এক করুণ বাস্তবতা

জলবায়ু পরিবর্তন এক জ্বলন্ত বাস্তবতা। কোনো কোনো দেশের জন্য এটি দূর ভবিষ্যতের হুমকি কোনো কোনো দেশের জন্য নিকট ভবিষ্যতের হুমকি আর কোনো কোনো দেশের জন্য এটি ইতোমধ্যেই হুমকি। দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশ পড়েছে ৩য় প্রকার দেশের মাঝে। জলবায়ু পরিবর্তনের বেশ কিছু নেতিবাচক দিকের মাঝে একটি হলো সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশের বড় একটা অংশ নিচু ভূমির। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা সামান্য বাড়লেই ডুবে যাবে বাংলাদেশের অনেক ভূমি।

এটা যদি বাংলাদেশ ছাড়া পশ্চিমের অন্য কোনো দেশ হতো তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। ভৌগলিক সুবিধার কারণে বাংলাদেশে মানুষের পরিমাণ বেশি। বাংলাদেশের একটা অংশ তলিয়ে গেলে ঘর হারাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ। বাংলাদেশ সামর্থ্যের দিক থেকে যথেষ্ট সচ্ছল নয়, তাদেরকে উপযুক্ত সুবিধা দিয়ে পুনর্বাসন করতে পারবে না সরকার, এটা স্বাভাবিক বাস্তবতা। তাই বলা যায় নিজের দেশে থেকেও রিফিউজি হবে লক্ষ লক্ষ মানুষ।

বাংলাদেশের জন্য এই ব্যাপারটি যেখানে জ্বলজ্বল করা সত্য সেখানে পশ্চিমা দেশের হর্তাকর্তারা ব্যাপারটিকে স্বীকারই করছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের রাষ্ট্রপতি জনতার সামনে বলেন যে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যদি সত্যই হতো তাহলে বাইরে কেন এত ঠাণ্ডা? এই বক্তব্য প্রাদানকারীর নাম ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেন-

বৈশ্বিক উষ্ণতা একটা গুজব। আমেরিকার শিল্পায়ন ধ্বংস করার জন্য এবং মানুষকে বোকা বানিয়ে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য  চীন এই গুজব ছড়িয়েছে।

ট্রাম্প মনে করেন বৈশ্বিক উষ্ণতা আসলে চীনের তৈরি গুজব; Source: AutoEvolution

জলবায়ু পরিবর্তন আর বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বাস্তবতাকে মানুক না মানুক এর ফল সবাইকেই পেতে হবে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রও বাদ যাবে না। সেজন্যই যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিজ্ঞানী এবং পরিবেশকর্মী এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।

শুনলে অবাক লাগবে, ইতোমধ্যেই আশঙ্কার ঘণ্টা বেজে গেছে। ১৮৮০ সাল থেকে শুরু করে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ২ ডিগ্রি ফারেনহাইট। সংখ্যায় কম দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে, একশো বছরেরও বেশি সময়ে তাপমাত্রা বেড়েছে সামান্যই, এতে শঙ্কিত হবার কিছু নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো এটা অনেক বেশি। আর কয়েক ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা বাড়লেই পৃথিবীর স্বাভাবিকতা নড়েবড়ে হয়ে যাবে। একটা ব্যাপার হিসেব করে দেখুন, বিশাল পৃথিবীর পৃষ্ঠের ক্ষুদ্র একটা অংশে সকল মানুষের বসবাস, এর বাইরে বেশিরভাগ জায়গাই মানবশূন্য। তার উপর পুরো বায়ুমণ্ডলও শূন্য। এ সত্ত্বেও উপরে-নিচে, চারদিকে সামগ্রিকভাবে তাপমাত্রা বেড়ে গেছে ২ ডিগ্রি ফারেনহাইট।

এর ফলে গলতে শুরু করে মেরু অঞ্চলের বরফ। বাড়তে শুরু করেছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ যদি চলতেই থাকে তাহলে পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যাবে। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন আর ৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা বাড়লেই সমুদ্রের পানির উচ্চতা এত বেড়ে যাবে যে পৃথিবীর মানুষের ঠাই দেবার জন্য পর্যাপ্ত ভূমিই থাকবে না।

