বুলগেরিয়ার মাগুরা, পাটাগোনিয়ার কুয়েভা দে লাস মানোস, ইথিওপিয়ার লাস গিল, ফ্রান্সের সভেঁ, স্পেনের আলতামিরা- এক নাগারে বেশকিছু গুহার নাম লেখা হলো। ভৌগোলিক অবস্থান, গুহার ধরন ইত্যাদি বিচারে এরা একে অপরের চেয়ে আলাদা হতে পারে। কিন্তু একটি বিশেষ কারণে এই গুহাদের এক কাতারে রাখা যায়। আর তা হচ্ছে, গুহার অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা একগুচ্ছ প্রাগৈতিহাসিক কল্পনা। আজ থেকে কয়েক হাজার বছর পূর্বে কোনো এক প্রাগৈতিহাসিক মানব তার শিল্পীমনকে ফুটিয়ে তুলেছেন আঙুলের ডগায় কয়েক ছটা রং মাখিয়ে। আর তার সেই রঙিন অভিব্যক্তি হাজার বছরের আবর্তনে এখনও টিকে আছে এসব গুহার পাথরে পাথরে।
একবিংশ শতাব্দীতে বসবাস করা আমাদের কাছে এগুলো শুধু রঙিন শিলাচিত্র নয়। চিত্রে ফুটে উঠা শিশুর হাতের ছাপ, বাইসন শিকার, অতিকায় ম্যামথের আক্রমণে পলায়নরত মানব- এই চিত্রগুলো স্রেফ বিনোদনের নিছক উপাদান বা মাধ্যম নয়। এর তাৎপর্য আরও গভীর। যেমন ধরা যাক লিয়াং টিম্পোসেং শিলাচিত্রের কথা। ইন্দোনেশিয়ার মারোসে আবিষ্কৃত এই চিত্রগুলোর প্রাচীনত্ব প্রায় ৪০ হাজার বছর। গুহার দেয়ালে চিত্রিত বাবিরুসার ভয়ঙ্কর মূর্তির দিকে তাকিয়ে একবিংশ শতাব্দীর আমরা পড়ছি এক প্রাগৈতিহাসিক চিঠি। এর রঙের কারুকাজে জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে আদিম মানব সম্প্রদায়ের জীবনের অব্যক্ত গাথা। কৌতূহলী চোখে সেই বাবিরুসা হয়ে উঠে বুনো পৃথিবীর বুকে এগিয়ে চলা সংগ্রামী সমাজের দিনলিপি।
২০১৯ সালের দিকে এই তালিকায় সংযুক্ত হয়েছে এক নতুন নিদর্শন। ব্রিটিশ এবং কলম্বিয়ানদের সমন্বয়ে গঠিত একদল পুরাতত্ত্ববিদ কলম্বিয়ার অধিভুক্ত আমাজনের গহীনে এক রোমাঞ্চকর অভিযানে নেমেছিলেন। সেই অভিযানে তারা আবিষ্কার করলেন এক নতুন প্রাগৈতিহাসিক চিত্রকর্ম। জেনে অবাক হবেন, সেই চিত্রকর্ম ছিল সুদীর্ঘ ৮ মাইল পাথরের দেওয়ালজুড়ে। এই বিশাল ক্যানভাসে প্রকৃতি আর মানুষের নানা অবয়ব আর মুহূর্তের গল্পগুলো সুনিপুণ ছন্দে চিত্রায়িত হয়েছে, যার রসবোধে মুগ্ধ হয়ে এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্রাচীনযুগের সিস্টিন চ্যাপেল’। আদিম এই শিলাচিত্রকর্মকে তুলনা করা হয়েছে ভ্যাটিকান প্রাসাদের সিস্টিন চ্যাপেলের সাথে। রেনেসাঁর মহাজাগরণের সময় এই চ্যাপেলের দেওয়ালে প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীদের অবদানে অনবদ্য ফ্রেস্কো অঙ্কিত হয়েছে। এর ছাদের ফ্রেস্কো এঁকেছেন বিখ্যাত শিল্পী মাইকেলেঞ্জেলো।
এই ফ্রেস্কোগুলোতে ফুটে উঠেছে বাইবেলের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী। যেন মানুষের ইতিহাসের ঘটনাগুলো একের পর এক জীবন্ত হয়ে ধরা দিচ্ছে সেই সিস্টিন চ্যাপেলের চার দেয়ালে। কলম্বিয়ায় আবিষ্কৃত এই চিত্রকর্মগুলো বিচিত্রতা, নৈপুন্য ও পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্বের বিচারে যেন সেই সিস্টিন চ্যাপেলের ফ্রেস্কোর প্রতিরূপ। কলম্বিয়ার এই শিলাচিত্রে রয়েছে হাজারো হাতের ছাপ, বরফ যুগের বিলুপ্ত প্রাণীদের ছবি এবং বিভিন্ন জ্যামিতিক আকারের আঁকিবুঁকি। আবিষ্কারের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করে পুরাতাত্ত্বিক মার্ক রবিনসন বলেন,
