পাখির মতো মুক্ত আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর ইচ্ছেটা মানুষের ভেতরে লালিত হচ্ছিল বহু আগে থেকেই। সে ইচ্ছে থেকেই কতজন কতকিছু করে দেখানোর চেষ্টা করে গেছেন; তার সবটা ইতিহাসের পাতায় না থাকলেও যেটুকু লিপিবদ্ধ আছে, সেটুকুই অবাক করবে আধুনিক বিজ্ঞানের এ যুগে বাস করা মানুষদের, করবে অনুপ্রাণিতও। অতীতের বহু চেষ্টার ফল হিসেবেই পৃথিবী পেয়েছে ভ্রানিয়েস বা সেবাস্তিয়ানের মতো মেধাবী-সাহসীদের, যাদের হাত ধরেই এসেছে প্যারাস্যুট।
এই প্যারাস্যুট নিয়ে কতজন দেখিয়েছেন কত বীরত্ব! ফেলিক্স বমগার্টনার নামের দুঃসাহসী স্কাইডাইভার সাহস দেখিয়েছেন ১ লক্ষ ২৮ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে মাটিতে লাফিয়ে পড়ার। স্কাইডাইভিংটা শখের হলেও প্যারাস্যুটই আজকের দিনে বিমান দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রধান সম্বল। এ বস্তু তৈরির ইতিহাসটা ছোট নয়।
জন্মকথন
প্যারাস্যুট প্রথম কবে কে তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন, তা স্পষ্টত জানা যায় না। বহু আগে থেকেই মানুষের মধ্যে ছিল উড়ে বেড়ানোর ইচ্ছে, সে হিসেবে বহু আগে থেকেই হয়তো প্যারাস্যুট তৈরির চেষ্টায় কাজ করছেন অনেকে। নবম শতকে আব্বাস ইবনে ফিরনাস যে সফলভাবে পাখির মতো উড়তে পেরেছিলেন, তা অনেকেই জানেন। তবে তার সে প্রচেষ্টা বর্তমান প্যারাস্যুটের মতো ছিল না। ১৪৭০ সালের রেনেসাঁ যুগের প্রাপ্ত একটি ইতালিয়ান হস্তশিল্পে পাওয়া যায় অনেকটা আজকের প্যারাসুটের মতোই একটি বস্তুসহ একজন মানুষের একটি ছবি।
১৪৮৫ সালের দিকে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি অনেকটা পিরামিড আকৃতির একটি প্যারাসুটের ছবি আঁকেন, যা রয়েছে তার ‘কোডেক্স অ্যাটল্যান্টিকাস’ নামক বইয়ে। পরবর্তীকালে ক্রোয়েশিয়ার ফাউস্ট ভ্রানিয়েইস ১৬১৭ সালে নিজের তৈরি প্যারাস্যুট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন ভেনিসের এক উঁচু টাওয়ার থেকে। তার এই পরীক্ষা সঠিকভাবে কাজ না করলেও প্রবল বায়ুপ্রবাহের কারণে বড় কোনো দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়নি তাকে।
১৮৭৩ সালে সফলভাবে প্রথম ব্যবহারযোগ্য প্যারাস্যুট তৈরি করেন লুইস সেবাস্তিয়ান। তার দু’ বছর পর ১৮৭৫ সালে জিয়েন ব্লানচার্ড একটি কুকুরকে বাক্সবন্দি করে সফলভাবে প্যারাস্যুটের প্রথম ব্যবহার করেন বলে জানা যায়। এরপর থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্নভাবে বিবর্তিত হয়ে প্যারাস্যুট আজকের রূপে এসেছে।
প্যারাস্যুট শব্দের প্রথম ব্যবহার
১৭৮৫ সালে লুইস সেবাস্তিয়েন ‘প্যারাস্যুট’ শব্দটি প্রথমবারের মতো ব্যবহার করেন। তিনি দুটি ফরাসি শব্দ ‘প্যারা’, যার অর্থ প্রতিরক্ষা এবং ‘স্যুট’, যার অর্থ পতন। দুটিকে একসাথে করে শব্দটি ব্যবহার করেন। এর শাব্দিক অর্থ- পতনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা।
প্যারাস্যুট জাম্পিং
২২ অক্টোবর ১৭৯৭; বলা হয়ে থাকে, এদিনই প্রথম প্যারাস্যুট জাম্প করেছিল কোনো মানুষ। সেখান থেকে এখন অব্দি প্যারাস্যুট জাম্প হয়েছে অসংখ্য। ১৯০৬ সালে চার্লস ব্রডউইক প্যারাস্যুট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আধুনিক প্যারাস্যুটের উন্নতি মানুষের দৃষ্টিতে আনেন। প্যারাস্যুট নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে ১৯১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মারা যান ফ্রেঞ্জ রেইচেল্ট নামক একজন। ২০১২ সালের ১৪ অক্টোবর, ফেলিক্স বমগার্টনার লাফিয়েছেন মহাশূন্য থেকে। প্যারাজাম্পিংয়ে এখন বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, নিত্যনতুন রেকর্ড গড়তে ব্যস্ত বহু স্কাইডাইভার, নিরাপত্তার কাজে ব্যবহার তো আছেই। শুধু মার্কিন আমেরিকাতেই ২০১৮ সালে ৩.৩ মিলিয়ন প্যারাস্যুট জাম্প রেকর্ড করা হয়েছে ।
কীভাবে কাজ করে?
ছোটবেলায় আমরা প্রায় সবাই বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনের মাথায় আপেল পড়ার ঘটনাটা শুনেছি, যা থেকে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন মহাকর্ষ বল। উপর থেকে ছেড়ে দেওয়া যেকোনো বস্তু নিচের দিকে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। কেন পড়বে, তার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তিনি। প্রতি সেকেন্ডে যেকোনো মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তু নিচের দিকে পড়বে ৯.৮ মিটার ত্বরণে। যত বেশি সময় নিয়ে তা নিচের দিকে পড়তে থাকবে, তত বেশি বেগ নিয়ে মাটি স্পর্শ করবে। একজন মানুষও যদি উপর থেকে মুক্তভাবে পড়ে, সে-ও একই নিয়ম মানতে বাধ্য হবে।
এ নিয়ম অনুযায়ী, একটি পাখির পালক আর একটি বড়সড় পাথরকেও যদি উপর থেকে ছেড়ে দেয়া হয়, তাদেরও সমান সময়ে মাটি স্পর্শ করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না; পাথরটাই আগে পৌঁছায়, কারণ বাতাসের বাধাকে এটি পাখির পালকের থেকে বেশি ভালোভাবে পরাস্ত করতে পারে। যে বস্তুর বাতাসের বাধা কাটিয়ে নেয়ার ক্ষমতা যত কম, সেটি তত ধীরে নিচের দিকে পড়বে। বিপরীতভাবে বলতে গেলে, যে বস্তুর উপর বাতাসের বাধা যত বেশি, সে বস্তু তত ধীরে নিচের দিকে পড়বে। প্যারাস্যুট মূলত এই বাধা বাড়ানোর কাজটিই করে থাকে। মহাকর্ষের বিপক্ষে বেশিক্ষণ ভেসে থাকতে বাতাসকে কাজে লাগায় এটি।
কিন্তু সামান্য বাতাসের বাধার ক্ষেত্রে কী হয়? পানিতে সাঁতার কাটার সময় অবশ্যই আপনার বিপরীতে পানি আপনার উপর বল প্রয়োগ করে খুব ভালোভাবেই। বাতাসের বাধাটা অবশ্য তার থেকে অনেক কম, তাই পানির বাধার মতো করে বোঝা যায় না; কিন্তু বাধা ঠিকই আছে। এই বাধা যতটা বাড়ানো যাবে, কোনো বস্তু উপর থেকে নিচের দিকে তত ধীরে পড়বে। প্যারাস্যুট সে কাজই করে। প্যারাস্যুট প্রান্তিক বেগ কমিয়ে দিয়ে মানুষকে নিরাপদে মাটিতে পা ছোঁয়ানোর কাজ করে থাকে। প্যারাস্যুটের মূল নকশা করা হয়েছে এ বেগ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দেয়ার মতো করেই।
এ বাতাসকে কাজে লাগিয়ে অভিকর্ষজ ত্বরণ আর বেগকে বুড়ো আঙুল দেখানোর কাজটা করে থাকে মূলত প্যারাসুট উইং বা প্যারাসুটের ডানা। উড়তে থাকা মানুষটির হাতে থাকা স্টিয়ারিং দিয়ে উইংয়ের আকার-আকৃতি পরিবর্তন করার মাধ্যমে পরিবর্তন ঘটে দিকের। উইংগুলো মূলত অর্ধভেদ্য। ওড়ার সময় এগুলো অনেকটা কঠিন পদার্থের মতো আচরণ করে থাকে। মূলত সাত থেকে নয়টি আলাদা আলাদা বায়ুভর্তিযোগ্য সেল একত্র করেই তৈরি হয় মডার্ন প্যারাসুট উইং, ওড়ার সময় যেগুলো কাজ করে একত্রে। প্রত্যেক সেলের সামনের দিকটা কিছুটা উন্মুক্ত, যেখান দিয়ে বাতাস প্রবেশ করে সেলগুলোর ভেতরে। গঠনটি আধুনিক প্যারাস্যুটের। কিন্তু ছোটবেলায় আমরা যে প্যারাস্যুটগুলো বেশি দেখতাম, সেখানে সেল ছিল না, সেগুলো ছিলো অনেকটা গোলাকার; একটি ফোলানো বেলুনের অর্ধেকের মতো।
বর্তমানে আয়তাকার বায়ুভর্তি সেলযুক্ত প্যারাস্যুটগুলো অধিকতর ব্যবহৃত হলেও মিলিটারি ক্ষেত্রসমূহে গোলাকার সেই অর্ধেক বেলুনাকৃতির প্যারাসুট এখনো ব্যবহৃত হয়। এর প্রধান একটি কারণ হলো, এই প্যারাস্যুট ব্যবহার করে অল্প জায়গায় অধিক ব্যক্তি ভালোভাবে অবতরণ করতে পারে।
মূলত ১০টি অংশ নিয়ে রাউন্ডেড প্যারাস্যুটগুলো তৈরি করা হয়ে থাকে। একেবারে উপরে থাকে পাইলট স্যুট, যেটি দিয়ে মূল প্যারাস্যুট খোলা হয়ে থাকে। পাইলট স্যুট ও মূল প্যারাস্যুট যুক্ত থাকে ব্রিডলের মাধ্যমে। প্যারাস্যুটের মূল অংশকে বলা হয় ক্যানোপি। এছাড়াও থাকে স্কার্ট, সাসপেনসন লাইন, কন্ট্রোল লাইনসহ আরও অনেকগুলো অংশ।
আধুনিক প্যারাস্যুট হোক কিংবা পুরনো, সবগুলোই থাকে কনটেইনার নামক এক ব্যাগপ্যাকে। এতে থাকে দু’টি প্যারাস্যুট। একটি যদি কোনো কারণে কাজ না করে, তবে দ্বিতীয়টি খোলা হয়; একে বলা হয় রিজার্ভ প্যারাসুট। যদিও প্রতি হাজারে প্রায় ৯৯৯টি প্যারাস্যুট প্রথম চেষ্টাতেই খুলে যায়, তবুও নিরাপত্তার জন্য রিজার্ভ প্যারাসুট রাখা হয়ে থাকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে।
প্যারাস্যুট প্যাকিং
প্যারাস্যুটকে কনটেইনারে প্যাক করার কাজ করতে প্রয়োজন হয় বিশেষ সার্টিফিকেটের। স্কাইডাইভারের নিরাপত্তার স্বার্থে রিজর্ভ প্যারাসুট প্যাকিংয়ের কাজ একটু বেশিই জটিল প্রক্রিয়ায় করা হয়ে থাকে। রিজার্ভ প্যারাসুট প্যাক করতে পারে শুধু FAA সার্টিফিকেট প্রাপ্তরা। এ সার্টিফিকেট পেতে হলে একজন আগ্রহীকে কমপক্ষে ১৮ বছর বয়সী হতে হবে, সেইসাথে ভালো দক্ষতা থাকতে হবে ইংরেজিতে। এরপর ২০টি রিজার্ভ প্যারাসুট সফলভাবে প্যাক করতে পারলেই কেবল মিলবে FAA সার্টিফিকেট। বলে রাখা ভালো, স্কাইভাইডিংয়ের লাইসেন্স পেতে হলে আগে প্যারাসুট প্যাকিংয়ের সার্টিফিকেট অর্জন করতে হয়। একজন স্কাইডাইভার নিজেও রিজার্ভ প্যারাসুট প্যাক করতে পারবেন না। প্যাকিংয়ে সাধারণত ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মতো সময় প্রয়োজন হয়ে থাকে।
সব মিলিয়ে প্যারাস্যুট কীভাবে কাজ করে, তা সম্পূর্ণরূপে ব্যাখা করাটা জটিল; তবে, মূল কাজটা কী, তা বলার চেষ্টা করা হয়েছে এখানে। বায়ুর বাধাকে কাজে লাগিয়ে স্কাইডাইভারের অভিকর্ষজ ত্বরণ কমিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে মানুষকে নিচের দিকে নামানোটাই এর মূল কাজ। প্যারাস্যুট একজন স্কাইডাইভারের গতিকে কমিয়ে সেটাকে অবতরণের মুহূর্তে সেকেন্ডে ৫ থেকে ৬ মিটার বা ঘণ্টায় ১২ মাইল করে দেয়; যাতে করে মাটিতে পা ছোঁয়ানোর সাথে সাথেই তিনি স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে বা কিছুটা দৌড়াতে পারেন। আর সেইসাথে দু’হাত প্রশস্ত করে দিগ্বিদিক ছড়িয়ে দিয়ে রোমাঞ্চ, উচ্ছ্বাস আর সাহসের সঞ্চার ঘটে নব্য স্কাইডাইভারদের মনে।