গলে যাচ্ছে জমাট জমাট বাধা বরফ; Source: allwallpaper.in

বর্তমানে শিল্প বিপ্লব যে পর্যায়ে পৌঁছেছে গত শতাব্দীতে পরিস্থিতি সেরকম ছিল না। পরিস্থিতি এখনকার চেয়ে কম খারাপ ছিল তখন। এখন গণহারে গাড়ি হয়েছে, বাড়ি হয়েছে, কল হয়েছে, কারখানা হয়েছে, বাড়িতে কলের নানা যন্ত্র হয়েছে, এদের সবগুলোই কার্বন নিঃসরণ করছে, করে যাচ্ছে।  তাই গত শতাব্দীতে ২ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা বাড়তে যে সময় লেগেছে বর্তমানের পরিস্থিতি চলতে থাকলে ২ ডিগ্রি ফারেনহাইট বাড়তে সেই সময় লাগবে না, তার আগেই বেড়ে যাবে। মিলিয়ন মিলিয়ন বছরে গড়ে উঠেছে যে প্রাণিবৈচিত্র্য সেটি নষ্ট হয়ে যাবে মাত্র কয়েক শত বছরে।

শত বছর, সে তো অনেক দেরি বলে যারা তেমন শঙ্কা করছেন না তাদেরকেও ভাবতে হবে নতুন করে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শুধু সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিই নয়, অন্যান্য অনেক দিকেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনাকাঙ্ক্ষিত খারাপ আবহাওয়া, ভুল সময়ে পরিবেশ ভুল ঋতুর মতো আচরণ করা ইত্যাদি সবকিছুর মাঝেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আছে। সময় এসেছে এখনই সতর্ক হবার। পরিবেশের জন্য হুমকি এরকম জিনিসকে বর্জন করার।

যুগে যুগে পৃথিবীতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ। দেখা যাচ্ছে বর্তমান সময়ের কার্বনের ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে ইতিহাসের সকল রেকর্ডকে। শুধু ছাড়িয়ে গেছে বললেই হবে না, বলতে হবে বেখাপ্পা রকমের পার্থক্য রেখে ছাড়িয়ে গেছে; Credit: Vostok ice core data/J.R. Petit et al.; NOAA Mauna Loa CO2 record

কিন্তু নগরায়ন এবং শিল্পায়ন কেন এখানে অপরাধী? কীভাবে হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম ফল বৈশ্বিক উষ্ণায়ন? উনিশ শতকের দিকে বিজ্ঞানীরা দেখতে পান বায়ুমণ্ডলে এমন কিছু গ্যাস আছে যেগুলো তাপকে আটকে রাখতে পারে। এ ধরনের গ্যাসের মধ্যে অন্যতম হলো কার্বন ডাই-অক্সাইড। এটি মূলত পৃথিবীর পরিবেশের জন্য ভালো দিক। কারণ পৃথিবীর তাপ প্রতিনিয়ত বিকিরিত হয়ে যাচ্ছে মহাশূন্যে। তাপ আটকে রাখার ব্যবস্থা যদি না থাকতো তাহলে পুরো পৃথিবী হতো অতি-শীতল বরফে ঢাকা। প্রাণ টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে দাঁড়াতো। তাই কিছু তাপ আটকে থাকা দরকার। কিন্তু এরও একটা সীমা আছে।

শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে প্রচুর কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে বায়ুমণ্ডলে। এগুলো বায়ুতে থেকে তাপ যাবার পথ আরো বেশি বন্ধ করে দিচ্ছে। ফলে ভেতরে ভেতরে উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী, আর নষ্ট হচ্ছে স্বাভাবিকতা। উত্তাপ ধরে রাখার বিষয়টা আগে যেমন ছিল তেমন থাকাই যথেষ্ট, এর বেশি হলেও ক্ষতি আবার কম হলেও ক্ষতি। কিন্তু আধুনিক সভ্যতা পরিবেশকে স্বাভাবিক থাকার অবকাশ দিচ্ছে না।

কেউ কেউ এমনও প্রশ্ন করে মানুষই যে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঘটাচ্ছে তার প্রমাণ কী? পরিবেশ নিজে নিজেও তো উষ্ণ হয়ে যেতে পারে। হ্যাঁ, তাত্ত্বিকভাবে পরিবেশ তা পারে। যেমন সূর্যের খুব তীব্রতর বিকিরণ যদি পৃথিবীতে আসতে থাকে তাহলে এমনটা হতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন সূর্যের কারণে এমনটা হয়নি। বর্তমানের উষ্ণায়ন এতই নাটকীয় যে এই কর্ম মানুষ ছাড়া আর কেউ করতেই পারে না।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রথম শিকার বাংলাদেশ; Source: Dhaka Tribune

মানুষই যে করেছে তার প্রমাণ কী? যেহেতু এটি গ্যাস সংক্রান্ত ব্যাপার তাই গ্যাস বিশ্লেষণ করলে তার উত্তর পাওয়া যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন প্রাকৃতিক গ্যাস নিঃসরণ আর শিল্প-কারখানা কর্তৃক গ্যাস নিঃসরণের বৈশিষ্ট্য আলাদা। অতিরিক্ত যে গ্যাসগুলো পৃথিবীভর বিরাজ করছে সেগুলো শিল্প-কারখানা থেকে কৃত্রিমভাবে নিঃসরিত।

