সমগ্র বিশ্বজগৎ তথা সবকিছু কী দিয়ে গঠিত তার রহস্য উদ্ঘাটন করতে হলে প্রবেশ করতে হবে বস্তুর গভীরে। গভীরে যেতে যেতে বস্তুর একদম ক্ষুদ্রতম অংশে গিয়ে উপনীত হতে হবে। ক্ষুদ্রতম যে যে বস্তু পাওয়া যাবে, আপাতভাবে বলা যায় তাদেরকে নিয়েই গঠিত এই জগৎ, তাদের দ্বারাই তৈরি জগতের সবকিছু।
ধরা যাক, কোনো একটি জিনিসকে টুকরো করার জন্য নিলাম। হাতের কাছে থাকা সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পরিমাণ সরু ও ধারালো ছুরি বা ব্লেড দিয়ে এটিকে দু’ভাগে বিভক্ত করলাম। বিভক্ত অংশগুলোকে আবারো দু’ভাগে বিভক্ত করলাম। নতুন বিভক্ত হওয়া অংশগুলোকে আবারো দু’ভাগে বিভক্ত করলাম। এভাবে একের পর এক ভাগ করতে করতে এগিয়ে গেলে এমন কোনো ক্ষুদ্র অংশ আসবে কি, যাকে আর বিভক্ত করা যায় না? এতই ক্ষুদ্র যে, তাকে আর অর্ধেক করা যায় না? এমন কোনো পর্যায় পাওয়া যাবে কি, যার থেকে ক্ষুদ্র আর কোনো কিছু নেই? রেজরের ব্লেডের ধারের অংশটি কতটুকু সরু? কিংবা সুঁইয়ের অগ্রভাগ কতটা ক্ষুদ্র? বস্তুর সর্বোচ্চ পরিমাণ ক্ষুদ্র অংশগুলো কী দিয়ে তৈরি? দেখতেই বা কেমন?
প্রাচীন গ্রিস, চীন ও ভারতের দার্শনিকেরা মনে করতেন, বিশ্বের সবকিছুই চারটি উপাদানে গঠিত। উপাদান চারটি হচ্ছে আগুন, পানি, মাটি ও বাতাস। তাদের দাবি ছিল, এগুলোকে যত খুশি তত ভাগে বিভক্ত করা যায়। তবে একজন প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস এসব ধারণার বাইরে গিয়ে সঠিক তথ্যের কাছাকাছি গিয়েছিলেন। ডেমোক্রিটাস বলেছিলেন, কোনো কিছুকে যদি পরপর বিভক্ত করে যাওয়া হয়, তাহলে এমন একটা অবস্থানে পৌঁছাবে, তখন একে আর ক্ষুদ্রতর ভাগে ভাগ করা যাবে না। ডেমোক্রিটাস এই ক্ষুদ্রতম অংশের নাম দিয়েছিলেন পরমাণু বা Atom।
বিভক্ত করাকে গ্রিক ভাষায় বলা হয় Tomos, আর ‘না’ বা নেতিবাচক উপসর্গের গ্রিক রূপ হচ্ছে ‘A’। সেই হিসেবে A-tomos দিয়ে এমন কিছুকে বোঝানো হয় যাকে আর বিভক্ত করা যায় না। এই A-tomos থেকেই এসেছে আজকের ইংরেজি Atom শব্দটি, যার বাংলা হচ্ছে পরমাণু।
স্বর্ণের অসংখ্য ক্ষুদ্রতম অংশ বা স্বর্ণের অসংখ্য পরমাণু একত্র হয়ে এক টুকরো স্বর্ণ গঠন করে। লোহার অসংখ্য ক্ষুদ্রতম অংশ বা লোহার অসংখ্য পরমাণু একত্রে মিলে এক টুকরো লোহা গঠন করে। অন্যান্য সকল পদার্থই এমন অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরমাণু দিয়ে গঠিত। আকাশ-পাতালের যা কিছু দেখতে পাই বা পাই না, তার সবকিছুই এই পরমাণু দিয়ে গঠিত। সমগ্র মহাবিশ্বই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরমাণুর সমাবেশ।