“এক কথায় অনবদ্য। এই অসাধারণ চিত্রকর্মগুলো আঁকা হয়েছে পশ্চিম আমাজনে বাস করা আদিমতম মানব সম্প্রদায়ের মাধ্যমে। তখনকার সমাজের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি এর মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার যে, তারা সেই সময়ে বিভিন্ন হিংস্র এবং অতিকায় প্রাণীদের মাঝে লড়াই করে টিকে থাকতেন।”
২০১৯ সালে আবিষ্কার হলেও এই তথ্য এতদিন গোপন রাখা হয়েছিল। অনেক সূত্রমতে, ২০১৭ সালেই এগুলো আবিষ্কৃত হয়েছিল। মূলত একটি পূর্ণাঙ্গ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ এবং নির্বিঘ্ন গবেষণার উদ্দেশ্যেই এমনটি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আবিষ্কারক দল।
তবে এই অভিযান মোটেও সহজ ছিল না। প্রথমত, আমাজনের মতো গহীন অরণ্যে যেকোনো অভিযানই চ্যালেঞ্জিং। দ্বিতীয়ত, গৃহযুদ্ধ কবলিত কলম্বিয়ার এই অঞ্চলে যেকোনো কর্মকাণ্ডের জন্য বহু রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়। তাই বহুদিন ধরে চেষ্টা করেও অনুমতি পাওয়া যাচ্ছিল না। ২০১৬ সালের দিকে বিবাদমান সরকার এবং গেরিলাদের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে অনুমতি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ২০১৭ সালে শুরু হয় আমাজনের গহীনে শুরু হয় এই ঐতিহাসিক অভিযান। তবে স্থানীয়রা বহু বছর ধরে এই শিলাচিত্রগুলো সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তারাই অভিযাত্রিকদের পথ দেখিয়ে এখানে নিয়ে এসছেন। ইউরোপিয়ান রিসার্চ কাউন্সিলের অর্থায়নে পরিচালিত এই অভিযানের নেতা ছিলেন পুরাতত্ত্বের অধ্যাপক হোসে ইরিয়ার্তে।
আমাজন এবং প্রাক-কলম্বীয় ইতিহাস নিয়ে তার পাণ্ডিত্য সর্বজনস্বীকৃত। তার অধীনে আমাজন এবং পুরাতত্ত্ব বিষয়ের কয়েকজন গবেষকের সমন্বয়ে একটি চমৎকার দল গড়ে উঠে। নানা প্রতিবন্ধকতা হটিয়ে এই দলটি আমাজনের গহীনে অবস্থিত এই প্রাগৈতিহাসিক শিল্পকর্ম আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। দলের নেতা ইরিয়ার্তে অভিভূত হয়ে জানান,
“একদম ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আপনি যখন এমন একটি স্থানে পৌঁছাবেন, তখন অভিভূত হয়ে পড়বেন। একটি দুটি নয়, বরং হাজার হাজার চিত্রকর্ম, তাও একই স্থানে! সব চিত্র রেকর্ড করতেও আমাদের বেশ ভালো সময় লেগে যাবে। গুহা এবং পাথরের প্রতিটি গলিতে নতুন নতুন চিত্রকর্মের দেখা পাচ্ছি।”
