১৫শ শতকের দিকে বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রে প্রাগ শহরে এক বিশালাকার অদ্ভুত ঘড়ি নির্মিত হলো। মহাকাশীয় ঘড়ি হিসেবে পরিচিত সেই ঘড়ি দেখতে যত না রহস্যময়, কারুকার্যে তার চেয়েও বেশি মনোমুগ্ধকর। লোকমুখে জানা গেলো এই ঘড়ি তৈরি করেছেন বিখ্যাত নির্মাতা হানোস। প্রাগের নগর কাউন্সিলরদের অনুরোধে তিনি এমন একটি ঘড়ি নির্মাণ করেছেন যার সাহায্যে সময় নির্ণয় করা ছাড়াও চন্দ্র, সূর্য, গ্রহের অবস্থান জানা যাবে। রাতদিন পরিশ্রম করে হানোস প্রাগের নগরপ্রাঙ্গনে এই অতিকায় ঘড়ি নির্মাণ করেছেন।
নগর কাউন্সিলরগণ যখন এই ঘড়ির দর্শন পেলেন তখন অভিভূত হয়ে পড়েন। এর আগে এমন সুন্দর ঘড়ি আর দ্বিতীয়টি দেখেননি। এই মুগ্ধতার সাথে মনের মাঝে হালকা ভয়ের উদ্রেক হলো। প্রাগের ঘড়ির দেখাদেখি হয়তো অন্য অঞ্চলেও এই ঘড়ি নির্মাণের প্রচেষ্টা হবে। কিন্তু সেটা হতে দেওয়া যাবে না। এমন ঘড়ি আর দ্বিতীয়টি হোক, কেউই চাইছিল না। আর তা নিশ্চিত করতে বেশ ঘৃণ্য একটি সিদ্ধান্ত নিল তারা। নির্মাতা হানোসকে অন্ধ করে দেওয়া যেন সে আর ঘড়ি নির্মাণ করতে না পারে।
কাউন্সিলের ভাড়া করা গুণ্ডারা রাতের আঁধারে আক্রমণ করলো হানোসকে। লোহার দণ্ড দিয়ে খুঁচিয়ে মহান নির্মাতা হানোসের চোখ উপড়ে ফেলা হলো। প্রাগ শহরকে বাকি শহর থেকে আলাদা করে তোলা এক ঘড়ি নির্মাণের পরিণাম হিসেবে তাকে বরণ করতে হলো অন্ধত্ব। অসহায় অন্ধ হানোস কাউন্সিলের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠলেন। কিছুটা সুস্থ হয়ে তার এক শিক্ষানবিসকে নিয়ে তিনি সেই ঘড়ির নিকট গেলেন। তারপর ঘড়িটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ একে একে অকেজো করে দিলেন। এভাবে প্রতিশোধ এবং হিংসার নিষ্ঠুর পরিণতিতে ইউরোপের অনন্য মহাকাশীয় ঘড়ির টিকটিক করা কাঁটা থেমে গিয়েছিল সেদিন। হানোসের অভিশাপ কিনা কে জানে, এই ঘড়ি পুনরায় চালু করতে প্রাগের লেগে গিয়েছিল সুদীর্ঘ একশত বছর! এরপর কেটে গেছে বেশ কয়েকটি শতক, তবে প্রাগের মহাকাশীয় ঘড়ি টিকটিক করে চলছে এখনও।
প্রাগের মহাকাশীয় ঘড়ি
মহাকাশীয় ঘড়ি (Astronomical Clock) হচ্ছে এমন একটি বিশেষ যন্ত্র, যার সাহায্যে মহাকাশের গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য নির্ণয় করা যায়। এর সাহায্যে জ্যোতিষ্কমণ্ডলের তারকারাজির অবস্থানও নির্ণয় করা যায়। এখানে উল্লেখ করা ঘড়িটি চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাগের সেই মহাকাশীয় ঘড়ির নাম হচ্ছে অরলোজ। অরলোজের সাহায্য তৎকালীন মানুষ সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র এবং ক্ষেত্রবিশেষে গ্রহের অবস্থান জানতে পারতো। এই তথ্য কাজে লাগিয়ে পঞ্জিকা নির্মাণ, উৎসবের দিনধার্য করাসহ গুরুত্বপূর্ণ কার্য পরিচালনা করা হতো। তবে অরলোজের কার্যক্ষমতা ছিল আরও ব্যাপক। কারণ, এই ঘড়ি মোটে দুটি অংশ ছিল। এক অংশে মহাকাশের যাবতীয় হিসাব-নিকাশ চললেও অপর অংশে সময়, তারিখ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যেত। নির্মাণের পর থেকেই নানান গল্পকাহিনী, গুজব, রহস্য, অভিশাপ নিয়ে ঘেরা এই ঘড়ি আজও সারাবিশ্বের নজর কাড়ছে এর অনন্য নির্মাণশৈলী এবং সূক্ষ্মতার কারণে। প্রাগের দর্শণার্থীদের প্রথম পছন্দ থাকে এই অতিকায় ঘড়ির দর্শন লাভ করা।
আসল নির্মাতা কে?
প্রাথমিকভাবে এর নির্মাতা হিসেবে হানোস নামক এক প্রাচীন ঘড়ি নির্মাতার নাম প্রচলিত ছিল। তবে ১৯৬১ সালে বেরিয়ে আসলো সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য। নতুন তথ্য অনুযায়ী ১৪১০ সালে কাদান শহরের ‘মিকুলাস’ নামক এক ঘড়ি নির্মাতার হাতে তৈরি হয়েছে এই বিখ্যাত ঘড়ি। জান সিডেল নামক এক জ্যোতির্বিদের গবেষণা থেকে এই তথ্য বেরিয়ে আসে। বিশেষজ্ঞদের নিরীক্ষার পর হানোস নয়, মিকুলাসকেই এই ঘড়ির আসল নির্মাতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। গবেষণায় আরো জানা যায়, হানোস সম্পর্কিত প্রচলিত তথ্যটি নিয়ে যথেষ্ট প্রমাণাদি না থাকায় তাকে আপাতদৃষ্টিতে লোককাহিনী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
নির্মাণের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রাগের অরলোজ ঘড়ি যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে অকেজো হয়ে পড়েছিল। তবে এর জটিল কলকব্জা মেরামত করা সহজ ছিল না। বিশেষ করে, ১৮শ শতকের শেষদিকে ঘড়িটি এমনভাবে অকেজো হয়ে পড়ে যে, তৎকালীন মিস্ত্রীরা একে ঠিক করতে ব্যর্থ হয়। তখন স্থানীয় নগর কর্তৃপক্ষ অরলোজকে সরিয়ে নতুন ঘড়ি নির্মাণের কথাও ভেবেছিলেন। তবে শেষপর্যন্ত সেই ভাবনা বাস্তবে রূপান্তরিত হয়নি। পরে ১৮৬৫ সালে ঘড়িটি মেরামত করা সম্ভব হয়েছিল। নতুন মেরামতের সাথে এর মধ্যে দিন-তারিখ হিসাব করার ব্যবস্থা সংযুক্ত করা হয়েছিল।
কীভাবে কাজ করে?
ঘড়ির মূল নির্মাতা এই ঘড়িকে বেশ কয়েকটি অংশে ভাগ করে নির্মাণ করেছেন। প্রতিটি অংশের কাজ ভিন্ন এবং সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। ঘড়িটি যখন নির্মিত হয়েছিল, তখন সৌরজগতের কেন্দ্র হিসেবে পৃথিবীকে গণ্য করা হতো। তাই ঘড়ির কেন্দ্রে রয়েছে আমাদের এই গ্রহ। কারুকার্যখচিত কাঁটা এবং ডায়ালের মাধ্যমে তাই ঘড়ির একটি অংশ পৃথিবীর পরিপ্রেক্ষিতে সূর্য এবং চন্দ্রের অবস্থান নির্দেশ করে। প্রাচীন চেক সময় এবং রোমান সময় গণনা- এই দুই পদ্ধতিতেই এই ঘড়ির মান নির্দেশ করা আছে।
ঘড়িটি যত কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা যাবে, তত বেশি তথ্য এর থেকে আহরণ করা সম্ভব হবে। ঘড়ির কেন্দ্রের দিকে রোমান হরফের বেশ কিছু ডায়াল চোখে পড়বে। দৈনিক ২৪ ঘণ্টার সময় নির্দেশ করাই এসব ডায়ালের উদ্দেশ্য। এই অংশের মূলদেহে ব্যবহৃত নীল এবং লাল বর্ণের সমন্বয়ে দিন, রাত, সূর্যাস্ত, সূর্যোদয়, অপরাহ্ন, মধ্যাহ্নসহ একদিনের বিভিন্ন ঘটনার সময়কাল নির্ণয় করা সম্ভব হয়। তাছাড়া বিষুবরেখা এবং ক্রান্তিয় রেখার হিসাব রাখতেও সক্ষম এই ঘড়ি। বিভিন্ন গ্রহণের সময় সূর্যের অবস্থান নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন রাশিচিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এই চিহ্নগুলো ঘড়ির কাঁটার বিপরীত ক্রমে সাজানো হয়েছে।
এর একটি আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে ডায়াল আর কাঁটার বাইরেও এর বেশকিছু অংশ রয়েছে যা দেখতে দর্শণার্থীদের ভিড় জমে। এর গায়ে রয়েছে ৮টি কাঠের মূর্তি বা পুতুল। যা ৪ পুণ্য এবং ৪ অশুভ বা অমঙ্গলের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ক্যালেন্ডারের ডায়ালের পাশে এদের দেখতে পাওয়া যাবে। ৪ অমঙ্গলের মধ্যে ‘মৃত্যু’কে চিহ্নিত করা এক কঙ্কাল মূর্তির দেখা মিলবে। এছাড়া খ্রিস্টান ধর্মমতে, যিশুখ্রিস্টের বিখ্যাত ‘দ্য লাস্ট সাপার’ এর সময় ১২ জন অনুসারীকে দূত বা বাণীপ্রচারক হিসেবে দেখানো হয়েছে। এখানে সেই ১২ জনের কাঠের মূর্তিও সংযুক্ত রয়েছে।
মূল দেহের ঠিক উপরে দুটি নীল দরজা রয়েছে। সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় একবার করে দরজাগুলো উন্মুক্ত হয়। আর তখন এই মূর্তিগুলো দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে সীমিত আকারে চলাচল করে ফের ভেতরে চলে যায়। যেমন, মৃত্যু মূর্তি যখন বেরিয়ে আসে, তখন সে ধাতুর তৈরি একটি ঘণ্টায় আঘাত করে শব্দ উৎপন্ন করে। আপনারা বুঝতেই পারছেন এর দ্বারা মৃত্যুঘণ্টাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
গুপ্ত বার্তার সন্ধান
প্রাগের অরলোজকে নিয়ে বিস্ময়ের অন্ত নেই। নির্মাণের কয়েকশত বছর পরেও সূক্ষ্মভাবে মহাকাশের নক্ষত্র, উপগ্রহের অবস্থান নির্ণয় যাচ্ছে এই ঘড়িটি। এছাড়া এর গায়ে ব্যবহৃত বাহারি রঙের কারুকাজ, কাঠের পুতুলের সংক্ষিপ্ত প্রদর্শনী এবং জটিল কলকব্জা শিল্প ও বিজ্ঞানের সমঝদারদের জন্য প্রশান্তির নিদর্শন হয়ে আছে। কয়েক বছর পর পর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এই ঘড়ির সরেজমিন মেরামত এবং সংস্কার সাধিত হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসেও এরকম একটি সংস্কার প্রকল্প পরিচালিত হয়েছিল। নিয়মানুযায়ী কর্মীরা ১২ দূতের মূর্তিগুলো পরিষ্কার করছিল। তখন একজন কর্মী দেখলেন একটি মূর্তি অন্যগুলোর চেয়ে কিছুটা ভারী লাগছে। ভারী মূর্তিটি ছিল সেন্ট থমাস নামক একজন দূতের প্রতিকৃতি। কর্তৃপক্ষের নজরে আনা হলে মূর্তিটি এক্স-রে করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। এক্স-রে প্রতিবেদনে দেখা গেলো এর অভ্যন্তরে ধাতব একটি বাক্স দেখা যাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ মূর্তিটি খুলে পরীক্ষা করা হলো। আর তখনই বের হয়ে আসলো শত বছরের লুকানো চিঠি।
এ যেন অতীত থেকে ভবিষ্যতের প্রতি লেখা কোনো বার্তা। কৌতূহলি হয়ে এই চিঠির পাঠোদ্ধার এবং উৎস জানার জন্য গবেষণাগারে পাঠানো হলো। পরীক্ষা করে দেখা গেলো এই বার্তার লেখক ছিলেন ভইতেক সুচার্দা নামক একজন ভাস্কর। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ঘড়ির মূর্তিগুলো সংস্কার এবং মেরামতের জন্য তাকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। তিনি একটি চিঠিতে ঘড়ি মেরামত এবং আরও বর্ধিত আকারে সংস্কার করার পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এছাড়াও দেশের অবস্থা এবং কমিউনিস্ট রাজনীতি নিয়ে বন্ধুসুলভ কিছু মন্তব্য ছিল সেখানে। সেই চিঠিটি পরবর্তীতে সেন্ট থমাসের মূর্তি থেকে উদ্ধার করা হয়। তবে কীভাবে এবং কেন এই চিরকুট এখানে লুকানো হয়েছিল তা বোঝা মুশকিল। এছাড়া চিঠি থেকে ঘড়ির পূর্ব সংস্করণ সম্পর্কে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। এমনকি ক্যালেন্ডার ডায়ালের কোনায় লুকানো বেশকিছু পাথরের ভাস্কর্যের সন্ধানও পাওয়া গেছে এই চিঠি থেকে।
অরলোজকে নিয়ে প্রচলিত রয়েছে শত শত অলৌকিক কাহিনী ও কল্পগাথা। অনেকে ধারণা করেন এই ঘড়ির সাথে নগরীর ভাগ্য নিবিড়ভাবে জড়িত রয়েছে। এজন্য কিছুটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষরা এই ঘড়িকে ‘দ্য ডেভিলস আই’ বা শয়তানের চোখ বলে অভিহিত করে। অবশ্য তাদের দোষ দেওয়ারও অবকাশ নেই। ইতিহাসে প্রাগ শহর যখনই কোনো দুর্যোগ বা বিপদের মুখে পড়েছে, অরলোজ ঘড়ি তার স্পন্দন থামিয়ে দিয়েছে। এমন অদ্ভুত কাণ্ড খুব বেশি দেখা যায় না। শেষবার এমনটি ঘটেছে ২০০২ সালের বন্যার সময়। বন্যাকবলিত প্রাগের এই ঐতিহাসিক ঘড়ি ‘অরলোজ’ অকেজো হয়ে পড়েছিল। অবশ্য এর পেছনে শহরের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াকেই দায়ী করবেন সবাই। তবে অনেকে বিশ্বাস করে এই ঘড়ি থেমে যাওয়া মানেই অশুভ কিছু। এমনকি ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঘড়িটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
মধ্যযুগে ঘড়িটি ধর্মগুরু, গণিতবিদ, জ্যোতিষীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের নিকট অপরিহার্য যন্ত্র ছিল। বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে, এই ঘড়িটি সৃষ্টিকর্তার দৈববাণী প্রকাশের একটি পবিত্র মাধ্যম। তাছাড়া আলকেমির সাধকরাও ঘড়িটির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ঘড়ির মূল নকশাতে ডায়াল আর কাঁটা ব্যতীত অতিরিক্ত কিছু ছিল না। তবে কালের আবর্তে এর সাথে যুক্ত হওয়া মূর্তিগুলোই আজ সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। ঘড়ির সামনে ভিড় জমানো দর্শনার্থীরা প্রতি ঘণ্টায় মৃত্যু মূর্তির ঘণ্টা বাজানো প্রদর্শনী দেহে মুগ্ধ হয়। তাছাড়া ঘড়ির দিকে মনোযোগ দিলে এর জটিল বিন্যাস এবং সূক্ষ্মতা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না।