এখন আমরা জানি, একশরও বেশি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পরমাণু আছে। এদের মাঝে ৯০/৯১ ধরনের পরমাণু প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। বাকিগুলোকে বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে তৈরি করেছেন। গবেষণাগারে পাওয়া গেলেও এদের স্থায়ীত্ব খুব অল্প সময়ের জন্য হয়। তৈরির পর এরা বেশিক্ষণ অস্তিত্ববান থাকে না, অন্য পরমাণুতে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
আমাদের চারপাশে অনেক ধরনের বস্তু আছে। এদের বেশিরভাগই আলাদা আলাদা ধরনের পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত। যে সকল বস্তু একটি মাত্র পরমাণু দিয়ে গঠিত, তাদেরকে বলা হয় ‘মৌল’। যেমন স্বর্ণ, লোহা, কপার, সোডিয়াম, পারদ ইত্যাদি। পৃথিবীতে এসব কঠিন পদার্থকে সহজেই পাওয়া যায়। আবার কিছু কিছু কঠিন মৌল আছে, এরা পৃথিবীতে খুবই দুর্লভ; যেমন- মলিবডেনাম। দুর্লভ বলেই আমরা কোনো কাজে মলিবডেনাম ব্যবহার করতে দেখি না। এ কারণে এই নামটাও অনেকের কাছে অপরিচিত মনে হতে পারে। তবে এরা পৃথিবীতে দুর্লভ হলেও মহাবিশ্বের অনেক স্থানে দুর্লভ নয়। অন্যসব পদার্থের মতো তাদেরও আধিক্য আছে সেখানে।
লোহা, স্বর্ণ, তামা, টিন, জিংক ইত্যাদি কঠিন মৌলের পাশাপাশি বায়বীয় বা গ্যাসীয় মৌলও আছে। যেমন অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন, নিয়ন ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের চারপাশের বেশিরভাগ পদার্থই মৌলিক আকারে থাকে না, মিশ্রিত অবস্থায় থাকে। যেসব পদার্থ একাধিক পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত তাদেরকে বলে ‘যৌগ’ বা যৌগিক পদার্থ।
আমাদের মাঝে সবাই হয়তো শুনে থাকবে, পানিকে মাঝে মাঝে H2O লিখেও প্রকাশ করা হয়। এখানে H2O হচ্ছে পানির রাসায়নিক ফর্মুলা। যার মানে হচ্ছে পানি একটি যৌগিক পদার্থ এবং এটি দুই ধরনের পরমাণু অক্সিজেন (O) ও হাইড্রোজেন (H) এর সমন্বয়ে গঠিত। ছোট করে (2) দিয়ে বোঝাচ্ছে একটি অক্সিজেনের সাথে দুইটি হাইড্রোজেন মিশ্রিত হয়ে পানির একটি ক্ষুদ্র কণা তৈরি করে। এই ক্ষুদ্র কণাটিকে বলে হয় ‘অণু’।
বিশেষ অনুপাতে সজ্জিত একাধিক পরমাণুর সজ্জাকে বলা হয় অণু। কিছু কিছু অণু আছে একদমই সহজ ও সাধারণ সজ্জা নিয়ে গঠিত; যেমন, পানির অণু। মাত্র তিনটি পরমাণু বিশেষ উপায়ে সরলভাবে সজ্জিত হয়ে পানির অণু গঠন করে। আবার কিছু কিছু অণু আছে যাদের সজ্জা অনেক জটিল। যেমন জীবন্ত প্রাণীর দেহে এমন অনেক অণু আছে যারা একশ’রও বেশি পরিমাণ পরমাণু দিয়ে তৈরি। শতাধিক পরমাণু বিশেষ সজ্জায় সজ্জিত হয়ে এমন ধরনের বড় অণু গঠন করে।
ভিন্ন ভিন্ন পরমাণু যেমন একত্র হয়ে অণু গঠন করতে পারে, তেমনই একই রকম পরমাণু একত্রে যুক্ত হয়ে অণু গঠন করতে পারে। আমরা শ্বাস প্রশ্বাসের সময় যে অক্সিজেন গ্রহণ করি, সেটা অক্সিজেনের অণু। দুটি অক্সিজেন পরমাণু একত্রে মিলিত হয়ে অক্সিজেনের অণু (O2) গঠন করে।
মাঝে মাঝে আমরা হয়তো ওজোন গ্যাসের নাম শুনে থাকবো। এই ওজোন (O3) গ্যাস তিনটি অক্সিজেন পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত। একইরকম পরমাণু দিয়ে গঠিত হলেও ওজোন ও অক্সিজেন বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে একদমই ভিন্ন। অণুর গঠনে পরমাণুর সজ্জা বা পরমাণুর সংখ্যার ভিন্নতার কারণে অণুর বৈশিষ্ট্য একদমই ভিন্ন হয়ে যেতে পারে, এমনকি তারা একই প্রকার পরমাণু দিয়ে গঠিত হলেও।
শ্বাস-প্রশ্বাসে ওজোন গ্রহণ করলে তা স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ক্ষতির কারণ হবে। অন্যদিকে অক্সিজেন ছাড়া বেঁচে থাকাই অসম্ভব। রসায়নের জগতটা আক্ষরিক অর্থেই রহস্য দিয়ে তৈরি। ওজোন শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ক্ষতিকর হলেও ওজোন হতে চমৎকার ও খুব দরকারি উপকার ভোগ করছি আমরা সকলে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে সমস্ত পৃথিবীকে ঘিরে আছে ওজোনের একটি স্তর যা অদৃশ্যভাবে আমাদেরকে ঢেকে রেখেছে। এই স্তর সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মি (Ultraviolet Ray) শোষণ করে নেয়। এই স্তরে অতিবেগুনী রশ্মি শোষিত না হলে তা পৃথিবীর জীবজগতের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিত।
সত্যি কথা বলতে কী, পৃথিবী এই মুহূর্তে মোটামুটি হুমকির মুখে আছেও। কারণ মানুষের বিবেচনাহীন পরিবেশ দূষণের কারণে দক্ষিণ মেরুর দিকে পৃথিবীর ওজোন স্তরে বিশাল এক ‘ছিদ্র’ বা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই ছিদ্র ধীরে ধীরে বড় হয়ে গেলে তা পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের জন্যও হুমকি বয়ে আনবে।
ক্রিস্টাল: পরমাণুর প্যারেড
খুব সহজভাবে বললে বলা যায়, পরমাণুর বিশেষভাবে সজ্জিত প্যাটার্নকে ক্রিস্টাল বা কেলাস বলে। ডায়মন্ড বা হীরকের একটি ক্রিস্টাল মিলিয়ন মিলিয়ন পরিমাণ কার্বন পরমাণু দিয়ে গঠিত বিশাল বড় এক অণু। সবগুলো পরমাণু নির্দিষ্ট একটি সজ্জায় সু-সজ্জিত। তাদের গঠন যেমন নির্দিষ্ট সজ্জায় গঠিত, তেমনই তাদের মাঝে ফাঁকা স্থানও নির্দিষ্ট সজ্জায় গঠিত। বলা যায়, এরা পরস্পর খাপে খাপে মিলে হীরকের অণু গঠন করে। ঠিক যেন কোনো আর্মি দলের প্যারেড, যেখানে সবাই মিলে একসাথে একই সময়ে একটা একটা করে পা ফেলে এগিয়ে যায়।
কঠিন পদার্থগুলোকে দেখতে একদম নিখাদ বলে মনে হলেও, সব কঠিন পদার্থেই ফাঁকা স্থান বিদ্যমান। কীভাবে? কাঠ দেখলে মনে হয় না এর মাঝে ফাঁকা স্থান আছে, কিন্তু এর মাঝে পেরেক ঠিকই বসানো যায়। ফাঁকা না থাকলে পেরেক ঢুকে গেল কীভাবে?
