন – যাকে বলে পেনরোজ ডায়াগ্রাম। ১৯৬৫ সালে পেনরোজ তার ধারণাটি প্রকাশ করেন।
১৯৬২ সালে সর্বপ্রথম কোয়েসারের দেখা মেলে। কোয়েসার হলো অনেক দূরের নক্ষত্র, যাদের নির্গত রেডিও তরঙ্গ এতই তীব্র যে এরা আসলে কীভাবে গঠিত হয় এবং এদের এত তীব্র শক্তি নির্গমনের উৎস কী, সেটা নিয়ে নানা ধরনের মতবাদ প্রস্তাবিত হয়। তবে সবচেয়ে বেশি যে ধারনাটা প্রশংসিত হয়, সেটা হলো কোয়েসারের সাথে ব্ল্যাক হোলের সংশ্লিষ্টতা। অর্থাৎ, কোয়েজারের এত বিপুল পরিমানের শক্তি নির্গমনের পেছনে কাজ করছে ব্ল্যাক হোল। ১৯৬৯ সালে বিজ্ঞানী ডোনাল্ড লিন্ডেন বেল প্রস্তাব করেন যে, গ্যালাক্সির কেন্দ্রগুলোতে সূর্যের চেয়েও এক মিলিয়ন থেকে এক বিলিয়ন গুন পর্যন্ত বড় সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের উপস্থিতি থাকতে পারে এবং মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেও এমনটা থাকতে পারে। পরে অবশ্য তিনি তার নিজের এই প্রস্তাবনার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, কিন্তু তার এই ধারণা অনেকেরই যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল।
স্যাজিটারিয়াস এ-স্টার (Sagittarius A*) মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের খুবই কাছে অবস্থিত, যেটা অনবরত রেডিও তরঙ্গের নির্গমন করেই যাচ্ছে। বিজ্ঞানী রেইনহার্ড গেঞ্জেল ও ডক্টর অ্যান্ড্রিয়া ঘেজ গত ত্রিশ বছর ধরে স্যাজিটারিয়াস এ-স্টার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এজন্য তারা বিভিন্ন নিত্যনতুন যন্ত্রপাতি ও পদ্ধতির আবিষ্কার ও প্রয়োগ করেছেন।পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাঁধা এবং গ্যালাক্সির কেন্দ্রের ডাস্টের পর্দা ভেদ করে তারা দেখার চেষ্টা করেছেন কেন্দ্রের নক্ষত্রগুলোর গতিপ্রকৃতি। ওই গতিপ্রকৃতি থেকেই ওনারা দেখিয়েছেন যে, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটা খুবই দানবাকার দৃঢ় বস্তুর উপস্থিতি থাকতে পারে। এই তিরিশ বছরে বিভিন্ন ল্যাবে এবং প্রকল্পের সাথে তারা যুক্ত ছিলেন। তাদের কাজ প্রত্যক্ষ্য ও পরোক্ষভাবে রেডিও অ্যাস্ট্রোনমির মতো শাখাগুলোকে আরো সমৃদ্ধতর করেছে।
ডক্টর রজার পেনরোজের কথা বলতে গেলে আমাদের বাংলাদেশী প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ডক্টর জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের কথাও বলতে হয়; তারা ভালো বন্ধু ছিলেন। আরেক নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালামের সাথে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টর জামাল নজরুল ইসলামের প্রতিষ্ঠিত গণিত ও ভৌত বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্রে এসেছিলেন ডক্টর রজার পেনরোজও। এমনকি ডক্টর জামাল নজরুল ইসলামের ভূয়সী প্রশংসা করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এমিরেটাস প্রফেসর’ করার জন্য তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলরকে একটি চিঠিও লেখেন ডক্টর পেনরোজ।
আমরা এমন একটা সময় পার করছি, যেখানে জ্যোতির্বিজ্ঞানের নানা অবিশ্বাস্য আবিষ্কার আমাদের প্রতিনিয়তই উদ্বেলিত করছে। প্রযুক্তির উন্নয়নে হয়তো সামনে আরো নতুন নতুন জিনিস আমরা জানবো। আমাদের জ্যোতির্বিজ্ঞানের জ্ঞানকে বিকশিত করে আরো এগিয়ে যাওয়ার পেছনে এই তিনজন নোবেলজয়ীর অবদান অসামান্য। এই নোবেল বিজয় তাদের দীর্ঘ গবেষণা জীবনেরও একটা দারুণ স্বীকৃতি। পদার্থবিদ্যার একজন ছাত্র হিসেবে তিনজন নোবেল বিজয়ীকে জানাই লেখকের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন।