পিটার প্যান সিনড্রোম: বড় হতে না চাওয়ার একটি রোগ

রাশেদ ছেলেটা একদম অন্যরকম। সে কখনোই তার আশেপাশের কোনো মানুষ কিংবা ঘটনার সাথে পুরোপুরি সম্পৃক্ত হয় না। কর্মক্ষেত্রেও সে একদমই স্থিতিশীল নয়, কিছুদিন পরপরই চাকরি পরিবর্তন করে। আর তাই তার জীবনে অর্থনৈতিক সঙ্কটও লেগেই থাকে।

যেকোনো ক্ষেত্রে সে তার সমপর্যায়ের মানুষদের চেয়ে একধাপ পিছিয়ে পড়ে। বিয়ে করে সংসার শুরু করা ও পরিবার গঠনের চিন্তাকে সে পাত্তাই দেয় না, অথচ সবসময় একাকীত্বে ভোগে। আর সেই একাকীত্ব দূর করতে গিয়ে সে হয়ে পড়ে মাদকাসক্ত। বাস্তবতার মুখোমুখি হতে চায় না সে, এসব থেকে পালাতে পারলেই যেন বাঁচে।

রাশেদের এই অদ্ভুত চরিত্রকে সংজ্ঞায়িত করা যায় পিটার প্যান সিনড্রোমের সাথে। পিটার প্যান সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তি হলো তারা, যারা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও জাগতিক সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে, সমাজ সংসারের অংশ হওয়ার পরিবর্তে সেখান থেকে মুক্তির পথ খোঁজে।

পিটার প্যান বড় হতে চায় না; Image Credit: Mariah Cornell via Pinterest

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তারা বড় হতে বা সাবালকত্ব লাভ করতে চায় না। তারা অনেকটা বইয়ের পাতার পিটার প্যানের মতোই ভাবে:

“স্বপ্ন সত্যি হয়, শুধু যদি আমরা তীব্রভাবে তাদের কামনা করি।”

কিন্তু তারা বুঝতে চায় না, স্বপ্ন সবার ক্ষেত্রে সত্যি হয় না। স্বপ্ন সত্যি হয় শুধু তাদের, যারা কেবল স্বপ্ন দেখাতেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখে না, বরং সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে কঠোর পরিশ্রমও করে।

আর এই না বোঝার ফল হয় মারাত্মক। একটি সুন্দর-সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে তারা নিজ হাতে গলা টিপে মারে। ক্যারিয়ারে যেমন তারা কখনোই নিজেদের যোগ্যতার সমতুল্য অবস্থানে পৌঁছাতে পারে না, তেমনই তারা ব্যর্থ হয় ব্যক্তিজীবনে কোনো অর্থবহ ও টেকসই সম্পর্ক গড়ে তুলতেও।

এভাবেই সম্ভাবনাময় ২০ বছরের টগবগে তরুণেরা পরিণত হয় অসুখী, শেকড়বিহীন ৪০ বছরের মধ্যবয়স্কে, কিংবা খিটখিটে, বদমেজাজি ৬০ বছরের বৃদ্ধে।

‘পুরুষরা আক্রান্ত হয় বেশি’

ইউনিভার্সিটি অফ গ্রানাডা হতে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, পিটার প্যান সিনড্রোমে নারী-পুরুষ উভয়েই আক্রান্ত হতে পারে, তবে নারীদের তুলনায় পুরুষদের এই সিনড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। কিংবা বলা যেতে পারে, পিটার প্যান সিনড্রোমে আক্রান্তদের বেশিরভাগই পুরুষ। 

পুরুষরা পিটার প্যান সিনড্রোমে আক্রান্ত হয় বেশি; Image Source: Getty Images

এর পেছনে প্রধান কারণ হতে পারে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, যেখানে আজো নারীদের চেয়ে পুরুষদের কাঁধেই বেশি দায়িত্বের বোঝা চাপে। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও অনেক পুরুষই সেই চাপ সামলানোর যোগ্য হয়ে ওঠে না, ফলে তাদের মাঝে সমস্যাটি দেখা যায়।

যেমন: ৩০ বছর বয়সী একজন পুরুষের কাছে হয়তো দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করা হচ্ছে, কিন্তু মানসিকভাবে সে এখনো একজন কিশোর রয়ে গেছে। তাই সে ভাবছে, তার উপর অর্পিত দায়িত্বগুলো অন্য কেউ পালন করে দেবে, যেমনটি বড়রা করত সে কিশোর বয়সী থাকতে।

আবার নারীদের পিটার প্যান সিনড্রোমে কম ভোগার পেছনে বড় কারণ হতে পারে নারীদের মানসিক পরিপক্বতাও। পুরুষদের চেয়ে নারীরা মানসিকভাবে দ্রুত পরিণত ও বাস্তববাদী হয়ে ওঠে, ফলে যেকোনো বাস্তব পরিস্থিতিতে পুরুষদের চেয়ে তারাই আগে সাড়া দেয়, এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে নিজেদের অভিযোজিত করতে পারে।

লক্ষণ ও উপসর্গ

পিটার প্যান সিনড্রোমের সকল লক্ষণ ও উপসর্গই দুইটি বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত:

  • স্বাভাবিক কর্মজীবন পরিচালনা ও সম্পর্ক রক্ষায় ব্যর্থতা

  • যেকোনো দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাওয়ার মানসিকতা

এবার আপনাদের সামনে তুলে ধরব পিটার প্যান সিনড্রোমের প্রধান কিছু উপসর্গ। একজনের মাঝেই হয়তো এই সকল উপসর্গ বিদ্যমান নয়। কিন্তু যদি কোনো ব্যক্তির মাঝে নিম্নলিখিত উপসর্গগুলোর অধিকাংশই দেখা যায়, তাহলে ধরে নেয়া যেতেই পারে যে সে-ও একজন পিটার প্যান।

স্থায়ী ক্যারিয়ার গঠনে ব্যর্থতা

এমন নয় যে পিটার প্যান সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা দক্ষতার বিচারে অন্যদের চেয়ে কোনো অংশে কম। বরং তাদের পক্ষে অপেক্ষাকৃত বেশি দক্ষ ও মেধাবী হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, সাধারণ মানুষের মধ্যে বয়সের সাথে সাথে পরিপক্বতা আসে। ফলে তারা বুঝতে পারে কর্মক্ষেত্রে সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে, নিজের ছোট ছোট খারাপ লাগাকে অবদমিত রেখে কীভাবে কাজ করে যেতে হয়। কিন্তু মানসিক পরিপক্বতার অভাবে পিটার প্যানরা তা বুঝতে পারে না। অল্পতেই তারা ধৈর্য হারায়, হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে, পরিশেষে কাজের সুযোগ হারায়। এভাবে বারবার কর্মক্ষেত্র পরিবর্তনের কারণে তাদের পক্ষে একটি স্থায়ী ক্যারিয়ার গঠনও সম্ভব হয় না।

পিটার প্যানরা এক কাজে বেশিদিন স্থায়ী হতে পারে না; Image Source: Paul Bradbury/Getty Images

অর্থনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণে ব্যর্থতা

স্থায়ী ক্যারিয়ার গঠনে ব্যর্থ হওয়ার ফলে পিটার প্যানদের সবসময় টাকা-পয়সার টানাটানিও লেগেই থাকে। অর্থনৈতিকভাবেও তারা খুব কম সময়ই স্থিতিশীল হয়ে থাকে। আবার এটিও বললে ভুল হবে না যে, পিটার প্যানরা অর্থনৈতিক দায়িত্বশীলতার প্রয়োজনীয়তাটাও উপলব্ধি করতে পারে না। কারণ তা যদি তারা পারতই, তাহলে অন্তত টাকার কথা চিন্তা করে হলেও তারা কর্মক্ষেত্রে আরো বেশি সাবধান হতো, ঝোঁকের মাথায় কিছুদিন পরপরই চাকরি ছেড়ে দিত না।

এক কাজে বেশিদিন মন বসাতে ব্যর্থতা

পিটার প্যানরা যে শুধু কর্মক্ষেত্রেই বেশিদিন মন বসাতে ব্যর্থ হয়, তা কিন্তু নয়। যেকোনো শখ বা পছন্দসই কাজেও তারা খুব বেশিদিন আগ্রহ ধরে রাখতে পারে না। আজ হয়তো তাদের নতুন কোনো একটি কাজ ভালো লেগে গেল। তাই পরের কয়েকদিন খুব উৎসাহের সাথে তারা কাজটি করল। কিন্তু এরপরই কাজটির প্রতি তাদের বিরক্তি ধরে গেল। এবং কাজটিকে তারা একেবারে ‘টা-টা বাই বাই’ বলে দিল। বিষয়টি অনেকটা ছোট বাচ্চাদের খেলনা নিয়ে খেলার মতো। নতুন কোনো খেলনা পাওয়ার পর তারা কয়েকদিন মহানন্দে সেটি নিয়ে খেলতে থাকে, কিন্তু এরপর আর সেটির দিকে ফিরেও তাকায় না।

অবাস্তব স্বপ্ন দেখা

পিটার প্যানরা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। কারণ স্বপ্ন দেখতে তো কোনো পরিশ্রম নেই, কষ্টও নেই। তাছাড়া তারা মনে করে, স্বপ্ন দেখার মাধ্যমেই অসম্ভবকে সম্ভব করা সম্ভব। আর তাই নির্দ্বিধায় অবাস্তব স্বপ্ন ও অলীক কল্পনায় দিন গুজরান করতে থাকে তারা। কিন্তু তাদের কাজের পরিধি এই স্বপ্ন দেখা ও কল্পনা করাতেই সীমাবদ্ধ। সেগুলোকে বাস্তবে রূপ দেয়ার কোনো চেষ্টাই তারা করে না। কীভাবেই বা করবে, কীভাবে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হয়, সেটিই তো তারা জানে না!

পিটার প্যানদের সময় কাটে অবাস্তব স্বপ্ন দেখে; Image Source: Shutterstock

লিঙ্গভিত্তিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা

নারী-পুরুষ সমান হলেও, উভয় লিঙ্গের কিছু স্বতন্ত্র দায়িত্ব রয়েছে, যেগুলো পালন করাকে সামাজিকভাবে জরুরি বলে মনে করা হয়। কিন্তু একজন পিটার প্যান নিজের লিঙ্গভিত্তিক সেসব দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়। পুরুষদের মাঝেই সেটি বেশি দেখা যায়। কেননা ছোটবেলা থেকেই নারীদের উপর জোর করে অনেক দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয় ও তাদের সেগুলো পালনে বাধ্য করা হয়। না চাইলেও নারীদের সেগুলো করতেই হয়। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর পুরুষদের আর চাইলেই সেগুলো করতে বাধ্য করা যায় না। তাই দেখা যায় সমবয়সী দুজন নারী-পুরুষের মাঝে নারীটিই তার নির্দিষ্ট লিঙ্গভিত্তিক দায়িত্ব বেশি পালন করছে।

ঘরের কাজে উদাসীনতা

শুধু কর্মক্ষেত্রেই নয়, নিজগৃহেও পিটার প্যানরা দায়িত্ব পালনে ভীষণ রকমের উদাসীন। বাজার-সদাই করা, বিদ্যুৎ বা পানির বিল দেয়া, কিংবা ঘর মোছা, খাবার তৈরি করা — এ ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালন থেকেও বিরত থাকে পিটার প্যানরা। তারা আশা করে, তাদের সঙ্গী বা পরিবারের অন্যরাই তাদের হয়ে কাজগুলো করে দেবে।

সম্পর্ক তৈরিতে অনীহা

একটি সম্পর্ক তৈরির সাথে আসে নানা ধরনের দায়িত্ব ও অঙ্গীকার। কিন্তু এই বিষয়গুলোকে খুব ভয় পায় পিটার প্যানরা। তাই কারো সাথে সম্পর্ক তৈরিকে তারা বাড়তি ঝামেলা বলে মনে করে। তাদের মনে হয়, কী দরকার এসব জটিলতায় যাওয়ার, তার থেকে নিজের মতো করে জীবনটা কাটিয়ে দেয়াই তো ভালো! এমন চিন্তার কারণেই তারা সহজে কারো সাথে রোমান্টিক সম্পর্ক করতে পারে না। আবার যারা ইতিমধ্যেই রোমান্টিক সম্পর্কে আছে, তারা সেটিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে, অর্থাৎ বিয়ে করতে চায় না। আবার বিয়ের পরও অনেকে অতিরিক্ত দায়িত্বের ভয়ে সন্তান নিতে চায় না।

পিটার প্যানরা ভয় পায় সম্পর্ক তৈরিতে; Image Source: Antonio Guillem/123rf

স্মৃতিকাতরতা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়

মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য সামনের দিকে এগিয়ে চলা। কিন্তু পিটার প্যানরা ব্যতিক্রম। তারা বর্তমানকে উপভোগ করে না, ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তা করতে ভয় পায়। বরং পেছন ফিরে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতে, অতীতে তারা কত সুখী ছিল তা ভাবতেই বেশি পছন্দ করে। এর পেছনে একটি সম্ভাব্য কারণ হলো, শৈশবে বা কৈশোরে তারা নিজেদের খেয়াল-খুশি অনুযায়ী চলতে পেরেছে। কোনো দায়িত্ব পালনের চিন্তা তাদের করতে হয়নি। তাই জীবনের সেই সময়গুলো তাদের কাছে উপভোগ্য ছিল। কিন্তু বর্তমানে তাদেরকে নানা দায়িত্ব পালন করতে হয়, এবং ভবিষ্যতেও করে যেতে হবে, এই চিন্তাগুলোই তাদেরকে জীবন বিমুখ করে দেয়

মাদকাসক্তি

পিটার প্যানরা কোনো দায়িত্ব পালন করে না ঠিকই, কিন্তু সেজন্য নিজেদের কাছেই তারা সবসময় ছোট হয়ে থাকে, আর বাস্তবতার কথা চিন্তা করে উদ্বিগ্নও হয়। এই উদ্বেগ থেকে তারা বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করে। তাছাড়া বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বাঁচার প্রবণতা তো রয়েছেই। ক্ষণিকের মানসিক প্রশান্তি ও বাস্তবতা থেকে পলায়নের উদ্দেশ্যে তাই তারা আশ্রয় খোঁজে মাদকে। এক পর্যায়ে তাদের মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তাদের জীবনের যেটুকু যা সম্ভাবনা অবশিষ্ট ছিল, সেগুলোরও অপমৃত্যু ঘটে।

বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বাঁচতে পিটার প্যানরা হয়ে পড়ে মাদকাসক্ত; Image Source: 123RF/Ronstik

অন্যদের দায়ী করা

পিটার প্যানরা জাগতিক সকল দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকার তো করেই, এমনকি নিজেদের জীবনের ব্যর্থতার দায়ভারও তারা নিজেরা নিতে চায় না। সেই দায়ও তারা অন্য কারো উপর চাপিয়ে দিতে চায়। তারা যে জীবনে বড় কিছু করতে পারেনি, পদে পদে হোঁচট খেয়েছে, এজন্য তারা আশেপাশের সবাইকে দায়ী করে। বাবা-মা, ভাই-বোন, শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব, প্রেমিক-প্রেমিকা, জীবনসঙ্গী, সন্তান, অফিসের বস — কেউই বাদ যায় না তাদের রোষানল থেকে। সবাইকেই তারা নিজেদের শত্রু বলে মনে করে, এবং এই শত্রুদের কারণেই তারা জীবনে কিছু করতে পারেনি, এমন চিন্তাভাবনার মাধ্যমে কিছুটা সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে নিজেদের।

কারা পিটার প্যান নয়?

যেকোনো উদাহরণের সাথে নিজেদের মিল খুঁজে পাওয়া মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এতক্ষণ পিটার প্যান সিনড্রোমের উপসর্গগুলো সম্পর্কে জানার পরও হয়তো অনেকের মনে হচ্ছে, “আমার সাথে তো এই উদাহরণগুলো মিলে যায়। তাহলে আমিও কি একজন পিটার প্যান?”

যারা এমনটি ভাবছেন, তারা জেনে স্বস্তিবোধ করতে পারেন, দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি কিংবা সারাজীবন ছোট থাকার ইচ্ছা শুধু পিটার প্যানদের একক মালিকানাধীন বৈশিষ্ট্য নয়। কমবেশি সব মানুষের মাঝেই এই বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যায়। সুতরাং আপনার মাঝেও এই বৈশিষ্ট্যগুলো রয়েছে বলেই যে আপনিও একজন পিটার প্যান, এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই।

দায়িত্ব গ্রহণে ভয় মানেই পিটার প্যান সিনড্রোম নয়; Image Source: unsplash.com/@axellvak

আপনি হয়তো দায়িত্ব পালনে শুরুতে অস্বীকৃতি জানান, যেমনটি আরো অনেকেই করে থাকে। কিন্তু আপনি শেষ পর্যন্ত দায়িত্বটি পালন করেন তো? যদি উত্তর হয় হ্যাঁ, তাহলে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, আপনি পিটার প্যান নন। আবার দুঃসময়ে বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বাঁচার কথা মনে হলেও, পরে ঠিকই নিজের মনকে মানিয়ে নিতে পারেন তো? বাস্তবতাকে মোকাবেলা করেন তো? যদি উত্তর হয় হ্যাঁ, তাহলে আপনি পিটার প্যান নন। আবার বড় হতে না চাওয়া, চিরদিন ছোট থাকতে চাওয়া, অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করা? এগুলোও মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। এসব মানসিকতা থাকা সত্ত্বেও যদি আপনি বর্তমানকে উপভোগ করতে পারেন, ভবিষ্যতের ব্যাপারে সচেতন হন, সর্বোপরি বাস্তবতাকে স্বীকার করার সৎ সাহস রাখেন, তাহলে আপনি পিটার প্যান নন।

পিটার প্যান সিনড্রোমের কারণ কী?

ঠিক কী কী কারণে একজন মানুষ হয়ে ওঠে পিটার প্যান? এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো কার্যকারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে মনোবিজ্ঞানীরা এ ধরনের সিনড্রোমের পেছনে বেশ কিছু কারণকে দায়ী করে থাকেন।

প্রথমত, যেসব শিশুকে ছোটবেলা থেকে বাবা-মা অনেক বেশি শাসনে বা আদরে রাখে, কিছু করতে দেয় না, তারা ক্রমশ পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তারা ভাবে, তাদের কাজগুলো সবসময় অন্যরাই করে দেবে। ফলে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও তারা আত্মনির্ভরশীল ও স্বাবলম্বী হতে পারে না।

দ্বিতীয়ত, যেসব শিশুদের ছোটবেলায় একা একা কাটে, কোনো সমবয়সী বন্ধুবান্ধব থাকে না, তারা নিজেদের তৈরি করা এক কাল্পনিক জগতে বিচরণ করে। বড় হওয়ার পরও তাদের পক্ষে সেই কল্পনার দুনিয়া থেকে বাস্তব দুনিয়ায় ফিরে আসা সম্ভব হয় না।

তৃতীয়ত, কোনো শিশু যদি ছোটবেলায় খুব বাজে কোনো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়, যেমন তার বাবা-মায়ের মধ্যে অশান্তি চলে বা তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়, কিংবা শিশুটি (ছেলে কিংবা মেয়ে) যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সে এক ধরনের ট্রমার মধ্য দিয়ে যায়। তার মনে নানা ধরনের অসুখ বাসা বাঁধে। এগুলো থেকে বাঁচতে সে নিজের মনেই এক ধরনের বিকল্প দুনিয়া তৈরি করে নেয়, যেখানে সে নিজেকে সুখী কল্পনা করে। এদিকে বাস্তব দুনিয়ার প্রতি তার মনে গভীর ঘৃণা বা ভীতি জন্মায়। তাই বাস্তব দুনিয়ার কারো সাথেই সে ভালো করে মিশতে পারে না, কোনো কাজ সহজভাবে করতে পারে না, কোনো দায়িত্ব গ্রহণের সাহস করে উঠতে পারে না।

আপনার করণীয় কী?

এতক্ষণ এই লেখাটি যারা মনোযোগ সহকারে পড়লেন, তাদের অনেকেই হয়তো এখন নিজেকে পিটার প্যান ভাবতে শুরু করেছেন। কিংবা আপনার পরিচিত কাউকেও আপনার পিটার প্যান বলে মনে হতে পারে। তাছাড়া পিটার প্যানে পরিণত হওয়ার কারণগুলো জানার পর আপনার পরিচিত কোনো শিশুর কথাও মনে হতে পারে, যে হয়তো ভবিষ্যতে পিটার প্যানে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

যদি আপনি নিজেকে, বা কাছের কোনো মানুষকে পিটার প্যান বলে মনে করেন, তাহলে আপনার উচিৎ হবে অতিসত্বর কোনো মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। কেউ যদি পিটার প্যান হয়, সেই দোষ কেবল তার নিজের নয়, তারও অধিকার আছে একটি সুস্থ জীবন লাভের। আর সেই সুস্থ জীবন লাভে সাহায্য করতে পারেন মনোচিকিৎসকের।

আর যদি আপনার মনে হয় আপনার পরিচিত কোনো শিশু অস্বাভাবিক আচরণ করছে, জানার চেষ্টা করুন তার এমন আচরণের কারণ কী। যদি সম্ভব হয় তার ঘনিষ্ঠ হোন, তার বিশ্বাস অর্জন করুন। হতে পারে বিশ্বাসযোগ্য ও সহানুভূতিশীল কারো সান্নিধ্য তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে। আর যদি আপনার মনে হয় শিশুর অস্বাভাবিকত্বের পেছনে তার বাবা-মা বা অভিভাবকের দায় আছে, তাহলে এই লেখাটি পড়তে দিতে পারেন তাদেরও। সর্বোপরি শিশুটির অবস্থা যদি খুব খারাপ হয়, তাহলে তাকেও একজন মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া আবশ্যক।

বিজ্ঞানের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/

This article is in Bengali language. It is about the Peter Pan Syndrome. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © Disney

Related Articles

Exit mobile version