শুধু হীরকই নয়, সকল ক্রিস্টালই আলাদা আলাদা কিন্তু নির্দিষ্ট সজ্জায় গঠিত। এক সেট পরমাণু নির্দিষ্ট সজ্জায় সজ্জিত হলে একটি নির্দিষ্ট অণু পাওয়া যাবে। নির্দিষ্ট সজ্জার বাইরে গেলে হয়তো অদ্ভুত ধরনের কোনো একটা কিছু পাওয়া যাবে, কিন্তু এটি দিয়ে কাজের কাজ কিছু করা যাবে না। অনেকটা এলোমেলো কোনো আর্মির প্যারেডের মতো। একজন সামনের দিকে আরেকজন পেছনের দিকে, একজন এগোচ্ছে আরেকজন লাফাচ্ছে, একজন লম্বা আরেকজন বেটে, একজন পোশাকে আরেকজন খালি গায়ে- এভাবে খিচুড়ি ধরনের একটা অবস্থা হবে।
আবার একই মৌলের অনেকগুলো পরমাণু ভিন্ন ভিন্নভাবে সজ্জিত হয়ে ভিন্ন ধরনের অণু তৈরি করতে পারে। কার্বন পরমাণুর সজ্জা যদি একভাবে হয়, তাহলে সেটা থেকে তৈরি হতে পারে অতি মূল্যবান হীরা, আবার একই মৌলের পরমাণু ভিন্নভাবে সজ্জিত হয়ে তৈরি করে গ্রাফাইট অণু। পিচ্ছিলকারী পদার্থ হিসেবে গ্রাফাইট ব্যবহৃত হয় এবং এরা হীরার তুলনায় একদমই সস্তা। একই পরমাণু সজ্জার ভিন্নতার কারণে একটি হয় মূল্যবান অলংকার আরেকটি হয় প্রায় মূল্যহীন পদার্থ। তবে মূল্যবান হোক আর মূল্যহীন হোক এদের উভয়েরই নির্দিষ্ট সজ্জা আছে। কার্বন পরমাণুকে এই সজ্জার বাইরে সাজানো হলে গ্রাফাইট কিংবা হীরক কোনোটাই হবে না।
ক্রিস্টাল বা কেলাস বলতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বচ্ছ জিনিসকে বোঝানো হয়। একদম বিশুদ্ধ ও স্বচ্ছ পানিকে মাঝে মাঝে বলা হয় ‘ক্রিস্টালের মতো পরিষ্কার’। মূলত স্বচ্ছ অস্বচ্ছ সকল কঠিন পদার্থই ক্রিস্টালের সমন্বয়ে গঠিত। সত্যি কথা বলতে কী, কঠিন পদার্থের মাঝে বেশিরভাগই অস্বচ্ছ। এক দলা লোহা অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লৌহ-ক্রিস্টালের সমন্বয়ে গঠিত।
অ্যালুমিনিয়াম, সীসা, তামা, সোনা ইত্যাদি সবই তাদের নিজেদের পরমাণু দ্বারা তৈরি ভিন্ন ভিন্ন ক্রিস্টালের সমন্বয়ে গঠিত। গ্রানাইট, বেলেপাথর এরাও ক্রিস্টালের সমন্বয়ে গঠিত। তবে তারা মাঝে মাঝে ভিন্ন ভিন্ন পরমাণুর সমন্বয়ে তৈরি ক্রিস্টালেও গঠিত হতে পারে। এদেরকে বলা যায় যৌগিক ক্রিস্টাল। কিংবা বলা যায় ভিন্ন ভিন্ন ক্রিস্টালের ‘মিশ্রণ’। এরকম মিশ্রণেই পাথরের মতো পদার্থগুলো গঠিত হয়ে থাকে, বালিকণাগুলোও ক্রিস্টালে গঠিত।
পাথর আর বালি মূলত একই। পাথরের ভেঙে বা ক্ষয়ে যাওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণাগুলোই বালি হিসেবে বিরাজ করে। কাদা বা পলি এগুলোর বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য। এদের মধ্যে ক্রিস্টালের পাশাপাশি অতিরিক্ত উপাদান হিসেবে মিশ্রিত থাকে পানি বা অন্য কোনো তরল। মাঝে মাঝে বালির কণা ও কাদার কণা একত্রে নতুন করে পাথর বা শিলার সৃষ্টি করে। এ ধরনের শিলাকে বলে ‘পাললিক শিলা’। পলিমাটি থেকে এর উৎপত্তি বলে এর নাম পাললিক শিলা। কোনো সমুদ্র বা উপত্যকার তলদেশে পলির স্তর জমতে জমতে বছরের পর বছর ধরে তা ধীরে ধীরে শিলায় রূপান্তরিত হয়।