বর্তমানে মানুষ বায়ুমণ্ডলে যে হারে কার্বন নিঃসরণ করছে ইতিহাসের কোনো সময়ই এত পরিমাণ কার্বন নিঃসরিত হয়নি। কীভাবে নিশ্চিত হওয়া গেল এই তথ্য? অতীতে তো মানুষ এই রেকর্ড রাখেনি। লক্ষ লক্ষ বছর আগের পরিবেশের তথ্য কীভাবে মানুষ জানলো?

তথ্য সংগ্রহ করা বিজ্ঞানের কাছে তেমন কঠিন কিছু নয়। ধরুন একটা অঞ্চলে তুষারপাত হচ্ছে। ভূমিতে অল্প অল্প করে তুষার জমা হচ্ছে। তুষারের ফাঁকে ফাঁকে একটু একটু করে বায়ু আটকে আছে। এদের উপর আরো তুষার পড়লো এবং তার উপর আরো। এভাবে তুষারের চাপে নিচের তুষারগুলো বরফ হয়ে যাবে। বরফ হয়ে গেলেও তার মাঝে বুদবুদ আকারে থেকে যাবে সেই আটকে থাকা বায়ুগুলো। আর বায়ুগুলোর মধ্যে থাকবে বায়ু সম্পর্কিত সকল তথ্য। বায়ু কেমন ছিল, বায়ুতে কী ছিল, কোন উপাদান কতটুকু ছিল ইত্যাদি। যত বছর বরফ থাকবে বায়ুও থাকবে তত বছর। এ যেন বরফের ভেতর আটকে থাকা ইতিহাস।

এখন কয়েক লক্ষ বছর পর কোনো বিজ্ঞানী যদি এ বরফের কোনো একটি অংশ কেটে নিয়ে উপযুক্তভাবে বিশ্লেষণ করতে পারে তাহলে লক্ষ বছর আগের বায়ুমণ্ডলে কেমন কার্বন ডাই-অক্সাইড ছিল তা সহজেই বলে দিতে পারবে।

বরফের ভেতর আটকে আছে ইতিহাস; Photo by Mike Waszkiewicz.

বাংলাদেশেই অনেক শিক্ষিত মানুষের দেখা পাবেন যারা বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বিশ্বাস করে না। তাদের দাবি পৃথিবীর তাপমাত্রা মাপার কাজটা চাতুরীর সাথে করা হয়েছে। আবহাওয়া কেন্দ্রগুলোতে এমন সব ডাটা গ্রহণ করা হয়েছে যেগুলোর ফলাফলে তাপমাত্রা বেশি আর সেসব ডাটাকে পরিহার করা হয়েছে যেগুলোর ফলাফলে তাপমাত্রা কম। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভ্রান্ত অনুমান।

সময় এসেছে বাস্তবতাকে গ্রহণ করার। আমরা বাংলাদেশিরা যেহেতু সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার তাই আমাদের উচিত এটি নিয়ে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা, সচেতনতা, সতর্কতা, কার্যক্রম ও উদ্যোগ। এমন সব পদক্ষেপ নিতে হবে যার মাধ্যমে দেশে বিদেশে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সম্পর্কিত নেতিবাচক কর্মকাণ্ডগুলো থামানো যায়। এমন সব উদ্যোগ নিতে হবে যার মাধ্যমে ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে যাওয়া পরিবেশকে ফিরিয়ে আনা যায়। যা ক্ষতি হবার হয়ে গিয়েছে ক্ষতি যেন আর না বাড়ে। এই পর্যায়ে স্থির থেকেই সারিয়ে ফেলতে হবে আমাদের তৈরি করা জঞ্জালগুলো।

সূত্র

  1. The Unfolding Tragedy of Climate Change in Bangladesh, Robert Glennon, Scientific American Blog, April 21, 2017
  2. Trump Has Called Climate Change a Chinese Hoax. Beijing Says It Is Anything But, Edward Wong, The New York Times
  3. Climate Change Is Complex. We’ve Got Answers to Your Questions, Justin Gillis, The New York Times
  4. মানুষ, মহাবিশ্ব ও ভবিষ্যৎ, ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৩
  5. ৮১৫ মিলিয়ন বছর আগের ‘সময়ের ক্যাপস্যুলে’ অক্সিজেনের অস্তিত্ব, বিজ্ঞান পত্রিকা

ফিচার ছবি- প্রবাল রশিদ

Related Articles

Exit mobile version