২০১৯ সালে কলম্বিয়ার সেরানিয়া দে লা লিন্দোসা অঞ্চলে এই চিত্রকর্মগুলো আবিষ্কার করেন ইরিয়ার্তের দল। প্রাগৈতিহাসিক এই চিত্রগুলো আঁকা হয়েছে লাল গিরিমাটির সাহায্যে। সুদীর্ঘ দেওয়ালজুড়ে অঙ্কিত এই চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি অবস্থান অনেক উঁচুতে। জমিনে দাঁড়িয়ে থেকে সেগুলো আঁকা অসম্ভব। ড্রোন উড়িয়ে সেগুলোর ছবি তুলতে হয়েছে। তখন প্রশ্ন উঠলো, আদিম মানুষ কীভাবে এত উচ্চতায় ছবি আঁকতে পেরেছে? অধ্যাপক ইরিয়ার্তে জানালেন, এর উত্তর পাওয়া যাবে চিত্রকর্মের মাঝে। বেশকিছু চিত্রে কাঠের তৈরি উঁচু মাচার ছবি আঁকা আছে। সেখান থেকে মানুষ লাফিয়ে পড়ছে এমন চিত্র দেখিয়ে ইরিয়ার্তে জানান, এই মাচাগুলোর সাহায্যেই তারা এত উঁচুতে উঠতে পেরেছিল। আধুনিক যুগের বাঞ্জি জাম্পিংয়ের মতো লাফ দেওয়ার দৃশ্যের অবশ্য কোনো সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
রেনেসাঁর শিল্পীদের চিত্রকর্মের সূক্ষ্মতা এবং স্পষ্টতা দেখে আমরা মুগ্ধ হই। সেই মুগ্ধতার রেশ পুনরায় আস্বাদন করতে পারবেন কলম্বিয়ার চিত্রগুলো দেখলে। বরফ যুগে পৃথিবীতে বিচরণ করা বিভিন্ন প্রাণী যেমন, মাস্টোডন, দানব স্লথ, টাপির, কুমির, বাদুড়, হরিণ, বানর, সাপ, শজারুসহ বহু চিত্র আঁকা রয়েছে এখানে। একটু সময় নিয়ে ছবিগুলো পর্যবেক্ষণ করলে এর সূক্ষ্মতা আপনার চোখে ধরা দেবে। প্রাগৈতিহাসিক ঘোড়ার একটি চিত্র এতটাই নিখুঁত যে এর গায়ের লোম এবং কেশর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। বর্তমান সময়ের ঘোড়ার সাথে সেই ঘোড়ার পার্থক্যও স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়। আদিম ঘোড়া আকারে বড় এবং বুনো।
মূলত, এই প্রাণীগুলোর চিত্র বিচার করে গবেষকরা এই শিলাচিত্রের বয়স আনুমানিক ১১ থেকে ১৩ হাজার বছর পুরানো বলে ধারণা করছেন। প্রাণী অবয়ব ছাড়াও আদিম মানুষদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ঘটনার চিত্র আঁকা হয়েছে। একদল মানুষ পাখির ঠোঁটের মতো মুখোশ পরে একে অপরের হাত ধরে নৃত্য পরিবেশনা করছে এমন চিত্র আছে কয়েকশত। তাছাড়া একটি পশুকে কেন্দ্র করে দল বেঁধে চক্রাকারে যজ্ঞ করার ছবিও এখানে রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, কেন্দ্রে থাকা পশুকে পূজা করার দৃশ্য চিত্রায়িত করা হয়েছে এখানে। ইরিয়ার্তের মতে,
“আমাজনের আদিম অধিবাসীদের নিকট মানুষ, জন্তু, বৃক্ষ- সবার আত্মা রয়েছে। এই আত্মার সাহায্যে তারা একে অপরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। আর এই যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যম ছিল এই পূজা-অর্চনা, যা আমরা শিলাচিত্রে দেখছি।”
শুরুতেই বলা হয়েছে, আদিম যুগের এসব শিলাচিত্র যাচাই করে আমরা সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থা এবং পরিবেশ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে পারি। কলম্বিয়ার চিত্রকর্মগুলোও আমাদের সেরকম কিছু বার্তা দিচ্ছে।
গবেষকরা অবাক হয়েছেন যে, চিত্রকর্মে আঁকা প্রকৃতির সাথে বর্তমান আমাজনের তেমন একটা মিল নেই। অনেকটা তৃণভূমির মতো আঁকা ভৌগোলিক চিত্র দেখে তারা ধারণা করছেন, হয়তো আজকের আমাজনের যে ঘন অরণ্য আমরা দেখি, তা সবসময় ‘রেইনফরেস্ট’ ছিল না। একসময় এর অনেক অঞ্চল বিশাল তৃণভূমি ছিল।
তৎকালীন মানব সমাজ মূলত শিকার করতো এবং খাবার সংগ্রহ করতো। চিত্রগুলোতে দেখা গেছে মানুষ গাছের ফল পেড়ে খাচ্ছে। আবার নদী থেকে মাছ এবং কুমির শিকার করেও খেতো তারা। অভিযানে উদ্ধারকৃত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যায়, তৎকালীন সমাজের মানুষ সাপ, ব্যাঙ, আর্মাডিলো এবং বিভিন্ন মূষিক খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতো। নতুন আবিষ্কৃত চিত্রকর্মগুলোর সাথে ১৮০ কিলোমটার দক্ষিণের এক অঞ্চলের সেরানিয়া ডি চিরিবিকেট শিলাচিত্রের যথেষ্ট মিল পাওয়া যায়। নতুন আবিষ্কৃত হাজার চিত্রকর্মের একাংশ পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা এমন সব তথ্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছেন।
বর্তমানে এই চিত্রগুলো পরীক্ষা করে আমাজনের বুকে বসতি স্থাপন করা প্রথম মানব সমাজের ধরন এবং কাঠামো বুঝার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের আগমনের কারণে এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যে কী পরিবর্তন এসেছে তাও জানা যাবে গবেষণা শেষে। দলনেতা ইরিয়ার্তে মন্তব্য করেছেন,
“মানুষের সংস্পর্শে এই আমাজন অঞ্চলে কীভাবে বড় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, মানুষ কীভাবে একে পুনঃনির্মাণ করেছে, শিকার করেছে, চাষাবাদ করেছে, মাছ ধরেছে- এসব কিছুর শৈল্পিক দলিল এই শিলাচিত্রগুলো। হতে পারে এই সমাজে চিত্রকর্ম খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি রীতি ছিল। সামাজিকভাবে একে অপরের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এটি খুব কার্যকর মাধ্যম। মানব সমাজ কীভাবে বর্তমানে বিলুপ্ত সেই অতিকায় জন্তুদের শিকার করে এখানে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল, তা এসব চিত্র পরীক্ষা করলে বোঝা যায়।”
আমাদের আদি ইতিহাস নিয়ে কৌতূহলের কোনো সীমা নেই। অতীতকে উদ্ঘাটনের নেশায় মানুষ জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে প্রাগৈতিহাসিক বার্তার হদিস করছে। কলম্বিয়ায় আবিষ্কৃত এই সুবিশাল অঞ্চলজুড়ে আঁকা শিলাচিত্রগুলো এক অনন্য প্রত্নতাত্ত্বিক দলিল। ইতোমধ্যে এই চিত্রকর্মের একাংশ গবেষণা করে বেশ চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য জানা গেছে যা আমাজন নিয়ে আমাদের সাধারণ ধারণা বদলে দিচ্ছে। প্রাথমিক গবেষণাপ্রাপ্ত ফলাফল গত এপ্রিলে ‘কোয়াটার্নারি ইন্টারন্যাশনাল’ নামক এক আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে চ্যানেল ফোরে সম্প্রচারিত ‘জাঙ্গাল মিস্টারি: লস্ট কিংডম অফ দ্য আমাজন’ শীর্ষক প্রামাণ্যচিত্রের ২য় পর্বে এই অনবদ্য অভিযানের গল্প নিয়ে ফিচার প্রদর্শিত হবে। তবে গবেষণা এখনও চলছে এবং ভবিষ্যতে আরও নতুন তথ্য উদ্ঘাটন করা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অভিযাত্রিক দল।