মনে করুন, আপনি আপনার খুব পছন্দের একজন মানুষের সাথে বসে আছেন। অনেকদিন পর তার সাথে দেখা হলো, তাই আপনার মনে অনেক কথা জমে আছে। তাকে সেসব কথা বলার জন্য আপনি উসখুস করছেন। কিন্তু হায়! আপনার কথা শোনার বদলে, সে নিজের মোবাইল বের করে চাপতে শুরু করেছে।
খুব সম্ভবত ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করছে কিংবা হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজ চেক করছে সে। খুব জরুরি কোনো কাজ নয়। এমনও নয় যে কাজটা এখনই করতে হবে, না করলে পৃথিবীতে মহাপ্রলয় সৃষ্টি হবে।
কিন্তু তার কাছে মনে হয়েছে, আপনার সাথে কথা বলার চাইতে মোবাইলে ওসব করা তার জন্য এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই কী আর করা! “চলি রে, আবার দেখা হবে,” বলে আপনি ওই স্থান থেকে চলে আসলেন। কিন্তু মনে মনে খুব কষ্টও পেলেন। অনেক অপমানিত হলেন। সারাদিন আপনার মনের মধ্যে একটা কথাই ভাঙা রেকর্ডের মতো বাজতে লাগল, “আমার চেয়ে মোবাইলটা ওর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল!”
ফাবিং কী?
এতক্ষণ যে দৃশ্যপটটির কথা বললাম, এর সাথে নিশ্চয়ই আপনারা সকলেই পরিচিত। নিশ্চয়ই প্রায় সময়ই আপনারা এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। কিংবা কে জানে, এমনও হতে পারে যে আপনাদের কারণেই হয়তো কাউকে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। অর্থাৎ আপনি যে ভূমিকাতেই থাকুন না কেন, এমন অভিজ্ঞতা আপনার হয়েছেই।
এই যে ব্যাপারটি, অর্থাৎ কারো উপস্থিতিতে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া, এটির কিন্তু একটি নির্দিষ্ট নামও রয়েছে। একে বলা হয় ‘ফাবিং’ (Phubbing). ইংরেজি শব্দ Phone (ফোন) ও Snubbing (অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ) মিলে তৈরি হয়েছে ফাবিং শব্দটি। সুতরাং, ফোনের প্রতি মনোযোগ দিতে গিয়ে যখন আমরা সামনে থাকা রক্ত-মাংসের মানুষটিকে অবজ্ঞা করি, তখন সেটিকে বলা হয় ফাবিং।
ফাবিং যখন মারাত্মক একটি অভ্যাস
আপাতদৃষ্টিতে ফাবিংকে খুবই নিষ্পাপ একটি আচরণিক বৈশিষ্ট্য বলে মনে হতে পারে। অনেকেই ভেবে বসতে পারেন, “সারাক্ষণ কারো মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় নাকি? একটু যদি মোবাইলটা হাতে নিই, মেসেঞ্জারটা বা ইনস্টাগ্রামটা খুলে দেখি কোনো আপডেট আছে কি না, তাতে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে!”
কিন্তু না পাঠক। যতটা সাদামাটা, অতি সাধারণ একটি অভ্যাস বলে ভাবছেন ফাবিংকে, আদতে তা নয়। বরং খুবই মারাত্মক একটি অভ্যাস একটি, যা কোনো একসময়ে আপনার সম্পর্ক ভাঙা বা জীবন বিষিয়ে ওঠার অন্যতম প্রধান কারণে পরিণত হতে পারে।
ঘনিষ্ঠতা নষ্ট করে
শুনতে রূঢ় শোনাতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো: আপনি যখন আপনার সামনে থাকা মানুষটির বদলে নিজের মোবাইলের দিকে মুখ গুঁজে বসে থাকেন, তখন আপনি নিজের অজান্তেই তাকে একটি অব্যক্ত সংকেত দিয়ে দেন, “এই যে মশাই, আপনি কিন্তু আমার কাছে অত বেশি জরুরি কেউ না। তাই তো আপনাকে রেখে আমি মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছি।”
আর এমন ভাবার ফলে, হয় ওই মানুষটি আপনার সামনে থেকে উঠে চলে যাবে, কিংবা ভদ্রতার খাতিরে রয়ে গেলেও, মনে মনে ঠিকই আপনাকে গালমন্দ করবে, কিংবা আপনার সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে নেবে। আর যখন আপনার সম্পর্কে কারো মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই ওই মানুষটির কাছে আপনার গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে। ফলে আপনাদের মধ্যে একসময় যতই ঘনিষ্ঠতা থাকুক না কেন, এখন একটি দূরত্ব সৃষ্টি হতে শুরু করবে।
বন্ধুত্ব শেষ করে দেয়
আপনি যখন আপনার সামনের বন্ধুটিকে বাদ দিয়ে ভার্চুয়াল জগতের বন্ধুটিকে মেসেজ পাঠাচ্ছেন, তার মানেটা কী দাঁড়াচ্ছে? তার মানে দাঁড়াচ্ছে এই যে, সামনাসামনি থাকা বন্ধুটির চেয়ে ভার্চুয়াল জগতের বন্ধুটিই আপনার কাছে বেশি মূল্যবান।
আর বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে সবসময়ই একটা মান-অভিমান, মানসিক টানাপোড়েনের জায়গা থাকে। কেউই মানতে পারে না যে সে যাকে বন্ধু করে, সেই বন্ধুটি তাকে বন্ধু ভাবে না, কিংবা ভাবলেও অন্য আরেকজন বন্ধুর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এরকমটা যখন আপনার সামনে থাকা বন্ধুটিও ভাববে, তখন থেকেই আপনাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হতে থাকবে।
রোমান্টিক সম্পর্ককে আক্রান্ত করে
ফাবিংয়ের ফলে রোমান্টিক সম্পর্কেও ভাঙন ধরে। আর তা কেন ধরবে না, বলুন তো!
একটি সম্পর্কে খুব ছোট ছোট মুহূর্তও অনেক বেশি মূল্যবান। হয়তো প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রী কিছু বলছেন না, চুপ করে বসে আছেন। কিন্তু ওই নীরবতার সময়টুকুও আপনাদের একান্ত নিজস্ব। ওই সময়ে যদি তৃতীয় পুরুষ (কিংবা নারী) হিসেবে মোবাইলের অনাহূত আবির্ভাব ঘটে, তবে তার ফলাফল হতে পারে ভয়াবহ।
বিশেষত নারীরা এই বিষয়গুলোতে বেশি প্রভাবিত হয়। একজন নারী হয়তো রাতের বেলা শুয়ে শুয়ে তার স্বামীকে সারাদিন কী কী হয়েছে তা বলছে। সে তখন চাইবে তার স্বামী পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তার কথাই শুনুক। কিন্তু তার স্বামী যদি ভাবে, “এক কান দিয়ে তো শুনছিই সব কথা, সেই সাথে একটু মোবাইলও চাপি না!” তাহলেই কিন্তু লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যেতে পারে। কিংবা তেমন কিছু না হলেও, ওই নারীর মনে একটা খারাপ লাগা কিন্তু থাকবেই, যা ঠিক ওই মুহূর্তে প্রকাশিত না হলেও, অন্য কোনো সময় ঠিকই বের হয়ে আসবে। ফলে তাদের সম্পর্কে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে।
তাছাড়া অবজ্ঞা কিংবা পূর্ণ মনোযোগ না পাওয়া থেকে এসব খারাপ লাগা কিন্তু কেবল নারীদের মনেই জন্মায় না, পুরুষদের মনেও জন্মায়। হয়তো একজন পুরুষ স্বাভাবিকভাবে খুব বেশি স্পর্শকাতর নয়। কিন্তু বারবার যখন তার সাথে এমনটা হতে থাকবে, তখন সে-ও একদিন ঠিকই প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলবে। আর সেই প্রতিক্রিয়ার সূত্র ধরে তাদের সম্পর্ক প্রায় খাদের কিনারায় চলে আসলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
যৌন সম্পর্ককে প্রভাবিত করে
হ্যাঁ, ফাবিং এমনকি যৌন সম্পর্কের উপরও খুব বাজে প্রভাব ফেলতে পারে। দেখা গেল, এক দম্পতির মধ্যে কোনো একজন হয়তো তার সঙ্গীর সাথে যৌনতায় লিপ্ত হতে আগ্রহী, তাই সে তার সঙ্গীকে আলতো করে চুমু খাচ্ছে বা তার গায়ে হাত বোলাচ্ছে। অথচ সঙ্গীটি তার মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। তাই আশপাশে কী হচ্ছে, কিছু সে টেরই পাচ্ছে না। এই ব্যাপারটি প্রথম ব্যক্তির মনে গভীর আঁচড় কেটে যেতে পারে। পরবর্তীতে তার সঙ্গী নিজে থেকে উদ্যোগী হলেও, তার মনে যদি ইতিপূর্বের খারাপ লাগার অনুভূতি থেকে যায়, তখন হয়তো সে চাইলেও সঙ্গীর ডাকে সাড়া দিতে পারবে না বা শীতল আচরণ করবে। এভাবেই তাদের যৌন সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মুক্তির উপায় কী?
যারা ভুক্তভোগী, তাদের কাছে ফাবিং যেন একটি জীবন্ত দুঃস্বপ্ন। কিন্তু একটু সদিচ্ছা থাকলেই এই দুঃস্বপ্নের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
- এক্ষেত্রে প্রথম উপায় হতে পারে মোবাইল ব্যবহার সীমিত করা। যুক্তরাষ্ট্রে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি দৈনিক গড়ে ৮০ বার মোবাইল চেক করে। এর মধ্যে অধিকাংশ সময়েই তারা কাজটি করে বিনা প্রয়োজনে, স্রেফ ঝোঁকের মাথায়। কিন্তু চাইলেই বারবার মোবাইল চেক করার এই প্রবণতাকে কমিয়ে আনা সম্ভব। একজন ব্যক্তি আগে থেকেই ঠিক করে নিতে পারে, সারাদিনে সে ৫০ বারের বেশি মোবাইল চেক করবে না। শুরুতেই হয়তো সে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না। তবে ধীরে ধীরে মোবাইলের প্রতি তার দুর্নিবার আকর্ষণ হ্রাস পাবে, এবং একপর্যায়ে সে অবশ্যই মোবাইলের প্রতি আসক্তিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারবে।
- ফাবিং যেহেতু একজন ব্যক্তি করে, কিন্তু এর প্রভাব পড়ে তার সঙ্গীর উপর, তাই তার সঙ্গীও এক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। কেউ যদি তার সঙ্গীর মাত্রাতিরিক্ত ফাবিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে যায়, তাহলে সে নিজেই তার সঙ্গীকে বলতে পারে, “দেখো, বারবার তোমার মোবাইল চেক করা উচিৎ না।” অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই এক কথাতেই কাজ হবে। তা-ও যদি সেই সঙ্গী একই ভুল করে, তাহলে তাকে ফের মনে করিয়ে দিতে হবে। এভাবে টানা কয়েকদিন মনে করিয়ে দিতে থাকলে সমস্যাটি অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
- কিন্তু টানা কয়েকদিনেও যদি সমস্যার সমাধান না হয়, তাহলে আরো কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে। দুজনকে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা যখন একে অন্যের সান্নিধ্যে থাকবে তখন খুব প্রয়োজন ছাড়া কোনো অবস্থাতেই মোবাইল হাতে নেয়া যাবে না। এরকম কড়াকড়ির মাধ্যমেও মোবাইলের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কমিয়ে আনা যেতে পারে।
- যদি উপরের তিন প্রচেষ্টাতেও কোনো সুফল পাওয়া না যায়, তাহলে বুঝতে হবে ফাবিং করতে থাকা ব্যক্তিটি কোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। আর এই মানসিক সমস্যাকে কোনোক্রমেই হালকাভাবে নেয়া যাবে না। সমস্যাটির গভীরতা উপলব্ধি করতে হবে, এবং তাকে কোনো মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়ে তার কাউন্সেলিং করাতে হবে।
শেষ কথা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যে আমাদের জীবনে কী বিশাল আশীর্বাদস্বরূপ, তা ঠিক বলে বোঝানো সম্ভব না। কিন্তু নিজেদের দোষেই অনেক সময় আমরা এই আশীর্বাদটিকেই অভিশাপে রূপান্তরিত করে ফেলি। ফাবিংয়ের কারণেও ঠিক এমনটাই হচ্ছে। মোবাইল আমাদের এত দরকারি একটা জিনিস, অথচ ফাবিংয়ের কারণে সেই মোবাইলকেই আমরা উপদ্রবে পরিণত করছি। কিন্তু সকল সমস্যার সমাধানেই প্রাথমিক পর্যায় হলো সচেতনতা। একবার যদি কেউ ফাবিংয়ের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে সচেতন হয়, তাহলে দেরিতে হলেও সে এই বদভ্যাসটি থেকে মুক্তিলাভ করতে পারবে। যেহেতু এতদিন ফাবিং সম্পর্কে অনেকেরই কোনো ধারণা ছিল না, তাই আশা করা যেতেই পারে এই লেখাটি তাদেরকে সেই প্রয়োজনীয় ধারণাটি দিতে পেরেছে, ফলে ভবিষ্যতে তারা নিজেরাই এই সমস্যাটি মোকাবেলা করতে পারবে।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/