বেলেপাথরের বালির অধিকাংশই কোয়ার্টজ বা ফ্লেডস্পারে তৈরি। এই দুটি ক্রিস্টাল পৃথিবীর অভ্যন্তরের ক্রাস্ট স্তরে পাওয়া যায়। চুনাপাথর কিছুটা ভিন্ন, যেমন- চক। চক চুনাপাথরজাত পদার্থ, এটি ক্যালসিয়াম কার্বনেট দিয়ে তৈরি। ক্যালসিয়াম কার্বনেট মূলত সমুদ্রতলে ধীরে ধীরে জমা হওয়া বিভিন্ন প্রাণীর মৃতদেহের অবশেষ। ক্ষুদ্র এককোষী হতে শুরু করে বড় বহুকোষী সকল প্রাণীর দেহাবশেষ একত্র হয়ে প্রবাল স্তর তৈরি করে। এই স্তরকেই পরবর্তীতে চুনাপাথর হিসেবে আহরণ করা হয়। যদি কখনো সমুদ্রের পাড়ে ঘুরতে গিয়ে দেখা যায়, সৈকতটি বেশ সাদাটে তাহলে ধরে নিতে হবে এগুলো ক্যালসিয়াম কার্বনেট তথা প্রবাল। এগুলো হাজার হাজার মৃত প্রাণের প্রতিনিধিত্ব করছে।
মাঝে মাঝে একই মৌলের পরমাণুর দীর্ঘ সজ্জায় ক্রিস্টাল গঠিত হয়। হীরা, সোনা, তামা ও লোহা এর অন্যতম উদাহরণ। কিছু কিছু ক্রিস্টাল আছে দুটি মৌলের সজ্জায় গঠিত। যেমন খাবার লবণ, এটি সোডিয়াম ও ক্লোরিন পরমাণুর সু-নির্দিষ্ট সজ্জা নিয়ে তৈরি। লবণের বেলায় সোডিয়াম ও ক্লোরিন পর্যায়ক্রমিকভাবে একটির পর অন্যটি বসে বসে ক্রিস্টাল তৈরি করে। সত্যি কথা বলতে কী, লবণের গঠনে এরা মূলত পরমাণু নয়, এদেরকে বলা যেতে পারে আয়ন। তবে এসব জটিলতায় না গিয়ে আমরা এখানে সরলীকৃতভাবে তাদেরকে পরমাণু বলেই ডাকবো।
প্রত্যেকটি সোডিয়াম পরমাণুর চারপাশে প্রতিবেশী হিসেবে যুক্ত থাকে ছয়টি করে ক্লোরিন পরমাণু। সামনে, পেছনে, ডানে, বামে, উপরে ও নিচে একটি একটি করে মোট ছয়টি। একইভাবে প্রত্যেকটি ক্লোরিন পরমাণুর চারদিকেও প্রতিবেশী হিসেবে ছয়টি করে সোডিয়াম পরমাণু যুক্ত থাকে। এভাবে এদের সম্পূর্ণ সজ্জা ঘনক আকৃতির হয়। যদি ক্ষমতাসম্পন্ন বিবর্ধক কাচ দিয়ে লবণকে পর্যবেক্ষণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে লবণের অত্যন্ত ক্ষুদ্র টুকরোটিও ঘনক আকৃতির।
একইভাবে অন্যান্য যে বস্তুকেই বিবেচনা করা হোক না কেন, ক্ষুদ্র পর্যায়ে গেলে তাদের গাঠনিক উপাদান হিসেবে বেরিয়ে আসবে কিছু অণু-পরমাণুর নাম। কোনো কোনো পদার্থ এক, দুই বা তিনটি ‘একক’ পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত, আবার কোনো কোনো পদার্থ তার চেয়ে বেশি পরমাণুর দ্বারা গঠিত হতে পারে। তবে হাজার হাজার বা লক্ষ লক্ষ জাতের যত পদার্থই আনা হোক না কেন, তারা ঘুরেফিরে পর্যায় সারণির শখানেক পরমাণুর কোনো কোনোটি দিয়েই গঠিত। পরমাণুগুলোও আবার আরো ক্ষুদ্র উপাদানে গঠিত। সেগুলো আবার পদার্থবিজ্ঞানের আরেক জগতের গল্প। তবে জাগতিক বস্তু কী দিয়ে গঠিত, তার আলোচনা করতে গেলে বস্তুর পরমাণুর স্তর পেরিয়ে আরো গভীরে যাওয়া লাগে না, পরমাণু পর্যন্তই গেলেই যথেষ্ট পরিষ্কার ব্যাখ্যা প্রদান করা যায়।